নিরালায় ভালোবাসি পর্ব-২০+২১

0
369

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২০ .

– ” বাবু তুমি এমন কেনো করো? ”
– ” কী করি? আমি তো তোমার সোনা ছেলে। আমি তো এখন খেলি।”

দ্বীপ নিজের বল নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। বারবার ইচ্ছে করে গেটের দিকে বল ছুঁড়ে দিচ্ছে। আবার সেটা আনতে ছুটছে। যা নিহির একদম পছন্দ না। নিহি খুব ভালো মতোই বুঝেছে যে, দ্বীপ বাইরে যেতে চাইছে। এই ছেলে বাড়িতে থাকতেই চায় না। অন্যদিন দ্বীপ ওর দাদুর সাথে ঘুমালেও আজ সে ঘুমায়নি। বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এই ভর দুপুর বেলা এমনিই রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে। তার উপর মাঝে মাঝেই সামনের রাস্তা দিয়ে বাস, লরি চলছে।
নিহি ভালো করে ছেলের উপর নজর রেখেছে যাতে বাইরে না যায় কিন্তু এই ছেলেকে বিশ্বাস নেই। হয়তো দেখা যাবে কয়েকদিন আগের মতো আবার বাইরে বেরিয়ে যাবে। নিহি আর নিহির ছেলে নিহির বাবার বাড়িতেই থাকে। সেই ঘটনার পর থেকেই নিহির মনটা ভেঙে গেছে। যাকে এতটা ভালোবেসেছিল সেই কিনা ওর আড়ালে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। সেই মেয়েটার জীবন পর্যন্ত নষ্ট করে দিয়েছে। অথচ নিহিকে কমফোর্ট এর মধ্যে রেখেছিল। এমন তো নয় যে সে নিহিকে ভালোবাসে না কিংবা নিহির সঙ্গে থাকতে পারছে না। তাহলে বিয়ে করার দরকার কী ছিল? ওই মেয়েটার জীবন কি ফেলনা!

তবুও বাস্তবতার দিক দিয়ে, এইসব কিছুর পরেও নিহি ফিরে যেতে চেয়েছে সুবীরের কাছে। নিজের জন্যে না অন্তত ছেলেটার জন্যে। সুবীরের স্ত্রীর মর্যাদা সে আর রাখতে পারবে না। তবে সুবীরের সন্তানের মা তো তাকে সারাজীবন থাকতে হবে। কিন্তু দ্বীপ নিজেই যেতে চাইছে না। দ্বীপ যতবারই সুবীরকে দেখছে ভয় পাচ্ছে। কিছুতেই সে সুবীরের কাছে যেতে চায় না। এর কারণ নিহি জানে না। কী জন্যে এতো ভয়! ইচ্ছের ঘটনাটা তো সুবীরের মা করেছিল। তবে ওর ঠাম্মি কে ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু ও বাবাকে কেনো ভয় পায়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিহি কিছুতেই পাচ্ছে না। তবে কি ওর জানার আড়ালে অন্য কিছু আছে?

দ্বীপ কিছুক্ষণ পরে আবারও গেটের দিকে বলটা ছুড়তে সেটা গিয়ে কারোর গায়ে আঁছাড় খেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দ্বীপ বলটা নিতে যেতে সামনে এগোলেও সামনের মানুষটাকে দেখে ভয়ে চোখ মুখ ঢেকে মায়ের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো।

– ” মা একে যেতে বলো, আ..মার ভয় করছে।”

নিহি পিছন ফিরে দ্বীপকে কোলে তুলে নিলো। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বললো, ” কী হয়েছে? এতো ভয় কীসের?”

কিন্তু দ্বীপ এতো পরিমাণে কাঁদছে যে অগত্যা নিহি দ্বীপকে নিয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু সুবীরের ডাকে পরক্ষণেই থমকে দাঁড়ালো। তারমানে সুবীরকে দেখেই এতো ভয়!

– ” প্লিজ নিহি বাড়ি ফিরে চলো। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি। কিন্তু, ”

নিহি পিছন ফিরলো না। প্রসঙ্গ ফিরিয়ে বললো, ” তুমি বাড়ি যাও। আমি ওকে বুঝিয়ে নিয়ে আসবো। ”

কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বলে নিহি বাড়ির ভিতরে চলে গেল। আর সুবীরের তো খুশির অন্ত নেই। ইচ্ছেকে একটু কী টাইট দেবার প্রস্তুতি নিলো, এর মধ্যেই ওর স্ত্রী ওর কাছে ফিরে যাবার কথা বলছে। সুবীরের মন বলে উঠলো, কোনো মেয়েই তার স্বামীর সঙ্গে অন্যকে মেনে নিতে পারে না। আর যদি তারা দেখে যে সতীন তার কষ্টে আছে তবে তো কথাই নেই তারা আরও বেশি খুশি হয়। সুবীর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। চোখ দুটো আনন্দে চকচক করছে। ভাবতেই তার আনন্দ হচ্ছে, নিহি যদি জানে যে ইচ্ছেকে কিভাবে কষ্ট দেবে বলে ঠিক করেছে ও। তাহলে নির্ঘাত নিহি খুশি হবে।

নিহি দ্বীপকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ছেলেটা আজও ভয় পেয়েছে। কতো কষ্ট করে বুঝিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে ওই জানে। দ্বীপের অপর পাশে বসতেই ওর খেয়াল গেলো পাশের টেবিলের উপর। জায়গাটা এখন ফাঁকা, আগে ওই খানে ওদের তিনজনের একটা ফ্যামিলি পিক ছিল। কিন্তু সেই দিন দ্বীপকে হসপিটাল থেকে বাড়ি আনার পরপরই দ্বীপ ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। আর সেই ছবি ওখানে রাখেনি সে। নিহি হাত বাড়িয়ে টেবিলের মাঝের ড্রয়ারটা খুললো। ভিতর থেকে ছবির ফ্রেমটা বের করে আনলো। ছবিটার উপরের কাঁচ গুলো চিড় খেয়েছে, উপর উপর কয়েকটা কাঁচ ও উঠে রয়েছে তবে তা খুলে যায়নি। নিহি গভীর ভাবে ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক ওদের সম্পর্কের মতোই যেনো অবস্থা ফ্রেমটার।

°°°°°°°°°°°°
হসপিটালের পাশাপাশি দুটো কেবিনের একটায় ইচ্ছে আরেকটায় দ্বীপ রয়েছে। একজনের অবস্থা জীবন মরণের মাঝামাঝি। তো আরেকজন সেন্সলেস। নিহি সেই মুহূর্তে কী করবে ভেবে না পেলেও পরমুহুর্তে বুদ্ধি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আশেপাশের কয়েকজন মানুষকে ডেকে নিয়েই সে তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসে। ইচ্ছেকে অপরেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়েছে ডক্টর। কিছুই তারা এই মুহূর্তে বলতে পারছে না। অপর দিকে দ্বীপ এর শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। পথে আসার সময় দুই বার বমিও করেছে সে। আসলে ওর ছোটো মাথাটা সেই মুহূর্তে দেখা ওতো রক্ত সহ্য করতে পারেনি। আপাতত ওকে পাশের কেবিনে ডক্টর চেক করছে।

পথে আসার সময় নিহি শুনেছে ওদের সঙ্গে আসা লোক দুটো বলেছিল যে , মেয়েটি নাকি সুবীরের স্ত্রী। আরে যা শুনে নিহির নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। নিজের উপরই ওর ঘৃণা হচ্ছে। শেষে ওর ভালোবাসার মানুষটাই কিনা ওকে ঠকালো।

– ” নিহি শোনো আমার কথা,,”

নিহির ভাবনার মাঝে কখন যে সুবীর ওর পাশে এসে বসেছে ও জানে না। তবে নিহি যখনই সুবীরকে ওর পাশে দেখলো সেখান থেকে উঠে চলে গেল। যা জানার তা ও জেনে নিয়েছে আর কিচ্ছুটি জানার নেই।

নিহির সাথে আসা লোকের মধ্যে একজন ইচ্ছের পরিবারকে খবর দিয়েছে। তারা এসে যাবে হয়তো! নিহির ভাবার মাঝেই ইচ্ছের বাবা, মা, দাদা সেখানে চলে আসে। বোনের খবর শুনে ধীর অসম্ভব রেগে ছিল। এমনকি পুলিশ অবধি সেখানে আসে। পাড়ার লোকেরা সুবীরের উপরে সোচ্চার হলে সুবীরের মা নিজে স্বীকার করেন যে সব কিছু তিনিই করেছেন।

সেই দিন দ্বীপকে সুস্থ্য করে বাড়িতে আনা গেলেও ইচ্ছের অবস্থা ছিল করুন। কাঁচের বেশির ভাগ অংশ ওর গলায় ফুটে গিয়েছিল। ডক্টর তো বাঁচবে আশা করতে অবধি পারছিল না।

কাঁচের উপর হাত লাগতেই ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো নিহি। পুরোনো কয়েকমাস আগের স্মৃতিটা ওর কাছে করুণ ছিল। হাতের রক্তগুলো নিহির কাছে ঠুনকো মনে হলো। এ আর এমন কী? এই থেকে অধিক রক্তাক্ত হতে ও কাউকে দেখেছে। দেখেছে মানুষটাকে নিজের সব হারাতে। নতুন করে শুরু করতেও দেখেছে। সে যদি পারে তবে নিহি কেনো পারবে না? অবশ্যই পারবে। অন্যায়ের সাথে কোনো আপস নয়।

———————————

ইরা অনেকক্ষণ ধরে ‘ পিকু ‘, ‘ পিকু ‘ বলে ডেকে চলেছে। আসলে ও ওর বোন-বন্ধুকে ওর উপর আকর্ষিত করতে চাইছে। কিন্তু, ইচ্ছে এক ধ্যানে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পা ছড়িয়ে বারান্দায় বসে রয়েছে ও । কোলে মাথা দেওয়া ব্যাক্তিটি পরম শান্তিতে ওর কোলে ঘুমিয়ে রয়েছে।

ইচ্ছে নীরবের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। ইচ্ছে তো কাল এখান থেকে চলে যাবে তাই নীরব আজ ওর সঙ্গে সঙ্গেই থাকছে। এই যেমন ইচ্ছের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে।

ইচ্ছের আগের মতো আবারও ঘুম আসে না। ঠিক যেমন হসপিটালে ছিল। সেবার পঁচিশ দিন পড়ে যখন চোখ খুলে তাকিয়ে ছিল, ও ছিল হসপিটালের বেডে। এর আগেও ওর জ্ঞান ফিরেছিল কিন্তু ডক্টর ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রেখেছিল ওকে। জ্ঞান ফিরে ইচ্ছে নিজের সামনে নিজের পরিবার, নীরবের মা কে দেখলেও দেখেনি কেবল নীরবকে। খারাপ লেগেছিল খুব। কিন্তু পর মুহুর্তেই মনে পড়েছিল যে এখন ও বিবাহিত। বর্তমানে সে তার স্বামীর কাজে এই হসপিটালের বেডে। খারাপ লাগা কমেছিল। বেড়েছিল অভিমান। কিন্তু সেই অভিমান ও স্থায়ী হলো না, যখন বুঝলো গলার স্বর বাইরে প্রকাশিত হচ্ছে না। শব্দগুলো গলার মধ্যেই ফিরে যাচ্ছে তখন তাচ্ছিল্য এসেছিল নিজের প্রতি। যা এখনও ইচ্ছে নিজের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, কষ্ট গুলোই আমায় ছুঁয়েছে, সুখগুলো কী তবে আমাকে ভীষন রকম অপছন্দ করে? তাই হয়তো পাশেই ঠিক ভাবে ঘেঁসে না।

নীরব হালকা করে নরে উঠলো। ইচ্ছে সেই দিকে তাকিয়ে নীরবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ও এই মানুষটাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু মানুষটা ওকে পছন্দও হয়তো করে না। তাই না? ঘাবরে গেলো ইচ্ছে, সত্যিই কি পছন্দও করে না? নাকি জানার বাইরেও কিছু কথা থাকে?

( চলবে )

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২১ .

বিকেলের দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল ইচ্ছে। হিসেব মতো এই বাড়িতে ওর আজ শেষ দিন। ফিরে যেতে হবে নিজের ঠিকানায়। হ্যাঁ সত্যিই তো এটা কি ওর নিজের ঠিকানা নাকি! আজ সুবীর বেঁচে আছে বলে ওকে নিতে এসেছে কিন্তু যদি সুবীরের আসার কোনো সুযোগ না থাকতো, তবে কি হতো! নীরব একদিন ঠিকই ওর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতো। এইটাই বোধহয় বেস্ট। কোনো কিছু করতে হলো না। ইচ্ছে নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো, আর যাই হোক নীরবের কাছে ফেরা যাবে না। এই যাওয়াকেই ও শেষ যাওয়া হিসেবে জানতে চায়। আর কোনো দিন এখানে না। জীবন যদি আগের ছন্দে চলতে চায় তাই সই। নামি দামি কোনো কিছু তো দূর এক মুঠো ভালোবাসাও ওর চাই না। ওর জীবনের চাওয়া তো কেবল মাথার উপরের একটু ছাদ। তাতেই সারাটা জীবন ও চালিয়ে নেবে। অবশ্য ইচ্ছের ইচ্ছে জীবনটা এই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলে মন্দ হয় না। সবার দৃষ্টির আড়ালে গেলে খুব বেশি ক্ষতি হবে নাকি!

– ” এই ইচ্ছে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। সুবীর তো এক্ষুনি চলে আসবে। ”

নীরব হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় এসে ইচ্ছের দিকে তাকালো।
” ও বাবা , ইচ্ছে তো দেখি সম্পূর্ণ তৈরি। যাক ভালো করেছিস। ”

ইচ্ছে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলো। নীরব এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। ইচ্ছের দৃষ্টি দূরের আকাশে দিকেই হয়তো তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু নীরবের মনে হচ্ছে চোখের ভাষা আজ অন্য। ইরা আজ বড্ড শান্ত। একদম চুপ। আচ্ছা পাখিদের কী মন কথা বলে! অবশ্যই বলে। ওরাও তো তাই নিজের মন মর্জি চলে। কাওকে ওদের তোয়াক্কা করতে হয় না। ওরা চাইলেই পারে দূর আকাশে ডানা মেলে উড়ে যেতে। ইচ্ছের খুব শখ ও ডানা মেলে ওই আকাশে উড়ে যাবে। যেই আকাশে নেই কোনো কষ্ট, না আছে বিধিনিষেধে বাঁধা শক্ত লোহার শিকলখানা। মানব জীবনের এই শিকলে আবদ্ধ হয়ে আর যেনো ইচ্ছে চায় না থাকতে। নাম যখন ইচ্ছেই রাখার ছিল, সৃষ্টিকর্তা তবে কেনো ডানা দিলো না, ইচ্ছেডানা।

আনমনেই ইরার খাঁচায় হাত রাখলো ইচ্ছে। খাঁচাটা নরে উঠলো। ইরাও ডানা ঝাপটালো। দূরের আকাশ যেনো ইরাকে আঁচল পেতে ডাকছে। ইচ্ছে ভাবনায় পড়লো, ও কী তবে ইরাকে আটকে রেখেছে এই লোহার খাঁচায়। ইচ্ছের মতো ওর ও তো তবে দম বন্ধ হয়ে আসে। সেও নিশ্চয় উড়তে চায় ডানা মেলে, ভাসতে চায় শরৎ কিংবা বসন্তের নীলাকাশে।

ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেলো ইরা। নিজের দুই বন্ধুর দিকে ফিরেও না তাকিয়ে সে উড়ে গেলো দূর আকাশে। মুক্ত বিহঙ্গে আজ বড়োই চঞ্চল সে। থামেনি কোনো গাছের ডাল কী ইলেকট্রিক পোস্টের তারের উপর। আজ কেবল ওড়ার দিন, স্বাধীনতার দিন।

শূন্য খাঁচায় কেবল ইরার দুই তিনটি পালক। খাঁচা পড়ে রইলো শূন্য। এই শূন্য খাঁচা কী কেউ কোনো দিন পূরণ করতে পারবে! পারবে না। আর পারলেও ইচ্ছে থাকবে না। ইচ্ছের স্মৃতির পাতায় ইরাই থাকবে। ওর আপন কেউ। যাকে ইচ্ছে এতদিন শিকলে আবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু ইরা, সে তো ইচ্ছেকে ভালোবাসার শিকলে আবদ্ধ করেছিল। আজ সবের সমাপ্তি করেই না হয় ইচ্ছে চলে যাবে। বুকটা কেমন যেনো ভার হয়ে গেলো ইচ্ছের। আর কোনদিনই ইরার সাথে বোধহয় ইচ্ছের দেখা হবে না। সূচনাটা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সেইখানেই সমাপ্তি ঘটাই মঙ্গলের। নাহলে আরেকবার ‘ অপয়া’ শব্দটা ইচ্ছে নিজের ঝুলিতে ভর্তি করবে।

নীরবের একদম পছন্দ হলো না ইরার চলে যাওয়া। ও নিজেই তো ইরার মায়ায় পড়ে গেছে। আর মায়া তো সহজে কাটানো যায় না। ইচ্ছে যে ইরার খাঁচাটা খুলে দেবে তার ধারণা নীরবের ছিল না। কেনো করলো কে জানে? মুখটা বেজার করে পাশে তাকালো নীরব, না ইচ্ছে নেই চলে গেছে। ” ইচ্ছের বাচ্চা তুই ইরাকে ছেড়ে দিলি কোন দুঃখে। উফফ,” বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে নীরব ঘরে গেলো। ইচ্ছে তখন আলমারি থেকে নিজের জামা কাপড় বের করছিল। কিন্তু তার আগেই নীরব ওকে সরিয়ে আলমারির দরজা আটকে দিলো। ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীরবের দিকে। বোকা বোকা হেসে নীরব বললো, ” আসলে আমি খুব শখ করে এই গুলো বউয়ের জন্যে কিনেছিলাম। সেই পড়বে।”

চুপ করে সরে গেল ইচ্ছে।এক মুহূর্তেই জন্যে মনে হয়েছিল নীরব ওকে আটকাবে। বলবে, তুই কোথাও যাবি না ইচ্ছে। কিন্তু না সবটা ভাবনাতেই রয়ে গেলো। কলিং বেলের শব্দে নীরব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আর ইচ্ছে, সে চুপ করে নিজের নিয়তির খেলায় নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো। জীবন ওকে আজ আরেকবার হারিয়ে দিতে বসেছে। আর হলোও তাই, সুবীর ওকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেলো অন্ধ এক কুঠুরিতে। আর নিশ্চল হয়ে ইচ্ছেও পিছু নিলো তার। কই নীরব তো আটকালো না। ভালোবাসে না তাই! নাকি শব্দহীন মানুষটার প্রয়োজন আর সকলের মতো ওরও নেই।

গাড়িটা যত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছের কষ্টের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু চোখের বৃষ্টিরা আজ আর ওর চোখে ধরা দিতে আসছে না। এসে তারা বলছে না, ইচ্ছের চোখের কাজল নষ্ট করবো আজ। আর নীরব, সে এখন অসম্ভব পরিমাণে রেগে রয়েছে। ভীষণ পরিমাণে রেগে রয়েছে। ওর ইচ্ছে তো করছিল মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সামলেছে। কানে থাকা ব্লুটুথ এ একটি মেয়ে গেয়ে চলেছে, “রাধা কায়াসে না জ্বলে। ”

” রজত এই ছাগলকে থামতে বলো। নাহলে আমি যে কী করবো নিজেও জানে না। ব্যাটার সাহস কম নয়, আমার বউয়ের হাত ধরে আমারই চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তাও আবার বলে কিনা, “আপনি তো ইচ্ছেকে বউ হিসেবে মানেন না। বোঝেন তো বোবা ও। ওকে আর আপনার ঘাড়ে বইয়ে কী করবেন.” বলি আমার বউ বোবা হোক আর খোঁড়াই হোক, ওর কী? ইচ্ছে শুধু মাত্র আমার। অন্য কেউ ওর গায়ে হাত দিয়ে তো দেখুক, জানে মেরে দেবো। সত্যিটা একবার পুরোটা জানি তারপর আমার হাতের মার ওই সুবীরকে খেতেই হবে। ”

ফোনের ওপাশ থেকে রজত পাশে থাকা ইপাশিকে চুপ করতে বললো। ইপশি এতক্ষণ নীরবের কথায় হেসেই যাচ্ছিল। রজতের ও অবশ্য হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সে এখন সিরিয়াস একটা অপরেশনে রয়েছে। ও এই মুহূর্তে রয়েছে সুবীরের বাড়ির বাইরে। সাথে অবশ্য ইপশিও রয়েছে।

– ” আচ্ছা নীরব, আমি ফোন রাখছি। যেকোনো মুহূর্তে সুবীর এসে যাবে। ”

নীরব বাড়ি থেকে বেরোতেই যাচ্ছিল সেই মুহূর্তে হুড়মুড় করে বাড়িতে আসে ধীর। আর এসেই নীরবকে প্রহার করতে শুরু করে।

– ” আরে কী করছিস ধীর, ছার লাগছে তো। ”

ধীর নীরবের কলার চেপে মুখে একটা ঘুষি মারে। চিৎকার করে বলে, ” আমি তোকে বলেছিলাম আমার বোনকে নিয়ে তোর সমস্যা হলে আমাকে বলবি। কিন্তু তুই ওকে ওই সুবীরের কাছে পাঠিয়ে দিলি। ”

ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্তটা মুছতে গিয়ে আটকে উঠলো নীরব। ওই উল্টে ধীরের কলার চেপে ধরলো,
” ওই তুই আমাকে কীভাবে মারছিস। যদি আমাকে ডক্টরের কাছে যেতে হয় এর জন্যে তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

– ” নীরব..”

ঠাস করে একখান চড় পড়লো নীরবের গালে। চড়টা মারলো রুমা দেবী।

– ” তুই ইচ্ছেকে সুবীরের কাছে পাঠিয়ে দিলি। ও না তোর স্ত্রী। কী করে পারলি! নীর না বললে তো জানতাম না। ”

গালে হাত বুলিয়ে নিরীহ ছেলের মতো মুখভঙ্গি করলো নীরব।
– ” আমি কী করবো? ইচ্ছের সাথে সুবীরের বিয়ে তো হয়েছে নাকি। ও তো মারা যায়নি। তাহলে আমাদের বিয়েটা কী বৈধ!”

আরেকটা চড় পড়লো নীরবের গালে। ধীর চিৎকার করে বললো, ” তোদের বিয়ের বৈধ সেটা তোকে বোঝাতে হবে। তোদের না রেজিস্ট্রি হয়েছিল। ”

কিছুক্ষণ থামলো ধীর। পড়ে ধরা গলায় বলল, ” অর্ধমৃত মেয়েটাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে পাওয়ার পর প্রথমেই ওর সাথে সুবীরের ডিভোর্স করাই আমরা। যদিও ওদের বিয়ের কোনো বৈধতা ছিল না। সুবীরের তো স্ত্রী ছিল। এক স্ত্রী বেঁচে থাকতে পুনরায় কী সেই বিবাহ গ্রহণযোগ্য হয়! হয় না। আর সুবীরের কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়নি। আর না ও মারা গিয়েছিল। ইচ্ছে সুবীরকে দেখলে আরও অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছিল। তখন ওকে আমরা মিথ্যে বলেছিলাম। না ও ডিভোর্সের ব্যাপারে অবগত না ও সুবীরের ব্যাপারে জানত। আরে ও তো এই সবে সুস্থ্য হচ্ছে। আগে কী হয়েছে ওর মনে আছে কিনা সন্দেহ। ”

চমকে ওঠে নীরব। ও ভেবেছিল হয়তো অ্যাকসিডেন্ট এ শয়তানটা মারা যায়নি। ও ইচ্ছের ব্যাপারে পুরোটাই জেনেছে রজতের থেকে। নীর ও অবশ্য যা জানে নীরবকে বলেছিল। রজত পুলিশে কর্মরত। আর ইচ্ছের কেসটা ওই দেখেছে। কিন্তু ইচ্ছের কেসে কিছু ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। কারণ ইচ্ছেই এই কেসে কোনো সাক্ষ্য দেইনি। আসলে দিতে পারেনি। ও সেই ঘটনার পর থেকেই একটা ট্রমায় থাকতো। বারবার ও সুবীর কিংবা ওর পরিবারকে দেখলে ভয়ে সেন্সলেস হয়ে যেত। কিন্তু সুবীরের মা নিজে সব স্বীকার করায় তার তো শাস্তি হয়েইছে। কিন্তু কেস টা সলভ হয়নি।

নীরবের ভাবনার মাঝে ইচ্ছের বাবা নীরবের হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো, ” তুই শুধু ইচ্ছেকে আমার কাছে এনে দে। আমি কথা দিচ্ছি ও কোনোদিন তোর কাছে আসবে না। ”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীরব। কোনোদিন আসবে না মানে কী? এখন এই সবে মাথা না ঘামিয়ে নীরব বেরিয়ে গেলো। পিছু পিছু ধীর ও গেলো।

( চলবে )