নিরবতায় হৃদয় কোনে পর্ব-১১

0
222

#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১১

শরৎ বিদায় নিয়ে প্রকৃতিতে ধরা দিলো হেমন্তের ছোঁয়া। একটু-আধটু ঠান্ডা আবহাওয়া, শীতের পূর্বাভাস। আবছা কুয়াশায় ঢেকে আছে মাঠঘাট। শিউলি ফুলের মৌ মৌ সুগন্ধি জানান দেয় হেমন্তের উপস্থিতি। নিত্যদিনের মতো আজও কাজের উদ্দেশ্যে বের হলো মিতালী। প্রথম টিউশন শেষ দিয়েই নির্ভীকের অপেক্ষায় দাঁড়ালো। নির্ভীক রিকশায় চড়ে এসেই বলল,
-“উঠে পড়।”

মিতালী রিকশায় চেপে বসতেই চালক প্যাডেল ঘুরিয়ে স্কুলের পথে রওনা হলো।
সব শিক্ষকদের ডাক পড়লো অফিস কক্ষে। মাস পূর্ণ হওয়ায় হাতে হাতে খাম ধরিয়ে দেওয়া হলো। বেতন হাতে তুলে ছোট্ট একটা সিগনেচার দিয়ে যে যার ক্লাসের উদ্দেশ্যে গেলো। এখানে খাটুনি হিসেবে বেতন একটু কম, তবে মাস শেষ হতেই হাতে বেতন পেয়ে আনন্দিত হলো মিতালী। তাছাড়া সপ্তম – অষ্টম শ্রেণীর গণিত ক্লাস তার। বেশ কয়েকটা স্টুডেন্ট এই মাস থেকেই প্রাইভেট পড়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। দুটো ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের একই সাথে না পড়ালে সময় হয়ে উঠবেনা। রিতু আর তার চাচাতো-বোনকে সকাল আটটা থেকে পড়াতো। এখন তাদের সাথে কথা বলে প্রাইভেট সাতটায় নিয়ে আসতে হবে। সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে নয়টা স্কুলের স্টুডেন্টদের পড়াবে। রিতুর পরিবার মানতে না চাইলে ছে*ড়ে দেবে তাদের পড়ানো।

আজ তিনটে টিউশনের দুটোর টাকা হাতে পেলো। বেতন আর টিউশনের টাকা থেকে চার হাজার আলাদা করে নির্ভীকের দিকে বাড়িয়ে দিলো। ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে প্রশ্ন করলো নির্ভীক,

-“কিসের টাকা?”

-“মনে নেই? তোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে মাহার ফর্ম পূরণ করলাম।”

টাকা নিতে সরাসরি নাকচ করলে মিতালী মানবেনা। বেশ শক্ত ধাঁচের মেয়ে সে। জোর করে হলেও টাকা সে ফেরত দেবে। তাই নির্ভীক একটু ঘুরিয়ে বলল,
-“আপাতত তুই ঝা*মে*লা সেরে নে। আমার যখন টাকার প্রয়োজন পড়বে, হাত খালি থাকবে তখন নাহয় দিস।”

নির্ভীকের হাতে চার হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে মিতালী বলল,
-“যখন তুই চাইবি, তখন আমি না ও দিতে পারতে পারি। তোর টাকা দিয়ে বাকি যেটা থাকবে, সেটা দিয়ে আমি সব সামলে নেবো।”

নির্ভীক কথা বাড়াতে চাইলোনা। রেখে দিলো টাকা। এগুলো সে খরচ করবেনা। দুদিন পর হয়তো মিতালীর আবার টাকার প্রয়োজন পড়তে পারে। তখন আবার তাকে এগুলো ফেরত দেবে।
আট হাজার টাকা থেকে নির্ভীককে দিয়ে অবশিষ্ট রইলো চার হাজার। টাকার খামটি সযত্নে বাবার হাতে তুলে দিলো মিতালী।

মতিন সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মিতালী ইশারায় বোঝালো,
-“খুলে দেখো।”

মতিন সাহেব খাম খুলে টাকা হাতে নিলেন। মিতালী বলল,
-“বেতনের টাকা।”

ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন মতিন সাহেব। আনন্দাশ্রু ঝরিয়ে মেয়েকে কাছে টে*নে নিলেন। উৎফুল্ল মেজাজ হুট করেই ব্যথাতুর কন্ঠে রূপ নিলো।
-“আমার মায়ের পয়লা চাকরির টেকা আমি হাতে নিছি। আমি তোমগো রোজগার খাইয়া যামু আশা কইরা পড়ালেখা করাইনাই। আমিতো আল্লাহর কাছে চাইছিলাম আমার রোজগারে আমার আম্মারা পড়ালেখা করবো। সুন্দরভাবে চলবো।”

মিতালী বাবার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
-“তুমি খুশি হওনি?”

দ্রুত চোখ মুছে নিলেন মতিন সাহেব। ত্রস্তব্যস্ত গলায় বললেন,
-“মেলা খুশি আব্বা। এই যে আব্বার চোখে পানি, এইডা আনন্দে ঝরতাছে।”

রোজী বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে বাবা – মেয়ের আনন্দ সিক্ত মুহূর্ত দেখে আঁচলে চোখ মুছলেন।
এই একমাস বহুকষ্টে রাস্তার ধার থেকে শাকপাতা নিয়ে এসে রান্না করেছেন রোজী বেগম। কোনোদিন শুধু আলু সেদ্ধ দিয়ে ভাত খেয়েছেন।
তবুও সুখে আছেন, আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে আছেন।
★★★

স্কুল থেকে ফেরার সময় মাহার পথ রোধ করে দাঁড়ালো ইশরাক। অস্বস্তিতে গাঁট হলো মাহা। তাকে পরোখ করে ইশরাক বলল,
-“মাহা মনি আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছো? নির্ভীকের সাথে তো ভীষণ সুন্দর হেসে হেসে কথা বলো। তাহলে আমার বেলায় লজ্জা কেন?”

এতক্ষণ যাবত খুব একটা লজ্জা না পেলেও এবারে মিইয়ে গেলো মাহা। নত দৃষ্টি আরেকটু খানি নত হলো। ইশরাক একটা চকলেট বাড়িয়ে দিলো। মৃদু হেসে বলল,
-“এটা তোমার জন্য। চলো কথা বলতে বলতে তোমায় বাড়িতে দিয়ে আসি।”

মাহা চকলেট নিতে হাত বাড়ালোনা দেখে ইশরাক নিজেই ওর হাতে চকলেট গুঁজে দিলো। শরীর শিরশির করে উঠলো মাহার। যেন মুহুর্তেই বিদ্যুৎ খেলে গেলো। অনুভূতিটি ঠিক কেমন ছিলো? ভালো নাকি অস্বস্তির, সে বুঝলোনা। সামনে পা বাড়াতে গিয়েই টের পেলো পাশাপাশি আরও একজোড়া পা চলছে। ইশরাক মাহাকে সহজ করার জন্য প্রথমেই পড়ালেখার ব্যাপারে কথা তুললো। একসময় মাহা এতটাই সহজ হয়ে উঠলো যে খিলিখিলিয়ে হাসতে হাতে কবে বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলো টেরই পেলোনা।
ইশরাককে বিদায় দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো মাহা। তার মনে সাতরং এর রংধনু দেখা দিয়েছে। মানুষটা কি সুন্দর করে কথা বলে। তাকে কি সুন্দর ইমপ্রেস করে নিয়েছে। তার ভাবানায় বিভোর হয়েই সে ঘরে প্রবেশ করলো। এদিকে ইশারাক দাঁড়িয়ে রইলো। একপলক তার প্রেমকে দেখার তৃষ্ণায় ইতিউতি করে উঁকি দিলো। মাহা তার সাথে সহজ হয়ে উঠেছে। এবার তার মাধ্যমে মিতালীর কাছে পৌঁছাতে খুব একটা সমস্যা হবেনা। মিতালীর সমস্ত খবরাখবরই নেওয়া যাবে।
উঠান থেকে শুকনো জামাকাপড় নিতে বের হলো মিতালী। তখনই তাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বিদায় নিলো ইশরাক।

★★★

চেয়ারম্যান বাড়ির বড় খাবার টেবিলে গোল হয়ে চেয়ার পেতে বসলেন পুরুষ, বাচ্চারা। মহিলারা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। মালিহা আস্তে আস্তে খাবার চিবুচ্ছে দেখে তার আম্মু মিনা ধমকে উঠে বলল,
-“দ্রুত খাবার চিবাও। তোমার এখনও হোমওয়ার্ক বাকি আছে।”

মালিহার মুখখানা চুপসে একটুখানি হয়ে গেলো। হোমওয়ার্ক, পড়ালেখা করতে তার ভালোলাগেনা। তবুও আম্মু প্রতিদিন তাকে পড়তে বসায়।
ছোট্ট মালিহার বেজার মুখে তাকিয়ে ইশরাক বলল,
-“ভাবি! এমনভাবে আমার ছোট্ট আম্মুটাকে বকছো কেন?”

মালিহার চোখজোড়া টলটলে জলে ভরে উঠলো। ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে ফেললো। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে নরম সুরে প্রতিবাদ করলো।
-“চাচ্চু তোমার ভাবি খুব পঁচা। আমায় প্রতিদিন পড়ায়, আমার ভালোলাগেনা। একটু গল্প ও করেনা আমার সাথে।”

ইশরাক খাওয়ার মাঝেই কিছু একটা ভাবলো। অধর কোনে দেখা মিললো সূক্ষ্ম হাসির মেলা। মালিহার গালে হাতের নরম ছোঁয়া দিয়ে বলল,
-“এখন থেকে আর আম্মুর কাছে পড়তে হবেনা। তোমার জন্য মিস আসবে। সে খুব মজা করে পড়ায়।”

মালিহা চোখ পিটপিট করে বলল,
-“সে কি গল্প করবে?”

ইশরাক ও মালিহার মতো চোখ পিটপিট করে ঢং করে বলল,
-“হ্যাঁ, সে দারুণ গল্প জানে।”

গদগদ কন্ঠ মালিহা বলল,
-“চাচ্চু আমি তোমার হাতে খাবার খাবো।”

ইশরাক মালিহার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো। সযত্নে তার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। মালিহা পা দুলিয়ে খাবার চিবুচ্ছে আর নানারকম কথা বলছে।
মালিহাকে ঘরে পাঠিয়ে দিতেই ইশরাকের বাবা প্রশ্ন ছুঁ*ড়*লে*ন,

-“কোথা থেকে মিস ঠিক করলি?”

ইশারাক খাবার প্লেটে হাত চালিয়ে নিয়েই বাবার প্রশ্নের জবাব দিলো,
-“ভাবছি মিতালীকে মালিহার মিস হিসেবে ঠিক করবো। ব্যাপারটা কেমন হবে?”

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
-“তুমি বললেই তো হচ্ছে না। তার ও তো মতামত থাকতে পারে।”

নির্ভীক খাওয়া থামিয়ে বলল,
-“আমার মনে হয়না মিতালী পড়াতে আসবে। দিনের বেলায় ওর একদণ্ড জিরোবার সময় নেই।”

ইশরাক বলল,
-“সন্ধ্যার পর পড়িয়ে দেবে না হয়।”

নির্ভীক ফের বলল,
-“সারাদিনের ধকল সহ্য করে আবার রাতে ও খাটুনি খাটবে?”

-“মিতালী অনেক দূরদূরান্তে টিউশন করতে যায়। সেখান থেকে একটা টিউশন ছেড়ে দিয়ে মালিহাকে পড়ালেই হবে। সে দিনে সময় না পেলে না হয় সন্ধ্যের পর পড়িয়ে যাবে।”

ইশরাকের কথায় খানিক বিরক্ত হলেও প্রকাশ ঘটালোনা নির্ভীক। বলল,
-“চাচা-চাচি সন্ধ্যার পর ও কে বান্ধবীর বাড়ি পর্যন্ত থাকতে দেন না। আর টাকার জন্য তো আরও আগেই থাকতে দেবেন না। নিরাপত্তার ও একটা ব্যাপার আছে।”

ইশরাক বলল,
-“সমস্যা কোথায়? আমি না হয় পৌঁছে দেবো।”

চেয়ারম্যান সাহেব এতক্ষণ যাবত দুজনের বাক্যালাপ শুনে গেলেন। এবারে মুখ খুললেন,
-“তোরা অযথা ত*র্ক করিসনা। মালিহা পড়তে চাইলে আমি মিতালীকে বলে দেখবো। সে যদি পড়াতে রাজি হয়, তখন না হয় পড়াবে।”

নির্ভীক আর ইশারাক কেউই কথা বলল না আর।
একজন প্রেমিক কখনো অন্যজন প্রেমিকের চোখকে ধুলো দিতে পারেনা। এ কয়েকদিন ইশরাকের আচরণ বেশ লক্ষ করেছে নির্ভীক। সে মনে মনে যে ভ*য়ের আ*শ*ঙ্কা করছে, তা যেন সত্যি না হয়। সে মনে প্রাণে চায় তার ধারণা ভু*ল প্রমাণিত হোক। ইশরাকের মনে যেন মিতালীর জন্য কোন অনুভূতি না জন্মে। তবে সে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
মিতালীর প্রতি এর বেশি ভাবনাচিন্তা দেখালে নির্ভীক সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদে যাবে। খোলাখুলি কথা বলবে ইশরাকের সাথে। যাকে একটু একটু করে মন গোপনে লালন করেছে, যার জন্য সুপ্ত অনুভূতির পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে, তাকে অন্যকারো হতে দেখা যায় না।

দ্রুত খাবার শেষ করে উঠলো নির্ভীক। ঘরে ফিরেই ফোন হাতে নিলো। ডায়াল করলো কাঙ্ক্ষিত নম্বরে। কানে বাজলো কাঙ্ক্ষিত সেই মধুময় সুর।

মিতালী বলল,
-“কিরে এখন ফোন করলি। জরুরি কোন কথা আছে?”

নির্ভীক জবাব দিলোনা। পাল্টা প্রশ্নে গেলো। গভীর আবেগ নিয়ে বলল,
-“তুই কি কখনো কারো মায়ায় জড়িয়ে আমাকে ছেড়ে দিবি?”

মিতালী খুঁজে পেলোনা এমন অযাচিত প্রশ্নের কারণ। বলল,
-“বুঝলাম না তোর কথা।”

-“তোর জীবনে যদি এমন কেউ আসে, যে তোকে সবরকম ভাবে সুখী করতে সক্ষম। ধর তুই তার মাঝে ভীষণভাবে আটকে গেলি, তখন কি আমায় ভুলে যাবি?”

মিতালী কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“তোর কী হয়েছে রে, সোজাভাবে বল।”

নির্ভীকের হুশ ফিরলো। সে কথা কা*টা*তে বলল,
-“কিছু না, এমনিই।”

মিতালীর বিশ্বাস হলোনা কথাটি। তাই বলল,
-“কিছু না হলে কেন এত অস্থিরতা।”

“বুকের ভেতর থমকে গেলে মন,
আমিই আমার অচেনা কেমন!
তখন, আলগোছে যে আয়না মেলে চাই,
দেখি, সেই সেখানে কোথাও আমি নাই।
আমার বন্ধঘরের অন্ধকারে, কোথাও আলো নেই।
আমি আমার খোঁজে নিরুদ্দেশ, তাই মনটা ভালো নেই।
আমার মনটা ভালো নেই।”

সাদাত হোসাইন

নির্ভীকের গলায় আবৃত্তি শুনে মিতালী নরম সুরে বলল,
-“কী করলে তোর মন ভালো হবে?”

নির্ভীকের কঠোর আদেশ,
-“আজ আমার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলবি।”

#চলবে……..