নীড় হারা পাখি পর্ব-০৯

0
282

#নীড়_হারা_পাখি
#৯ম_পর্ব

এর মাঝেই তিতির ছুটে এলো। তুলিকাকে জড়িয়ে বলল,
“খুব ভয় পেয়ে গেছিলি তাই না?”

তুলিকা উত্তর দিলো না, শুধু বেড়ালের বাচ্চার মতো তিতিরের উষ্ণ আলিঙ্গনে লুকালো। রোদ্দুর উঠে দাঁড়ালো। এর মাঝেই বাঁধনে মা খানিকটা তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালেন,
“অন্ধকারে কি করছিলে তোমরা?

রোদ্দুর মহিলার প্রশ্নে কিছুসময় তাকিয়ে রইলো। এটা ঠিক কোনো ধরনের প্রশ্ন সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলো সে। খুব ইচ্ছে করছিলো বলতে,
“ছু কিত কিত খেলছিলাম। আমি ছুউউউ বলে তুলিকার দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম, তারপর ও আমাকে আউট করার চেষ্টা করছিলো। ফলে দুজন দুজনকে আউট করার ধান্দায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম”

কিন্তু উত্তরটা দেওয়া হলো না। বন্ধুর শ্বাশুড়িরমায়ের সাথে তাহলে চূড়ান্ত পর্যায়ের বেয়াদবি হয়ে যাবে, তখন তিনি মুখে না বললেও কানে কানে ঠিক নিজের মেয়েকে বলবেন,
“জামাই এর সঙ্গ ভালো না, ডাক্তার হলেই কি ভালো ছেলে হয় নাকি!”

মেয়েও ব্যাপারটাকে খতিয়ে দেখবে এবং প্রতীকের কানের কাছে প্যান প্যান করে জানাবে যে রোদ্দুর কোন লেভেলের বেয়াদব। ফলে এতোকালের বন্ধুত্ব মুখের উপর সত্য বলার জন্য ভেঙ্গে যাবে। তাই এখানে সত্য কথাটা বলা ঠিক ভালো দেখাবে না। রোদ্দুর বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কপাল ঘষলো। শান্ত গলায় বললো,
“আমরা এখানে আটকা পড়ে গি্যেছিলাম। একেই ইলেক্ট্রিসিটি ছিলো না, দরজাটাও খুলছিলো না। হয়তো কেউ বাহির থেকে আটকে দিয়েছিলো। হেল্পের জন্য ফোনও করেছিলাম। আনফরচুনেটলি কেউ ধরে নি। সেকারণেই এখানে বসেছিলাম”
“একে অপরকে জড়িয়ে?”

বাঁধনের মা তীক্ষ্ণ স্বরে কথাটা বললেন। কথাটা বলার সময় তার মুখভঙ্গি একেবারেই পছন্দ হয় নি রোদ্দুরের। তার চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। অসম্ভব মাত্রার বিরক্তি জমলো। তার মুখশ্রীতেও সেই বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। তত সময়ে রোদ্দুরের অবন্ধুসুলভ বন্ধু শাহীন, জাহিদ সেখানে প্রবেশ করলো। তারা আশপাশ না লক্ষ্য করেই রোদ্দুরকে প্রশ্ন করে বসলো,
“তুই এখানে কি করছিস? তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। আর ফোন বন্ধ কেনো?”
“একমিনিট, সব প্রশ্নের উত্তর পাবি। ধৈর্য্য ধর”

রোদ্দুরের কথায় বেশ অবাক হলো তারা। আরোও অবাক হলো যখন কনে পক্ষের মোটামোটি বড় একটা সমাবেশ সেখানে মৌমাছির চাকের মতো জটলা পাকিয়েছিলো। ব্যাপারখানা যে কিঞ্চিত গুরুতর তাদের বুঝতে বাকি রইলো না। রোদ্দুর বাঁধনের মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“আন্টি, আমরা এখানে অনৈতিক কিছুই করছিলাম না। কোথায় কি করা উচিত সেই জ্ঞান আমার আছে! তুলিকা অন্ধকার ভয় পায়। যেকোনো মানুষ ই কিছু না কিছু ভয় পায়। যেহেতু ইলেক্ট্রিসিটি ছিলো না, আর আমরা কোনোভাবেই এই ঘুপছি থেকে বের হতে পারছিলাম না; তাই ওর শরীর খারাপ করছিলো। ডাক্তার হিসেবে আমার তখন যা করলে রোগী ট্যাকেল দেওয়া যাবে মনে হয়েছে আমি সেটাই করেছি। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন”

বাঁধনের মা চুপ থাকলেও তার পাশের ঘ/ষে/টি বেগমের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি চুপ রইলেন না। এতো গুরুতর সমস্যায় দুকথা না বললে বড্ড বেমানান লাগে। নিজের গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা মোটেই তিনি ভুলবেন না। তাই তিনি বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠলেন,
“জড়িয়ে ধরে চিকিৎসা করছিলে? বাপের জন্মে শুনি নি”
“এমন অনেককিছুই আমরা বাপের জন্মে শুনি না আন্টি। তাই কি শুনেছেন বা শুনেন নি সেটাকে সত্য ধরা উচিত নয়। এখন আমি যদি বলি, Pneumonoultramicroscopicsilicovolcanoconiosis কি? আমার মনে হয় না এখানের সকলেই সেটা শুনেছে বা জানে! কোন রোগীকে ঠিক কেমন চিকিৎসা দিলে সে সুস্থ থাকবে সেটা নিশ্চয়ই আমিই ঠিক করবো। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, এই দরজা টি ভেতর থেকে আটকানো পেয়েছেন? আশাকরি না। নিশ্চয়ই অশোভন কোনো কাজ করলে সেটা অন্তত ভেতর থেকে খোলা থাকতো না। যাক গে আন্টি, আমি কথা বলতে এসেছিলাম, কারণ বাহিরে অনেক সোরগোল ছিলো। আমার বন্ধুরা সাক্ষী, আর আমি তাদের ফোন ও করেছি। তারা ধরে নি। সেটাও অস্বীকার করতে পারবে না কেউ, কি শাহীন? জাহিদ?”

শাহীনকে এর মাঝে টানতেই সে হকচকিয়ে উঠলো। কিছুটা অপ্রস্তুত স্বরে বললো,
“হ্যা”
“আমার ফোন অফ হবার কারনে ওদের সাথে যোগাযোগ হয় নি। একারণেই এতোটা সময় আমি আর তুলিকা এখানে আটকানো। আর আপনাদের যদি আরোও তদন্ত থাকে তবে প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি করবেন। মেয়েটার শরীর ভালো নেই। ওকে এখন বাসায় পাঠানোটা জরুরি”

বাধনের মার পাশের মহিলার মুখখানায় আষাঢ়ের মেঘ মেদুর জমলো। সে তার যুক্তিতর্কে এগোতে পারছে না। কারণ সত্যি দরজাটা বাহির থেকে আটকানো ছিলো। তারাই খুলেছে। মহিলার মিয়ে যাওয়া মুখখানা কিছুটা হলেও রোদ্দুরকে প্রশান্তি দিলো। রোদ্দুর তাই তাদের পেছনে সময় নষ্ট করলো না। বরং তিতিরের দিকে তীর্যক দৃষ্টি প্রয়োগ করলো। খানিকটা কড়া স্বরে বললো,
“বান্ধবীর বিয়ে বলে বোনের দায়িত্ব ভুলে যাওয়াটা ঠিক নয় তিতির। আমি আগের দিনও তোমাকে বলেছি তুলিকার খেয়াল রাখবে। দায়িত্ব নিলে সেটাকে পালন করতে শিখো। এখনো কি বিয়ে খাওয়ার শখ আছে না বাড়ি যাবে?”
“জ্বী বাড়ি যাবো”
“এগোও, আমি আসছি”

রোদ্দুরের তীর্যক দৃষ্টি এবং শীতল কন্ঠের কড়া ধমকে তিতিরে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলো না। এদিকে ঘোলা চোখদ্বয় অপলক দৃষ্টি টিকিয়ে রেখেছে সৌম্যপুরুষটির দিকে। কোথাও না কোথাও ভয় ছিলো সে বুঝি আবারও কটুক্তির বানে ঝ/ল/ছে যাবে। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। পুরুষটি সবকিছু সামলে নিলো। এই প্রথম কেউ কথা রাখলো! “সে সত্যি আছে”

মৌচাক খানিকটা খালি হতেই শাহীন টেনে ধরলো রোদ্দুরের বাহু। ফিসফিসিয়ে বললো,
“কাহিনী কি রে?”
“মোবাইলটা যদি কথা বলার জন্য ব্যবহার করার ইচ্ছে না থাকে তবে ফেলে দে। এমন মোবাইল আর বন্ধু না থাকলেও খুব একটা যায় আসবে না”

বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো রোদ্দুর। শাহীন যেনো বেকুব বনে গেলো রোদ্দুরের আচারণে। অবাক স্বরে বললো,
“ও চটে গেলো কেনো?”

******

সোডিয়াম আলোয় রাঙ্গানো পিচের চিরে এগোচ্ছে সিএনজি। সাই সাই করে শীতল হাওয়া বইছে। আকাশে আজ চন্দ্রিমা দর্শনের উপায় নেই। ফলে কালো আকাশটা যেনো আরোও অধিক কালো লাগছে। সিএনজি থেকে খানিকটা মুখ বাহির করে রয়েছে রোদ্দুর। শীতল হাওয়া লোমকূপ কাঁপালেও মন্দ লাগছে না। পাশে বসে রয়েছে তুলিকা। সে বোকা চোখে রোদ্দুরকে দেখছে। তার ও মন্দ লাগছে না তিতির খানিকটা আঁটসাঁট ভাবে বসে রয়েছে। সে রোদ্দুর ভাই এর কাছে আর ঝাড়ি খেতে ইচ্ছুক নয়। সিএনজি যখন থামলো, তড়িঘড়ি করে বের হলো তিতির। ভাড়া দিতে চাইলেই রোদ্দুর বলল,
“রেখে দাও”
“মা বকবে”
“বলো না তাহলে”

তিতির কথা বাড়ালো না। রোদ্দুর ভাড়া মিটিয়ে তুলিকার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“বাসায় যেয়ে এই ঝঞ্জাট ছেড়ে শুয়ে পড়বে। আজ যেনো তোমাকে বারান্দায় না দেখি। ঠান্ডা পড়েছে”

তুলিকা হ্যা না কিছুই বললো না। শুধু ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলো। রোদ্দুর ও অপেক্ষা করলো না। সে হাটা দিলো নিজের বাড়ির দিকে। তখন ই মনে হলো কেউ কোর্টের হাতা টেনে ধরলো। পেছনে তাকাতেই দেখলো তুলিকা তার কোর্টের হাতা টেনে দাঁড়িয়ে আছে। রোদ্দুর স্মিত হেসে বললো,
“কিছু বলবে?”
“আপনি আমার সাথে এতোটা ভালো আচারণ করেন কেন? দূরছাই করেন না, খারাপ ব্যাবহার করেন না। আমাকে দয়া করছেন বুঝি?”

তুলিকার শান্ত প্রশ্নে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রোদ্দুর। হ্যা, সে সত্যি তুলিকার সাথে খারাপ ব্যাবহার করে না, ভালো আচারণ করে। স্বার্থপর পৃথিবীতে এটা বিরল ব্যাপার। পরিবার ব্যাতীত যারা এমন করে তারা হয় সমবেদনার খাতিরে করে, নয় তাদের মারাত্মক বাজে উদ্দেশ্য থাকে। তুলিকার থেকে উদ্দেশ্য হাসিলের মানসিকতা রাখে না রোদ্দুর। তবে কি দয়ার জন্য করা! সেটিও নয়। তুলিকার প্রতি তার এই আচারণের কারণটি ঠিক কি তা রোদ্দুর নিজেও জানে না। তবে সেটা আর যাই হোক দয়া নয়। রোদ্দুর নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বললো,
“তুমি আমার কেনো কারোর ই দয়ার যোগ্য নও। সুতরাং তোমাকে দয়া করার সাধ্য আমার নেই”
“তাহলে কেনো এতো ভালো ব্যাবহার?”
“তোমাকে বললেও বুঝবে না। তাই তোমাকে আমি বলবো না। যেদিন বুঝবে সেদিন বলবো”

রোদ্দুরের কথাগুলো মনোঃপুত হলো না তুলিকার। বরং রাগ হলো, ভীষন রাগ। তাই তো সে আর দাঁড়ালো না। হনহন করে হেটে ভেতরে চলে গেলো। মেয়েটির কাজ অনিমেষ চাহনীতে দেখলো রোদ্দুর। তার ঠোঁটের কোনের হাসিখানা চওড়া হলো যেনো। তারপর অলস পা বাড়ালো নিজের বাড়ির দিকে। এদিকে একজনের মনে সন্দেহ বীজের অংকুরোদগম হলো। কেনো যেনো মনে হলো, এই শান্ত পরিবেশটা খুব দ্রুতই বদলে যাবে। বদলে যাবে চাহিদা, হৃদয়ের কামনা____

****

মধ্যরাত। বাতাসের বেগ বেসামাল। দামাল হাওয়ায় উড়ছে সুরভীর অবাধ্য কেশ। কালো রজনীতে জানালার ধারে বসে রয়েছে সে। কালো নয়ন দেখছে, নিঃস্ব কালো রজনী। পাড়ার মোড়ের সোডিয়াম লাইটটাও যেনো হার মেনেছে এই আঁধারে। গায়ে সোয়েটার নেই, শাড়ির আঁচল অযত্নে কাঁধে পড়ে আছে। চোখগুলোর জল এখনো শুকায় নি। ক্লান্ত চোখে ঘুম নেই। ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নগুলো খুঁজছে সে। এমন সময় কারোর পায়ের ধ্বনি এলো। কিন্তু সুরভী নির্বিকার। মানুষটি মোটা চাঁদর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
“ঘুমাবে না?”
“ঘুম আসছে না”

খামখেয়ালী উত্তর পছন্দ হলো না তুরানের। শীতল স্বরে বললো,
“চোখে ক্লান্তি আর বলছো ঘুম আসছে না?”
“ক্লান্তি আর ঘুম এক?”
“এখন কি ধাঁধা জিজ্ঞেসের সময়?”
“সময়? আচ্ছা তুরান আমার জন্য তোমার সময়টা কি আদৌও হয়?”

বিদ্রুপের স্বরে কথাখানা বললো সুরভী। তুরানের কথাটা ভালো লাগলো না। রাত তিনটের সময় স্ত্রী এমন অদ্ভুত আলাপ করলে সেটা কারোর ই ভালো লাগবে না। আগামীকাল সকালে অফিস আছে। সুতরাং এই ছেলেমানুষীর মানে নেই। তুরানের স্বর গম্ভীর হলো,
“ঘুমাতে চলো। রাত বিরাতে ছেলেমানুষী ভালো লাগে না”
“একেবারেই ঘুমাতে চাই, তোমাকে ছেলেমানুষী থেকে মুক্তি দিতে চাই……………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি