নীড় হারা পাখি পর্ব-০২

0
443

#নীড়_হারা_পাখি
#২য়_পর্ব

বাহিরে যেতেই দেখলো অবিন্যস্ত চুলে এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তুলিকা। তার বিপরীতে বা হাতটা চেপে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে রোদ্দুর। তার পাশে র/ক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রোদ্দুরের মা শাহানা বেগম। সুরভীকে দেখতেই এলোমেলো কদমে ছুটে এলো তুলিকা তার পেছনে গুটিসুটি মেরে লুকাবার ব্যার্থ চেষ্টা করলো সে। সুরভী তার দিকে তাকাতেই বললো,
“সে আমার হাত ধরেছিলো, আমি কিছু করি নি”

তুলিকার কন্ঠে ভীতি, আতংকের স্পষ্ট উপস্থিতি টের পেলো সুরভী। সে ঈষৎ কাঁপছে, ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে রোদ্দুরের মা, শাহানা বেগমের দিকে। সুরভী কিঞ্চিত চিন্তিত, সে রোদ্দুরের দিকে সন্দিহান নজরে চাইলো। ছেলেটা এখনো তার জ/খ/মি হাতটা চেঁপে দাঁড়িয়ে আছে, আহত হবার বিন্দুমাত্র রেশ তার মুখশ্রীতে নেই। নির্বিকার শ্যাম মুখখানা, উদাসীন চাহনী, অপলক দৃষ্টিতে সে তুলিকার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এদিকে শাহানা বেগম তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,
“মানুষ যদি কু/কু/রের মতো আচারণ করে তবে তাদের সাথেও তেমন আচারণ করা উচিত। মাথার স্ক্রু যেহেতু ঢি/লা তাদের বাহির করো কেনো? দেখেছো কা/ম/ড়ে কি করেছে? র/ক্ত বের করে দিয়েছে ছেলের। আমার ছেলে বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে অন্য কেউ হলে তো”
“মা ছাড়ো না, অহেতুক কথা বাড়ানোর মানে হয় না”

রোদ্দুর শান্ত কন্ঠে কথাটা বললো। তার চোখ মুখ খানিকটা কুঞ্চিত হয়ে এসেছে। মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ প্রকাশ পাচ্ছে। আশেপাশের কয়েকজোড়া চোখ নিজের সকল কাজ ফেলে একরাশ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এখানে কি ঘটছে সেটা জানাই যেনো তাদের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই ঘটনার ময়নাতদন্ত না করলে তাদের যেনো ভাত হজম হবে না। যা অতিমাত্রায় বিরক্ত করছে রোদ্দুরকে। কিন্তু তার কথার খুব একটা প্রভাব পড়লো না শাহানা বেগমের উপর, তিনি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“বাদ দেবো কেনো? হাতের কি হাল করেছে দেখেছিস! ভাগ্যিস আমি দেখেছি নয়তো তো টের পেতাম ই না। মানুষের দাঁত কতটা বিষাক্ত জানিস না?”

রোদ্দুর উত্তর দিলো না। শুধু তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে। কি চমৎকার দেখতে মেয়েটি! সরু, ছিপছিপে গড়ন, শুভ্র মুখশ্রী, মাজা অবধি নেমে গেছে সা/পের মতো প্যাচানো অবাদ্ধ কৃষ্ণ কেশ, পাতলা গোলাপী ঠোঁটজোড়া দাঁতে পিষছে। মেয়েটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার চোখজোড়া। ঘোলাটে বিড়ালের মতো গোলগোল চোখ। কথায় আছে ”অতি সুন্দর জিনিস সর্বাধিক ভয়ংকর“— আজ তার জীবন্ত প্রমাণ পেয়েছে রোদ্দুর। এতো চমৎকার মেয়েটি নাকি পাগল, ভাবা যায়! এর মাঝে সুরভী শান্ত গলায় বলে উঠলো,
“কোথাও ভুল হচ্ছে আন্টি, আমাদের তুলি অকারণে কাউকে আঘাত করে না”
“মানে কি বলতে চাইছো সুরভী? আমার ছেলে কি তোমার ননদকে মেরেছে নাকি কিছু করেছে! পাগল ননদকে বাঁচাতে আমার ছেলের উপর দোষ দিচ্ছো?”
“আমি তা বলি নি”

এর মাঝেই অস্পষ্ট স্বরে আবারো তুলিকা বললো,
“সে আমার হাত ধরেছে”

বলেই শক্ত করে সুরভীর আঁচলটা ধরলো সে। তুলিকার ক্ষীনস্বর ঠিক ই শাহানা বেগমের কান অবধি পৌছালো। ফলে তার ক্রোধ বাড়লো। কন্ঠের রোষ বাড়িয়ে বললেন,
“মিথ্যা কথা বলতে বারণ করো ওকে”

তুলিকা আরোও গুটিয়ে গেলো। হাতের মুঠো শক্ত করলো। তিতির এবং অভিলাষা তাকে অভয় দেবার জন্য বাহু ধরলেও সে শান্ত হলো না। ঈষৎ কাঁপছে তার দেহ। সুরভী কিছু বলার পূর্বেই রোদ্দুর বলে উঠলো,
“ও মিথ্যে বলে নি মা, আমি সত্যি তার হাত ধরেছি”

হ্যা, রোদ্দুর তুলিকার হাত ধরেছিলো। ঘটনাটি ঘন্টা খানের পূর্বের। রোদ্দুর দোকানে এসেছিলো পাউরুটি, ডিম কিনতে। ছুটির দিন হবার দরুন সকাল এগারোটা বাজলেও এখনো তার নাস্তা করা হয় নি। বাসায় ফিরছিলোই কিন্তু তখন ই দেখলো রাস্তার মাঝে একটি মেয়েটি অবিন্যস্ত চুলে বসে রয়েছে। তার হাটুর কাছে পায়জায়া হালকা ছিড়ে গেছে। হাটুর কিছুটা এবং কনুই এর কাছে ছি/লে গেছে। একটি মেয়েকে রাস্তার মধ্যিখানে হাটুগেড়ে বসে থাকতে দেখতে হয়তো কারোর ই ভালো লাগে না। তাই বলে এগিয়ে গেলো রোদ্দুর তাকে সহায়তা করার ইচ্ছায়। কিন্তু মেয়েটির সম্মুখে যেতেই দেখলো মেয়েটি তুলিকা। একই পাড়ায় থাকার কারণে তুলিকার মুখচেনা, তবে কখনোই কথা বলা হয়ে উঠে নি। চুপচাপ মেয়েটিকে প্রায় নিগূঢ় রাতে বারান্দায় একা বসে থাকতে দেখেছে রোদ্দুর কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি তার উদাসীনতার কারণ। মেয়েটি তার ছি/লে যাওয়া কনুই এ ফু দিচ্ছে। ফলে ধীর কন্ঠে রোদ্দুর বলে,
“বেশি ব্যাথা পেয়েছো কি?”

রোদ্দুরের কন্ঠে চমকে উঠলো তুলিকা। খানিকটা জড়তা দেখা গেলো তার মাঝে, কেমন ভয় পেয়ে গুটিয় যাবার মতো। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ। রোদ্দুর তাকে আশ্বস্ত করে বললো,
“ভয় পেও না। আমি কিছু করবো না। তুমি কি দাঁড়াতে পারবে, আমি সাহায্য করি?”
“লাগবে না”

মেয়েটির কন্ঠে রোষের সূক্ষ্ণ রেখা। রোদ্দুর অবাক হলো কিছুটা। এমনটা অস্বাভাবিক আচারণ আশা করে নি সে। তুলিকা তখনও বসে রয়েছে রাস্তায়। দৃশ্যটি অশোভনীয় বটেই। একটি উনিশ-বিশ বছরের মেয়েকে এমন করে রাস্তায় বসে থাকতে দেখতে কারোর ই ভালো লাগে না। তাই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তাকে টেনে তুলে রোদ্দুর। বিধিবাম, তার এই কার্যে ধন্যবাদ পাবার বদলে অতর্কিতে তার বা হাতে কা/ম/ড় বসিয়ে দিলো তুলিকা। ব্যাথায় শ্যাম মুখখানা শক্ত হয়ে উঠলো রোদ্দুরের। তবুও শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অবাক হলেও তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া ছিলো না। ইতোমধ্যে তিতির ছুটে এলো। তুলিকাকে ছাড়ালো সে। রোদ্দুরের হাত থেকে ততসময়ে র/ক্ত পড়তে থাকলো। তিতির কল্পনাও করে নি বোনকে দশ মিনিট ছাড়তেই এই কান্ড করে বসবে। ধমকের স্বরে বললো,
“কি করছিলি তুই? পাগল হয়ে গেছিস নাকি আপা?”
“আমি ঠিক আছি”

রোদ্দুর শান্ত কন্ঠে বললো। কিন্তু তার পূর্বেই ছেলেকে ডাকতে সেখানে হাজির হলেন শাহানা বেগম। দূর্ভাগ্যবশত তিনি বারান্দা থেকে এই ঘটনা দেখেছেন। ব্যাস আর কি! এখন তিনি হিমা বেগমের কাছে এর বিচার চান।

রোদ্দুর গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। মাকে শান্ত করতে বললো,
“এখন অহেতুক সিন করে লাভ নেই। যা হয়েছে এক্সিডেন্ট। দোষ আমার ছিলো, আমি দুঃখিত”

শাহানা বেগম ছেলের কথায় যে সন্তুষ্ট হলেন না তা তার মুখশ্রীতেই প্রকাশ পেলো। সুরভী শান্ত কন্ঠে বললো,
“না না, আমাদের দোষ। ওকে দেখে রাখা উচিত ছিলো। ওর জন্য তোমাকে অহেতুক ঝামেলা পোহাতে হলো”
“ব্যাপার না, ওর হাটু ছিলে গেছে। বাড়ি নিয়ে যান। আর মা তুমিও চলো, আমার ক্ষুধা লেগেছে”

বলেই পা বাড়ালো রোদ্দুর। শাহানা বেগম যাবার সময় তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“পাগল নয়, সে/য়া/না পাগল। জাতে মা/তা/ল তালে ঠিক”

কথাটা কানে গেলেও উত্তর দিলো না সুরভী। সে তুলিকার হাত ধরে বাসায় নিয়ে এলো।
“আমি ইচ্ছে করে কামড়াই নি ভাবী”

তুলিকার স্বগোতক্তিতে সুরভী অস্থির স্বরে বললো,
“তুই কামড়াবি বা কেন?”
“সে আমায় ছুয়েছে”

তুলিকার ঠান্ডা উত্তরে আর কথা খুঁজে পেলো না সুরভী। ছোট একটি নিঃশ্বাস গোপন করে বললো,
“সে তোমাকে ক্ষতি করার জন্য ছোয় নি। সাহায্য করেছে। তোমাকে বুঝতে হবে সেটা”

তুলিকা কি বুঝলো জানা নেই, তবে সে ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলো। এর মাঝেই পোড়া একটি গন্ধ নাকে এলো সুরভীর। অভিলাষা বললো,
“তরকারীটা চুলায়”
“খাইছে”

তরকারী কড়াইতে লেগে গিয়েছে। অথচ তাদের খেয়াল ই নেই। তিতির ঢোক গিলে বললো,
“পুড়ে গেলো?”

অভিলাষা কড়াই বদলাতে বদলাতে বললো,
“মা জানলে রক্ষা থাকবে না”
“তুমি পোড়া অংশ গুলো ফেলে দাও। মা টের পাবে না”

সুরভীর কথায় খিলখিল করে হাসতে হাসতে তুলিকা বললো,
“ভাবীও তাহলে মিথ্যে বলবে? ছিঃ ছিঃ ভাবী, আমার মা বোঝে না বলে তুমি তাকে বোকা বানাবে?”
“তা দোষটা কার শুনি?”

তুলিকার কান হালকা করে মু/লে শুধালো সুরভী। তুলিকা ভদ্র বাচ্চার মতো বললো,
“আর হবে না”
“চলো, মলম লাগিয়ে দেই। দেখি কই চো/ট পেলে”

সুরভী তুলিকাকে নিয়ে গেলো। অভিলাষা তরকারীর দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বাহিরে না গেলে হয়তো তরকারীটা পুড়তো না________

*********

বাসায় ফিরতেই মায়ের প্রশ্নের মুখোমুখি হলো রোদ্দুর,
“কেনো নিয়ে এলে তুমি? আজ একটা বিহিত করে আসতাম”
“তোমাকে বস্তির ঝগড়াটে মহিলাদের মতো লাগছিলো মা, যা আমার কাছে দৃষ্টিকটু”

ছেলের মুখে এমন বাক্য মোটেই সহ্য হলো না শাহানা বেগমের। তীব্র স্বরে বললেন,
“রোদ্দুর, আমি তোমার মা”
“সেজন্য ই তোমার সম্মান রক্ষাও আমার দায়িত্ব। আর একটি অসুস্থ মেয়েকে হেনস্তা করে কি লাভ মা। দোষ তো আমার”
“তাই বলে তোমাকে কামড়াবে?”
“স্বাভাবিক হলে কামড়াতো না, নিজেও তো বলছিলে সে অসুস্থ। তাহলে? আর এভাবে রাস্তার মাঝে সকলের সামনে সিন ক্রিয়েট করাটা মোটেই শোভনীয় না। তাহলে তার আর তোমার মাঝে কি পার্থক্য?”

রোদ্দুরের কথায় এবার কিছুটা দমলেন শাহানা বেগম। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
“বেশ আর সিন ক্রিয়েট করবো না। তুমি তুলিকার আশেপাশেও থাকবে না। আজ কামড়েছে কাল ঢিল ছুড়বে। পাগলের কি ভরসা?”

মায়ের কথাগুলো যেনো শুনেই মস্তিষ্কে ধারণ করলো না রোদ্দুর। তার মস্তিষ্কে এখন একটি নাম ই পর্যাবৃত্ত গতিতে ঘুরছে, “তু….লি…কা”

*****

নিগুঢ় রাত, ব্যস্ত শহরে নেমে এসেছে কৃষ্ণ আঁধার। ঘরের প্রতিটি প্রাণ এখন বেঘুরে ঘুম। শুধু ঘুম নেই অভিলাষার চোখে। চোখের পাতা এক করতে পারছে না সে। দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার কাছে। চোখজোড়া প্রতিক্ষিত। তিমির যে এখনো ফিরে নি……

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি