না চাহিলে যারে পাওয়া যায় পর্ব-২১+২২

0
489

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-২১

ওষ্ঠদ্বয়ের ব্যবধান দুই ইঞ্চিরও কম। দু’জনেই দু’জনার নিশ্বাসের উত্থান পতন টের পাচ্ছে। রুহির হার্ট এতো দ্রুতলয়ে বিট করছে যে নিজেকে কন্ট্রোল করতে ও বুকের উপর থাকা ওড়না খামচে ধরে চোখ বুজলো। কেন যেন রাযীনকে আজ থামাতে মন চাইছে না। লোকটা এই এতো দিনে একবারও ওর কাছাকাছি আশার চেষ্টা করেনি। আজ যখন অপ্রত্যাশিত ভাবে কাছে এলো তখন রুহিও বাঁধা দেবে না ভাবলো। অথচ অন্তরের ভেতরটায় অস্থিরতা ঘুরপাক খাচ্ছে। ওষ্ঠদ্বয় কাঁপছে তিরতির করে। রাযীন চোখ বোজা রুহিকে দেখে মুচকি হাসে। কপালের উপর থাকা সেলাইটাতে নিজের হাতের স্পর্শ দিতেই রুহি কেঁপে উঠলো থরথর। রাযীন আরেকটু এগোয়, রুহির অধরজোড়ায় আঙুল ছোঁয়াতেই রুহি চোখ খোলে। চোখে চোখে চোখাচোখি অতঃপর স্থির দৃষ্টিতে পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকা। রাযীন মুখটা আরেকটু এগিয়ে নিতেই দরজায় শব্দ হলো। একবার দু’বার তিনবার এরপর রোজীর গলা শোনা গেলো-
“রাজ, আসবো?”
দু’জনে প্রায় ছিটকে সোফার দুপ্রান্তে চলে গেলো। রুহি পড়িমরি করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জামা ঠিকঠাক করছিলো দেখে রাযীন হেসে দিলো ফিক করে। রুহি লাজুক হেসে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই রাযীন দরজা খুলে দিলো।
“তোমার সাথে কথা ছিলো একটু। বউমা কোথায়? ওকেও লাগবে।”
“ও মনেহয় ওয়াশরুমে আছে। তুমি বসো মা, বলো কি বলবে।”
রোজীকে বিরক্ত দেখাচ্ছে, অস্থির গলায় বললো-
“আজ যা হলো মোটেও ভালো হলোনা। আমাদের পরিবারে রেষারেষি কখনো এমন পর্যায়ে যায়নি আগে। এরকম ঘটনা বারবার হলে কি হয় জানো?”
রাযীন উত্তর না দিয়ে মায়ের মুখ পানে চেয়ে রইলো। জানে মায়ের কথা শেষ হয়নি কাজেই মুখ খোলা বৃথা। রুহি ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই রোজী কাছে বসার জন্য ইশারা করলো-
“চোখের পর্দা নষ্ট হয়ে যায়। তখন সবাই নিজের ইচ্ছে মতন চলতে শুরু করে। চেইন অফ কমান্ড ভেঙে পড়ে। এতে করে পারিবারিক সুনাম তো যাবেই সেই সাথে ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে। তোমার বাবা নিজের সমস্ত জীবন এইসব নিয়মনীতি মানতে আর মানাতে কাটিয়ে দিয়েছে। তাতে ঘরে বাইড়ে সিংহভাগ লোকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তবে সংসার আর ব্যবসা সামলেছিলেন দক্ষ হাতে। এতোটুকু আচঁড় লাগতে দেননি কোথাও। সেই তার ছেলে হয়ে আজ তুমি এমন কাজ করলে এটা আমার কেন যেন বিশ্বাস হয় না। তবুও নিজ চোখে দেখা জিনিস অস্বীকার করি কি করে।”
বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন রোজী। হাতের নখ দেখছিলেন চুপচাপ তারপর রাযীনের দিকে মুখ তুলে চাইলেন, ক্লান্ত চেহারায় হাসার চেষ্টা করলেন-
“আমার আর এসব ভালো লাগে না রাজ। আমি চাই না দ্বিতীয়বার এমন ঘটনা ঘটুক। তুমি তো সব ফেলে চলেই গেছিলে হয়তো আর ফিরতেই না। এখন হঠাৎ এসে যদি এমন আচরণ করো তাহলে সবারই মেনে নিতে কষ্ট হবে। আর মনে রাখবে সম্পর্ক টাকার চাইতে অনেক দামী জিনিস। কাজেই ব্যবসা টাকা এসবের মায়ায় জড়িয়ে সম্পর্ক নষ্ট করো না।”
রাযীন চুপচাপ মায়ের কথা শুনে গেলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যেয়েও বললো না। আজ মাকে একটু বেশিই ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মায়ের এই ক্লান্তিতে কি তারও ভুমিকা নেই? তারা সবাই কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। মায়ের দিকটা কখনো ভেবে দেখেনি। রোজীর ক্লান্তিকর মুখের দিকে তাকিয়ে রাযীনের বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো।

★★★

“সৌরভ একা একা এতোবড় কাজ করলো কি করে? আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি?”
আফজাল বিস্ময় নিয়ে শিখার দিকে তাকালো। শিখা গম্ভীর হলো-
“আহ এতো বেশি মনে লাগাচ্ছ কেন? ছেলে বড় হয়েছে নিজের মনের মতো কোন কাজ যদি করে তাহলে এতো রাগ করা উচিত না। ওরা নিজে নিজে কাজ না শিখলে চলবে কি করে?”
আফজাল শিখার চেহারার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো-
“তুমি জানতে ব্যাপারটা?”
শিখা ইতস্তত করে মাথা নাড়লো। আফজাল অবাক হলো-
“ওকে মানা করোনি কেন? সবাই যদি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তবে বিজনেস কি টিকে থাকবে?”
“সে তো এমনিতেই টিকবে না। আজকালকার জেনারেশন একসাথে মিলে মিশে থাকে কোথায় বলো? তাছাড়া অতীতে যা হয়েছে সেটা কারো পক্ষেই ভোলা সম্ভব না। তুমি দেখলেনা রাজ কি করলো? আমার মনেহয় নিজেদের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নেওয়াটা কোন ভুল কিছু না।”
“তুমি কি বুঝে এসব বলছো জানি না। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে সবাইকে ভুগতে হবে শিখা। আমি চাই না আলিফ কিংবা নুরীর মতো কোন ভুল কেউ করুক।”
“ওরা কেউ ভুল করেনি ভুল ছিলো ভাইজানের। ভাইজান নিজের মত সবার উপর চাপিয়ে দিয়ে সবাইকে অত্যাচার করেছে। ওরা সহ্য করতে পারেনি সেটা।”
শিখা চাপা কন্ঠে গর্জে উঠলো। আফজাল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালো-
“সেই পুরনো ইস্যুতে আঁটকে আছো। শিখা ভুলে যাও পুরনো ঘটনা।”
“তুমি ভুলতে পারো কিন্তু আমি না। আমি মা, এতো সহজে কি করে ভুলবো। মেয়েটা বেঁচে থাকার পরও তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয় এর চাইতে কষ্টের কি আছে?”
শিখার চোখ দুটো লাল, ছলছল আঁখি থেকে জল গড়ায়। আফজাল শিখার পানে না চেয়ে বেড়িয়ে এলো।

ঝিলিকের শরীরটা মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে। উল্টো হয়ে শুয়ে থাকা ঝিলিক ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কিছুক্ষণ আগেই সৌরভের কাছে তীব্র শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার দোষ, রাযীন কিভাবে হোটেলে ইনভেস্ট এর খবর পেলো? অথচ ঝিলিক এ ঘটনার বিন্দুবিসর্গও জানে না। বারবার বলার পরও সৌরভ ওর কথা বিশ্বাস করেনি। ঝিলিকের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই জোর করে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। চুলের মুঠি টেনে ধরে বারকয়েক প্রশ্ন করেছে, কেন বললি? এখনও ভুলিসনি নাগরকে? মনে এখনো ওকেই জায়গা দিয়ে রেখেছিস? শরীর জুড়ে ব্যাথায় ঝিলিক নড়াচড়া করতে পারে না। ভাবে, কোন কুক্ষণে সৌরভকে বিশ্বাস করেছিলো পাঁচ বছর আগে? বিশ্বাস করে সৌরভের ডাকে সারা দিয়ে চলে গিয়েছিলো নির্জন বাড়িতে। কেন বোকার মতো ভুল বুঝেছিলো রাজকে? আর কেনইবা রাজকে দূরে ঠেলে সৌরভকে বিয়ে করতে রাজি হলো? রাগের মাথায় হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্ত আজ বিষফোড়ায় রুপ নিয়েছে। না পারছে গিলতে না পারছে উগলাতে। সৌরভ কেমন মানুষ ভেবে পায় না ঝিলিক। এতো কিছু করার পরও একটুও অনুতপ্ত নয় নিজের কাজে। উল্টো দিনরাত ঝিলিককে রাজের কথা বলে মানসিক চাপে রাখে। বউ হিসেবে এতোটুকু সন্মান পায়নি সৌরভের কাছ থেকে। পুরনো স্মৃতি মনে করে ঝিলিক হুহু করে কেঁদে উঠলো। বাথরুম থেকে ঘুরে এসেও ঝিলিককে কাঁদতে দেখে সৌরভের মাথা যেন আগুন হয়ে গেলো-
“এখনো এতো নাকি কান্না কিসের? উঠে পড়ো অনেক ঢং হয়েছে।”
“ঢং আমি ঢং করছি? আর কতো অত্যাচার করবে আমাকে? ইউ ফ্রড, লায়ার, চিটার। চিট করে আমাকে বিয়ে করেছো।”
ঝিলিক ঝাজিয়ে উঠলো। সৌরভ শয়তানি বিটকেল হাসি দিলো-
“আহারে আমার সতী সাবিত্রী রে। কেন এসেছিলে আমার ডাকে সারা দিয়ে? রাজের সাথে দিনরাত এই করতে তা কি বুঝিনি? তা না হলে আমি ডাকতেই দৌড়ে চলে এলে কেন?”
“রাজ কোনোদিন স্পর্শ করেনি আমাকে। ও তোমার মতো নিচ নয়। আমি তোমাকে ভাই মনে করে তোমার ডাকে সারা দিয়ে এসেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম। তুমি আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করে আমাকে রেপ করেছিলে বাধ্য করেছিলে বিয়েতে রাজি হতে।”
ঝিলিকের কথা শুনতে শুনতে সৌরভের চেহারা পাল্টে গেলো। রাগে চন্ডাল মুর্তি হয়ে ঝিলিকের মাথার চুল খামচে ধরে গালে সপাত করে দুটো চড় বসায়-
“আমি নিচ? আমি খারাপ? খা..কি….মা… আজ তোকে উচিত বুঝিয়ে ছাড়বো আমি কি? রাজের নাম তোর মন থেকে চিরদিনের মতো ভুলিয়ে ছাড়বো।”
সৌরভ দ্বিগুণ আক্রোশে ঝিলিকের উপর ঝাপিয়ে পড়লো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-২২

শুভকে ভুলতেই কিনা কে জানে রুহি আজকাল রাযীনের সাথে ভীষণ আন্তরিক। রাযীনের টুকটাক কাজ ইদানিং নিজ থেকেই করে দেয়। রাযীন রাতে ল্যাপটপে কাজ করতে বসলে নিজ উদ্যোগে কফি বানিয়ে এনে দেয়, অফিস যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের কাছে গুছিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে টুকটাক গল্পও করে। রাযীনকে আগের মতো বদমেজাজি বদমায়েশ মনে হচ্ছে না। বরং মনেহচ্ছে যে লোক বউয়ের জন্য সাহস করে এতোটা করতে পারে সে অতোটা খারাপ লোক না। হয়তো লোকটার প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন কিন্তু মনটা কলুষিত নয়। হতে পারে পাঁচ বছর আগে করা নিজের কাজের জন্য সে অনুতপ্ত। অন্তত শুভর চাইতে হাজারগুন ভালো। শুভ জেনেবুঝে তার অনুভূতি নিয়ে খেলেছে। নিজেকে নিয়ে মিথ্যাচার করেছে। এই লোক তা করেনি। নিজেকে ভালো সাজানোর নাটক করে রুহিকে পটানোর চেষ্টা করেনি, স্বামী হিসেবে রুহিকে কাছে টানাও সুযোগ খোজেনি। এইটুকু ভাবলেও রুহির মনে প্রশান্তি আসে। রাযীনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে রুহি ছাদে পেতে রাখা চেয়ারে হেলান দিলো। বিকেলের সময়টা আজকাল ছাদে আসে রুহি। ডুবি ডুবি সূর্যের আলোয় চারপাশটা নরম আলোয় ভরে থাকে। পাখিরা সব কিচিরমিচির শব্দ তুলে ঘরে ফিরে যায়। এইসময় রুহি চুপচাপ বসে থেকে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতা ওল্টায়।
“আমাকে ছাড়াই আজকাল ভালো থাকছো দেখি?”
শুভ এসে দাঁড়িয়েছে রুহির সামনে। কথাটা শুনে চমকে শুভর পানে চাইলো রুহি। শুভর চুলগুলো এলোমেলো অবিন্যস্ত, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির আভা, চোখদুটো কোটরে ঢুকে গেছে। রুহির মনে হলো গত ক’দিন শুভকে দেখেনি সে। হঠাৎ শুভর বা হাতের দিকে নজর গেলো। বিশাল বড় একটা ক্ষত দেখা যাচ্ছে সেখানে।
“ভালো থাকাটা আপেক্ষিক বিষয় শুভ। চাইলে তুমিও ভালো থাকতে পারো। তোমার হাতে কি হয়েছে?”
শুভ রুহির সামনের চেয়ারে বসলো, হাত বাড়িয়ে দিলো রুহির দিকে-
“তোমার অবহেলা আর অবিশ্বাসের শাস্তি দিলাম নিজেকে।”
রুহি অবাক হয়ে শুভকে দেখলো-
“পাগল হয়ে গেছো?”
শুভ রুহির চোখে চোখ রাখে-
“তুমি আমার থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছ ততই নিজেকে পাগল লাগছে। কেন এমন করছো রুহি? প্লিজ চলো আমরা ঢাকায় ফিরে যাই। আমরা আমাদের পুরনো জীবনে ফিরে যাই।”
রুহি গভীর চোখে শুভকে দেখলো। শুভর চেহারায় বিষাদ খেলা করছে, কিছুটা পাগলামি ছেয়ে আছে মুখের রেখায়।
“এখন আর তা হয় না শুভ। তুমি যদি নিজের পরিচয় না লুকাতে তাহলে হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। আমি কে সেটা জানার পরও তুমি যে অন্যায় কাজটা করেছো সেটার পর তোমার সাথে আমার আর কোন কিছু হওয়া সম্ভব না। আমার চিন্তা তোমার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। তুমি বরং তোমার কাজে ফিরে যাও শুভ।”
শুভর মুখের রেখাগুলো দ্রুত বদল হচ্ছে। চেহারায় কাঠিন্যতা স্পষ্ট হচ্ছে। সে হিসহিসিয়ে উঠলো-
“তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার জন্য কি করেছি। এতোগুলো বছর তোমার পেছনে ঘুরেছি, তোমাকে সাহস দিয়েছি। আজ অন্য একজন এসে তোমায় আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে এটা আমি কিছুতেই হতে দেবোনা।”
শুভর এই পরিবর্তন দেখে রুহির বুক কাঁপছে। এ কোন শুভ? এসব কি বলছে? নিজের অন্যায়কে দেখেও দেখছে না? রুহি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে-
“এসব কি বলছো শুভ? অন্যায় তোমার, তুমি আমার সাথে ছলচাতুরী করেছো। এখন আরেকজনার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছ?”
“তোমাকে ভালোবেসেছি এটা অন্যায়? আমি ছলচাতুরী করেছি এখন তুমি করছো না? আমাকে ভুলে ভাইকে আপন করতে চাইলো এটা অন্যায় নয়? যে তোমাকে ফেলে রেখে চলে গেলো তাকেই এখন সবকিছু মনে হচ্ছে?”
শুভ উত্তেজিত হয়ে গেলো। রুহি ভীরু কন্ঠে প্রতিবাদ করে-
“সে যাই করুক তোমার মতো মিছে কথা তো কয়নি? তুমি তো আমার সাথে…”
“বাস আর শুনতে চাই না। তুমি যা করছো তার জন্য তোমাকে ভুগতে হবে রুহি। আমাকে বিশ্বাস করলে নাতো? দেখবে তুমি ঠকবে, ঠকে তোমায় আমার কাছেই ফিরতে হবে। তখন আমিও দেখবো…”
শুভ কথা শেষ করার আগেই রাযীনকে উঁকি দিতে দেখা গেলো-
“আরে তোমরা এখানে যে? দেবরের সাথে ভালোই আলাপ জমে গেছে দেখছি?”
রুহির ফ্যাকাসে চেহারা রাযীনের নজরে এলো না। শুভ তার আগেই উঠে দাঁড়ালো-
“তোমরা কথা বলো আমি যাই।”
“সে কিরে। আমি মাত্রই এলাম আর তুই চলে যাচ্ছিস? বয় গল্প করি।”
“না ভাইয়া, ওকে বড়মা ডাকছিলো তাই জানাতে এসেছিলাম। এসে দেখি বই পড়ছে। বই নিয়েই গল্প হচ্ছিল এতোক্ষণ।”
রাযীন রুহির দিকে তাকালো, রুহি ফ্যাকাসে হাসি দিলো-
“আমি দেখি মা কি বলে।”
রুহি নিজেকে আড়াল করতে উঠে চলে যেতে উদ্যত হলে রা্যীন থামায় ওকে-
“আরে দাঁড়াও। মায়ের সাথে দেখা করেই তো এলাম। আপাতত তোমার যেতে হবে না। এসো এখানে বসে এককাপ চা খাই। শুভ তুইও বয়।”
“নাহ আমার একটা কাজ আছে ভাইয়া৷ আমি গেলাম তোমার বসো।”
শুভ দাঁড়ালো না, এলোমেলো পা ফেলে দ্রুত নিচে নেমে গেলো। রুহিও উঠে দাঁড়ালো-
“চলুন ঘরে যাই। সন্ধ্যার সময় নাকি ছাদে থাকতে নেই?”
রাযীন হাসলো-
“কে বলেছে এসব কথা?”
“সবাই বলে। প্লিজ ঘরে চলুন, রাতে না হয় আসবো আবার?”
রুহি অসহায় দৃষ্টিতে তাকাতেই রাযীন আর কথা বাড়ায়নি। দু’জন একসাথে নেমে এলো।

★★★

দু’দিন ঝিলিককে খাবার টেবিলে না পেয়ে রুহি অবাক হলো। ঘরে থাকা সত্বেও ঝিলিক রুমে বসে খাচ্ছে এটা জেনে রুহির মনে খটকা লাগলো। দুপুর খাওয়ার আগে তাই আজ ঝিলিককে ডাকতে এলো। রুমের দরজায় অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর ঝিলিক দরজা খুলে-
“আরে রুহি যে? হঠাৎ আমার খোঁজে? কোন দরকার?”
“ভাবি, দু’দিন ধরে নিজের কামরায় বসে খাচ্ছ ভাবলাম দেখে যাই কি অবস্থা তোমার। শরীর কি বেশি খারাপ?”
রুহি উকি দিতেই ঝিলিক দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়-
“এসো ভেতরে এসো। এখন একটু ভালো আছি।”
রুহি রুমে ঢুকে ঝিলিকের বিছানায় বসলো। খেয়াল করে দেখলো বিছানায় বসতে যেয়ে ঝিলিক বারকয়েক মুখ কুঁচকালো। হয়তো ব্যাথা পেয়েছে কোন। রুহি চোখ ফিরিয়ে নিতে যেয়ে নজর এলো হাতের ক্ষতর দিকে। ঝিলিকের বাহুতে কালসিটে দাগ স্পষ্ট-
“ভাবি কি হয়েছে?”
ঝিলিকের হাতের দিকে ইশারা করে রুহি। ঝিলিক দ্রুত হাতে তা ওড়নায় ঢেকে নেয়-
“তেমন কিছু না রুহি একটু ব্যাথা পেয়েছি ঠিক হয়ে যাবে।”
“ওহহহ। নিচে খেতে যাবেনা?”
“নারে। আমার শরীর সত্যিই খারাপ। বেশিক্ষণ হাঁটলে মাথা ঘুরায়।”
“আর ইউ এক্সপেকটিং?”
ঝিলিক চমকে তাকালো রুহির দিকে-
“আরে না। একথা কেন বলছো হঠাৎ?”
রুহি মুচকি হাসলো-
“কেন যেন মনেহচ্ছে। কিছু মনে না করলে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
ঝিলিক অবাক হয়ে জানতে চাইলো-
“হ্যা অবশ্যই। কি বলবে বলো।”
“উনাকে তুমি ভালোবাসতে? কি হয়েছিলো তোমাদের মধ্যে? ওকে জিজ্ঞেস করলে আনসার দিতে চাইবে না জানি তাই তোমার কাছে জানতে চাওয়া। বললে আমি কিছু মনে করবো না।”
রুহি শান্ত স্বরে কথাগুলো বলে। ঝিলিক দোনোমোনো করে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নেয়-
“ছিলো। দু’জনই দু’জনকে পচ্ছন্দ করতাম। তারপর কি থেকে কি হলো দু’জনার পথ আলাদা হলো। সেও অনেক দিন আগের কথা। আপাতত আমাদের দু’জনার মধ্যে কিছু নেই। তোমার স্বামী তোমারই আছে ডিয়ার ভয় পেয়না।”
ঝিলিক কথাগুলো বলে হাসলো। রুহি মৃদুস্বরে গুনগুন করে যেন-
“ভয় পাচ্ছি না। ভাবছি যদি তাই হয়ে থাকে তবে তোমার গায়ের দাগগুলো কেন এলো?”
ঝিলিক চমকে তাকালো, কিছুক্ষণ নীরব থেকে ফিসফিস করলো-
“সবাই একরকম নয় রুহি। কারো বিশ্বাসের ভীত ভীষণ নড়বড়ে। তাদের ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। কাজেই তাদেরকে তাদের নিজেদের ভাবনা নিয়ে থাকতে দেওয়া উচিত।”
রুহির মুখে কথা আসে না। ঝিলিকই পূনরায় মুখ খুলে-
“রাজ ভালো ছেলে তবে সহজে অন্যের দারা প্ররেচিত হয়। তুমি ওকে আগলে রেখো যেন কেউ ওকে না ফুসলাতে পারে। তোমাদের মাঝে তৃতীয় কাউকে আসতে দিয় না। দেখবে দু’জনে সুখী হবে।”
রুহি মন দিয়ে ঝিলিককে দেখে। ওর মনে রাজকে নিয়ে সত্যিকার অর্থে কেন অনুভূতি আছে কিনা তা খোঁজার চেষ্টা করলো। ঝিলিকের চেহারা জুড়ে বিস্বাদ ছেয়ে আছে। রুহি কিছু একটা ভেবে আর কথা বাড়ায় না। উঠে আসার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝিলিককে ডাকে-
“ভাবি, সব সহ্য করো তবে আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয় না।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin