নীড় হারা পাখি পর্ব-০১

0
770

#নীড়_হারা_পাখি
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

পোঁ/ড়া হাতখানা নিপুনভাবে লুকিয়ে হেসেলে রান্নায় ব্যাস্ত অভিলাষা। শ্বাশুড়ি মায়ের কর্কশ ধ্বনি ক্রমশ কানে আসছে। শানিত বাক্যে ঘা/য়ে/ল হলেও নীরবতাই তার একমাত্র উপায়। হিমা বেগমের বাকবিতন্ডা চলছে তার স্বামী তিমিরের সাথে। বাকবিতন্ডার কারণ তিমির এবং অভিলাষার অনাগত সন্তান। এই বাকবিতন্ডা বিগত দুসপ্তাহ থেকে চলেই যাচ্ছে। হিমা বেগম মোটেই এই সন্তানের আগমনে সন্তুষ্ট নন। অন্যান্য পরিবারে সন্তানের আগমণ বর হলেও তার পরিবারে এ বাড়তি ঝামেলা বই কিছুই না। তাই তার মতে বাচ্চাটি রাখার মানেই নেই। কিন্তু তিমির তার সিদ্ধান্তে অটল। সে মোটেই তার সন্তানের জীবনের ঝুঁকি নিবে না। বাকযু/দ্ধের এক পর্যায়ে হিমা বেগম চেঁচিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন,
“লজ্জা করে না তোর? এতো স্বার্থপর কেনো রে তুই? একেই একটা মেয়েকে ধুম করে বিয়ে করে এনে ভাইয়ের ঘাড়ে খাচ্ছিস, এখন আরোও একটা প্রাণ ওর গছিয়ে দিবি? লজ্জা করে না তোর?”
“মা, আমি তো বলেছি ভাইয়ের উপর চাপ হবে না। যে আসছে সে তো তার রিজিক নিয়েই আসছে। বাবা হয়ে এতোটা নিষ্ঠুর কি করে হবো মা? আর আমি বা আমার স্ত্রী কেউ ই ভাইয়ের ঘাড়ে নেই। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা তো করছি”

তিমিরের শীতল বাক্যে শান্ত হবার বদলে যেনো আরোও রেগে উঠলেন হিমা বেগম। চেঁচিয়ে বললেন,
“লজ্জা করে না তোর? লজ্জা করে না? কত স্বপ্ন ছিলো ছেলে আমার ভালো রেজাল্ট করে ভালো চাকরি করবে। তুরান কতোটা কষ্ট করে তোর পড়ার খরচ চালিয়েছে। কিন্তু কি করলি তুই? শেষ বছরের পরীক্ষাটাও দিলি নি, এখন সেলসম্যানগিরি করিস! কতো পাস? আবার বড় বড় কথা। আর এই জমানায় বাচ্চা পালা কি এতো সহজ? আর তোর কি রাজার ভান্ডার আছে? তোর বাবা রিটায়ার্ড করে বাসায় বসে রয়েছেন। কয়টাকা পান পেনশনে? অসুখে জর্জরিত মানুষটার কথা না হয় নাই ভাবলি! ঘরে একটা পাগল বোন আছে তার কথা তো ভাবতি! তিতিরের তো পুরো জীবন ই বাকি! লজ্জা করে না তোর, এর মাঝেও নিজের কথা ভাবতে? আর বাচ্চা নেবার সময় কি চলে যাচ্ছে? পড়াশোনাটা শেষ কর, একটু নিজের পায়ে দাঁড়া। এরপর না হয়, বাচ্চা নিবি!”
“আমি এবোর্শন করাবো না। অভিলাষার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তাই এই নিয়ে কথা এখানেই শেষ করো মা, আমি কাজে যাচ্ছি।”

বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো তিমির। ফলে হিমা বেগমের ক্রোধ মাত্রা ছাড়ালো। বাজখাঁই কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“বড় হয়ে গেছো অনেক তাই না? বুঝি না কিছু? এসব কার বুদ্ধি আমি বুঝি না। অপয়া মেয়ে আমার সংসার গি/লে খেলো”

হিমা বেগমের কথাগুলো রান্নাঘর অবধি আসছে। অভিলাষার কানে যাবার পর ও সে নীরব। সে তার কাজে ব্যাস্ত। পালংশাকের পাতা ধুতে ধুতে সুরভী বললো,
“মায়ের কথায় কিছু মনে করো না অভিলাষা, বয়স হচ্ছে তো তাই মুখের বাঁধও কমছে। আটজনের টানাপোড়েনের সংসার। বোঝোই তো”

সুরভীর কথায় ম্লান হাসি হাসলো অভিলাষা। নিয়তির কাছে সকলের হাত ই বাঁধা। এই ধরনীতে আমরা সকলেই কাঠের পুতুল, আমাদের সুতোগুলো যার হাতে যে যা নির্ধারণ করেছেন সেটাই হবে। তার অতিরিক্ত কিছুই পাবার উপায় নেই। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই হিমা বেগমের চক্ষুশূল অভিলাষা তা অজানা নয় তার। হবেই না বা কেনো! মেধাবী ছাত্র যখন তার সমস্ত জীবনটা সংকটে ফেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা বাড়ায় তখন মা হিসেবে কেউই তা মেনে নিবে না। ছেলের বয়স কতো! সবে তেইশ পার হলো, পড়াশোনার পাঠ ও চুকায় নি সে। শেষ বছরের পরীক্ষায় বসার কথা ছিলো তার, বরাবর ভালো শিক্ষার্থী হবার দরুন তাকে ঘিরে পরিবারের অজস্র স্বপ্ন। কিন্তু সকল স্বপ্নের গ/লা টি/পে অভিলাষাকে নিয়ে হাজির হয়েছিলো তিমির। ছেলে বিনা খবরে বিয়ে করে বাড়ি আনবে তা ইহজীবনেও কল্পনা করেন নি হিমা বেগম। ফলে গৃহবধুকে বরণ অবধি করতে চান নি তিনি। অভিলাষা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো বাড়ির সদরে। অসহায় মা-বাবা হীন মেয়েটিকে সদরে দাঁড় করিয়ে রাখার মতো নিষ্ঠুর হতে পারলেন না শফিক সাহেব। তাই তাকে ঘুরে তুললো তিমিরের বড় ভাবী, সুরভী। টানাপোড়েনের সংসার হিমা বেগমের। তিমিরের বড় ভাই তুরান একজন সরকারী কর্মকর্তা। তার বেতন আহামরি হয়, সেই বেতন এবং বাবার পেনশন মিলিয়ে চলছে এই সংসার। বড় মেয়েটির চিকিৎসা, তিমির এবং তিতিরের পড়াশোনা, সব মিলিয়ে প্রতিমাসেই টান লেগেই থাকে। তার মাঝে একজন উটকো মেয়ে, জানা নেই শোনা নেই তাকে কি করে মেনে নিবেন হিমা বেগম। ফলে পরিবারে কোন্দল লেগেই রইলো। অভিলাষার সাথে উচ্চবাচ্য না করলেও ছেলের সাথে তার কাটাকাটি যেনো প্রতিদিনের নিয়ম হয়ে উঠলো। ভাইয়ের উপর বসে বসে খাওয়ার খোঁটাটাও যেনো গ/লায় কাঁ/টায় পরিণত হলো তিমিরের। ফলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো সে, পড়াশোনা ছেড়ে চাকরির জন্য হন্যে হলো। তিমিরের এমন কাজে ক্রোধ কমার বদলে বাড়লো, ফলে অভিলাষার প্রতি অসন্তোষের মাত্রাও বাড়লো। তুরান বোঝাবার কম চেষ্টা করে নি তাকে। কিন্তু তিমিরের জিদের কাছে সব বিফলে গেলো। অভিলাষা শাশুড়ীর মন পাবার চেষ্টা করে নি বললে ভুল হবে, কিন্তু তার কোনো কাজ ই যেনো হিমা বেগমের কঠিন হৃদয়কে গলাতে পারে নি। দিনগুলো এভাবেই যাচ্ছিলো, দেখতে দেখতে কবে মাস পেরিয়ে বছর গড়াতে যাচ্ছিলো টের অবধি পেলো না অভিলাষা। এর মাঝে তার যে পরিবারের মানুষদের সাথে বনিবনা হয় নি তা নয়, বড়ভাবী সুরভী, ননদ তুলিকা এবং তিতিরের সাথে বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য এই হিমা বেগমের তীক্ষ্ণ আচারণেও দাঁতে দাঁত চেপে সংসার করছিলো অভিলাষা। কিন্তু সব কিছু যেনো আবারোও এলোমেলো হয়ে গেলো। নতুন সদস্যের আগমনের সংবাদ সুখ থেকে বিষাদ ই যেনো বয়ে আনলো তিমির এবং অভিলাষার জীবনে। যা/তা/ক/লে/র মাঝে পিসছে যেনো দুটো জীবন। ছোট জীবন যার আগমনে তাদের সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হওয়া উচিত তার জীবন বাঁচানোই যেনো তাদের নিকট যু/দ্ধে পরিণত হয়েছে। অভিলাষার মাঝে মাঝে নিজের প্রতি খুব ঘৃণা হয়, ঘৃণা হয় নিজের কৃত কর্মের জন্য, নিজের লোভের জন্য, নিজের স্বার্থপরতার জন্য। চাচীর অ/মা/ন/বি/ক/তা থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটি ছেলের এবং একটি পরিবারের সকল স্বপ্ন, আকাঙ্খাকে গ/লা চে/পে হ/ত্যা করেছে সে। আজ তার জন্য এই পরিবারটিতে এতোটা অশান্তি। তার এই ভাবনার ছেদ পড়লো সুরভীর ক্ষীন স্বরে,
“হাত পোঁড়ালে কি করে?”

কথাখানা কর্নপাত হতেই ঘাড় ঘোরালো অভিলাষা। সুরভীর মুখশ্রীতে দুঃশ্চিন্তার ছাপ। সে আতংকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভিলাষার সফেদ হাতের দিকে। অনেক খানি পুড়েছে, সাদা হাতে লাল হয়ে আছে। কিভাবে পুড়েছে ঠিক বলতে পারলো না অভিলাষা। ফলে সুরভী চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“এতো অন্যমনস্ক হলে হবে? এখন তো আরোও সাবধানতা অবলম্বন করার পালা”
“আর সাবধানতা, যার থাকাটাই অনিশ্চিত তার সাবধানতা হিসেব করে কি করবো?”
“এভাবে বলতে নেই অভি, তুমি তো বুদ্ধিমান মেয়ে। এতো বোকা বোকা কথা বললে হয়?”
“আচ্ছা ভাবী, ও আসলে কি খুব অভাব বাড়বে? আমি একটু কম খেলে হবে না?”

অভিলাষার কাতর কন্ঠে বক্ষস্থলের চাঁপা দীর্ঘশ্বাসটি নিপুন ভাবে গোপন করে নিলো সুরভী। তার পরিবারের এমন অবস্থাটি ছিলো না, রাজার ভান্ডার না থাকলেও একেবারে অস্বচ্ছলতা তাদের ছিলো না। কিন্তু একটি ঘটনা সব কেমন যেনো এলোমেলো করে দিলো। দেনা শোধ করতে করতে জমি বিক্রি হলো, অসুস্থতা শফিক সাহেবকে জর্জরিত করলো। তুলিকাটাকে চিকিৎসা করাতে মাসে কতগুলো টাকা চলে যায় তার হিসেব নেই। তিনরুমের বাসাটায় কোনো ভাবে থাকতে শুরু করলো পরিবারটি। তবুও মাস শেষে হিমসিম খাতে হচ্ছে তুরানের। এখন তিমিরের কিছু আয় আছে বলে দিব্যি চলছে তারা। শ্বাশুড়ি মায়ের আচারণে নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পেলেও সুরভী তাকে খারাপ বলতে পারছে না। যার বিয়ের বয়সী মেয়ে পাগল হয়ে ঘরে বসে থাকে, ছেলে বিনা খবরে একটি অচেনা মেয়েকে বিয়ে করে আনে তার আচারণ কত ই বা স্বাভাবিক হয়। সুরভী ম্লান হেসে বললো,
“সময়ের থেকে বড় ঔষধ আর নেই অভিলাষা। একটু সময় দাও। ঠিক হয়ে যাবে”

অভিলাষা বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“আমার জীবনে কিছু বুঝি ঠিক হবার নয় ভাবী”

সুরভী কিছু বললো না। এর মাঝেই তিতির ছুটতে ছুটতে এলো। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাপিয়ে হাপিয়ে বললো,
“ভাবী, তাড়াতাড়ি আসো। বড় আপা কান্ড করেছে”
“তুই হাপাচ্ছিস কেনো? তুলি কি করেছে?”

সুরভীর চিন্তিত কন্ঠের প্রশ্নের বিপরীতে তিতির বললো,
“বড় আপা রোদ্দুর ভাইকে কা/ম/ড়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, একেবারে র/ক্ত বের করে দিয়েছে। রোদ্দুর ভাইয়ের মা ক্ষেপে গেছে। মাকে বললে আপাকে আস্তো রাখবে না। তুমি চলো”

তিতিরের কথা শোনামাত্র সুরভীর মুখশ্রী র/ক্তশুন্য হলো। সে হাতে থাকা বার্নার ক্রিম অভিলাষার হাতে দিয়েই ছুটলো সদরের দিকে। অভিলাষাও পিছু নিলো তার। ফলে চুলোয় থাকা তরকারীটা ওভাবেই পড়ে রইলো।

বাহিরে যেতেই দেখলো অবিন্যস্ত চুলে এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তুলিকা। তার বিপরীতে বা হাতটা চেপে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে রোদ্দুর। তার পাশে র/ক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রোদ্দুরের মা শাহানা বেগম। সুরভীকে দেখতেই এলোমেলো কদমে ছুটে এলো তুলিকা তার পেছনে গুটিসুটি মেরে লুকাবার ব্যার্থ চেষ্টা করলো সে। সুরভী তার দিকে তাকাতেই বললো,
“সে আমার হাত ধরেছিলো, আমি কিছু করি নি”………….

চলবে