নীড় হারা পাখি পর্ব-০৫

0
288

#নীড়_হারা_পাখি
#৫ম_পর্ব

“আচ্ছা, তুলিকা কি ছোটবেলা থেকে এমন নাকি কোনো কারণে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে?”

চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্নটি করলো রোদ্দুর। মেয়েটিকে নিয়ে তার কৌতুহল প্রচুর। তার ই বহিঃপ্রকাশ হলো অজান্তে। উত্তরে শিহাব বললো,
“যতটুকু শুনেছি মেয়েটির এই অবস্থা বছর দুয়েক হবে, বিয়ের ভাঙ্গার ফল বুঝলি।“

শিহাবের কথায় খানিকটা অবাক হলো রোদ্দুর। চায়ের কাঁপ নামিয়ে কপাল কুচকে ধীর স্বরে শুধালো,
“বিয়ে ভাঙার ফল মানে?”
“শুনেছি মেয়েটির নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। কিন্তু খুব হেনস্তা করে বরপক্ষ বিয়েটা ভাঙ্গে। তুলিকা নাকি আ/ত্ম/হ/ত্যা করতে গিয়েছিলো। এর পর থেকেই ওর মানসিক বিপর্যয় ঘটে। এতোটা খারাপ অবস্থা ছিলো যে ওকে পাগলাগারদে দেবার মতো পরিস্থিতি হয়েছিলো। সুরভী ভাবী আর তুরান ভাই এর জেদের জন্য সেটা ঘটে নি। ওর নাকি চিকিৎসা চলছে। এখন তো অনেক স্বাভাবিক দেখায়, দূর থেকে দেখলে কেউ বলতেই পারবে না মেয়েটির মাথায় গন্ডগোল। কাছে গেলেই বোঝা যায় কাহিনী কি! তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ তো তুই”
“কেনো বিয়ে ভেঙ্গেছিলো?”

আনমনেই কথাটা শুধালো রোদ্দুর। রোদ্দুরের কন্ঠটা শান্ত, তার দৃষ্টি চায়ের কাঁপে স্থির। চা টা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সেদিকে মন নেই রোদ্দুরের। তুলিকার প্রতি রোদ্দুরের এমন আগ্রহে অবাক হলো শিহাব। বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“সুন্দর চেহারায় কি ডাক্তারবাবু গলে গেলো? অবশ্য অস্বাভাবিক নয়, অমন পুতুল মুখশ্রীতে কঠিন থেকে কঠিন হৃদয় ও গলে পানি হবে। সেখানে তুমি তো সামান্য ডাক্তার। হৃদয় তোমার স্বভাবতই নরম। তবে এ যে সে নারী নয়, কা/ম/ড়ের দাগ তো এখনো অক্ষত”

শিহাবের কথায় যুবকমহলে হাসির লহর উঠলো। রোদ্দুর খানিকটা বিরক্ত হলো বটে, কিন্তু দাঁতে পিষে নিলো তা। চায়ের কাপটা বেঞ্চে রেখে দাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। এখন বসে থাকা মানেই যত আজগুবি কথা গেলা, অহেতুক একটি অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে চর্চা যার কোনো সুফল নেই। কথার হাত পা না থাকলেও তার দৌড় অনেক। সামান্য কৌতুহল কাউকে আঘাত দেবার কারণ হতেও সময় নিবে না। তাই কথার ধোঁয়ার কুন্ডলী সেখানেই দমিয়ে দেওয়া উত্তম।

রোদ্দুরের বাড়ি এবং তুলিকাদের বাড়ির দূরত্ব কয়েক মিনিট মাত্র। তিন বাড়ি রেখেই রোদ্দুরের বাড়ি, ফলে প্রতিনিয়ত যেনো এই বাড়ির সামনে থেকে যাওয়াটা অভ্যাস হয়ে গেছে তার। যাওয়ার সময় একটিবার দক্ষিণের বারান্দায় তাকানো একটি বিশ্রী স্বভাব। রাস্তা থেকে বারান্দাটি দেখা যায় না। বরং তার জানালা থেকে বারান্দাটি আরো স্পষ্ট দেখা যায়। তবুও যাবার পথে একবার সেদিকে তাকাবেই রোদ্দুর। আজও ব্যাতিক্রম হলো না। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই বাসার তিনতলায় তারা ভাড়া নেয়। বিশাল পরিবার, যান্ত্রিক শহরে যেখানে মানুষ নিজের আলাদা গন্ডি বানিয়ে নিয়েছে সেখানে তুলিকাদের পরিবারে তখন সাতজন সদস্য। ব্যাপারটা পাড়ায় খুব আলোচিত হলেও সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় তুলিকা। পুতুলের মতো তুলতুলে একটি মেয়ে, যার ঘোলা চোখের অবুঝ দৃষ্টিতে যেকোনো পুরুষের শীতল হৃদয়ে উষ্ণ রক্তসঞ্চালনের বেগ বাড়াতে যথেষ্ট। পাড়ার শাহিন ভাই ও তাদের একজন ছিলেন। সুযোগ পেলেই তুলিকার সাথে কথা বলার চাহিদা তাকে মহা বিদঘুটে পরিস্থিতিতে ফেলেছিলো, যখন তুলিকা তাকে জু/তো খুলে মেরেছিলো। সবাইকে চেঁচিয়ে বলেছিলো,
“এই পঁচা লোকটা আমাকে বাজে ভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে”

সবার সম্মুখে লজ্জায় মিশে গিয়েছিলো শাহিন ভাই, তার পরিবার তুলিকাদের পাড়া ছাড়াতে চাপ দিলে জানা যায় মেয়েটির মাথায় সমস্যা। সকলের দৃষ্টি বদলে যায়, আগে যাদের তুলিকার দর্শন হৃদস্পন্দন বাড়াতো তারা মুখ বাকাতে লাগলো তুলিকাকে দেখে। কেউ কেউ আফসোস করলো, সমবেদনা জানালো আবার কেউ বিদ্রুপের আশ্রয় নিলো। তবে সেই স্বাভাবিক আচারণটি আর এলো না। রোদ্দুর মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করে, মেয়েটির প্রতি এত কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দু কি? কেবল ই সমবেদনা নাকি তার পেশা! পেশাগত ভাবে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়, তাই তো নিজেকে আর ঘাটায় না। ঘাটানোটা বুদ্ধিমানের ও নয়, কেঁচো খুড়তে সা/প বেড়িয়ে গেলে? তখন কি হবে? এপ্রোনটা চেয়ারে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। নিস্তদ্ধ ঘরে তখন প্রগাঢ় অন্ধকার। লাইট জ্বালাবার বেকার কষ্ট করলো না। শুধু জানালাটা খুলে দিলো। ঘুমোট গন্ধটা মিলাতেই লাগলো শীতল হাওয়ায়। ক্লান্ত চোখ জোড়ায় তখন নিদ্রাদেবীর আগমণ, আর মস্তিষ্কের ভেতর একটি প্রশ্ন,
“কেনো ভাঙ্গলো তারা বিয়ে? না ভাঙ্গলে তো আজ মেয়েটির গল্পটি অন্যরকম হতো। হয়তো নীড় হারা পাখির ন্যায় নিস্তদ্ধ রাতের কৃষ্ণ আকাশে নিজের ঠায় খুঁজতো না”

*******

আজকের সকালটা অন্য সকালের মতো হলো না, তীব্র তাপে ঝাপসা চোখজোড়া খুলতেও কষ্ট হচ্ছে অভিলাষার। শরীরে বিশ্রী ব্যাথা, মাথায় যেনো হাতুড়ি পে/টা হচ্ছে। থার্মোমিটারের পারদও জানান দিবে তাপমাত্রা একশ পার করেছে। শুষ্ক ঠোঁট জিভ দিয়ে ভেজালো সে। গলা শুকিয়ে এসেছে, একটু পানি পেলে মন্দ হতো না। এর মাঝেই শীতল হাতের স্পর্শ পেলো কপালে। চিন্তিত কন্ঠ বলে উঠলো,
“এতো জ্বর বাঁধালে কিভাবে?”

অভিলাষা চোখ মেলে চাইলো। তিমির চিন্তিত দৃষ্টিতে তার পানে চেয়ে আছে। লোকটির কালো নয়নে নিজের প্রতিবিম্ব দেখলো অভিলাষা। স্মিত হেসে বললো,
“কখন এসেছো?”
“এই তো মাত্র”

নতুন চাকরি পেয়েছে তিমির। আগের সেলসম্যানের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে সে। এটা নাকি কলসেন্টারের চাকরি। শুধু ফোনে কথা বলতে হবে। ফোন ও যে সে নয়, বাহিরের দেশের কাস্টোমারের ফোন। যেহেতু বরাবর ই ছাত্র ভালো তাই ইংলিশে তার বেশ ভালো দক্ষতা। ফলে সার্টিফিকেটের জন্য আটকায় নি কিছু। বিশাল ই চাকরি টা যোগাড় করে দিলো। মাস গেলেই কড়কড়া পনেরো হাজার। ফলে তিমিরের বারণ করার কারণ ই নেই। রাতের শিফট করতে হয়। সেই বিকালে বের হয় আর আসে সকালে। রাতটা অভিলাষার একাই কাটে। ভীত অভিলাষা গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকে। সেই ঘুম ভাঙ্গে কলিংবেলে। কিন্তু আজ আর কলিংবেলের শব্দ কানে পৌছায় নি। ফলে দরজাটিও সে খুলে নি। অভিলাষা উঠতে গেলে রামধমক খেলো,
“উঠছো কেনো?”
“তুমি খাবে না?”

অভিলাষা করুন স্বরে কথাটা শুধালো। উত্তর না দিয়েই সবল হাতজোড়া তাকে নিজের কাছে টেনে নিলো। চুলে বিলি কাঁটতে কাঁটতে বললো,
“তোমার বর টা অনেক বাজে তাই না?”

তিমিরের কন্ঠটা কেমন যেনো শোনালো। অভিলাষা তার প্রসস্থ বুকে মাথা এলিয়ে বললো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“আমার জন্য তোমাকে এই যাতাকলে পিষতে হচ্ছে, তুমি না বললেও আমি জানি তোমার অসুস্থতার কারণ। সেদিন ও মা তোমাকে অনেক কথা শুনিয়েছে”
“ভুল তো কিছু বলেন নি তিনি, আমার জন্যই তো তোমার এই দশা। আমার জীবনে সুখ আনতে যেয়ে নিজের জীবনে কালবৈশাখী ঝড় তুললে”

অভিলাষা ধরা গলায় কথাটা বললো। তিমির তার মুখশ্রী আলতো হাতে তুলে ধরলো। কপালে গভীর চুম্বন এঁকে বললো,
“তুমি আমার শুভ্র গোলাপ অভিলাষা, ঐ নরপিশাচের হাতে কি করে তোমায় নষ্ট হয়ে দেই! সেদিন যা করেছিলাম আমি বুঝেই করেছিলাম”

অভিলাষা চোখ বুজে নিলো, ফলে অশ্রুমালা পড়লো কোমল গাল বেয়ে। দিনটি এখনো তার স্মৃতিতে স্পষ্ট। অচেনা একটি লোকের সাথে অর্থের লোভে অভিলাষার জোরপূর্বক বিয়ে দিচ্ছিলেন তার চাচী পলি বেগম। অভিলাষার ইচ্ছেকে গ/লা চে/পে হ/ত্যা করে তার থেকে বিশবছরের একজন বিপত্নীক এক পুরুষের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেন পলি বেগম। ফলে এই অমানবিক অ/ত্যা/চা/র থেকে রক্ষা পেতেই তিমিরের সাহায্য নেয় অভিলাষা। তিমির যেদিন দলবল নিয়ে বিয়ে ভাঙ্গতে আসে। তখন তারা দুজনের সম্পর্কটি কেবলই কলেজের সিনিয়র এবং জুনিয়রের ছিলো। পুলিশ নিয়ে এসে ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক বিয়েটি থামায় তিমির এবং তার দলবল। একটি বাইশ বছরের মেয়েকে তার অনিচ্ছায় বিয়ে দেওয়া আইনত অপরাধ। ফলে পুলিশের ভয়ে পলি বেগমের সুসজ্জিত পরিকল্পনা বিফলে যায়। অভিলাষা জানতো এর পর চাচীর কাছে থাকা মানেই প্রতিনিয়ত মানসিক য/ন্ত্র/ণার মুখোমুখি হওয়া। পলি বেগম তার সূচনা বিয়ে ভাঙ্গার পর পর ই করেছিলেন। কটুক্তি এবং অকথ্য বাণীতে যখন অভিলাষাকে বারবার আঘাত করা হচ্ছিলো তখন তার সম্মুখে ঢাল হয় তিমির। বিদ্রোহ করে বলেছিলো,
“কথা দিয়ে যদি কারোর মন জয় না করতে পারেন তবে কাউকে আঘাত করার অধিকার ও নেই আপনার। নিজের লোভের মাত্রায় অন্ধ হয়ে গেছেন। এতটুকুও দেখেন নি কার সাথে বিয়ে দিচ্ছেন অভিলাষার”
“আমার ভাতজী আমি বুঝবো, তুমি কে গো? মনে রেখো ও আমার অন্ন ই ধ্বংস করে”
“করবে না, এখানে থাকবে না অভিলাষা”
“কোথায় থাকবে?”
“সেটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না”

শান্ত কন্ঠে কথাটা বললো তিমির। পরমূহুর্তেই সে অভিলাষার নরম হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“কোথায়?”
“আমার সাথে”

অভিলাষার নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কে কথাটা ঝংকার তুললো। অবাক নজরে অপলক দৃষ্টিতে যখন তাকিয়ে রইলো সে তিমিরের দিকে, তিমির তখন শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমায় বিয়ে করবে অভিলাষা? কথা দিচ্ছি, তোমাকে আগলে রাখবো”

কথাটার মাঝে অবর্ণনীয় সম্মোহনী শক্তি ছিলো। অস্থির হৃদয়টা নিমিষেই যেনো শান্ত হয়ে গেলো অভিলাষার। মনে হলো এই বুঝি তার সকল যন্ত্রণার মুক্তি। বাড়িয়ে থাকা হাতটি বিনা প্রশ্নে আঁকড়ে ধরলো অভিলাষা। ভেবেছিলো নীড় হারা পাখি বুঝি নীড় খুঁজে পেলো, সুখের ঠিকানা খুঁজে পেলো। কিন্তু ভুল ছিলো, সুখের ঠিকানার খোঁজ পেলেও নীড়ের খোঁজ পেলো না সে। তিমিরের শার্টখানা আগলে ধরে আকুল কন্ঠে বললো,
“আমি যদি কিছু চাই দিবে?”
“কি চাই তোমার?”

অভিলাষার মুখে এই প্রথম আবদার শুনলো তিমির। প্রিয় মানুষের আবদার মেটানোর মাঝেও শান্তি রয়েছে, হোক না যত নিষ্ঠুর কোনো চাহিদা_______

******

শফিক সাহেবের চশমাটা বদলাতে হবে। আজকাল ঝাপসা লাগে সব। খবরের কাগজের লেখা ছোট হয়েছে নাকি তার চোখের পাওয়ারে গন্ডগোল এই তর্ক প্রতিনিয়ত ই স্ত্রীর সাথে লেগে যাচ্ছে। হিমা বেগম বারবার বলছেন ডাক্তার দেখাতে, কিন্তু অর্থ অপচয় তিনি করতে চান না। আজ ও হিমা বেগমের সাথে তার বাকযুদ্ধ চলছে। হিমা বেগম তীক্ষ্ণ কন্ঠে তাকে কথার বান দিয়ে আঘাত দিচ্ছেন। শফিক সাহেব তা না শোনার ভান করে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে আছেন। এর মাঝে আগমন ঘটলো তিমিরের। তিমিরকে দেখেই মুখ বাকালেন হিমা বেগম। তিমির বিনা ভনীতায় বললো,
“তোমাদের কিছু বলার ছিলো”
“কি?”

শফিক সাহেব খবরের কাগজটা রেখে শুধালেন। তিমির ঠোঁট ভিজিয়ে ধীর স্বরে বললো,
“আমি ফাইনাল পরীক্ষা দিবো……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি