নীড় হারা পাখি পর্ব-০৮

0
297

#নীড়_হারা_পাখি
#৮ম_পর্ব

আঁচলটা ঠিক করেই তুলিকার হাত নিজের হাতের ফাঁকে পুরলো সে। এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। কিন্তু গোল বাধলো যখন দেখলো দরজাটি বাইরে থেকে আটকানো। ঘটনাটি মস্তিষ্কের শান্ত কোষগুলোকে মূহুর্তেই উত্তেজিত করে তুললো। রোদ্দুর দরজায় ক্রমশ আ/ঘা/ত করতে লাগলো। বিকট শব্দে ধাক্কা দেবার পরও অপরপ্রান্ত শান্ত। একেবারেই নিস্তদ্ধ। অন্ধকার বদ্ধ ঘর, তার ভেতর আটকে রয়েছে দুজন মানব মানবী। ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে কটু না লাগলেও একটু ঝাঝালো মশলা দিলে বেশ কানাগোসার জন্য উপযুক্ত টপিক হয়ে উঠবে। রোদ্দুর শান্ত থাকতে পারলো না। চিৎকার করে উঠলো,
“কেউ কি আছেন? আমরা ভেতরে আটকে গেছি”

কিন্তু সাড়া এলো না। তুলিকা তার বাহু আকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় করছে, কিন্তু প্রকাশ করছে না। এদিকে রোদ্দুরের মাঝে খানিকটা অস্থিরতা দেখা গেলো। সে দরজা ধাক্কাচ্ছে। ফলাফল শুন্য। রোদ্দুর বুঝলো, এখানে কেউ নেই। হয়তো, স্টোররুম বিধায় কেউ ভুলে আটকে দিয়েছে। আর বিদ্যুৎ না থাকায় সকলে মঞ্চের কাছেই আছে। এছাড়া আর কোনো যুক্তি নেই। ফলে না পেরে একে একে বন্ধুদের ফোন করতে লাগলো। ফোন বেজেই চলেছে অথচ কেউ ধরছে না। দরকারের সময় যে বন্ধু ফোন ধরে না, তাকে নিঃসন্দেহে বিভীষণ উপাধি দেওয়া যায়। রোদ্দুরের বন্ধুগণকে এখন বিভীষণের উপাধিটি ই দিতে ইচ্ছে করছে। বন্ধু সাথে নেই অথচ তাদের কোনো হেলদোল নেই। ফোন দেওয়া হচ্ছে অথচ একজন ও ফোন ধরছে না। কি এক মহা যন্ত্রণার মধ্যে পরলো। এর মাঝেই তুলিকা শান্ত গলায় বললো,
“আপনার মা আপনাকে খেতে দেয় না তাই না?”

তুলিকার প্রশ্নে অবাক চোখে তাকালো রোদ্দুর। বোঝার চেষ্টা করলো এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য। কিন্তু ব্যর্থ হলো। ফলে শান্ত গলায় বললো,
“কেনো?”
“কখন থেকে একটা দরজা খোলার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন, পারছেন না। দেখতে এতোটা কাবু লাগে না। একটু আপনি আমার থেকেও কাবু”

তুলিকার কথায় বেকুবের মতো চেয়ে রইলো রোদ্দুর। কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটি এতোটা শান্ত কন্ঠে তাকে সূক্ষ্ণ ভাবে অপমান করে দিবে কল্পনাও করে নি। রোদ্দুর স্মিত হেসে বললো,
“কাবু তো বটেই নয়তো বাচ্চা মেয়েদের কাছে কা/ম/ড় খাই?”
“আপনার স্বভাবে খান, কে বলেছিলো আমার হাত ধরতে?”

সাথে সাথে নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিলো তুলিকা। মেয়েটির উত্তরে এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো রোদ্দুর। তুলিকা এতে বিরক্ত হলো, একেই নিস্তদ্ধ তমসালীলা তার উপরে যদি কারোর ভুবন কাঁপানো হাসি হয় তবে ভয়ের মাত্রা বাড়ে বই কমে না। ফলে খানিকটা তেজী স্বরেই বললো,
“হাসছেন কেনো শুধু শুধু?”
“হাসতেও বুঝি কারণ লাগে?”
“অবশ্যই লাগে, নয়তো মানুষ পাগল বলে। সত্যি করে বলেন তো আপনাকে কি আমার রোগ ধরেছে?”
“ঠিক বলেছো, পাগলে পাগলে কাটাকাটি”

বলেই অট্টহাসিতে মেতে উঠলো রোদ্দুর। তুলিকা অবাক নয়নে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটিকে দেখছে। হাসলে কি কোনো মানুষকে এতোটা মোহনীয় লাগে! জানা ছিলো না তুলিকার। নীরব আঁধার আলোয় হাসি যেনো ঝংকার তুলছে। সেই সাথে ভয়ংকর পরিবেশটিও হয়ে উঠলো মোহনীয় সুন্দর।

তিতির ক্রমাগত ঘামছে। বিয়ে বাড়ির সোরগোল যেনো বিষের মতো লাগছে। বিগত পনেরো মিনিট যাবৎ সে তুলিকাকেই খুঁজে যাচ্ছে। কনেকে স্টেজের তোলার সাথে সাথেই কারেন্ট চলে গেলো। জ্যোতিময় বাড়িতে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। ফলে খানিকটা বিশৃঙ্খলা দেখা গেলো বিয়ে বাড়িতে। কনেপক্ষের মানুষের ভেতর জেনারেটর লাগাবার ব্যস্ততা শুরু হলো। কারেন্ট যাবার সাথে সাথেই তিতিরের উদ্বিগ্নতা বাড়লো। তুলিকা ভেতরে একা, ও যে অন্ধকারকে ভয় পায়। একদিন এই অন্ধকার ই তার জীবনের সকল জ্যোতি কেড়ে নিয়েছিলো। সেদিনের পর থেকেই অন্ধকারকে মেয়েটি সহ্য করতে পারে না। ফলে তিতির ফোনের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়েই ছুটলো ঘরের ভেতরে। বাঁধন তার অস্থিরতা দেখে শুধালো,
“অন্ধকারে কই যাস?”
“আপা ভেতরে একা, ও যে অন্ধকার ভয় পায়”

বাঁধন ও তার সাথে এলো। যা ভয় পেয়েছিলো তাই হলো, তুলিকা কোথাও নেই। একে একে সকল ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলো তারা। কিন্তু তুলিকা কোথাও নেই। তিতিরের উদ্বিগ্নতা মাত্রা ছাড়ালো। পাগলের মতো তিতিরকে খুঁজতে লাগলো সে। তিতিরের উদ্বিগ্নতা দেখে বাঁধনের মাও বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। অন্ধকারে মেয়েটি কোথায় গেলো! একেই বিয়ে বাড়ি, কত শত মানুষ। কোনো একটি অপ্রীতিকর ঘটনা তার মেয়ের বিয়ের আনন্দ মাটি করে দিতে সক্ষম। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বেশ কিছুসময়। কিছুক্ষণের মাঝে উপস্থিত মেহমানদের মাঝেও কথা ছড়িয়ে গেলো একটি মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মাঝে জেনারেটর লাগানো হলো। ফলে পুরো বাড়ি খোঁজা হলো তুলিকাকে। অপরদিকে প্রতীক শাহীনকে ডেকে বললো,
“রোদ্দুর কোথায় রে? কথা বলতে বলতে কি হাওয়া হয়ে গেলো?”
“আমিও তো দেখি নি ওকে। দাঁড়া ওকে ফোন দিচ্ছি”

ফোন বের করতেই দেখলো রোদ্দুরের আট নয়টা মিসকল। সাথে সাথেই রোদ্দুরকে ফোন দিলো সে। কিন্তু ফোনটি বন্ধ।

চার্জ না থাকার দরুন ফোনটা ধপ করে বন্ধ হয়ে গেলো। ফলে যা একটু আলো ছিলো তাও নিভে গেলো। গুমোট ঘরটিতে নেমে গেলো কৃষ্ণ আঁধার। তুলিকার নিভে যাওয়া ভয়টা আবারো জ্বলে উঠলো। কাঁপা স্বরে বলল,
“আলো জ্বালুন”
“আমার মোবাইলে চার্জ নেই, বন্ধ হয়ে গেছে”
“তাহলে দরজাটি খুলুন, এক্ষনি খুলুন”

তুলিকা কাঁপছে, তার স্বর দলা পাকাচ্ছে। আঁধারে দেখা না গেলেও রোদ্দুরের বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটি অশান্ত হয়ে উঠেছে। তুলিকার হাতের বাঁধন শক্ত হয়েছে। নখ বসে যাচ্ছে রোদ্দুরের হাতে। তার হাত ঘামছে। রোদ্দুর তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো,
“এখন ই আলো চলে আসবে তুলিকা শান্ত হও”
“আসবে না, আলো আসবে না। ওরা চলে আসবে”

ভীত কন্ঠে কথাটা বললো তুলিকা। তুলিকা এতোটা অস্থির হয়ে যাবে রোদ্দুর ভাবতে পারে নি। শান্ত গলায় বললো,
“কেউ আসবে না তুলিকা, আমি আছি তো”
“আপনি জানেন না কিছু, ওরা আপনাকেও মে/রে ফেলবে। যেমনটা ওরা ওকে মে/রে ফেলছিলো”
“কাকে মে/রে ফেলেছিলো?”

তুলিকা উত্তর দিলো না, বরং বসে কান চেপে ধরলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“তিতিরকে ডাকুন, আমি বাড়ি যাবো। আমি বাড়ি যাবো”
“তুলিকা শান্ত হও”
“আমি বাড়ি যাবো”

তুলিকার হাত পা কাঁপছে। রোদ্দুর তাকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারছে না। মেয়েটির শীতল হাত তাকে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। পাছে কোনো অঘটন না ঘটে যায়। এমন ই একটি রোগীকে গত পরশু রেখেছিলো সে। মহিলায় মেন্টাল ব্রেকডাউন ঘটে খিঁচুনী উঠেছিলো। ফলে ইঞ্জেকশন নিয়ে তাকে শান্ত করা হয়েছিলো। তুলিকার সাথে এমন কিছু ঘটলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। ফলে উপায়ন্তর না পেয়ে রোদ্দুর তাকে জড়িয়ে ধরলে। বুকের সাথে মিশিয়ে তীব্র স্বরে বলল,
“আমি আছি তুলিকা, কিচ্ছু হবে না তোমার”

তুলিকার প্রলাপ বন্ধ হলেও সে এখনো কাঁপছে। এর মাঝেই বাহিরে দরজা খোলার শব্দ কানে এলো। মূহুর্তেই খুলে গেলো বদ্ধ দরজা। ফলে আঁধারে ঘেরা ঘরটি হয়ে উঠলো আলোকিত। রোদ্দুর সেদিকে তাকাতেই দেখলো বেশ কজোড়া অপরিচিত চোখ তাদের দেখছে। তাদের চোখে ভীষণ কৌতুহল, কিঞ্চিত সন্দেহ এবং বিব্রতবোধ। এই দৃষ্টিটির কারণ রোদ্দুরের জানা। তবুও সে শান্ত রইলো। তুলিকাকে নিজ থেকে পৃথক করলো না। সেভাবেই আঁকড়ে রাখলো। এর মাঝেই তিতির ছুটে এলো। তুলিকাকে জড়িয়ে বলল,
“খুব ভয় পেয়ে গেছিলি তাই না?”

তুলিকা উত্তর দিলো না, শুধু বেড়ালের বাচ্চার মতো তিতিরের উষ্ণ আলিঙ্গনে লুকালো। রোদ্দুর উঠে দাঁড়ালো। এর মাঝেই বাঁধনে মা খানিকটা তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালেন,
“অন্ধকারে কি করছিলে তোমরা?”…………

চলবে