নিরালায় ভালোবাসি পর্ব-২২+২৩

0
345

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২২ .

ঘরের প্রতিটা বন্ধ দরজার অপর পাশ থেকে একফোঁটা আলো আসা দূরস্থ প্রতিটা জানালা দরজা কোনোদিন খোলা হয়েছে কিনা সন্দেহ। এমনিতেই সময়টা রাত্রি নয়টা। বাইরে থেকে এই বহু পুরনো ঘরে আলো আসা অসম্ভব। এই ঘরটা ইচ্ছে জানে না। কোনোদিন দেখেও নি। অথচ এই বাড়িতে ইচ্ছে ছয় মাস থেকেছে। কিন্তু অনেক ভেবেও ইচ্ছে ধরতে পারেনি এই ঘরটা কোথায়। সুবীর যখন এই বাড়িতে নিয়ে আসে তখন তো সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সুবীর তখন ভুল করেও আলো জ্বালায়নি। বাড়িতে প্রবেশ করেই সুবীর ফোনের টর্চ এ সর্বপ্রথম ইচ্ছের চোখটা রুমাল দিয়ে বেঁধে দেয়। অর্থাৎ ইচ্ছের বর্তমান অবস্থান ইচ্ছে ঠিক মত জানেই না। শুধু এই টুকু ইচ্ছের মনে রয়েছে- ওকে যখন এই ঘরে আনা হয় তখন ও সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেছিল। কিন্তু ও তো উপরে ওঠেনি যে সিঁড়ি দিয়ে আবার নিচে নেমে আসবে। ঠিক এই মুহূর্তে ইচ্ছের মনে হচ্ছে ও কোনো আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে। কিন্তু ইচ্ছের জানা নেই এই বাড়িতে কী কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড রয়েছে?

পুরো অন্ধকার ঘরটায় কেবল একটা টর্চ জ্বলছে। যার পাওয়ার খুব কম। ঠিক ভাবে কিছু দেখাই যাচ্ছে না। বলতে গেলে ঘরটা অন্ধকারই। সুবীর সেই যে ইচ্ছেকে বসিয়ে বেরিয়ে গেছে এখনও আসেনি। অন্ধকার কুঠুরিতে ইচ্ছে এখন বন্দি। আগের ইচ্ছে হলে এতক্ষণে ভয়েই তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেত, কিন্তু এখন কার ইচ্ছের জীবনের প্রতি মায়া কম তাই ভয়ও নেই। খুব করে নীরবের মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আর প্রতিবারই তা যেনো জোর করে ইচ্ছে সরিয়ে ফেলেছে। নিজের ভাবনাকে কন্ট্রোল করলে আখেরে লাভ ওরই হবে। এমনিতেই তো ওর লোকসানের দিকে গলা অবদি ডুবে রয়েছে। এখনই নিজেকে সামলাতে না পারলে তলিয়ে যাবার চান্সটা বেশি।

ইচ্ছের কাছে এই অন্ধকার ঘরটা কেমন যেনো আপন মনে হচ্ছে। আলো তো সবার আপন, ওর না হোক অন্ধকারই আপন হলো। যার জন্যেই হয়তো এতো অন্ধকারকে অন্ধকার মনে হচ্ছে না।

ইচ্ছে বসে থেকে থেকে ঝিমুচ্ছে। সময়টা তো অনেকই বেড়ে গিয়েছে, কম করে এগারোটা কী বারোটা! বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে। তার মানে নিশ্চিত ঘরটা খুব নীচে না। সুবীর এসেছে, হাত খালি। অন্য কেউ হলে নির্ঘাত ভাবতো ও নিশ্চিত ইচ্ছের জন্যে খাবার এনেছে। কিন্তু আসলে তা হলোই না। সুবীরের হাত খালি। কিডন্যাপাররাও কমসে কম তার হাতে বন্দী মানুষটিকে কিছু অন্তত খেতে দেয়। আর ইচ্ছে তো ওর প্রাক্তন স্ত্রী। সুবীর ঘরের একটা ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিল। ল্যাম্প টা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা নতুন।

এতক্ষণে পুরো ঘরটা ইচ্ছের কাছে দৃষ্টিগোচর হলো। এতক্ষণ ঘরে জানালা খোলা হয়না বলে মনে হলেও আসলে এই ঘরে কোনো জানালায় নেই। ঘরটা আসলে একটা স্টোর রুমের মতো। কিন্তু চারিদিকটা পরিপাটি করে গোছানো। সুবীর দাঁড়িয়ে রয়েছে সিঁড়ির ঠিক নীচে। সিঁড়ির মাথায় একটা দরজা, সেই দরজা দিয়ে ফ্রিজ দেখা যাচ্ছে। ইচ্ছে এক ঝটকায় বুঝে ফেললো এই ঘরের অবস্থান কোথায়! ও ছয় মাস এই বাড়িতে থেকেছে, বাড়ির সব কাজ সামলেও কখনো সিঁড়ির নীচের এই গুপ্ত ঘরের কথা জানতেই পারেনি। সিঁড়ির মাথায় ফ্রিজটা উপরের সিঁড়ির ঠিক নিচেই রয়েছে।

সুবীরের মুখের ভয়ঙ্কর এক হাসি ইচ্ছের বুক ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলো। এই হাসি মানুষকে খুন করতেও পিছপা হয় না। হয়তো আজ ইচ্ছের শেষ দিন। এতক্ষণ জীবনের প্রতি কোনো মায়া না থাকলেও হুট করেই ইচ্ছের বাঁচতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ আগের বিষাদ হীন পৃথিবীটা ওর সবথেকে আপন মনে হচ্ছে। নিজের আপন মানুষ গুলোর প্রতি অভিমান গুলো এখনই যেনো ওর কাছে অতীব তুচ্ছ মনে হচ্ছে। এই জন্যেই কী কবিগুরু বলেছিলেন, ” মরণ এলে হঠাৎ দেখি, মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো। ” ( কবিতা -বোঝাপড়া )

একপা একপা করে সুবীর এগিয়ে ইচ্ছের ঠিক সামনে গিয়ে বসলো। সুবীরের প্রতিটা পদধূলিতে ইচ্ছে পিছনের দেওয়ালে মিশে যেতে লাগলো। যদি সত্যিই এই দেওয়ালে মিশে যাওয়া যেত তাহলে বোধ করি ভালোই হতো।

– ” কেমন লাগছে ইচ্ছে?”

ইচ্ছের নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে থাকা সুবীরের যেনো আমোদ ফুর্তি বেশি হলো। প্রাণ খোলা এক হাসি হাসলো সে। যেই হাসি ইচ্ছের কাছে ভয়ের সীমা বাড়ালো।

– ” ও হো আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি ইচ্ছে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি বোবা, সরি আপনি। দেখছো তোমাকে তুমি বলবো না আপনি বলবো তাই নিয়ে সমস্যা। আপনি তে আর যেতে পারছি না তুমিই ঠিক আছে। সে যাইহোক তুমি হচ্ছো বোবা। বোবা মানে জানো তো….?

সুবীরের করা প্রশ্ন ইচ্ছের মধ্যে এক রাগের সঞ্চার করলো। এতদিন অনেকে ওর কথা বলতে না পারার জন্যে ও সকলের কাছে হাস্যকর বস্তু রূপে প্রতিফলিত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এতদিন তার জন্যে সকলের সেই ‘ ‘বোবা ‘ ডাকটা ওর কাছে ওর কষ্টের কারণ ছিল। সকলের কাছে বঞ্চনায় ও রোজ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আজ সুবীরের মুখে ‘ বোবা ‘ শব্দটা ওকে যেনো রাগী করে তুললো। কেনো? কারণটা খুব সহজ, ইচ্ছের জীবনের এই কারণটার জন্যে সুবীরই দায়ী। সুবীর তখনও ইচ্ছেকে নিয়ে হেসে চলেছে। ইচ্ছে আর থাকতে পারলো না। যা আজ পর্যন্ত কারোর সঙ্গে করার সাহস তো দূর ভাবতে অবধি পারেনি সেই কাজটাই করলো। ঠাস করে দুই খানা চড় সুবীরের গালে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রচন্ড ক্ষোভে সুবীরের দিকে তাকিয়ে রইল। ইচ্ছের দৃষ্টিতে সুবীর ভয় পেলেও ভরকালো না। ও উল্টে ইচ্ছেকে বার কয়েক প্রচণ্ড তেজে চড় মারলো। ইচ্ছের ঠোঁটের কোণ দিয়ে তখন দরদর করে রক্তের স্রোত বইছে। সুবীর ইচ্ছের চুলের মুঠি ধরে ওর মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দিলো। শব্দহীন ইচ্ছের গলায় আর্তনাদটা বেরিয়ে এলো। সজোড়ে দেওয়ালে লাগানো মাথাটা সুবীর চেপে ধরেই বললো, ” তোর এতো তেজ কিসের? আমার জীবন তো ধ্বংস করেই দিয়েছিস। সব থাকতেও আজ আমার কেউ নেই। আর তার জন্যে তুই দায়ী। আর তুই শুধু আমার জীবন নষ্ট করেছিস এমন না , আমার মনে হয় যতদিন তুই পৃথিবীতে থাকবি তুই সবার জীবন নষ্ট করবি। নীরব ও মনে হয় আমার ভাবনায় ভেবেছিল। তাইতো নিজেই আমাকে ফোন করে তোকে ওর কাছ থেকে নিয়ে যেতে বললো। তুই ভাববি না এতে আমি কতটা খুশি হয়েছি। ও মনে হয় এই মুহূর্তে রিলাক্স করছে। ঘাড় থেকে বোঝা নেমেছে তো। আসলে তুই তো বোঝাই। বিয়ের আগে কতো উড়ো ফোন করে বলতাম, সুবীরকে বিয়ের জন্যে না করে দিন। ও খারাপ ছেলে। কিন্তু কোনো দিনই তো শুনিস নি। পড়ে কী করেছিলিস ওই নীরব কে ফোনটা দিয়ে আমাকে যা তা বলেছিলিস। এখন তার শাস্তি ভোগ তো করতেই হবে।”

সুবীর ইচ্ছেকে ছেড়ে দিয়ে পাশের একটা পুরোনো সোফায় বসলো। সোফাটা এতে খানিক নড়বর করে উঠলেও ভেঙে গেলো না। কিছুক্ষণ আগের রেগে যাওয়া , বাঁচতে চাওয়া মেয়েটার মস্তিষ্ক যেনো একমুহূর্তে সুবীরের হস্তগত হলো। নীরব যে নিজেই সুবীরের সাথে যোগাযোগ করেছিল এটা ইচ্ছে ভাবতে পারলো না। শেষে কিনা নীরব…..! ভালো।

মাথাটা মাঝে মাঝে ব্যথা করে উঠছে ইচ্ছের। একভাবে আর দাঁড়াতে পারছে না। তাই আস্তে আস্তে নিচে বসে গেলো। এই মুহূর্তে সুবীরের জন্যে ইচ্ছের খুব মায়া হলো। সত্যিই তো নিহিকে ও কতো ভালোবাসে। তাই না ইচ্ছেকে বিয়ে করতে বারণ করেছিল। এমন কি বিয়ের পর ইচ্ছের সামনেও আসেনি। চলে গিয়েছিল। ও সবসময় নিহিকে নিয়ে থাকতে চেয়েছে। তাই বোধ হয় এতটা ডেসপারেট হয়েছিল। সুবীর নিহি কে খুব খুব ভালোবাসে। ইসস, ওকেও যদি কেউ এমন ভাবে ভালো বাসতো! নীরব যদি ওকে ভালোবাসতো, তাহলে নিশ্চয় সুবীরের উড়ো ফোনকলের কথা বিশ্বাস করতো। অবিশ্বাস করে বলে যেতো না , তোকে বলেছিলাম আমি বিয়ে করবো চল। কিন্তু ছেলেটার নামে খারাপ কিছু রটাবিনা। কিন্তু তুই সেই কাজটাই করছিস। ছি, তোর লজ্জা করছে না। কাকে দিয়ে ফোন করাচ্ছিস বল?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইচ্ছে। নীরব ওকে ভালোবাসে না। সুবীর ঠিকই বলেছে, নীরব এখন রিলাক্স করছে। হয়তো খুব খুব আনন্দ করছে। ইচ্ছের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নিজের ভাগ্যের পরিধির মাপকাঠি বেশ ভালোই।

ইচ্ছেকে হাসতে দেখে সুবীর বললো, ” কী ভাবছিস? ভাবছিস তো তোকে মেরে দেবো, ইচ্ছে আমার এখনও ভাবনা আছে তোকে মেরে ফেলবো। কিন্তু আমি তোকে মারতে চাই না। আমার স্ত্রী বলেছে, ওই সব যাকে তাকে মেরে নিজেকে কেনো ব্যস্ত করবে। ও হ্যাঁ তোকে তো বলাই হয়নি, নিহি মানে আমার স্ত্রী এখানে আসছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। ও আসছে শাস্তি দিতে। ওর স্বামী কে তোর বিয়ে করার অপরাধে এই শাস্তি। ও খুব খুশি জানিস। প্রথম স্ত্রী থাকা সত্বেও দ্বিতীয় বিবাহ, মাকে দিয়ে তোকে টর্চার, পড়ে তোকে সেই কাঁচের মধ্যে ফেলে দেওয়া। কতো কি করলাম। কিন্তু দেখ আমার কিন্তু শাস্তিই হবে না। আহা, কী শান্তি তোকে বলে বোঝাতেই পারবো না। ”

সুবীরের কথায় ইচ্ছে কিছুই শুনলো না। চুপ করে বসে রইল। সুবীর তখন গুনগুন করেই চলেছে। সেই মুহূর্তে ইচ্ছের মনে হলো কেউ ওকে দেখছে। কিন্তু কে? সুবীর তো নয়। সুবীর তো মেঝের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করছে। ইচ্ছের ভাবনার মাঝেই কেউ সুবীরের বসা সোফায় লাথি মেরে দিলো। এতক্ষণের নড়বড়ে সোফাটা ক্যাচক্যাচ শব্দ করে ভেঙে পড়লো। সুবীর ভাবেনি এতো তাড়াতাড়ি তার পতন হবে, তাও ইচ্ছের পায়ের সামনে। আসলে সুবীর ইচ্ছের পায়ের কাছেই পড়েছে।

( চলবে )

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২৩ .

সুবীরদের বাড়িটা বহু পুরোনো। কিন্তু রেনোভেট করে নেওয়ায় দেখলে মনে হয় না বাড়িটা সুবীরের বাবার দাদুর আমলের। তাই হয়তো নীরব কিংবা রজত কারোরই ধারণা নেই যে এই বাড়িতে গোপন একটি ঘর পর্যন্ত রয়েছে। তারা তো এক নাগাড়ে প্রতিটা ঘর দেখে চলেছে। কিন্তু ইচ্ছে তো দূর সেখানে কোথাও সুবীরের টিকি অবধি দেখা যাচ্ছে না। নীরব তিন তলা পুরো দুইবার চক্কর দিয়ে দোতলায় এলো। রজত তখন একটা দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।

– ” রজত তোমরা ঠিক দেখেছো তো, ইচ্ছেকে এই বাড়ি তেই কী আনা হয়েছে? ”

– ” আরে হ্যাঁ রে বাবা। এই বাড়ির মধ্যেই তো সুবীর ইচ্ছেকে রেখে কোথায় একটা বেরিয়ে গেছে। এতক্ষণে ফিরেছে কিনা তাও জানি না।”
ভাবনায় পড়ে গেলো নীরব। একটা বাড়িকে এতবার খোঁজার পরেও তাকে দেখা যায় না কেনো?

– ” নীরব!”

রজতের ডাকে ঘোর ভাঙলো নীরবের। কপালের ঘাম টুকু মুছে বলল, ” হ্যাঁ, কিছু বলবে?”

– ” বলছি এক টা বিষয় কী খেয়াল করেছো? এখানের প্রতিটা ঘর সাউন্ড প্রুফ। ঘরে কথা বলার ফিসফাস শব্দ গুলো এখানে নর্মাল শব্দের মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু বাইরে না সেই শব্দ যাচ্ছে, আর না বাইরে থেকে ভিতরে শব্দ আসছে।”

– ” তাই তো দেখছি। ” পরমুহূর্তে নীরবের , ইপশির কথা মনে পড়লো। পরমুহূর্তে ভাবলো ওকে হয়তো রজত গাড়িতে রেখে এসেছে। সেই ভেবেই নীরব জানতে চাইলো, ” ইপশি কোথায় ?”

– ” ইপশি নীচের ঘর গুলো দেখছে।”
– ” তুমি কি পাগল হয়েছ রজত? ওকে তুমি এখানে নিয়ে এসেছ?? ”

– ” কিছু করার নেই, আমার কথা শোনেনি। তাই আনতে হলো। চলো আমরা বরং নীচে যাই। এখানে তো কাউকেই দেখছি না। ”

——————————

ইপশি নীচের ঘর গুলো খোঁজার মুহূর্তে বাইরে দরজার আওয়াজ পায়। ইপশি তখন হলঘরের দিকেই আসছিল। বাইরের আলোয় সুবীরকে দেখে বেচারী ভয় পেয়ে কোথায় পালাবে ঠিক করতে পারে না। ছুটে চলে যায় সিঁড়ির তলার দিকে। কিন্তু সুবীরের বুটের আওয়াজ গুলো ওর দিকে আসছে দেখে প্রচণ্ড ভয়ে ও ফ্রিজের পিছনে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সুবীর ফ্রিজের দিকেই এগিয়ে যায়। ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকা ইপশি বলে দিতেই যাচ্ছিল, আমার কিছু করবেন না, আমি কিছু জানি না। কিন্তু তার আগেই সুবীর ফ্রিজের মাথা থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে একটা দরজা খুলে ভিতরে চলে যায়। ইপশি অবাক হয়ে সেই ঘরের দিকে তাকালে প্রথমে ভুতুড়ে ঘর মনে হলেও পরে চোখে পড়ে ইচ্ছে কে। আস্তে আস্তে ওই লুকানো জায়গা থেকে বাইরে বেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে ও। একবার ভেবেছিল রজতকে ইনফ্রম করবে। কিন্তু তার আগের সুবীরের কথা শুনে নিজের বুদ্ধি মত্তার পরিচয় দিয়ে সুবীরের বলা প্রতিটা শব্দ মুঠোফোনে বন্দি করে। ও চাইলেও পারে না সেই মুহূর্তে ইচ্ছেকে বাঁচাতে। কিন্তু সুবীরের বলা শেষ কথা টুকু ওর আর সহ্য হয় না। আচমকাই সে গিয়ে একটা লাথি মারে সোফায়। যার দরুন খুব তাড়াতাড়ি পতন হয় সুবীরের।

সুবীর বুঝতে পারে না হুট করে কী করে ও পরে গেলো। পড়ে নিজেই বিটকেলে হেসে ওঠে।

– ” আমি জানতাম তো নীরব বাবু এখানে ঠিক আসবে। আর এলো ও,…..”

পিছন ফিরতেই থেমে যায় সুবীর। এই অচেনা মেয়েটি কে? কিন্তু ভাবনা তার বেশিক্ষণ টেকে না। তার আগেই ভাঙ্গা সোফার একটা কাঠ নিয়ে অচেনা মেয়েটির হাতের মার খেতে থাকে। আর ইচ্ছে, সে তো অবাক হয়ে ইপশির দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই ন্যাকা স্বভাবের মেয়েটি কিনা ওকে বাঁচাতে এসেছে। তাও এতো রাতে, একা! নাকি সঙ্গে আরও কেউ আছে। নীরব! তার মানে নীরব কী এসেছে? কথাটা মাথায় খেলতেই চট করে সিদ্ধান্তে যায় ইচ্ছে। অসম্ভব, নীরব এখানে আসতে পারে না। সে তো আর ইচ্ছে কে চায় না। যে এতো রাতে এইখানে এসেছে ইচ্ছেকে বাঁচাতে। কখনো ই সম্ভব না।

ইচ্ছের ভাবনার মাঝেই ইপশি এসে ইচ্ছের কাঁধে হাত রেখে হুড়মুড় করে বলে দিলো,” ইচ্ছে ওঠো, চলো আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। ”

সুবীর তখন মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। ইপশি কম করে ঘা পঁচিশ তো ওকে মেরেইছে। ইচ্ছে তখনও নির্বিকার চিত্তে ইপশির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ইপশি পুনরায় ইচ্ছেকে ঠেলা মারলো ওঠার জন্যে। কিন্তু ইচ্ছে সেই জায়গায় বসে মাথা নাড়লো, ও এইখান থেকে কোথাও যাবে না। কিছুতেই যাবে না। আজ না হয় ও মৃত্যু স্বাদই নিলো।

ইচ্ছেকে যাবার কথা বলতে বলতে ক্লান্ত ইপশি এবার কেঁদে দিলো। ওর ধারণা ও সেই দিন ইচ্ছেকে অপমান করেছিল তাই ইচ্ছে ওর উপরে খুব রাগ করেছে। ইপশি কে নিয়ে কেউ হাসলে, কেউ বকলে, কেউ যদি ওকে মারেও তাও ওর সহ্য হয়। কিন্তু কেউ যদি ওর উপর রেগে থাকে , কথা বলতে চায় না, ইগনোর করে তবে ওর ভীষন কষ্ট হয়। চোখ দুটো তখন ছলছল করে ওঠে। তখন চোখের জল গুলো ইপশির সঙ্গে বেইমানি করে। ওর কোনো শাসানি, বারণ শোনে না। গাল বেয়ে ঝরে পড়ে।

– ” আমি সেই দিন তোমায় অমন করে বলে ছিলাম বলে তুমি আমার উপর রেগে আছো না ইচ্ছে! আমি জানি আমি খারাপ। কোথায় কি বলতে হয় জানি না। কাকে কি বললে সে দুঃখ পাবে বা সে হাসবে আমি তা জানি না। কিন্তু এর জন্যে তুমি নিজের ক্ষতি করো না। আমার জন্যে কারোর কোনো ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না। আর তুমি বিশ্বাস করো আমি সেইদিনের জন্যে তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ছিলে না। এইবার অন্তত চলো।”

একসময়ের দুষ্টু মিষ্টি শত্রুকে যদি এমন ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে দেখা যায় তবে আশ্চর্য্যের বেশি হাসি পাবে। ইচ্ছের ও হাসি আসছে। ইপশি পাশে তাকিয়ে দেখলো সুবীর ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিবার। ইপশির কান্নার মাঝেও হাসি পেলো। জীবনে একটা কাজের কাজ করেছে। ওর মা শুনলে আর নিশ্চয়ই বলবে না,” উদ্ধার করে দিয়েছো। ”

– ” আরে ইচ্ছে চলো না। আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগছে এখানে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমাকে
সরি বলছি। এইবার তো চলো।”

ইচ্ছের কী হলো কে জানে? ও উঠে দাঁড়ালো। নিজের জন্যে না হোক অন্তত এই অবুঝ মেয়েটির জন্যে। ইচ্ছে ভালোই বুঝেছে, এই মেয়েটা ওকে ছাড়া কোথাও যাবে না।

– ” ইচ্ছে চলো, তোমার কোনো চিন্তা নেই। সুবীর আর তোমার কিছু করতে পারবে না। এইবার ও শুধু জেলের চালের কাঁকর বাছতে পারবে। আমি সব রেকর্ড করে নিয়েছি চলো। ”

ইচ্ছের হাত ধরে বাইরের দিকে ছুটলো ইপশি।

নিজের এতো কষ্টের প্ল্যান বিফলে যাওয়ায় একেই তো ক্ষেপে ছিল সুবীর। সেই ক্ষোভে যোগ হলো, ইপশির শেষ কথা গুলো। পা এবং কোমরের ব্যথা কে অগ্রাহ্য করে ইচ্ছেদের পিছু নিলো সুবীর।

ইপশি তখন বাইরের দরজা খুলছিল। সুবীর ইচ্ছের হাত ধরে টান দেবার চেষ্টা করলো। সেই মুহুর্তে সুবীরের মাথার চুলগুলো টেনে ধরলো নীরব। প্রচণ্ড ক্ষোভে গমা গম করে এক একটা ঘুষি পড়তে লাগলো সুবীরের মুখে, পেটে। যত ক্ষোভ ছিল সব বের করতে লাগলো নীরব। সুবীর ও যথা সম্ভব নীরব কে প্রতিহত করতে লাগলো। কিন্তু নীরবের সঙ্গে সুবীর ঠিক পেরে উঠছে না। এলোপাথাড়ি মার সুবীর আর কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। হাতের সামনে থাকা ছোটো দেওয়াল ঘড়িটা নীরবের কপালে আঘাত করলো। আচমকা আক্রমণে নিজেকে বাঁচানোর যথা সম্ভব চেষ্টা করলেও বেশ গভীর ভাবেই মাথাটা কেটে যায় নীরবের। তাও সুবীরকে ছাড়ে না নীরব। কিন্তু সুবীর নিজেকে কোনোমতে নীরবের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। রজত তখন পুলিশ নিয়ে ভিতরে চলে এসেছে।

– ” ইউ আর অ্যান্ডার অ্যারেস্ট সুবীর বাবু। ”

রজতের কথায় পাগলের মতো হেসে উঠে সুবীর। এই হাসি কোনো পাগলের হাসি না। এই হাসি ধূর্ততার। সকলকে হকচকিয়ে দেওয়ার একটা টেকনিক। আর সেই কাজটাই সুবীর করলো। পাশে থাকা ইপশির হাত থেকে ছো মেরে ফোনটা নিয়ে পিছু হটতে থাকে। ফিচেল হেসে বলে, ” সম্ভব না আমাকে ধরা। ”

সেই মুহূর্তের ধাক্কা খায় কারোর সঙ্গে। নিহি, সুবীরের পিছনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে ধীর। নিহির চোখ মুখ কঠিন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে হাহাকারে মরে যাচ্ছে যেনো।

– ” আজ সকালে দ্বীপ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে তার বাবাকে কেনো এতো ভয় পায়? ও বললো, ‘বাবা তো বাজে, ইচ্ছে দিদিকে মেরেছে। জানো মা, কতো রক্ত বেরোচ্ছিল। ‘ বুঝলাম ছেলেটা না চাইতেও তার বাবার কৃতকার্য দেখেছে। আমি চাই না আমার ছেলেটা কোর্টে এক ঘর লোকের সামনে সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াক। আমি চাই না দ্বীপ তার বাবার জন্যে নিজের মধ্যে কোনো অনুশোচনা রাখুক। কিন্তু আমি ইচ্ছের প্রতি অন্যায় হতে দেখতেও পারবো না। তোমার অন্যায় মেনে নিয়ে বাঁচা আমার পক্ষে সম্ভব না। অনুশোচনায় আমি রোজ দগ্ধ হই। এইবার তুমি বাবা হিসেবে ভাবো তোমার ছেলেকে কী আমি কোর্টে নিয়ে গিয়ে হাজির করবো! নাকি নিজের কৃত কর্মের শাস্তি তুমি নিজেই গ্রহণ করবে! ”

ছলছল চোখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকায় সুবীর। কান্না ভেজা চোখে পুলিশের নিকট নিজেকে স্যারেন্ডার করে সে। কোনো বাবাই হয়তো নিজের ছেলে মেয়ের চোখে নিঁচু হতে চায় না। সুবীর ও পারলো না। এমনিই তো তার ছেলে ওকে দেখে ভয় পায়, কান্না করে। কিন্তু এখন যদি আত্মসমর্পণ না করে তাহলে হয়তো ঘৃণা করবে।

( চলবে)