নীড় হারা পাখি পর্ব-০৬

0
281

#নীড়_হারা_পাখি
#৬ষ্ঠ_পর্ব

হিমা বেগম তীক্ষ্ণ কন্ঠে তাকে কথার বান দিয়ে আঘাত দিচ্ছেন। শফিক সাহেব তা না শোনার ভান করে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে আছেন। এর মাঝে আগমন ঘটলো তিমিরের। তিমিরকে দেখেই মুখ বাকালেন হিমা বেগম। তিমির বিনা ভনীতায় বললো,
“তোমাদের কিছু বলার ছিলো”
“কি?”

শফিক সাহেব খবরের কাগজটা রেখে শুধালেন। তিমির ঠোঁট ভিজিয়ে ধীর স্বরে বললো,
“আমি ফাইনাল পরীক্ষা দিবো”

কথাটা শোনামাত্র হিমা বেগম হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। তিমির এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। শফিক সাহেব বিছানা থেকে উঠলেন। এগিয়ে গেলেন ছেলের কাছে। তার চোখজোড়া ছলছল করছে। মুখে অনাকাঙ্খিত কিছু পাবার আনন্দ স্পষ্ট। ছেলেকে মুখে জড়িয়ে ধরা গালায় বললেন,
“সত্যি বলছিস বাবা?”
“হ্যা বাবা, বর্তমান চাকরিটা তো রাতে তাই ক্লাস করতে ঝামেলা হবে না। আমি আগামীকাল যেয়ে আবার রেজিস্ট্রেশন করে নিবো।“
“তুই জানিস না আমি কতটা খুশি হয়েছি। আমার ভাঙ্গা স্বপ্নটা এখন আবার জোড়া লাগবে। আমার ছেলেটা ভালো রেজাল্ট করে আরোও বড় চাকরিতে ঢুকবে। ও তুরানের মা শুনেছো? খুব তো বলো আমার ছেলে অকর্মণ্য, দেখো আমার ছেলের বুদ্ধি ফিরেছে”

শফিক সাহেবের কথা শুনে হিমা বেগম থমথমে গলায় বললেন,
“শুনেছি, তা এই বুদ্ধি উদয়ের কারণ কি? এতোদিন তো বলে বলে মুখে ফেনা তুলে দিলেও সুবুদ্ধি হয় নি”
“আরে ছাড়ো তুমি কারণ, ও যে এবার পড়াশোনাটা শেষ করবে এটাই অনেক না?”
“বেশ, তাই হোক। বুদ্ধি কতদিন থাকে সেটাই দেখার বিষয়”

বলেই বিছানায় রাখা শুকনো দলামচা কাপড় গুলো গুছাতে লাগলেন। তিমির একটু এগিয়ে এসে মায়ের পাশে বসলো। ধীর গলায় বললো,
“একটা আবদার করবো মা?”

হিমা বেগম উত্তর দিলেন না। তিমির ছোট্ট একটী নিঃশ্বাস গোপন করে বললো,
“অভিলাষার সাথে কি একটু ভালো আচারণ করা যায় না? মেয়েটি তো এখন একা নয়, এই সময় ওকে আরোও আগলে রাখার সময়। আমি পড়াশোনা শুরু করলে ওকে সেই সময়টুকু দিতে পারবো না। তাই এই ছোট্ট আবদার”
“কান ভরা হয়ে গেছে? তাই তো বলি এতো সুবুদ্ধি হলো কিভাবে?”
“অবাক ব্যাপার কি জানো? ও আমাকে কিছুই বলে নি। তুলিকা আমাকে বলেছে। দোষ ধরলেই তো দোষ, একটু দোষ ব্যাতীত ওকে দেখো না। আমার পছন্দ এতো খারাপ নয় মা। ওর খুব জ্বর জানো, খাবার রুচি নেই। কিছু খেতে গেলেই বমি হয়, পেটে যা থাকে সব উগড়ে দেয়। অরুচি হয় মাছে, ছোট আলু দিয়ে মাংসের ঝোল খেতে চেয়েছে। আমার কাছে টাকা নেই বলে চেপে গেছে। মা ও আমাকে বিয়ে করে কিন্তু সুখী নয়। অথচ কথাটা কিন্তু আমি বাদে কেউ জানে না। তিতিরকে ও খুব ভালোবাসে মা, তাই ভালো মন্দ খাওয়ার জন্য দেওয়া টাকাটা অকে জুতো কেনার জন্য দিয়ে দিয়েছে। ওর আপন কেউ নেই, আমি আর আমার পরিবারকে তাকে সর্বস্ব দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে। পাঁচজনের তো মা তুমি, আরেকজনের মা হলে কি খুব ক্ষতি হবে? ভাবীকে কম আদর করো না তুমি, তাহলে অভিলাষা কেনো সেটা পায় না? একটি ছোট্ট প্রাণ তোমাকে আধোবুলিতে ডাকবে সেটা ভালো লাগবে না তোমার?”

হিমা বেগম কোনো কথা বললেন না। কাপড়গুলো হাতে রেখেই বসে রইলেন। তিমির ফোঁস করে বক্ষস্থলে চাপা দীর্ঘশ্বাসটি ছাড়লো। তারপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“কালকে ওর চেকাপ, পারলে তুমি বা ভাবী একটু নিয়ে যেও। আমি কলেজে যাবো”

বলেই ধীর পায়ে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। হিমা বেগম ঠাঁয় বসে রইলেন। শফিক সাহেব তখন ধীর গলায় বললেন,
“ছেলে ভুল বলে নি”

*******

ডাক্তার ইয়াসমিনের কেবিনে বসে রয়েছে সুরভী এবং অভিলাষা। বিকেলের তখন শেষ প্রহর, ঠান্ডা পড়েছে অল্পস্বল্প। ইয়াসমিন তার চোখের চশমা নামিয়ে ধীর গলায় বললো,
“জ্বর কতদিন তোমার?”
“দুদিন হবে?”
“ঔষধ কি খাচ্ছো?”
“খাচ্ছি”
“আর খাওয়া দাওয়া?”
“ভালো না লাগে, কেমন গন্ধ লাগে। খেতে পারি নি। খেলেই বমি হয়।“
“বুঝলাম। ঘুম হয় কি?”
“খুব একটা নয়, অসময়ে ঘুম আছে। রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করি হয় না”
“চিন্তা করো নাকি খুব?”

অভিলাষা উত্তর দিলো না। ইয়াসমিন কিছু ঔষধ লিখতে লিখতে বললো,
“দেখো, এখন সময়টা একটু রিস্কি। যত্নটা বাড়াতে হবে, মিসক্যারেজ এই সময়তেই হয়। ভারী কাজ করবে না, হাসি খুশী থাকার চেষ্টা করবে। একটা আল্ট্রাসোনোগ্রাম করাও, দেখি বেবির গ্রোথ কেমন”

ইয়াসমিনের কথামত অভিলাষা এবং সুরভী আল্ট্রাসোনোগ্রাম রুমে গেলো। আল্ট্রাসোনোগ্রাম করানোর সময় যখন ক্ষুদ্র মানুষটির হৃদস্পন্দন শুনতে পাওয়া গেলো তখন অভিলাষার চোখের কোনে সুখের নোনাজল জমলো। এতোদিনের সকল বিষাদের মেঘ সরে গেলো অচিরেই। মনখারাপের আকাশে উদিত হলো নতুন প্রভাতকিরণ। সুরভী অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলো ক্ষুদ্র বিন্দুটিকে। ছোট্ট একটি প্রাণ ধীরে ধীরে বাড়ছে অভিলাষার মাঝে। এই সময়টা ঠিক কেমন হয়? তার জানা নেই, তবে মানুষ বলে, এই সময় নাকি খুব বিশেষ। বিষাদ, আনন্দ, প্রতীক্ষা, ভয় সব কিছুর সংমিশ্রণ মনকে ব্যাকুল করে তোলে। মূহুর্তেই আবেগের পরিবর্তন ঘটে, কতোটা পীড়া যায় মায়ের শরীরের উপর। সেই পীড়া মূহুর্তেই সুখে পরিণত হয় ক্ষুদ্র মানুষটির আগমণে। সুরভীর নয়নজোড়ায় জমলো কিছু আক্ষপের নোনাজল। মা হবার ইচ্ছে যে তারও ছিলো। জীবন্ত অনুভূতিগুলোকে বরণ যে সেও করতে চায়। কিন্তু সব চাওয়া যে পূরণ হয় না। কিছু ক্ষত যে হৃদয়ে থেকেই যায়।

চেম্বার থেকে বের হতেই দেখা গেলো রক্তিম অপরাহ্নের রঙ্গ মিলিয়ে যাবার পথে, ধীরপায়ে শহরতলীর বুকে নামছে নিস্তদ্ধ সাঁধের মায়া। মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে দূরের মসজিদ থেকে। সুরভী এবং অভিলাষা মাথায় কাপড় দিলো। অভিলাষার ঠোঁটের কোনে এখনো অক্ষত আনন্দের রেশ। বাচ্চার গ্রোথ ভালো। তবুও সাবধান থাকতে বলেছে। সুরভী আলট্রাসোনোগ্রাম রুম থেকে বের হবার পর থেকেই চুপচাপ। রিক্সার খোঁজে যখন সুরভীর চোখ এদিক ওদিক দেখছে তখন অভিলাষা আদুরে স্বরে বললো,
“ভাবী একটু ফুচকা খাবে নাকি?”

রাস্তার ওপারে ফুচকাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। সুরভী চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“পেট খারাপ করবে তো, একেই জ্বর। আর সন্ধ্যে হয়ে গেছে অভি বাড়ি চলো”
“বাড়ি তো যাবোই একটু ফুচকা খেয়ে যাই না। খুব খেতে ইচ্ছে করছে”

অভিলাষার আবদারের কাছে হার মানলো। বাধ্য হয়ে দুই বউ মিয়ে রাস্তার কাছে ফুচকা খেতে দাঁড়ালো। ঝাল ফুচকা এঁকে এঁকে খেলো অভিলাষা। জিহ্ববা জ্বলছে, ঠোঁট, নাক লাল হয়ে গেছে। বুকটাও জ্বলছে তবুও খাওয়া থামাচ্ছে না। সুরভী নিজের গুলোও তাকে দিয়ে দিলো। অভিলাষাকে এতোটা আনন্দিত দেখে তারও ভালো লাগছে। স্মিত হেসে বললো,
“খুব খুশী নাকি আজ?”
“খুব খুশি ভাবী। আমার জীবনে সুখের কাঠিটা বোধ হয় পেয়েছি। আচ্ছা ভাবী তুমি সুখী নও?”

সুরভী নিঃশব্দে হাসলো। ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে ধীর স্বরে বললো,
“সংসার নামক রঙ্গমঞ্চে আমরা সবাই এক একজন অভিনেতা। সবার এক একটা চরিত্র। সেই চরিত্রকে ঘিরে সবার বিচিত্র কাহিনী। আনন্দ, বেদনা, যন্ত্রণা, সুখ সবকিছুর মিশ্রণ সে কাহিনী। আমার কাহিনীটাও অজস্র সুখ দুঃখের মিশ্রণ। তাই আমি যে অসুখী তা বলবো না; আমি সুখী, খুব সুখী”

সুরভী কন্ঠে চাঁপা বেদনা। সবাইকে খুশী রাখা মানুষটির মাঝেও যে হাজারো বিষাদের উপকথা জমে রয়েছে সেটা কি কেউ জানে?

*****

বন্ধুর বিয়েতে বরপক্ষ হয়ে এলেও কাজের পিছু যেনো ছাড়ছে না রোদ্দুরের। এদিকে বন্ধু কবুল বলার তাড়ায় আছে ওদিকে তার সিনিয়র ক্রমশ তাকে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। ফোন সাইলেন্ট না থাকায় প্রতীকের কটমটে দৃষ্টির আ/ঘা/ত সইতেই হলো। তবুও অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললো,
“তুই কবুল বল, আমি ভাইকে সামলে আসছি”

বলেই মঞ্চ থেকে চুপিসারে নেমে পড়লো। যেহেতু বিয়েটি কনেপক্ষের বাসাতেই হচ্ছে তাই একটি ফাঁকা ঘরে ঢুকে পড়লো সে। ঘরটির অবস্থা বেগতিক। ফুলের টুকরি, লাইটের সরঞ্জাম, অব্যাবহৃত চেয়ার, তত্ত্বের ডালার সব ডিবি করে রাখা। বাহিরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে দরজাটা একটু টেনে ফোনটা ধরলো সে। ফোন ধরতেই বাজখাই স্বরের ধমক জুটলো,
“এই তোমার ডিউটি না? কই তুমি?”
“ভাই আমি নিশাদকে ডিউটি বুঝিয়ে দিয়েছি। ও আজ আমার ডিউটি করবে?”
“আমাকে জানিয়েছো?”
“তানি আপুকে জানিয়ে এসেছি রবিন ভাই”

কথা শুনতেই কিছুটা থামলো সিনিয়র রবিন ভাই। এর মাঝেই কারেন্টটা চলে গেলো। নিস্তদ্ধ ঘরটিতে নেমে এলো ঘুটঘুটে আঁধার। জেনারেটর এখনো অন করা হয় নি। ফোনটা কেটেই দরজার কাছে যেতে ধরলেই মনে হলো কারোর চাপা আর্তনাদ কানে এলো। কৌতুহল বশত ফোনের ফ্লাশ লাইটটি জ্বালিয়ে পুরো ঘরটা দেখতে লাগলো রোদ্দুর। মনের ভুল মনে করে যেতে ধরলেই খেয়াল করলো চেয়ারের সারির পেছনে কারোর আঁচল দেখা যাচ্ছে। অবাক হলেও সেদিকে এগিয়ে গেলো রোদ্দুর। একের উপর এক রাখা চেয়ারগুলো সরাতেই দেখলো ঘাপটি মেরে একটি মেয়ে বসা। বেনী করা চুল, পরণে লাল শাড়ি। মুখে ফ্লাশ ধরতেই অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“তুলিকা”…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি