৯ম পর্বের পর থেকেঃ-
”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
১০ম পর্ব
সকাল থেকেই ওয়াফিফ বাড়িতেই আছে। ঘুম থেকে উঠে দেখে জিনিয়া তখনও ঘুমিয়ে । জিনিয়ার ওর আগে কোন দিন ঘুম থেকে উঠতে পারল না। ওকেই ডেকে তুলতে হয় রোজ। অবশ্য জিনিয়ার বাড়ি থাকাকালীন জিনিয়াকে এতো সকালে ঘুম থেকে উঠাবে না সেটাই ভেবে রেখেছে ওয়াফিফ। ওর মাথায় এখনো চিন্তা একটাই। কবে জানাবে বাড়িতে যে জিনিয়া প্রেগন্যান্ট। অবশ্য এখনই জানানোর কোন প্ল্যানিং নেই। ওদের বিয়ের ২ সপ্তাহ হয়ে চলেছে। এখন চাইলেই জানিয়ে দেওয়া যায়। তবে এতো দ্রুত প্রেগন্যান্ট হওয়া সম্ভব হলেও জানতে পারা সম্ভব না। আবার অনেকের বুঝতেই অনেক দিন লেগে যায়। কিন্তু জিনিয়া বিয়ের ২ সপ্তাহ আগে থেকেই প্রেগন্যান্ট। তাই কখন কিভাবে বলবে সেটা বুঝতে পারছে না। দীর্ঘ ৩১ বছরের জীবনে এই ১ম সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে যেন। নিজের পেশেন্টের রোগের চিকিৎসার সময়ও সে এতো ভাবে নি। কিন্তু কোন একটা বিষয় লুকানো সহজ কাজ ও নয়। ওয়াফিফ জিনিয়াকে প্রটেক্ট করতে চায়। বিশেষ করে এই সিচুয়েশনে। মেয়েটা যাই হোক, ১ বার তো ধোঁকা পেয়েছে। বড় কোন বিষয় একা সামলাতে পারবে না। আর যদি গভীর ভাবে ভেবে দেখা হয় তাহলে বেশির ভাগ মেয়েরা এই কথা সামনে আনলে তাদের যেই পরিস্থিতিত্র মুখোমুখি হতে হয় সেটা সামলাতে না পেরে অনেক সময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। হাসপাতালে এমন কেস ওয়াফিফ অনেক দেখেছে। অনেকে এই ক্ষেত্রে মেয়েদের ই দোষ দেয়। কিন্তু মেয়েদের যে দোষ একেবারেই নেই সেটা বলা হচ্ছে না। কিন্তু তারা তো জেনে শুনে এই স্টেপ নিয়ে নেয় না। ইচ্ছা করেই প্রেগন্যান্ট হয় না। কোন না কোন পরিস্থিতিতে পড়েই এমন করে, সেটা কেউ ভেবে দেখে না। বিয়ের আগেই প্রেগন্যান্ট হওয়ায় আত্মহত্যা করেছে – এমন শোনার পর সবাই এটাই বলে – ঠিকই হয়েছে। কেন গিয়েছিল মান সম্মান খোয়াতে? কিন্তু যেই মানুষটা এমন পরিস্থিতিতে পড়ে, তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে একবার ও ভেবে দেখে না। তাই হয়তো তার সমস্যা বুঝতে পারে না। যেই মানুষটা প্রথমে বিশ্বাস অর্জন করে আর পরে ধোঁকা দেয়, তার পরের পরিস্থিতি কারোর হাতে থাকে না। এমন এক পরিস্থিতিতে জিনিয়াও পড়েছে।
ওয়াফিফ নিজে ডাক্তার। এমন কেস অনেক দেখেছে। বিশেষ করে এদের কারণ জেনেছে। তাই সে চায় না আরেকটা প্রাণ যাক কোন ভুল সিদ্ধান্তে। প্রথমে মায়ের ব্ল্যাকমেইল করার কারণে বিয়েতে রাজি হলেও পরে জিনিয়াকে বাঁচাতে সে রাজি হয়েছে। এমন তো না সে একাই সমাজ এর চিন্তা ধারা বদলাতে পারবে। কিংবা এমন ও নে যে একসাথে ১০০ টা বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু যদি এক জনকে সঠিক পথ দেখাতে পারে তাহলে ক্ষতি কোথায়? এক জনই হোক সে। এসব ভেবেই সে সেদিন ক্যাফে তে চুপ ছিল। কিছু সময়ের মধ্যে সব ভেবেই শান্ত ছিল। জিনিয়া নিজে কতটা সাহস করে আর বিশ্বাস করে ওয়াফিফকেই প্রথমে বলেছিল সেটা ওয়াফিফ বুঝতে পেরেছিল। আর যে নিজের সন্তানের বাবার আগে ওয়াফিফ কে বলেছে, তাহলে সে হয়তো এমন পরিস্থিতিতেই আছে, যেখানে হয়তো অপর পক্ষ রাজি নয়। তাই জিনিয়ার প্রতি তার এক আলাদা মায়া জন্ম নিয়েছিল সেই মুহূর্তেই। জিনিয়া দেখতে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার ভিতরে যে ঝড় চলছিল সেটার আভাস পেয়ে ওয়াফিফ জিনিয়াকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। আজও সে জিনিয়ার স্বাভাবিক আচরণ করে । তবে এটা ভালোবাসা না। দায়িত্ববোধ। জিনিয়াকে বিয়ে করেছে, তারপর তাকে তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিবে না, অবহেলা করবে- এমন মানুষ ওয়াফিফ নয়। এতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীন সে নয়। জিনিয়াকে খুশি রাখার দায়িত্ব তার। আর নিজের মনের কোণে কখনো জায়গা দিতে পারবে কি না – সেটা সময় ই বলে দিবে। এখন ও তো তার মনে আরেকজন সেই ৬ বছর ধরে জায়গা দখল করে আছে। অবশ্য এ দিক থেকে জিনিয়ার মনে জাবির আছে ৩ বছর ধরে। তাই সে জিনিয়াকেও জোর করবে না বা করার কোন কারণ নেই।
ভাবতে ভাবতে ওয়াফিফ আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল বৃষ্টিতে। অবশ্য এটা বৃষ্টি না। তবে ওয়াফিফের কাছে বৃষ্টি মনে হল। চোখ পিটপিট করে খুলতেই বুঝল এটা জিনিয়ার চুলের পানি যেটা তোয়ালে দিয়ে ঝাড়ার ফলে তার উপর পড়ছে। সে ঘুম ঘুম কণ্ঠেই বলে উঠল,
–জিনিয়া, এই বৃষ্টি বন্ধ করো।
জিনিয়া বৃষ্টির নাম শুনে অবাক হল। বাইরে কড়া রোড। গেলেই পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা শত ভাগ। সেখানে ওয়াফিফ বৃষ্টি পেল কি করে? সে জিজ্ঞাসা করল,
–বৃষ্টি কোথায়? এখন তো রোদ পড়ছে। আপনি বৃষ্টি কোথায় পেলেন?
–আগে তুমি চুল ঝাড়া বন্ধ করো, বৃষ্টি আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাবে।
জিনিয়া হা করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথায় তখনও ঢুকে নি আসলে বৃষ্টি কোথায় হচ্ছে। সে ওয়াফিফের কাছে গিয়ে মাথার হাত রাখল। গালে আর গলায়ও হাত রেখে দেখল ওয়াফিফের জ্বর এসেছে কি না? কিন্তু সব স্বাভাবিক।
ওয়াফিফ বলল,
–তুমি ডাক্তারের উপর ডাক্তারি খাটাচ্ছ?
–আপনি কি তাহলে পাগল হয়ে গেলেন?
জিনিয়ার মুখ দেখে এবার হাসি আসলো ওয়াফিফের। মেয়েটা নিজেই পাগল। একটু পেচিয়ে কথা বললেই সব মাথার উপর দিয়ে যায় যেন। এই কথায় কত মেয়ে গলে যেত, ক্রাশ খেত আর এই মেয়ে এখনো বুঝেই নি যে কি বলেছি। সে আবার বলল,
–আমি পাগল হই নি আর আমার জ্বর ও আসে নি। একদম ফিট এন্ড ফাইন আছি। তুমি চুল ঝাড়ছিলে যার জন্য পানি আমার উপর পড়ছিল সেটা বন্ধ করতে বলেছি শুধু।
–তাহলে বৃষ্টি?
–বৃষ্টির কথা বাদ দাও। আগে এই কাজ বন্ধ কর।
–শুনুন।
–বলুন।
–আপনি এখনো বাসায়?
–জ্বি। আজ আমার জায়গায় আরকজনকে প্রক্সি দিয়ে এসেছি। আজ ছুটি কাটাব। যাও বিবি সাহেবা। আমার জন্য এক কাপ গরম গরম চা নিয়ে এসো।
–তাহলে আজ আপনি বাসায় থাকবেন?
–এতক্ষণে বুঝলে? এবার আমাকে ঘুমাতে দাও।
বলেই নিজের পাশ থেকে বালিশ নিয়ে সেটা মাথার উপর দিয়ে মুখ লুকাল ওয়াফিফ। জিনিয়া কিছু না বুঝতে পেরে নিচে চলে গেল চা বানাতে। তার কাছে ওয়াফিফের মতো গজ্ঞানী মানুষ একটাও নেই। ওয়াফিফ হল তার সমস্যার সমাধানকারক। ওর কাছে সমাধান নেই এমনটা হতেই পারে না। তাই সব সময় তার সব কথাই মানার চেষ্টা করে জিনিয়া। সে নিজের ফোন হাতে নিয়ে সোজা আফিয়া রহমান কে ফোন করতে করতে নিচে চা বানাতে চলে গেল। আফিয়া রহমানের সাথে কথা বলতে বলতে চা বানানোও শেষ করে সেটা নিয়ে উপরে চলে এলো। একন্তু অবাক করার বিষয় একটাই। সারিকা কখনো দুপুর ১২ টা – ১ টার আগে ঘুম থেকে উঠে না। সেখানে সকাল ৮ টায় সারিকা ঘুম থেকে উঠেছে আর ডাইনিং রুমে বসে মায়ের সাথে গল্প করছে । এটা বিশ্বাস করতে পারল না। সে ভাবল হয়তো রিতিকা আপুকে সারিকা আপু ভেবেছে। কয়েক বার চোখ দুই হাত দিয়ে ঘষেও যখন সারিকাকেই দেখল, তখন হা করে নিজের রুমেই চা নিয়ে চলে গেল। আর গিয়ে দেখল ওয়াফিফ আবার ঘুমিয়ে গিয়েছে। সবার আগে ঘুম থেকে উঠা মানুষ ও যে এতো ঘুমাতে পারে – সেটা জিনিয়ার জানা ছিল না। সে ওয়াফিফ কে জাগাতে চায়। অন্তত চা যে দিয়ে গিয়েছে সেটা জানাতে চায়। কিন্তু কিভাবে জাগাবে সেটা বুঝতে পারছে না।
কয়েকবার ডাক দিল ধীরে ধীরে। কিন্তু কথাটা এতো ধীরে ছিল যে জিনিয়া নিজেই শুনতে পারল না মনে হয়। সে সাহস নিয়ে ওয়াফিফের কাঁধে হালকা ধাক্কা দিল। এতেই কাজ হল। ওয়াফিফ সহজেই জেগে উঠল। জিনিয়ার চুল থেকে তখনও পানি পড়ছিল। ওয়াফিফের জন্য ঠিক করে মুছতে পারল না তখন। জিনিয়া ধীর গলায় বলল,
–আপনার চা।
জিনিয়া তখনও ওয়াফিফের দিকে ঝুকে ছিল। ওয়াফিফ ঘুমের ঘোরেই জিনিয়াকে ভুল দেখে সে বলল,
–ছবি, আই লাভ ইউ।
–কি বললেন?
জিনিয়া নামটা ঠিক করে শুনতে না পারলেও লাভ ইউ কথাটা শুনল। তাই খুব জোরেই প্রশ্নটা করে বসল। ওয়াফিফের ঘুম এবার জিনিয়ার আওয়াজে পুরোপুরি ভেঙে গেল। নিজে কি বলেছে সেটা বুঝতে পেরে সে সামাল দিতে বলল,
–কি আর বলব? বললাম, জিনিয়া, চা দেও।
–তাই?
–কেন? তুমি কি শুনেছ? তোমার কানে কোন প্রবলেম হয় নি তো? হলে আগে আমাকে বল, আমার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
–আপনি এতো ভাবছেন কেন? আমি কিছুই শুনি নি। আপনি ঘুমের ঘোরে কিভাবে বললে, কথা জড়িয়ে জড়িয়ে আসছিল, তাই জিজ্ঞেস করলাম। এই নিন চা।
বলেই চায়ের কাপটা ওয়াফিফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিনিয়া দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ওয়াফিফ সেখানে বসে চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে ভাবল সে এতক্ষণে ঘুমের ঘোরে কি বলে ফেলতে যাচ্ছিল। ছবির কথা সে এখন জিনিয়াকে জানাতে চায় না। পরে সময় আসলে এক সময় জানানো যাবে। অবশ্য না জানালেও কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু যেহেতু তার সাথে জিনিয়ার জীবন জড়িয়ে আছে তাই সব জানার অধিকার জিনিয়ার আছে। আর সে জিনিয়াকে বলবেও। কিন্তু সেটা এখন না। আর এভাবে না। এতে জিনিয়ারর উপর প্রেশার পড়লে জিনিয়ার ক্ষতি হবে।
নিজে হাত মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল খাবার খেতে। বের হয়ে আসতেই দেখল জিনিয়া তার মায়ের সাথে কথা বলছে। সাথে সারিকা আর রিতিকাও আছে। রিতিকা আর জিনিয়া দুজনে মিলে সবজি কাটছিল আর সারিকা বসে ছিল। আর ওরা সবাই মিলে কথা বলছিল। জিনিয়ার বাবা জাকির হোসেন ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। জারিফ নেই। হয়তো ঘুমাচ্ছে। ছুটির দিন হওয়াই। সে গিয়ে জাকির হোসেনের কাছে বসে পড়ল আর সালাম দিল। উনিও হাসি মুখে জবাব দিয়ে ওয়াফিফের সাথে কথা বলতে থাকল।
চলবে।