নীড় হারা পাখি পর্ব-০৪

0
305

#নীড়_হারা_পাখি
#৪র্থ_পর্ব

উপায়ন্তর না বুঝে দোকান থেকে ছুটে পালাতে গেলেই তার হাতখানা টেনে ধরলো ছেলেটি। ছেলেটির কাছ থেকে ছুট পাবার চেষ্টা করলো তুলিকা। কিন্তু সুডৌল শরীরের শক্তির কাছে পেরে উঠলো না। উপায়ন্তর না পেয়ে মুখ এগিয়ে দিলেই ছেলেটি তার হাত সরিয়ে নিলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“যদি আরেকবার কা/ম/ড়াতে যাও, আমিও কিন্তু কা/ম/ড়ে দিবো। আমার দাঁত কিন্তু তোমার থেকে ধা/রা/লো”

কথাটা কানে বাজলো তুলিকার। মাথা তুলতেই দেখলো ছেলেটি তীর্যক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার গম্ভীর মুখশ্রী দেখে বোঝার উপায় নেই সে সত্য না মিথ্যে বলছে। তবে তার তীক্ষ্ণ চাহনী তুলিকার মনে ভয় সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। তুলিকাকে চিন্তিত দেখে রোদ্দুর মাথাটা খানিকটা ঝুকিয়ে বললো,
“কি কা/ম/ড় দিবে?”

তুলিকার পাতলা ঠোঁট জোড়া কাঁপছে ঈষৎ। তার ভয় হচ্ছে, আশপাশটায় ঘোলাটে চোখে একবার দেখলো। অপরিচিত পরিবেশ তার ভেতরের নিকষকালো ভয়কে প্রগাঢ় করলো। রোদ্দুরের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা অব্যাহত রাখলো সে। কিন্তু সফল হলো না। একটা সময় ক্ষীণ তেজী কন্ঠে বলে উঠলো,
“হাত ছাড়ুন আমার”
“ছটফট থামাও”
“আমি কিন্তু চিৎকার করবো”

তুলিকার কন্ঠে সুপ্ত আতংকের ছাপ। তবে চোখে তেজ। তার রোষাগ্নি দৃষ্টি যেনো মূহুর্তেই ঝ/ল/সে দিবে রোদ্দুরকে। রোদ্দুর অবাক হলো। মেয়েটিকে সেদিন ও আতংকিত লেগেছিলো, মেয়েটির চোখজোড়ায় ক্ষীণ ভয়ের আভাস সেদিন ও পেয়েছিলো সে। মেয়েটি কেনো এতো ভয় পায়! কেনো তার জ্বলজ্বল করতে থাকা তেজী চোখগুলোতে ভয়ের আভাস পায় রোদ্দুর! এতো প্রতিরোধ কি তবে সেই ভয়কে আড়াল করতেই? প্রথম সাক্ষাৎ এ যত না অবাক করেছিলো, দ্বিতীয় সাক্ষাৎ এ তার চেয়ে দ্বিগুণ আকর্ষিত করছে মেয়েটি। গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। শান্ত গলায় বললো,
“কার সাথে এসেছো?”
“বলবো কেনো?”
“না বললে লস তোমার, আমি কিন্তু মানুষ ভালো নই। ছে/লেধ/রা ও হতে পারি৷ তোমাকে ধরে নিয়ে পাঁচার করে দিতে পারি”

কথাটা শুনতেই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো তুলিকার। চোখে ভয়ের ছাপ গাঢ় হলো৷ কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি জানি আপনি ছে/লে/ধ/রা নন। আপনি ওই খ/চ্চ/র মহিলার ছেলে”

মায়ের এমন পরিচয়ে কেনো যেনো হাসি পেলো রোদ্দুরের। তবুও হাসলো না৷ বরং গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমার মা খ/চ্চ/র?”

তুলিকা কিছু বললো না। নতমস্তক দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে এখন খাঁচায় বন্দি সিংহীর মতো লাগছে, যে দাঁতে দাঁত পিষলেও গর্জন করতে পারছে না। রোদ্দুর ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো, হাতের বাঁধনটা আরোও দৃঢ় করে বললো,
“জানো যখন আমি ছে/লে/ধ/রা নই তাহলে এতো আ/ক্র/ম/নাত্বক আচারণ কেনো? আমি তো তোমার ক্ষতি করছি না”
“কি ভরসা?”
“সে তুমি নাই করতে পারো, তবে তোমাকে তুলে নিয়ে আমার দুপয়সা লাভ নেই। উলটো ক্ষতি। গতবারের কা/ম/ড়ের দাগ এখনো চিৎকার করে জানান দেয় তুমি মানুষ কেমন”
“তাহলে আমাকে যেতে দিচ্ছেন না কেনো?”
“চিন্তা হয়”

শান্ত কন্ঠে কথাটা বললো রোদ্দুর। কথাটা খুব ছোট্ট, তবে তুলিকার কর্ণকুহরে যেনো ঝংকার তুললো। বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো তুলিকা রোদ্দুরের মুখপানে। তার ঠোঁটে এখনো হাসি লেগে আছে। তার কৃষ্ণ চোখে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে তুলিকা। কি দুর্বোধ্য চাহনী! তুলিকার সরল মস্তিষ্কে মোটেই লোকটির কথাগুলো বোধগম্য হচ্ছে না। কি চায় সে! রোদ্দুর তার আঙ্গুলের ফাঁকে নিজের আঙ্গুল গলিয়ে বললো,
“কার সাথে এসেছো? কোন দোকানে সে? চলো পৌছে দিচ্ছি। সন্ধ্যে হতে চলেছে। আর দেরি করা উচিত হবে না”
“তিতির জুতো কিনছে৷ ওর সাথে এসেছিলাম। কোন দোকান চিনতে পারছি না।”

অপরাধী কন্ঠে মিয়ে যাওয়া স্বরে বললো তুলিকা। রোদ্দুরের হাসি প্রসারিত হলো। তুলিকার কোমল হাতটা শক্ত করে ধরে হাটা শুরু করলো সে। তুলিকাও চললো তার পিছুপিছু। রুক্ষ্ণ হাতের ভেতর পিষছে কোমল হাত। উষ্ণ স্পর্শ ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা দেহে। অন্য এক শিহরণ কাজ করছে, ব্যাতিক্রম এক অনুভূতি। তুলিকার জানা নেই অনুভূতিটির নাম। শুধু এটুকু জানে এই ছেলেটির সঙ্গ বিপদজনক।

অবশেষে তিতিরের দোকান খুঁজে পাওয়া গেলো। তিতির তুলিকাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গিয়েছে। জুতা দেখতে দেখতে তুলিকার কথাটা ভুলেই গিয়েছিলো সে। চার-পাঁচ জোড়া তুলোর মাঝে একটি জুতো খুব মনে ধরলে যখন অতিউৎসাহী কন্ঠে আপাকে তা বলতে গেলো, তখন ই আবিষ্কার করলো তার আপা তার পাশে নেই। পুরো দোকানের কোথাও আপা নেই। হন্যে হয়ে সকলকে শুধাতে লাগলো,
“সাদা সেলোয়ার কামিজ পড়া একটি ফর্সা মেয়ে ছিলো, একপাশে লম্বা বেনী দেখেছেন?

কিন্তু কর্মব্যস্ত মানুষের যেখানে নিজের খোঁজ নেবার সময় নেই সেখানে অপরিচিত একটি মেয়ের খোঁজ কিভাবে দিবে তারা! ফলে একে একে সকল দোকান ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো তিতির। অবশেষে আধ ঘন্টা বাদে সে তার আপার খোঁজ পেলো তাও রোদ্দুর ভাই এর সাথে। সেদিনের ঘটনার পর লোকটিকে তুলিকার সাথে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলো তিতির। কিন্তু তার হতবাক চিত্তকে শান্ত করে রোদ্দুর বললো,
“মাছের দোকানে চলে গিয়েছিলেন মহোদয়া। ভাগ্যিস আমি সেখানে ছিলাম। লাভের লাভ যেটা হলো, তোমার আপা হারায় নি। আর লোকসান হলো আমার, গোল্ডফিস আর কেনা হলো না!”

রোদ্দুরের কথা শুনে ছোট করে সরি বললো তিতির। তারপর তুলিকার সাথে ঝাঝালো কন্ঠে বললো,
“তোকে এজন্য কোথায় নিতে চাই না। আমি বলেছিলাম আমার সাথে থাকতে? কেনো আমাকে না বলে গেলি? আমার জান বেরিয়ে গেছিলো। এর মধ্যে মায়ের কয়শ ফোন আসছে জানিস?”

তুলিকা মুখ লম্বা হলো, সে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তখন রোদ্দুর শান্ত কন্ঠে বললো,
“দোষটা কিন্তু তোমার! যেহেতু তুমি ওকে নিয়ে এসেছো ওকে দেখে রাখার দায়িত্বটাও তোমার। ওর মানসিক অবস্থা বোন হিসেবে আমার থেকে বেশি তুমি জানো। তাই ওর সাথে বকাবকি না করে, নিজের ভুলটা শুধরে নিও”

রোদ্দুরের কথায় বেশ লজ্জা পেলো তিতির। সে আর কথা বাড়ালো না। দিনের শেষ আলোকবিন্দু নিগূঢ় আধারের কৃষ্ণ ছাপে হারিয়ে গেলো। মাগরিবের আযান কানে আসছে। রোদ্দুর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, বাড়ি কিভাবে যাবে?”
“চলে যাবো আমরা”
“আমিও তো একই জায়গায় যাচ্ছি, চল একসাথে যাই”
“না না, তার দরকার নেই”
“তোমার আপা জানে আমি ছে/লে/ধ/রা নই। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, একা যাওয়া নিরাপদ না”

তিতির কথা বাড়ালো না। এদিকে তুলিকা গোলগোল চোখে রোদ্দুরকে দেখছে। তার মোটেই মানুষটিকে ভালো লাগছে না। কিন্তু সে ভালো মেয়ে, উপকারী উপকার ভুলে না। তাই বিনাবাক্যেই সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট দশেকের ভেতর একটি সিএনজি ঠিক করলো রোদ্দুর। তারপর তিতির এবং তুলিকাকে উঠতে বললো। অবশেষে সিএনজি ছাড়লো। গন্তব্য এখন বাড়ি, সারা রাস্তা পাশাপাশি বসলেও কোনো কথা হলো না, কেবল শোনা গেলো রাস্তায় ব্যাস্ত যানের হর্ণের কোলাহল_______

******

বসার ঘরে থমথমে একটি পরিবেশ। হিমা বেগমের মুখ কঠিন হয়ে আছে। তার সম্মুখে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে অভিলাষা। তার কপাল ঘামছে। কথা বলার সাহস হচ্ছে না তার। মা হঠাৎ করে কেনো জরুরি তিনি তলব দিলেন বুঝে উঠতে পারলো না অভিলাষা। তবে মায়ের মুখের ভাবভঙ্গিতে এতোটুকু নিশ্চিত তিনি কোনো কারণে অসন্তুষ্ট। এর মাঝেই ঘরের কলিংবেল বাজলো। দরজা খুলতেই তিতির এবং তুলিকা ঘরে প্রবেশ করলো। তাদের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালেন হিমা বেগম। তারপর হিনহিনে স্বরে শুধালেন,
“কোথায় ছিলে?”
“বলেছিলাম না স্মৃতির বাড়ি যাচ্ছি”
“মিথ্যে কথাটাও কি ওই মেয়েটি টাকা দেওয়ার সাথে শিখিয়ে দিয়েছে?”

কথাটি শুনতেই চমকে উঠলো তিতির। অভিলাষার মুখশ্রী পাংশু বর্ণ ধারণ করলো। তিতির মায়ের ক্রোধ জানে। কিছু বললেই হিতে বিপরীত হবে। তাই সে মৌন রইলো। হিমা বেগম তিতিরের হাত থেকে জুতোর প্যাকেটটা নিয়ে অভিলাষার হাতে ধরিয়ে দিলেন। তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“আমার ছেলের জীবনটা তো নষ্ট করেই দিয়েছো, অন্তত মেয়েটিকে নষ্ট করো না। আজ তোমার জন্য সে মিথ্যে বলেছে, কাল না জানি কি করবে! এই শেষ বয়সে এসে অন্তত মেয়েকে উচ্ছন্নে যেতে দেখতে পারবো না।”
“মা, আমি ওকে মিথ্যে বলতে বলি নি। আমি ওকে টাকা দিয়েছিলাম যেনো ও একটা ভালো জুতো কিনে। পরিবারের মানুষ হয়ে এটুকু তো করতেই পারি”
“লাগবে না, অনেক করেছো তুমি। তোমার জন্য আজ আমার ছেলে রাত বিরাতে বাড়ি ফিরে, এমনটা তো হবার কথা ছিলো না। লেখাপড়া শিকে তুলে এখন সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। আমার সাথে তর্ক করতেও সে পিছপা হয় না। আর কি করতে চাও? ক্ষমা চাচ্ছি। এবার রেহায় দাও। মা তো হচ্ছো, সন্তান বেপথে গেলে কেমন লাগে হাড়ে হাড়ে টের পাবে”

হিমা বেগমের কথাগুলো বিষাক্ত সুই এর মতো বিঁধছে অভিলাষার। চোখ জ্বালা করছে, ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তবুও মৌন থাকলো অভিলাষা। ছোট একটি নিঃশ্বাস গোপন করে জুতোর প্যাকেটটি নিয়ে ভেতরে চলে এলো। নিজের স্বার্থপরতার জন্য নিজেকেই ঘৃণা হচ্ছে! আজ এতোটা হেয় কি সত্যি তার প্রাপ্য_____

****

চায়ের দোকানে গরম চায়ের ধোঁয়া উড়ছে। পাড়ার ছেলেপেলে চায়ের চুমুকে আড্ডার আসর জমিয়েছে। রিক্সা থামতেই সেখান থেকে নামলো রোদ্দুর। হাতে সাদা এপ্রোন। বারো ঘন্টার টানা ডিউটি অবশেষে শেষ হলো। এখন বাড়ি যেয়েই লম্বা ঘুম। এর মাঝেই শিহাব তাকে ডাকলো,
“রোদ্দুর চা খাবে নাকি?”

মাথা ব্যাথার কার্যকরী ঔষধটিকে মানা করতে পারলো না সে। তাই বসেই পড়লো। তপন দা এগিয়ে দিলো গরম চায়ের কাঁপ। এর মাঝেই শিহাব শুধালো,
“হাতের কি হাল, শুনেছি তুলিকার কা/মড় খেয়েছিস?”
“ওই আর কি, দাগ বসেছে”
“ওই মেয়ের আশেপাশেও থাকিস না, ভীষণ ড্যাঞ্জারাস”
“আচ্ছা, তুলিকা কি ছোটবেলা থেকে এমন নাকি কোনো কারণে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে?”

চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্নটি করলো রোদ্দুর। মেয়েটিকে নিয়ে তার কৌতুহল প্রচুর। তার ই বহিঃপ্রকাশ হলো অজান্তে। উত্তরে শিহাব বললো,
“যতটুকু শুনেছি মেয়েটির এই অবস্থা বছর দুয়েক হবে, বিয়ের ভাঙ্গার ফল বুঝলি……..

চলবে