নীড় হারা পাখি পর্ব-১০

0
285

#নীড়_হারা_পাখি
#১০ম_পর্ব

রাত তিনটের সময় স্ত্রী এমন অদ্ভুত আলাপ করলে সেটা কারোর ই ভালো লাগবে না। আগামীকাল সকালে অফিস আছে। সুতরাং এই ছেলেমানুষীর মানে নেই। তুরানের স্বর গম্ভীর হলো,
“ঘুমাতে চলো। রাত বিরাতে ছেলেমানুষী ভালো লাগে না”
“একেবারেই ঘুমাতে চাই, তোমাকে ছেলেমানুষী থেকে মুক্তি দিতে চাই। কিন্তু নিরুপায় আমি, আমার হাতে সে ক্ষমতা নেই”

সুরভীর কন্ঠে সুপ্ত অভিমানের রেখা। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অশ্রু নামক দূর্বলতা সে তুরানকে দেখাতে চায় না। তুরান এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তার সুগাঢ় নয়ন অনিমেষ দৃষ্টিতে দেখছে সুরভীকে। মেয়েটি কাঁদছে। স্বামী হিসেবে তার উচিত তাকে স্বান্তনা দেওয়া, তার ব্যথিত হৃদয়ে উষ্ণ পরশ দেওয়া। তার অশ্রুসিক্ত আঁখি মুছে দেওয়া। কিন্তু এমন কিছুই করলো না তুরান। মেয়েটিকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখাটা তার নিতান্ত অপছন্দের কাজ। নিজেকে তখন পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানবের একজন মনে হয়। সুরভীর কষ্টের উৎস তার অজানা নয়। কিন্তু তার করণীয় কিছুই নেই। সে চাইলেও এই দুঃখমোচন করতে পারবে না। মেয়েটির প্রতি তার দয়া হয়। মেয়েটির ধৈর্য্যক্ষমতা তাকে বিরক্ত করে। তার স্থানে অন্য কেউ থাকলে এতোদিনে নিজের রাস্তা মেপে নিতো। তুরান সুরভীকেও সেই সুযোগ বহুবার দিয়েছে। এই সংসার নামক শিকল থেকে মুক্ত দেবার চেষ্টা সে কম করে নি। কিন্তু জেদী মেয়েটি তার একটি কথাও শুনে নি। অভাব নামক কালো মেঘে ঘেরা এই নীড়ে দাঁত কামড়ে পরে রয়েছে। ফলে সুখ নামক নীড়ের খোঁজটি তার পাওয়া হয় নি। তুরান তাকে কখনোই সুখের নীড়ের ঠিকানা দিতে পারবে না, কারণ সে সর্বপ্রথম এই পরিবারের বড় ছেলে। বড় ছেলে নামক পদটি তার কোনোকালেই কাম্য ছিলো না। অনেকে বলে বড় হওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ তার জন্ম সবার প্রথম হয়। সবার ভালোবাসার উপর তার আধিপত্য থাকে সবথেকে বেশি। কিন্তু তুরানের ক্ষেত্রে ঘটনাটি ব্যতিক্রম। তার বুঝ হবার পর থেকেই দায়িত্ব নামক বোঝার রশি তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে শেখানো হয়েছে, “তোমার ভাইবোন রয়েছে, আমাদের পর তাদের দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। বড় ভাই তুমি তাদের, বড়ভাইদের নিজের সুখের কথা ভাবতে নেই”। ফলে ছোটবেলা থেকেই তুরানের পরিচয় এই বাড়ির বড়ছেলে। নিজের ইচ্ছে, স্বপ্ন সবকিছুর গলা টিপে হ/ত্যা করেছে সে। তার নিজস্ব কিছু নেই। ফলে মানুষের চামড়ার ভেতরে একটি ইচ্ছেহীন জড় পদার্থ সে। তার দুঃখ নেই, সুখ নেই, লক্ষ্য নেই। এই শুষ্ক, বেরং জীবনে হুট করেই একদিন রংধনুর আবির্ভাব হলো সুরভীর রুপে। চুপচাপ, শান্ত, তুলতুলে একটি মেয়ে। টানাটানা পরিষ্কার চোখে নিজের প্রতিবিম্বটা দেখে মনে হয়েছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ সে। সুখ নামক পেজো তুলোর গন্ধ সেই প্রথম পেয়েছিলো তুরান। কিন্তু মেঘ যে কেবলই জমাট হয়ে থাকা হাওয়া। ছুতে গেলেই মিলিয়ে যায়। তুরানের ক্ষেত্রেও তাই হলো। তুলিকার অসুস্থতা, বাবার দেনা, তিমিরের বেখেয়ালী স্বভাব সব কিছু সুখী হবার ইচ্ছেটিকে আবারোও মেরে ফেললো। ফলে তুরান পুনরায় নিজেকে বানিয়ে ফেললো জড় বস্তু। এই যন্ত্রের সাথে সুরভী নামক মেয়েটির জীবনটাও বেরং হয়ে উঠলো। হারিয়ে গেলো তার সুবাস। মেয়েটি যেদিন প্রথম আবদার করেছিলো, “আমাদের মাঝে ক্ষুদ্র একজনকে আনা যায় না?”

তুরান নিষ্ঠুরতার সাথে বলেছিলো, “আমি চাই না আমাদের কোনো সন্তান হোক। তিন সন্তানকে কে পালতে পালতে আমি ক্লান্ত”।

সুরভী সেদিন ও কেঁদেছিলো। সুগাঢ় নয়নে সেদিন ও জমেছিলো নোনাজলের লহর। সুরভীর অশ্রু এতোটা আহত করবে জানা ছিলো। ইচ্ছে করছিলো মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরতে, বলতে, “আমার এখানে ভালো লাগে সুরভী, আমি সুখী হতে চাই। আমার সাথে পালিয়ে যাবে?”

কিন্তু বলা হয় নি। বরং চরম অমানুষের মতো বলেছিলো,
“সুরভী, তুমি বরং আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারবো না। আমার সাথে থাকলে একদিন নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হবে। আমার জীবন সুখ, ইচ্ছে, স্বপ্ন নামক কোনো শব্দ নেই। অন্ততঃ আমার সাথে থেকে নিজেকে শেষ করো না। আমি খুব করে চাই তুমি সুখী হও”

সুরভীর কান্না কমার বদলে সেদিন বৃদ্ধি পেয়েছিলো। টানা টানা চোখে অভিমানের কালবৈশাখী উঠেছিল। কান্নার দমকে কথাও বলে নি সে। উঠে চলে গিয়েছিলো। তুরান ভেবেছিলো, ভালোই হলো। মেয়েটি এখন নিজেকে গুছিয়ে নিবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং এই অভাব জঞ্জালে নিজেকে বেঁধে রাখলো সে। আর প্রতি মূহুর্ত মনে করিয়ে দিতে লাগলো তুমি একজন ব্যর্থ স্বামী। তুমি ছেলে ভালো, ভাই হিসেবে ভালো কিন্তু স্বামী হিসেবে ঢাহা ফেল।

তুরান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। ধীর কন্ঠে বললো,
“এখনো সময় আছে সুরভী। মুক্তির পথ এখনো খোলা”
“আমি তো মুক্তি চাই না তুরান, আমার চাওয়াটা যে স্বল্প। আমি শুধু তোমাকে চাই। আমি তো তোমাকে ভালো ছেলে হতে মানা করি নি, বলি নি তোমার সবকিছু জুড়ে আমার আধিপত্য হবে। শুধু চেয়েছি সবার ভেতর আমাকেও রাখো। আমিও তোমার স্নেহ চাই, তোমার যত্ন চাই। খুব বেশি সেগুলো?“
“তোমার কাছে যা সামান্য তা আমার কাছে এক আকাশ সম। সবার দ্বারা যে সব হয় না”
“আমি বাচ্চা নেবার জেদ ছেড়ে দিবো, কিন্তু এই শুন্য হৃদয় যে আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। আমার বুকের ভেতরের নিঃসীম ভালোবাসাটা বাঁচার আকুতি করছে। আমি যে ভালোবাসার কাঙ্গাল।“

তুরান উত্তর দিলো না। নতমস্তক দাঁড়িয়ে রইলো। সুরভীর রাগ হলো। বিষাদ, বেদনা, ক্রোধ তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ঘুরে দাঁড়ালো সে। তুরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি নিষ্ঠুর, অমানুষ”

তার কন্ঠের রোষ স্পর্শ করছিলো তুরানকে। কিন্তু সে নীরব রইলো। সুরভী চোখ মুছে বিছানায় চলে গেলো। তুরান অনিমেষ নয়নে তাকালো সুরভীর দিকে। তার অভিমানী শ্যাম মুখখানা মানসপটে এঁকে নিলো। মনে মনে বললো,
“আমি যে স্বার্থপর সুরভী, খুব স্বার্থপর”

********

পিঠে পুলির উৎসবে মুখরিত কলেজ প্রাঙ্গন। মেয়েরা আজ রঙ বেরঙ্গের শাড়ি পরেছে। শীতের প্রাণহীন বিকেল যুবক যুবতীর উচ্ছ্বাসে হয়ে উঠেছে প্রানবন্ত। তিতির ও আজ সবুজ রঙ্গের একটি শাড়ি পরেছে। গাদা ফুলের মালা লাগিয়েছে মোটা খোঁপায়। বান্ধবীদের সাথে পিঠে খাবে সে। সুরভী আসার সময় তার হাতে দুশো টাকা গুজে দিয়েছে। বলেছে,
“যা ইচ্ছে খাস”

তিতির ও সেই আনন্দে আত্মহারা। নাচতে নাচতে বান্ধবীদের সাথে এসেছে সে। কিন্তু আনন্দে পুরো মাটির তেল পড়ে গেলো যখন দেখলো স্টলের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে সৌভিক বসে আছে। ছেলেটিকে মোটেই সহ্য হয় না। দেখলেই পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে যায়। গতবার এই লোকের জন্য তার জুতোর গচ্ছা দিতে হয়েছে। এখন আবার এখানে এসেছে সকলের আনন্দে বা হাত ঢোকাতে। অনার্সের ছেলেপুলেরা দিয়েছে পিঠে পুলির স্টল। এক একটা ভাপা পিঠের দাম বিশ টাকা। অথচ বাহিরে এই পিঠে দশ টাকায় পাওয়া যায়। যখন ই ক্ষুদে ক্ষুদে মানুষ সেটার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছে, তাদের অধিপতি সৌভিক বেশ সুন্দর অংকের যুক্তি দিয়ে দিচ্ছে,
“এই যে স্টল, এতে খরচা হয়েছে হাজার দুই। এই যে পিঠে সেটা বানাতে খরচা গেছে আরোও দুই হাজার। এখন পিঠের দাম তো দশ ই আছে শুধু স্টলের দামটা যোগ করা হয়েছে। এখন স্টল না বসাতে পিঠে পেতে কই?”

এই যুক্তিটি তিতিরের কাছেও দিলো সে। তিতি্র ও কম নয়, এবার তাকে ছেড়ে দিবে না। সৌভিক যদি বুনোওল হয় তবে তিতির বাগা তেতুল। সেও সুন্দর মতো স্টলের কানের বয়ামে রাখা পিঠেগুলো গুনতে থাকলো। সৌভিক এতে বেশ অবাক হলো। সব গুনে সে বললো,
“এখানে মোট ছয়শত বিশটা পিঠে আছে। আমি যদি দু হাজার দিয়ে ছয়শত বিশ ভাগ দেই তাহলে খরচা পড়ে তিনটাকা বাইশ পয়শা। এখন যদি স্টলের খরচা বিবেচনা করেও যোগ নেই তাহলে খরচা পড়ে সাড়ে ছয়টাকা। তাহলে তার বিনিময়ে আপনি বিশ টাকা কি করে নেন? বাহিরের মামা তো এই পিঠে আমাদের কাছে দশ টাকায় বেঁচেন। কলেজের অনুষ্ঠান। আমরা এই কলেজের ছাত্র-ছাত্রী। তাহলে তো আরোও কম টাকায় আপনি বিক্রি করবেন। কলেজের ছাত্র অথচ জুনিয়রদের সাথে ডা/কা/তি?”

তিতিরের যুক্তিতে মোটামোটি সকলেই একমত। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের তো লুটা হচ্ছে। সৌভিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো তিতিরের দিকে। কিন্তু এতে তিতির ঘাবড়ালো না। বরং সে নির্ভীক ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো সৌভিকের সামনে। বন্ধু লিটন ফিসফিসিয়ে বললো,
“এই মেয়ে তো জনগন খেপিয়ে দিচ্ছে”
“থাম দেখছি”

এবার সৌভিক একটু গলা খাকারি দিলো। তারপর তিতিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
“তোমার অংকের হিসেব ভালো। কিন্তু তুমি যে ভুল করে ফেললে। আমি তো শুধু সরঞ্জামের হিসেব দিয়েছি। যারা এতো কষ্ট করে পিঠে বানানো তার পারিশ্রমিক ধরবে না। নিতান্ত গরীব খালা, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তার পারিশ্রমিক মেরে দিয়ে পিঠে খাবে? ছি ছি এই তুমি কলেজের ছাত্রী? আমাদের কলেজের নাম বীরবিক্রম আব্দুস সালাম কলেজ। একজন বীরবিক্রমকে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে এই কলেজের নির্মাণ। এখানের ছাত্রী হয়ে তুমি কারোর পারিশ্রমিক মেরে দিবে? আমাদের তো উচিত শেফালী খালাকে আরোও বেশী সহায়তা করা। এক একটা পিঠে ডাবল দামে কেনা। বিশ টাকা তো খুব কম”

সৌভিকের বক্তৃতায় সবার মন গললো। কেউ কেউ তো আবেগে ভেসে চল্লিশ টাকায় পিঠে কিনতে লাগলো। এমন কি তিতিরের বান্ধবীও সেই কাজ ই করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তিতির গললো না। বরং সে বলল,
“হুম, ঠিক বলেছেন। আমাদের উচিত শেফালী খালাকে সহায়তা করা। তাই যখন পরিশ্রমিক দিতে যাবেন তখন আমরা সবাই যাবো। আমি তো যাবোই। ভিডিও করে নিয়ে আসবো। আজকাল তো এমন ভালো মানুষ পাওয়া যায় না। তাই আমি চাই আপনার এই মহৎ সবাই দেখুক। কি সৌভিক ভাই, আমাকে নিয়ে যাবেন তো?”

তিতিরের কথায় কপালে ভাঁজ পড়লো সৌভিকের। মেয়েটি তাকে কিস্তিমাত করে দিলো। ফলে পিঠে উৎসব শেষ বাধ্য হয়ে তিতিরকে নিয়ে যেতে হলো তাকে বানানো শেফালী খালার কাছে। তাকে টাকার দেবার ছবিও তুললো তিতির। তারপর পৈশাচিক হাসি অক্ষত রেখে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। লিটন পাশ থেকে বললো,
“ভাবছিলাম এই এক উৎসবে লাভে লাভ হবে। এই মেয়ে আমাদের লাভ টাই গিলে দিলো”
“চিন্তা করিস না, এক মাঘে শীত যায় না”

******

কুয়াশা ঢাকা ভোর। সূর্যের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। শুকনো পাতায় রাস্তার কোনে ভরে গেছে। এই শীতে ঝাড়ুদারেরা নিজের সময় ভুলে নি। শো শো করে ঝাড় দিচ্ছে রাস্তা। তিমির নাইট শিফট করে বাড়ির পথে যাচ্ছে। এমন সময় তাকে কেউ পেছন থেকে কেউ ডাকলো। পেছনে ঘুরেই দেখলো মোটা খাদি শাল জড়িয়ে আছে রোদ্দুর। হাতে পাউরুটি আর ডিম। শালটা একটু নামিয়ে বলল,
“কেমন আছো তিমির?”
“ডাক্তারবাবু দেখি, এই তো চলছে”
“অফিস থেকে ফিরলে?”
“হ্যা, এখন বাড়ি যেয়ে ঘুম। দশটায় কলেজ আছে। তোমার কি অবস্থা?”
“এই তো অফ ডে। ডিম কিনতে এসেছি”
“আচ্ছা, তাহলে বাড়ি যাও। আমিও যাই”
“একটা কথা ছিলো”

রোদ্দুর ইতস্ত কন্ঠে বললো। তিমির ও খানিকটা অবাক হলো। কৌতুহল ও জাগলো। শুধালো,
“বলো, কি কথা?”
“কথাটা তুলিকার ব্যাপারে………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি