না চাহিলে যারে পাওয়া যায় পর্ব-১৯+২০

0
282

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-১৯

রুহি আর নিজের কামরায় ফেরত যায়নি। লবিতেই একা একা বসে ছিলো অনেকটা সময়। শুভর কথা আর কাজে মনটা অস্থির হয়ে আছে। এমনিতেই তার জীবনের জটিলতা কম নয় তার উপর নতুন উপদ্রব শুভ। মনেহচ্ছে সব ছেড়ে ছুড়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যেতে। এই ঘরসংসার, আশেপাশের মানুষ কাউকেই আর বিশ্বাস করার সাহস হচ্ছে না। সবাইকে মুখোশ মানুষ মনেহচ্ছে। পূনরায় সংসার করা নিয়ে মনে যে দ্বিধা ছিলো তা এখন ফুলেফেঁপে শঙ্কায় পরিণত হয়েছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে দুটো পথ দু’দিকে চলে গেছে। কোন পথে শেষটা কেমন তা রুহির অজানা। অথচ একটা পথ রুহিকে বাছতেই হবে। রুহির সানগ্লাসের আড়ালে জমে থাকা চোখের জল ওড়নার কোনে মুছে নিলো। সন্ধ্যা নামতেই সমুদ্র থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাসে রুহির মনটা ক্রমশ শীতল হচ্ছিল। এ পর্যন্ড বারকয়েক চা খেয়ে ফেলেছে। আরো একবার চায়ের কথা বলতে উঠতেই রাযীনকে চোখে পড়লো। ওকে দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলো-
“তুমি নাকি সারাদিন এখানেই বসে আছো? কিছু হয়েছে নাকি?”
রুহির হঠাৎ কি হলো সে দৌড়ে রাযীনের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হু হু করে কাঁদতে শুরু করলো। রাযীন প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কি ঘটনা। বোকার মতো বারবার রুহিকে নিজের থেকে আলাদা করতে চাইলো-
“আরে কি হলো তোমার? এভাবে কাঁদছো কেন?”
রুহি আরো বেশি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রাযীনকে।
রা্যীন বিরক্ত হলো রুহির আচরণে, আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে দেখছে ওদের। হোটেলের কর্মচারীটা মুখ লুকিয়ে হাসছে। রাযীন প্রায় ধমকে উঠলো-
“রুহি, কি হচ্ছে এসব? সবাই তাকিয়ে দেখছে আমাদের। ডোন্ট ফরগেট এটা আমাদের হোটেল, মান সম্মান ডুবিয়ে দিয় না প্লিজ। চলো রুমে চলো কি হয়েছে শুনি।”
রুহি নিজেকে সামলে নিলো, লজ্জিত হলো ভীষণ। আসলেও তো একি বোকামি করলো সে? এতোটা দূর্বল মানসিকতার তো সে কখনো ছিলোনা? আজ হঠাৎ কি হলো? রুহি প্রায় দৌড়ে যেয়ে লিফটে উঠলো।

“এবার বলো কি হয়েছিল তখন? ভয় পেয়েছিলে?”
রা্যীন রুমে এসেই শাওয়ার নিয়ে খাবার অর্ডার করে রুহির সামনে বসলো। রুহি দ্বিধা নিয়ে মুখ খুললো-
“আপনার ভাই শু…”
রাযীন ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রুহি থেমে গেলো। শুভর কথা কি রাযীনকে বলা উচিত হবে? এসব শুনে রাযীন নিশ্চয়ই শান্ত খোকা বাবু হয়ে বসে থাকবে না। এমনিতেই শশুর অসুস্থ, এসব নিয়ে ঝামেলা হলে সংসারে একটা বিশাল কেওয়াজ বাঁধবে। রুহি মুখে আসা কথাগুলো গিলে নিলো। শুকনো হাসি দিয়ে বললো-
“না কিছুনা। আসলে সারাদিন একা একা ছিলাম তো তাই আপনাকে দেখে মনটা ভীষণ খুশি হয়ে গেছিলো।”
রাযীন ভ্রু কুঁচকে রুহির পানে চেয়ে রইলো-
“সত্যি তো? এখনো সময় আছে অন্য কোন ঘটনা থাকলে বলে ফেলো।”
রুহি সজোরে মাথা নাড়লো-
“অন্য কোন ঘটনা নেই।”
রাযীন আর ঘাটায় না। মোবাইলে ফোন আসতেই সে ব্যস্ত হয়ে ফোনে কথা বলতে উঠে গেলে রুহি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

পরদিন ঘুরে টুরে বাড়ি ফিরতেই ঝিলিকের সামনে পড়লো দু’জন। ওদের দেখে ঝিলিক মুচকি হাসে-
“আরে বাহ, দু’জনকে এতো ফ্রেশ দেখাচ্ছে যে?
তোমরা কি হানিমুন সেরে এলে নাকি?”
ঝিলিকের বলার ধরনে রুহি ভীষণ লজ্জা পেলো।
সে উত্তর না দিয়ে লাজুক হেসে শশুর কে দেখার ছুতো দিয়ে পালায়। রাযীন রাগী দৃষ্টি হেনে ঝিলিককে দেখছে-
“স্টপ স্টকিং আস। তাহলে নিজেও শান্তিতে থাকতে পারবে সাথে আমিও।”
“আমার জীবনকে অশান্তিতে ফেলে তুমি শান্তিতে থাকতে চাইছো? এটা আমি কিভাবে হতে দেই বলোতো?”
ঝিলিক ক্রুর দৃষ্টিতে রাযীনের পানে চেয়ে রইলো। রাযীন গম্ভীর হলো-
“এ জীবন তুমি বেছেছো ঝিলমিল, এর দায় কোনোভাবেই আমার উপর চাপানোর চেষ্টা করো না।”
“প্রথম কথা এ জীবন বাছতে তুমি বাধ্য করেছিলে কাজেই এখন নিজে দায় এড়াতে চাইলেই পারবে না। দ্বিতীয় কথা ডোন্ট কল মি ঝিলমিল। আম ইয়োর ভাবি, সো কল মি ভাবি।”
ঝিলিক শয়তানি হাসি দিলো। রাযীনও পাল্টা হাসলো-
“যাক আমার আর মনে করিয়ে দিতে হলো না বলে ভালো লাগলো। দেবর ভাবি সম্পর্কটা খুব সেনসেটিভ জানো তো? আমি চাই না তোমার কারনে ভাইয়ের সাথে আমার ভুল বোঝাবুঝি হোক। আর দায়ের কথা যেটা বললে, আমি মনে করি তোমার প্রতি আমার কোন দায় নেই। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো, ভাইকে বিয়ে করে এ বাড়ির বউ হয়েছো এসব তোমার সিদ্ধান্ত। তোমার সিদ্ধান্তে বরং আমি কষ্ট পেয়েছি। এ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। এখন তুমি আমাকে উল্টো দোষারোপ করছো? শোন, আমি বলি কি যা হওয়ার হয়েছে। সব ভুলে নতুন করে শুরু করো সব। অতীতে পড়ে থেকো না তাতে আমাদের দুজনারই মঙ্গল হবে।”
“কিন্তু আমি যে তোমার মঙ্গল চাই না? যে দহনে আমি সর্বদা জ্বলছি তোমারও তো কিছুটা জ্বলা উচিত তাই না?”
“সেটা আর কোনদিনই সম্ভব হবে না। আমি তোমাকে ভুলে অনেক দূর এগিয়ে গেছি।”
রাযীন মরিয়া হয়ে জবাব দিতেই ঝিলিক হাসলো-
“আমি আবার পিছু টেনে আনবো তুমি ভেবো না।”
“ওকে, ট্রাই ইট এন্ড দেন গো টু হেল।”
রাযীন দাঁড়ালো না, গটগট করে হেঁটে চলে গেলো নিজের কামরায়। ঝিলিক দাঁতে ঠোঁট কামড়ে জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

★★★

“শুভ, তোর কি হয়েছে বলবি? এমন পাগলামি কেন করছিস? তুই তো কখনো এমন ছিলিস না? কি হয়েছে বাবা বল মাকে?”
শিখার আকুতিভরা কন্ঠ শোনা গেলো। ছেলের হাত ধরে অনুনয় করতেই শুভ এক ঝটকায় সে হাত ছাড়িয়ে নিলো-
“হ্যা, সবসময় তোমাদের লক্ষী ছেলে হয়ে ছিলাম। তাতে কি পেয়েছি জীবনে? না তোমাদের মনোযোগ না তোমাদের ভালোবাসা। তুমি সারাজীবন ছিলে তোমার রুপচর্চা, শাড়ী চুড়ি গয়না নয়তো তোমার বাকী সন্তানদের নিয়ে। আমার দিকে মনযোগ দেওয়ার সময় ছিলো তোমার?”
শিখা দুঃখী চোখে ছেলের পানে চাইলেন-
“এভাবে বলছিস কেন বাবা? তুই তো আমার লক্ষী ছেলে ছিলিস তাই তোকে নিয়ে কখনো সেভাবে ভাবতে হয়নি।”
“হয়েছে থাক, আর মনভোলানো কথা বলোনা মা।এখন এসব কথায় চিড়ে ভিজবে না।”
শুভ একদৃষ্টিতে কাটা হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। গতকাল কেটে ফেলা হাতের জায়গাটা বিভৎস ভাবে হা হয়ে আছে। এখনো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। শিখা সেদিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো-
“জায়গাটা ব্যান্ডেজ করতে দে বাবা। নয়তো সেপটিক হয়ে যাবে।”
“কোন দরকার নেই। যেমন আছে থাক, সেপটিক হোক পচুক তাতে তোমাদের কি?”
শুভ গোয়ারের মতো বসে রইলো। শিখা পাগলের মতো শুভর হাত ধরে-
“তোর পায়ে পরি বাপ এমন করিস না। তোর কিছু লাগলে বল মাকে। যা চাস তাই দেবো। এমন জেদ করিস না বাপ।”
“সত্যি দেবে তো?”
শুভ আচমকা মায়ের মুখের দিকে তাকালো। শিখা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানতে চাইলো-
“কি দেবো?”
“যা চাই তাই দেবে তো?”
“হ্যা হ্যা তাই দেবো। কি চাই তোর বল আমায়?”
“ভেবে দ্যাখো। পরে আবার পিছু ফিরলে কিন্তু আমি নিজের জান দিয়ে দেবো। জীবনে প্রথমবার তোমার কাছে কিছু চাইছি। যদি না দিতে পারো আবার হারিয়ে যাবো তোমাদের জীবন থেকে। মনে রেখো।”
শুভর কথায় কেন যেন শিখার কলিজা কেঁপে উঠলো। ছেলেটা কি এমন চাইবে যে এমন করে বলছে? শিখা ভেতর ভেতর ঘামছে। তার এই ছেলেটা বরাবরই শান্ত। শান্ত মানুষ রেগে গেলে নাকি
ভয়ানক হয়। কথাটা এই মুহূর্তে ভীষণ রকম সত্য মনেহচ্ছে শিখার কাছে। শুভর হাতের দিকে তাকালো আবার। আর তাকিয়েই মনে হলো, শুভ যাই চাক সেটা দেওয়া যাবে। এমন কিছু নিশ্চয়ই চাইবে না যেটা শিখার দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এই মুহূর্তে শুভর ট্রিটমেন্ট জরুরি। শিখা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে-
“তুই যা চাইবি দেবো শুধু এরকম পাগলামো করিস না। চল এখনি হাসপাতালে চল। হাতের ব্যান্ডেজ করিয়ে আনি।”
শুভ ভদ্র ছেলের মতো মায়ের সাথে বেড়িয়ে এলো।

দিন কয়েক বাদে রাযীন রুহির কাছে জানতে চাইলো-
“ব্যাংকের চিটাগং ব্রান্চে কাজ করতে তোমার সমস্যা নেই তো?”
“মানে?”
রুহি অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
“মানে তুমি তোমার ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলে জানাবে তুমি চিটাগং ব্রান্চে জয়েন করতে চাও তাহলেই হবে।”
“কিন্তু ঢাকায় আমার… ”
“চাইলে আবার যে কোন সময় ঢাকায় ট্রান্সফার নিতে পারবে। ঠিক আছে? আপাতত এখানে জয়েন কর।”
এতো প্রশ্ন শুনে রাযীন একটু বিরক্ত স্বরে বললো। রুহি কিছু বলতে যেয়ে থামলো। ওর আসলে জানতে মন চাইছে রাযীন কি করে ম্যানেজ করলো এসব? ভালোও লাগছে এই ভেবে লোকটা ওকে নিয়ে ভেবেছে, ওর মতামতের মুল্য দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা একবারও চাকরি ছাড়তে বলেনি বা ফোর্স করেনি। রুহির মনে একটা প্রশান্তির বাতাস খেলে গেলো। ঘটনা হয়তো এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলোনা, উল্টো একটা জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আসলো। সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফিরে আফজাল যখন নিচতলা থেকে হুঙ্কার দিয়ে রাযীনকে ডাকলো তখন পুরো বাড়ি যেন কেঁপে উঠলো। রাযীন আফজালের সামনে এসে দাঁড়াতেই আফজাল পুরো বাড়ির লোকের সামনে বিরাশি কেজি ওজনের এক চড় কষালেন রাযীনের গালে। সে দৃশ্য দেখে রুহির হাতে থাকা চায়ের ট্রে ঝনঝন শব্দে মেঝেতে আছড়ে পড়লো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-২০

“তোমার সাহস হয় কি করে আমার অনুমতি না নিয়ে একশো কোটি টাকার ফান্ড ওই ব্যাংকে জমা করার? টাকাটা অন্য বিজনেসে ইনভেস্ট করার কথা ছিলো এটা কি কেউ তোমাকে বলেনি?”
আফজাল রাগে চেচিয়ে উঠলো, কথা বলার সময় থরথর করে কাঁপছে। রাযীন ক্ষীন কন্ঠে উত্তর দিলো-
“আমিও বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের একজন ছোট আব্বু। ডিসিশন নেওয়ার অধিকার আমারও আছে। আমি ভালো করে যাচাই বাছাই করেই ডিসিশন নিয়েছি। ব্যাঙ্কে ইনভেস্টমেন্ট আপাতত লাভজনক হবে স্টিল মিলের চাইতে।”
“হাউ ডেয়ার ইউ? তোর এতো সাহস আব্বুর মুখে মুখে তর্ক করিস? একেতো চুরি তারউপর সিনা জুড়ি?”
সৌরভ তেড়ে এলো রাযীনের দিকে। ঝিলিক তাকে থামালো। আফজাল ফোঁস করে উঠলেন-
“সেদিনের পুঁচকে ছেলে আমাকে তুমি বিজনেস শিখাচ্ছো? কোনটা লাভ কোনটা লস এসব কি আমি বুঝি না? আর তুমি একা ডিসিশন নেওয়ার কে? আমরা কি মরে গেছি সবাই?”
আফজাল তেড়েফুঁড়ে আসতেই শিখা আটকালো-
“আহ! এতো উত্তেজিত হয়ো না তোমার শরীর খারাপ করবে।”
চিৎকার শুনে রোজী এসে দাঁড়িয়েছে-
“কি হয়েছে আফজাল? কি করেছে রাজ?”
“কি করেছে সেটা আপনার গুনধর ছেলের মুখ থেকেই শুনুন ভাবি। দু’দিন হয়নি দেশে এসেছে এরমধ্যেই নিজের মনমর্জি মাফিক চলতে শুরু করেছে। বড়ভাই যতদিন সুস্থ ছিলো কখনো কি শুনেছেন ভাইজানকে বাদ দিয়ে আমি কোন কাজ করেছি? সেই সাহসই তো ছিলোনা আমার। আর আপনার ছেলে দু’দিন হলো বিজনেসে জয়েন করে আমার অনুমতি না দিয়ে ব্যাংকে একশো কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে। আপনি ওর কাছে জানতে চান এই সাহস সে পেলো কোথায়?”
রোজী বিস্মিত হয়ে রাযীনের দিকে তাকালে সে চোখ নামিয়ে নিলো-
“ছোট আব্বু যা বলছে তা কি সত্যি রাজ? কেন তুমি এ কাজ করলে?”
“প্রয়োজন ছিলো বলেই করেছি আম্মু।”
“প্রয়োজন! কি প্রয়োজন? তুমি তো এতোদিন দেশেই ছিলে না। এভাবে হুট করে এতো টাকা ইনভেস্টমেন্টের রিস্ক নেওয়া কি ঠিক হয়েছে?”
রোজী শান্ত স্বরে কথাগুলো বললো। রাযীন নিজেকে বাচানোর চেষ্টা করলো-
“ঠিক হয়েছে। আমি ভালো করে খোঁজ নিয়েছি।”
“কিন্তু তোমার উচিত ছিলো ছোট আব্বুর পারমিশন নেওয়া। ছিলো না?”
রাযীন জবাব দিলো না। আফজাল চাপা গলায় বললো-
“ভাবি ওকে বলুন টাকা ফেরত আনতে। আমার প্রজেক্ট মোটামুটি ফাইনাল করে রেখেছি এখন ইনভেস্টমেন্ট না পেলে লসের মুখে পড়তে হবে।”
“সেটা সম্ভব না ছোট আব্বু। আপনি বরং সৌরভ ভাইকে বলুন টাকা দিতে। গত মাসে পঞ্চাশ কোটি টাকা ফাইন্যন্স করেছে কক্সবাজারে নিজের নামে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মানের প্রজেক্টে তাও আবার কোম্পানির লিকুইড ক্যাশ থেকে নিয়ে। যেটা নতুন শিপ তৈরির বুকিং মানি ছিলো। এখন শিপ এর নির্মানের জন্য প্রয়োজনীয় কাচামালের অভাবে সে প্রজেক্ট নির্দিস্ট ডেডলাইন পার হওয়ার পথে। এসব নিশ্চয়ই আপনি জানেন?”
আফজাল অবাক বিস্ময়ে সৌরভের দিকে তাকালো। সৌরভের মুখচোখে যেন কেউ কালি মেখে দিয়েছে। সে ততক্ষণে মাথা নিচু করে বসে পড়েছে সোফায়।
“ওহহহ, তোমরা দু’ভাই শুরু করেছো কি? এতো কিছু হয়ে যাচ্ছে আর আমি কিছু টের পাই না কেন? ব্যবসাটাকে কি ডুবিয়ে ছাড়বে তোমরা?”
আফজাল হতাশ হয়ে সোফায় লুটিয়ে পড়লো। রোজী পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলো-
“এখন আর এসব নিয়ে কথা বলোনা আফজাল। অফিস থেকে এসেছো ফ্রেশ হও। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন মাথা গরম করে কিছু পাওয়া যাবে না। শিখা তুমি আফজালকে নিয়ে যাও। আর তোমরাও সবাই যার যার কাজে যাও।”
উপর থেকে শান্ত দেখালেও রোজীর ভেতরে ভাঙচুর হচ্ছিলো। তার স্বামীর এতো কষ্টে গড়ে তোলা ব্যবসার হাল বুঝতে বেগ পেতে হয়নি বেশি। ক্ষমতা পেয়ে সবাই যার যার মতো করে নিজের আখের গোছাতে চাইছে এটা তো একটা বোকাও বুঝতে পারবে। রোজী কি করবে ভেবে পেলোনা। তার কি কিছু করনীয় আছে?

সৌরভ চলে যেতে যেতে রাযীনকে শিকারীর ন্যায় আপাদমস্তক জরিপ করলো। তার স্বপ্নের প্রজেক্টের খবর রা্যীন কি করে পেলো তাই তার মাথায় ঢুকছে না। অফিসেও বিশেষ কেউ এখবর জানে না। যারা জানে তাদের পক্ষে খবর ফাঁস করা সম্ভব না। তাহলে কে দিলো খবর? রাযীন তো দেশেও ছিলোনা এতোদিন। তার এতোবড় শুভাকাঙ্ক্ষী এখানে কে আছে যে সৌরভের খবর রাযীনের কাছে পৌঁছে দেয়। এতো সাহস কার হয়েছে? খুঁজে বের করতে হবে তাকে যত দ্রুত সম্ভব। ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে গেলো সৌরভ, তার পেছন পেছন ঝিলিক। আজ কোনভাবে সৌরভকে রাগানো যাবে না নয়তো ঝিলিকের খবর করে ছাড়বে। যদিও রাযীনকে অপমান হতে দেখে ঝিলিকের মোটেও ভালো লাগছিলো না। হাজার হোক এক সময় দু’জনেই মিষ্টি একটা সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলো। রাযীনকে অন্য কেউ অপমান অপদস্ত করছে এটা এখনো ঝিলিক সইতে পারে না। অন্তত আজকের ব্যাপার দেখে তাই বুঝতে পারলো সে নিজে। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে ঝিলিকের মনে অন্য প্রশ্ন উদয় হয়। প্রশ্ন হলো, রাজের মতো ছেলে হুটহাট কিছু করার মানুষ না। যে ছেলের বাবার ব্যবসা নিয়ে আগ্রহই ছিলো না সে কিনা সেই ব্যবসার টাকা অন্য কোথাও ইনভেস্ট করেছে শুনলে কেমন যেন খটকা লাগে। এতো বড় ইনভেস্টমেন্ট রাজ এমনি এমনি করবে এটা কেন যেন বিশ্বাস হয় না। এর পেছনে যৌক্তিক কারন নিশ্চয়ই আছে। কার জন্য এতো বড় রিস্ক নিলো রাজ?

★★★

“ইশশ, আঙুলের দাগ বসে গেছে। প্লিজ একটু বরফ লাগাতে দিন না?”
রুহি আইসব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাযীন এতোক্ষণ মেজাজ খারাপ করে বসে ছিলো। আজকের ঘটনার রেশ অনেকদিন থাকবে। এর কনসিকোয়েন্স যে আরো খারাপ হবে সেটা ভালোই বুঝতে পারছে। সৌরভ এতো সহজে ওকে ছাড়বে না। আফটারঅল ওর গোপন খবরটা সকলের সামনে ফাঁস করে দিয়েছে। বসে বসে ভাবছিলো পরবর্তীতে সৌরভ কি করতে পারে। হঠাৎ রুহির দিকে তাকাতেই রুহি কথাটা বলে। রাযীন ওর পানে চেয়ে মুচকি হাসলো, নিজের চড় খাওয়া গাল পেতে দিলো-
“লাগাবে? লাগাও।”
রুহি খুশি হয়ে রাযীনের পাশে এসে বসলো। আইসব্যাগটা রাযীনের গালে লাগাতেই রাযীন ব্যাথায় অস্ফুটে চিৎকার করলো। রুহি দু’ঠোঁট গোল করে ফু দিতে দিতে সান্ত্বনা দেয় রাযীনকে-
“এই তো আরেকটু। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। ব্যাথা হচ্ছে খুব তাই না?”
রুহি নিজের আগুল দিয়ে লালচে দাগ হয়ে থাকা গালের জায়গাটা ছুঁয়ে দিলো-
“আপনি আমার জন্য এতো ব্যাথা সহ্য করছেন এটা আমার বিশ্বাসই হতে চাইছে না। এতোকিছু কেন করছেন আমার জন্য? নিজেকে খুব ছোট মনেহচ্ছে।”
রাযীন ফট করে রুহির হাত ধরে ফেলে, ওর চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলো-
“মানে কি? তোমার জন্য করবো কেন? ব্যবসায়ী কখনো নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু করে না। ইনভেস্টমেন্টে লাভ না হলে কখনো টাকা ঢালতাম না। মনে রাখবে ব্যবসায়ীর প্রতিটা পদক্ষেপে লাভ থাকে।”
রুহি বোকা বোকা হাসি দিলো-
“তাই বুঝি? তা আমার ব্যংকে একশো কোটির ইনভেস্টমেন্টে কি লাভ বলুন তো?”
রাযীন মুচকি হেসে নিজেকে সামলে নিলো। আইসব্যাগটা রুহির হাত থেকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে গালে চেপে ধরলো-
“তোমার আর জবে না গেলেও চলবে। বাসায় বসে বেতন নেবে। চাইলে যে কোন জায়গায় যে কোন সময় ট্রান্সফার নিতে পারবে। এতোকিছুর পরেও একশো কোটির ইনভেস্টমেন্টে লাভ আসবে। আসবে কি এসে গেছে অলরেডি। এই মনে করো তোমার হৃদয়ে জায়গা, তোমার সেবা এসব তো অনন্য দামী জিনিস। এগুলো বোনাস সহ বাড়ি গাড়ি পাচ্ছি সেটা কি কম পাওয়া? তাছাড়া টাকাটা কোথাও রাখা যাচ্ছে নিশ্চিন্তে এটাও কি কম পাওয়া?”
লাজে রুহির গালে রক্তিম আভা। লজ্জায় অধোবদন হয়ে মেঝেতে টাইলস দেখছে মন দিয়ে। তার ইচ্ছে করছে ছুটে পালাতে কিন্তু পা যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে নড়তেই পারলোনা। রাযীন ওর অবস্থা বুঝতে পেরে মুচকও মুচকি হাসছে।
“তা ম্যাডাম, গালে কি শুধু বরফই দেবো? কিন্তু এতে যে ব্যাথা যাচ্ছে না?”
রুহি ব্যস্ত হয়ে মুখ তুললো-
“কি ওষুধ দেবেন বলুনতো আমি এখনি লাগিয়ে দিচ্ছি।”
রাযীন রুহির ওষ্ঠের দিকে ইশারা করে-
“একটু স্পর্শ পেলেই আমি এই মুহুর্তে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবো। এর চাইতে ভালো মলম পৃথিবীতে আর একটিও নেই।”
রুহির চেহারা চেরি ফলের মতো লাল হতে শুরু করেছে। সে কপট রাগ হওয়ার ভাব দেখিয়ে বলে-
“আপনার স্প্যানীশ গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করতে হবে দেখছি। গার্লফ্রেন্ড কে মিস করছেন খুব তাই না?”
“তা মিস করছি বটে কিন্তু আমার এখন স্প্যানীশ না দেশি বউয়ের আদর লাগবে।”
রাযীনের কথায় রুহি কান গরম হয়ে গেছে। সে সইতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো-
“অসভ্য। দাঁড়ান আপনার গার্লফ্রেন্ডকে বিচার দিচ্ছি।”
“কোন সমস্যা নেই দিলে। ওটা অনেক উদার হয়। আমার উপর তুমি ভাগ বসালে কিছু মনে করবে না।”
রাযীন চোখ টিপলে রুহি চোখ বড় বড় করে তাকায়-
“আপনি সত্যি অসভ্য হয়ে গেছেন।”
রুহি চলে যেতে উদ্যত হতেই রাযীন ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো। রুহি সাথে সাথে বসে পড়ে রাযীনের গালে হাত দিলো-
“ইশশশ, খুব ব্যাথা তাই না? কেন যে আমার জন্য এতো ঝামেলা কাঁধে নিলেন?”
রাযীন মিষ্টি করে হাসলো, আলতো করে রুহির থুতনি ধরে মুখটা ওর মুখের সামনে নিয়ে আসে। অপলক তাকিয়ে থাকে রুহির মুখের দিকে। প্রথমদিকে রুহির চেহারাটা চাকমা মেয়েদের মতো লাগলেও আজকে আর তেমন লাগছেনা। বরং ওর মোটামোটি ফর্সা মুখায়বরটি মায়াময় কোমল নরম আদর আদর লাগছে। চোখ দুটোর ঘোরে ডুবে যেতে যেতে রাযীন ফিসফিস করলো-
“তুমি আমার বউ না? বউয়ের জন্য একটা চড় কেন হাজার চড় খেতে রাজি আছি। এর চাইতে অনেক বেশি ব্যাথা সইতে রাজি। বউয়ের জন্য আমার জান হাজির।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin