নীড় হারা পাখি পর্ব-০৭

0
292

#নীড়_হারা_পাখি
#৭ম_পর্ব

এর মাঝেই কারেন্টটা চলে গেলো। নিস্তদ্ধ ঘরটিতে নেমে এলো ঘুটঘুটে আঁধার। জেনারেটর এখনো অন করা হয় নি। ফোনটা কেটেই দরজার কাছে যেতে ধরলেই মনে হলো কারোর চাপা আর্তনাদ কানে এলো। কৌতুহল বশত ফোনের ফ্লাশ লাইটটি জ্বালিয়ে পুরো ঘরটা দেখতে লাগলো রোদ্দুর। মনের ভুল মনে করে যেতে ধরলেই খেয়াল করলো চেয়ারের সারির পেছনে কারোর আঁচল দেখা যাচ্ছে। অবাক হলেও সেদিকে এগিয়ে গেলো রোদ্দুর। একের উপর এক রাখা চেয়ারগুলো সরাতেই দেখলো ঘাপটি মেরে একটি মেয়ে বসা। বেনী করা চুল, পরণে লাল শাড়ি। মুখে ফ্লাশ ধরতেই অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“তুলিকা”

হাটু গেড়ে বসে রয়েছে মেয়েটি। চোখে মুখে তীব্র আতংক। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রোদ্দুরের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো সে। তার পাতলা ঠোঁটটা কাঁপছে ঈষৎ। রোদ্দুর অবাক হলো, এই ঘরে তুলিকাকে সে মোটেই কল্পনা করে নি। হাটু ভাঁজ করে বসলো সে তুলিকার সম্মুখে। অবাক কন্ঠে শুধালো,
“তুমি এখানে কি করছো?”

তুলিকার ভয় যেনো বৃদ্ধি পেলো। গুটিয়ে গেলো সে আরোও। হাটু আরোও দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরলো। রোদ্দুর বুঝলো মেয়েটি ভীত, সন্ত্রস্ত। সে তাকে ভরসা কোনোকালেই করে না, বরং তার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে। বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কপাল ঘষলো সে, তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি কাউকে ডেকে নিয়ে আসছি”

বলেই উঠতে গেলে তুলিকা ব্যস্ত হয়ে তার হাত আঁকড়ে ধরলো। এতোটাই শক্ত করে ধরলো যে নখ বসছে। তুলিকার কাজে অবাক হলো রোদ্দুর। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। তুলিকা তখন কাঁপা স্বরে বললো,
“যাবেন না, আমার ভ…ভয় হয়। ভীষণ ভয়। অন্ধকার, অন্ধকার। আমাকে ওরা খুঁজে নিবে। তারপর মে/রে ফেলবে”

তুলিকার কথার আদ্যোপান্ত বুঝলো না রোদ্দুর, কারা খুঁজে নিবে! কারা মে/রে ফেলবে! কিন্তু সে জানে এই প্রশ্নের উত্তর সে পাবে না। রোদ্দুর তবুও শান্ত কন্ঠে বলল,
“আমি না গেলে দুজনকেই এখানেই থাকতে হবে, অন্ধকারে। ব্যাপারটা কি ভালো হবে? তোমার ভয় করবে না? তাই ছাড়ো হাতটা। আমি দূরে কোথাও যাবো না। এই কাছেই থাকবো। আর এখানে কেউ তোমাকে খুঁজবে না। আমি আছি তো। একটু ভরসা করেই দেখো”

তুলিকার ইচ্ছে হলো না হাতটি ছাড়তে। কিন্তু কেনো যেনো এই ছেলেটাকে ভরসা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই অবধি সে তার ক্ষতি করে নি, কা/ম/ড় খেয়েও চুপ থেকেছে, হারিয়ে গেলে তিতিরকে খুঁজে দিয়েছে। তাই না চাইতেও কিছুটা ভরসা তৈরি হয়। যদিও ভরসা জিনিসটা খুব বাজে, যত গাঢ় হবে ততই দূর্বল করবে। সেই দূর্বলতাই একদিন নিঃস্ব করে দিবে তোমায়। তুলিকা হাতটা ছাড়লো। রোদ্দুর ধীর স্বরে শুধালো,
“কে এসেছে তোমার সাথে?”
“তিতির”

রোদ্দুরের বুঝতে বাকি রইলো না কেনো তুলিকা এই ঘুপচি মার্কা স্টোররুমে। তুলিকা এখানে তিতিরের সাথে এসেছে। বিয়েটা তিতিরের বান্ধবীর বড় বোনের। ছোটবেলার বান্ধবী বিধায় ঘটা করে দাওয়াত পেয়েছে সে। তুলিকাকে আনার ইচ্ছে তিতিরের ছিলো না। কিন্তু তুলিকা তো তুলিকা। তার জিদের কাছে মাথানত করতেই হলো। আসার পূর্বে তিতিরের স্পষ্ট ভাষ্য ছিলো,
“আমাকে না বলে কোথাও যাবি না”
“যাবো না”
“যেখানে বসাবো বসবি”
“বসবো”

প্রায় দু বছর পর তুলিকা কোনো অনুষ্ঠানে এসেছে। তার মানসিক অবস্থার জন্য তাকে কোথাও যেতে দেওয়া হয় না। প্রথমে হিমা বেগম তো রাজী হচ্ছিলেন না। মেয়ের স্বভাব সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। কোথায় কোনো কান্ড হলেই অহেতুক মেয়ের পা/গ/লা/মি নিয়ে কথা হবে। ঠাট্টা হবে, বিদ্রুপ হবে। কি দরকার। অবশেষে সুরভীর জন্য রাজী হলেন। তুলিকার একমাত্র ঢাল, সব আবদার পূরণের চাবিকাঠি। মেয়েটি তুলিকার জন্য জাদুর কুপির দৈ’ত্য। যে তার সকল আবদার পূরণ করবে। তাই তো ভাবীর কাছে শাড়ি পড়ার আবদার ও করলো সে। যখন সুরভী শুধালো,
“শাড়ি পড়ে কি করবি?”
“বাহ, বিয়েতে যাবো সাজবো না? আমার ভালো জামা নেই। তাই শাড়ি পড়বো। ছোট ভাবীর মতো আমাকে সাজিয়ে দিবে। লাল টুকটুকে শাড়ি, খোঁপা। আমাকে দেখে যেনো তোমাদের মতো লাগে। কেউ যেনো না বলে তিতির তার পাগলী বোনকে নিয়ে এসেছে”

তুলিকার কথা শুনে হাসলো সুরভী, সত্যি ই তো মেয়েটি তো পা/গ/ল নয়। না কখনো ছিলো। তার বিশ্বাসকে কেউ গ/লা টিপে হ/ত্যা না করলে আজ তুলিকাও আর পাঁচটা মেয়ের মতো প্রাণ খুলে বাঁচতো, ডানা মেলতো নীলাম্বরে।

সুরভী খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো তার ননদকে। লাল শাড়ি, উশখোখুশকো চুলগুলো বেনী করে দিলো, ঘোলাটে চোখগুলোয় দিয়ে দিলো গাঢ় কাজল, পাতলা ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক। সাজানোর পর মনে হলো কোনো স্নিগ্ধ গোলাপকে দেখছে সে, সদ্য ফুটন্ত গোলাপ।

বিয়ে বাড়িতে এসেই তিতির তাকে নিজের সাথে রাখলো। এক মূহুর্ত ছাড় না তার হাত। কিন্তু যখন বউ কে স্টেজে নেওয়া হবে তখন বাঁধন অনুরোধ করলো তাকে সাথে যাওয়ার। ফলে একটি চেয়ারে তুলিকাকে বসিয়ে তিতির কড়া করে বললো,
“তুই কিন্তু কোথাও যাবি না”
“যাব না”
“কথা দে”
“দিলাম”

হাসতে হাসতে বললো তুলিকা। কিন্তু কথা দেওয়াই হয় ভাঙ্গার জন্য। তিতির যেতেই তুলিকা দেখলো কয়েকটা ছোট্ট মেয়ে ছোটাছোটি করছে। তার অবুঝ মনে জাগলো কৌতুহল। তাদের কাছে গিয়ে বলল,
“কি খেলো তোমরা?”
“লুকুচুরি”
“আমাকে নিবে?”
“তুমি আমাদের সাথে খেলবে কেন?”
“আমার বন্ধু নেই, একা একা বসে থাকতে কার ভালো লাগে। নিবে আমায়?”

বাচ্চাগুলো মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। তাদের মাঝে বিশাল কৌতুহল দেখা গেলো। এতো বড় মেয়ে তাদের সাথে খেলতে চাচ্ছে এটাই যেনো বড্ড বেশি বিস্ময়ের ব্যাপার। তবুও তারা তুলিকাকে খেলায় নিলো। কারণ বিচিত্রই পৃথিবীর নিয়ম। তুলিকা তাদের সাথে লুকোচুরি খেলতেই এই ঘরে এসে পড়েছে। যখন রোদ্দুর এই ঘরে প্রবেশ করে তখন সে চেয়ারের পেছনে লুকায়। কিন্তু তখন কারেন্ট চলে যায়। হুট করে সব আঁধারে ঢেকে যাওয়ায় নিজেকে সামলাতে পারে নি তুলিকা। বুকের এক কোনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বিশ্রী কালো ভয়টা হাত বাড়িয়ে ঘিরে ধরলো তাকে। ঘামতে লাগলো সে, শরীর কাঁপতে লাগলো। মনে হলো বিশ্রী অতীত পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে। ঠিক তখন ই একরাশ আলোকরশ্নি দিয়ে হাজির হলো রোদ্দুর। রোদ্দুরকে দেখে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো বহু সময়। ধীরে ধীরে সেই ভয়ের মেঘটা সরতে লাগলো রোদ্দুরের শান্ত কথায়। তাই তো তাকে আঁকড়ে ধরা।

রোদ্দুর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আলতো হাতে তুলিকার কোমল গালে হাত রাখলো। ধীর স্বরে বললো,
“দেখো, ভয় পাবার কিছু নেই। আমি আছি। এখন আমরা বাহিরে যাবো। হয়তো বাহিরে আলো চলে এসেছে। ঠিক আছে?”
“ওরা ধরে ফেলবে”
“ধরবে না, ধরলেই আমি বকে দিবো। ঠিক আছে?”
“সত্যি?”
“সত্যি”

তুলিকা রোদ্দুরের সাথে একমত হলো। উঠে দাঁড়ালো তারা। তুলিকার শাড়ির অবস্থা ভালো নেই। কুঁচি দলামচা হয়ে আছে। আঁচলটাও নেমে গেছে। ফলে কন্ঠাস্থিও দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে দেখা যাচ্ছে কন্ঠাস্থির নিচের তিলটি। আচ্ছা তিল কি এতোটা সুন্দর হয়! হয় হয়তো। রোদ্দুরের প্রথম মনে হলো সেও পুরুষ, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো উষ্ণ রক্তের ঢেউ। সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। খানিকটা অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
“আঁচল ঠিক করো”

তুলিকা বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। রোদ্দুরের কথাটা ঠিক বোধগম্য হলো না তার। ফলে বাধ্য হয়ে তার হাতে মোবাইল ধরিয়ে রোদ্দুর ই তার আঁচল ঠিক করার দায়িত্ব নিলো।

রোদ্দুরকে নিজের কাছে এগিয়ে আসতে দেখে ঘাবড়ে গেলো তুলিকা। খানিকটা ভীত স্বরে শুধালো,
“এগুচ্ছেন কেনো?”

রোদ্দুর উত্তর দিলো না, সে তার হাত বাড়ালো তুলিকার এলোমেলো আঁচলে। আঁচলটি ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“যা সামলাতে পারো না, তা পড়ার কি মানে?”
“বিয়ে বাড়িতে তো সবাই সেজেগুজে আসে”
“সবাই আর তুমি এক?”
“এক নই?”

অবাক কন্ঠে প্রশ্নটি করলো তুলিকা। রোদ্দুর তখন তাকালো তুলিকার দিকে। ঘোলাটে চোখে উত্তরের প্রতীক্ষা। ফ্লাশের মৃদু আলোতে তুলিকার মায়াবী মুখের থেকে চোখ সরাতে পারলো না রোদ্দুর। আলোআঁধারীর অলীকখেলায় যেনো মায়াবন বিহারিনীর মায়া বৃদ্ধি পেয়েছে। রোদ্দুর তখন ফিসফিসিয়ে বললো,
“তুমি সবচেয়ে আলাদা”

আঁচলটা ঠিক করেই তুলিকার হাত নিজের হাতের ফাঁকে পুরলো সে। এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। কিন্তু গোল বাধলো যখন দেখলো দরজাটি বাইরে থেকে আটকানো………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি