নীড় হারা পাখি পর্ব-১১+১২

0
289

#নীড়_হারা_পাখি
#১১তম_পর্ব
(প্রাপ্ত বয়স্কমনাদের জন্য)

রোদ্দুরের ইতস্ত কন্ঠে তিমির ও খানিকটা অবাক হলো। কৌতুহল ও জাগলো। শুধালো,
“বলো, কি কথা?”
“কথাটা তুলিকার ব্যাপারে”

তুলিকার নাম শুনতেই তিমিরের কপালে ভাঁজ পড়লো। দৃষ্টি সরু হলো। বোনটি তার ঘরের চার দেওয়ালেই বন্দি থাকে।। নিতান্ত জেদ বা প্রয়োজনীয়তা ব্যতীত তুলিকাকে ঘর থেকে বের করা হয় না। সুতরাং রোদ্দুরের মুখে তুলিকা নামটি বড্ড বেমানান। হ্যা, এটা ঠিক মাস খানেক পূর্বে তুলিকা তার হাতে কা/ম/ড় বসিয়ে দিয়েছিলো। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোদ্দুরের মা শাহানা বেগম এক চোট দহরমমহরম কান্ড বাধিয়েছেন। রোদ্দুর কি সে ব্যাপারেই কিছু বলবে! কিন্তু রোদ্দুরের আচারণ কখনোই এমন নয়। সে সর্বদাই শান্তিপ্রেমী মানুষ। বই এর মাঝে মুখ গুজে থাকা যুবকটিকে পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডায় খুঁজে পাওয়াই ভার। ডিউটি, হাসপাতাল, বাড়ি এই শব্দগুলোই যেনো তার শব্দকোষে খুঁজে পাওয়া যায়। কোন্দল, ঝামেলা, ঝগড়া, বন্ধু, প্রেম, মারামারি শব্দগুলোর অস্তিত্বই যেনো নেই সেই শব্দকোষে। পাড়ার সকলের প্রিয় ছেলেটির আচারণে নাকি তার বাবার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। রাহাত সাহেব বরাবর ই অতি সুশীল ব্যাক্তি, আচারণ কথাবার্তা মার্জিত। সুতরাং রোদ্দুর তুলিকার মানসিক অবস্থা নিয়ে মন্তব্য করার মানুষটি ই না। তিমিরের চিন্তার ঘোরে ছেদ পড়লো রোদ্দুরের কথায়,
“কি ভাবছো? অনুমতি দিলে বলি?”
“দেখো রোদ্দুর ভাই, বোনটা আমার সকলের মতো নয়। জানি ও তোমাকে কা/ম/ড়ে ছিলো। কিন্তু ওর জন্য মনে ক্ষোভ রেখো না”
“তোমার সত্যি মনে হয় আমি সেই ব্যাপারে কথা বলবো?”
“সেই ব্যাপারে না?”
“না”
“তাহলে?”

তিমিরের উৎকুন্ঠা বাড়লো। রোদ্দুর একটু গাঢ় নিঃশ্বাস নিলো। কথাগুলো গুছাতে সময় লাগলো তার কয়েক মিনিট। তারপর একটু গম্ভীর গলায় বললো,
“আমি তুলিকার চিকিৎসা করতে চাই”

রোদ্দুরের কথা বোধগম্য হতে সময় নিলো তিমিরের মস্তিষ্ক। বিমূঢ় কন্ঠে বললো,
“মানে?”
“মানে টা খুব একটা জটিল নয়। বর্তমানে আমি মনোরোগ নিয়ে পড়াশোনা করছি বহুদিন। আমার ট্রেনিং ও চলছে। সুতরাং তুলিকাকে আমি সাধ্যমত সাহায্য করতে পারবো। আমার সিনিয়রও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সুতরাং আশা রাখছি তুলিকা সুস্থ হয়ে যাবে”
“হঠাৎ এই প্রস্তাবের কারণ?”
“ভাবছো তোমার বোনকে গিনিপিগ বানাবো?”
“না, কৌতুহল হচ্ছে। আসলে স্বার্থপর দুনিয়ায় আদৌও কি কেউ নিঃস্বার্থভাবে উপকার করে? তাই জিজ্ঞেস করলাম”
“বুজেছি। তুলিকা আমার প্রোফাইলের জন্য অনেক হেল্পফুল হবে বটে, কিন্তু সেকারণে আমি এই অফার দেই নি। তুলিকা ব্যতিক্রম, আলাদা কিন্তু অনন্য। নিষ্পাপ মেয়েটির একটি সুন্দর জীবন প্রাপ্য। আমার ভালো লাগে না ওকে এভাবে গুমড়ে গুমড়ে বাঁচতে দেখতে। কষ্ট হয়। হয়তো এটা আমার প্রফেশনের জন্যই। হয়তো সারাটাদিন জীবন যুদ্ধে পরাজিত মানুষদের দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। তাই একটা ফুলকে বাঁচানোর ইচ্ছে জেগেছে। চিন্তা করো না, আমি তুরান ভাই এর সাথেও কথা বলবো”
“লাভ হবে না”

তিমিরের নেতিবাচক উক্তিতে খটকা লাগলো রোদ্দুরের। হতবিহ্বল চাহনীতে তাকালো সে তিমিরের দিকে। নিস্প্রভ স্বরে বললো,
“কেনো?”
“ভাই কেনো, আমরা কেউ চাই না তুলিকা সুস্থ হোক”
“ফাজলামি নাকি?”
“ফাজলামি কেনো হবে? এটাই সত্য”

রোদ্দুরের মাথাটা যেনো ঝিম ধরে গেলো। চোখ মুখ খিঁচে প্রচন্ড রোষের প্রতিফলন দেখা গেলো মুখশ্রীতে। ক্রোধ দমিয়ে আবারো বললো,
“নিজের সামনে একটা নিষ্পাপ মেয়েকে এভাবে ছন্নছাড়া জীবন দিতে বাধছে না তোমাদের?”
“না, কারণ এতে করে অন্তত ও বেঁচে আছে। ও সুস্থ হলে আমার বোনটি হারিয়ে যাবে। ডাক্তারবাবু, দুনিয়াটা অনেক নিষ্ঠুর। অনেক বেশী নিষ্ঠুর”

******

২০২০ সাল, ঠা ঠা রোদ্দুরে তপ্ত সকাল। কাঠ পাথরের দেওয়াল গুলোও নিষ্প্রাণ। নিষ্ঠুর গরম শুষে নিয়েছে তাদের অন্তরাত্মা। বাতাসের গতি মন্থর। কচি পল্লবগুলো পানির জন্য তৃষ্ণার্ত। যান্ত্রিক জীবনে নিরন্তর যুদ্ধরত মানুষগুলোও হাপিয়ে উঠেছে রোদের প্রখরতা। বারান্দা থেকে কতটা মলিন দেখাচ্ছে এই শহরকে। তুলিকা একটা ছোট্ট নিশ্বাস গোপন করলো। তিতির শব্দ উচ্চারণ করে পড়ছে, “জাইগোট কোষটি স্পোরোফাইটের প্রথম কোষ”। এই লাইটটি এতোবার পড়েছে যে তুলিকার মুখস্থ হয়ে গেছে। এই মেয়েটি কখনোই নিঃশব্দে পড়তে পারে না। যখন ই পড়ে চেঁচিয়ে দুনিয়া জানিয়ে। তার মতে এতে করে মা ঠান্ডা থাকবে। মাও খুশি সেও খুশি। তুলিকার এতে বিরক্তিটা বাড়লো কিঞ্চিত। একেই গরমে মেজাজ খিটখিট লাগছে উপরন্তু এই মেয়ের চিৎকার। কিছু বলতে যাবে তখন ই সুরভী ঘরে এলো। তাকে বেশ প্রসন্ন লাগছে। গদগদ কন্ঠে বললো,
“তুলি, তৈরি হ। শাফিন আসছে”

শাফিনের নামটি শুনতেই তুলিকার হৃদয়ের খরা জমিনে এক পশলা শীতল বারিপাত হলো। শাফিন ছেলেটির সাথে তুলিকার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনে তুলিকার ফাইনাল পরীক্ষা, এর পর ই বিয়ে। যদিও বিয়ের জন্য তুলিকা অনেক ছোট, তবুও ভালো ছেলে হাতছাড়া করতে চান না শফিক সাহেব। শাফিন নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে। ছেলে বিদেশে ভালো চাকরি করে। ভালো বেতন তার। দুমাস হয়েছে সে দেশে এসেছে। শাফিনের পরিবারও অনেক ভালো। কারণ সম্বন্ধটি শফিক সাহেবের এক কলিগ এনেছেন। শাফিন এবং তার পরিবার বিয়ের পর তুলিকাকে পড়াশোনার সুযোগও দিবে। তাহলে এমন ছেলেকে কি হাত ছাড়া করা যায়? তাই বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। তুলিকার ও শাফিনকে ভালো লেগেছে। প্রথমে অনেক প্রশ্ন জড়ো ছিলো কিন্তু মানুষটির সাথে দেখা হবার পর থেকেই সব প্রশ্নগুলো গলে গিয়েছে। এতোটা অমায়িক মানুষ হয় বুঝি। লোকটি যখন বলেছিলো,
“তুমি কি আমায় ভয় পাচ্ছো? ভয় নেই। আমি তোমার অমতে কিছুই করবো না। তুমি না করে দিলেও আমি জোর করবো না। তবে আফসোস হবে। চাঁদ না পাওয়ার আফসোস”
তুলিকার কিশোরী হৃদয় গলে গিয়েছিলো। অজানা শিহরণে দোলা খাওয়া দুর্বাঘাসের মতো দুলেছিলো হৃদয়। তাই তার নামখানা যে বড্ড প্রিয় তার। শাফিনের নাম শুনতেই কোমল গালগুলো উষ্ণ হলো। সুরভী একটু মজা করে বললো,
“থাক লজ্জা পাস না, সে বিকেলে তোকে নিয়ে ঘুরতে যাবে”

তুলিকা রেগে বললো,
“ভাবী তুমিও না”

কিন্তু মুখে বললে কি হবে, হৃদয়ে তো বিকেলের অপেক্ষাই ছিলো।

****

পড়ন্ত্ বিকেল। নদীর ঢেউ এর শব্দ কানে আসছে। মৃদুমন্দা বাতাস। দূর্বাঘাসের উপর হাটছে দুজন প্রাণী। শাফিন ধীর স্বরে বললো,
“কিছু খাবে?”
“না”
“লজ্জা পাচ্ছো নাকি?”

তুলিকা উত্তর দিলো না। সে লজ্জা পাচ্ছে, এই প্রথম কোনো পুরুষের সাথে বাহিরে এসেছে। লজ্জাটা স্বাভাবিক। শাফিন কিছুসময় অনিমেষ চাহনীতে তাকালো তার দিকে। তারপর বললো,
“আমার না ফুচকা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। একা একা খেতে কেমন লাগে! তুমি না খেলে আমারো খাওয়া হবে না”

ফুসকার কথা শুনতেই জিভে পানি এলো তুলিকার। ফুচকাকে কি না করা যায়। উপরন্ত সাপে বর হয়েছে, শাফিনও খাবে। তাই আর মানা করার মানেই নেই। ফলে গদগদ হয়ে বললো,
“খাবো তো”

শাফিন নিঃশব্দে হাসলো। কিছু না বলেই চলে গেলো ফুসকা আনতে। তুলিকা সেখানেই অপেক্ষারত রইলো। হঠাৎ কারোও বিশ্রী কন্ঠ কানে এলো,
“একা একা কি করেন? কেউ নেই নাকি? বললে সময় দিতে রাজী আছি”

কথাটা মস্তিষ্কে আন্দোলন শুরু করলো। কথাগুলো এতোটা বিশ্রী শোনালো যে তুলিকার গায়ে কাটা দিলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সেদিকে। পাঁচ ছয়টা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের লোলুপ দৃষ্টি যেনো গিলে খাচ্ছে তুলিকাকে। অঙ্গভঙ্গিতেই একটা অস্বস্তি কাজ করছে। তুলিকার রাগ হলো। কিন্তু এদের সাথে কথা বাড়ানোটা বোকামি। তুলিকা তাই পা বাড়ালো শাফিনের দিকে। ছেলেগুলো দমলো না। তারাও পিছু নিলো তুলিকার। বিশ্রী আঙ্গিকে বলল,
“চলে যাচ্ছো যে, আমাদের একা রেখে যেও না”

তুলিকার পায়ের জোর বাড়ালো। হঠাৎ ধাক্কা খেলো শাফিনের সাথে। ধাক্কায় শাফিনের হাত থেকে ফুচকার প্লেটগুলো পরে গেলো, অবাক স্বরে বললো,
“কি হয়েছে ছুটছো কেনো?”

তুলিকা উত্তর দেবার পূর্বেই ছেলেগুলো বললো,
“এর দেখি নাগর আছে, তা এক নাগরে হবে?”

কথা নামক জিনিসটি এতোটা অশ্রাব্য হবে জানা ছিলো না তুলিকার। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে যেনো। এর মাঝেই শাফিন তাদের বললো,
“ভাই, আপনাদের দেখে তো ভদ্র বাড়ির ছেলে মনে হচ্ছে। তবুও একটি মেয়েকে এভাবে দিনের আলোয় ডিসটার্ব করা কি ঠিক?”

শাফিনের কথায় বেকুব বনে গেলো তারা। শাফিন তখন আশেপাশের উপস্থিত মানুষদের বললো,
“আচ্ছা, আপনি বলুন তো ভাই এদের কি ইভ টিজার লাগে? কি ভালো জামা কাপড়, কি দামী ঘড়ি। বাবা মায়ের তো টাকার অভাব নেই। তাহলে এমনে আচারণ কেনো?”

শাফিনের কথায় আশেপাশের মানুষের মাঝেও কানাগোসা শুরু হলো। কিছু বৃদ্ধ তো ছেলেগুলোকে গালমন্দ করতে লাগলেন। কিছু লোকতো মারার জন্য তেড়ে এলেন। লোকলজ্জার ভয়ে ছেলেগুলো মাথা নিচু করে প্রস্থান করলো। তুলিকা যেনো হাফ ছাড়লো। ভাবলো অবশেষে বিপদ কাটলো বুঝি, কিন্তু তার তো জানা ছিলো না এতো ঝড় আসার পূর্বলক্ষণ…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#নীড়_হারা_পাখি
#১২তম_পর্ব
(প্রাপ্ত বয়স্কমনাদের জন্য। ১৮+ এলার্ট)

লোকলজ্জার ভয়ে ছেলেগুলো মাথা নিচু করে প্রস্থান করলো। তুলিকা যেনো হাফ ছাড়লো। ভাবলো অবশেষে বিপদ কাটলো বুঝি, কিন্তু তার তো জানা ছিলো না এতো ঝড় আসার পূর্বলক্ষণ। ছেলেগুলোকে লেজ গুটিয়ে পালাতে দেখে শাফিন হাসলো। তার চোখে মুখ অদ্ভুত প্রশান্তির ছোয়া। তুলিকার গোলগোল চোখে বিস্ময়। বিস্ময় শাফিন ছেলেটাকে কেন্দ্র করে। কত সহজেই সে বিপদের অবসান ঘটালো, না ঝগড়ায় গেলো, না বিতন্ডায়। তাদের সাথে কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য ও করলো না। তাকে বিচলিত দেখালো না, ভীত দেখালো না। আবার সে অদম্য সাহসীও নয়, একটা সাদামাটা যুবক যে কি না বুদ্ধিমত্তা দিয়েই হার মানালো কিছু অসভ্য মানুষকে। তুলিকার চোখে ভেসে উঠলো এক গুচ্ছ মুগ্ধতা। শাফিনের গাঢ় কন্ঠে ধ্যান ভাঙলো,
“সিনেমা দেখবে তুলিকা?”

তুলিকার মস্তিষ্ক এখনো শাফিনের ঘোরেই লিপ্ত। ঠাহর করতে পারলো না শাফিনের কথা। বিমূঢ় কন্ঠে বলল,
“হ্যা?”
“সিনেমা দেখো তো? আমার আবার সিনেমা ভালো লাগে। দেখবে আমার সাথে?”

তুলিকা মাথা দোলালো। শাফিন নিঃশব্দে হাসলো। তারপর তুলিকার হাতখাতা গলালো নিজ হাতে। উষ্ণ স্পর্শে কাঁপলো তরুনী। তবে মন্দ লাগছে না। অজানা শান্তি কাজ করছে। এ যেনো ভরসার জায়গা। আড়চোখে দু একবার দেখলো শাফিনকে। ধরা পরা যাবে না। তাহলে লজ্জার শেষ থাকবে না। লুকিয়ে লুকিয়ে পুরুষকে দেখা তো আর নারীদের কাজ নয়। পুরুষ দেখবে তার প্রেয়সীকে। নারী কেনো দেখবে? কি অদ্ভুত সব যুক্তি।
“লুকিয়ে লুকিয়ে হবু বরকে দেখার কোনো মানে নেই, পুরোদস্তর মানুষটাই তোমার। তাই বুক চেতিয়ে দেখো”

শাফিনের কথায় লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো তুলিকা। কি ভীষণ লজ্জা। গোল শুভ্র গালজোড়া হয়ে উঠলো টমেটোর ন্যায় লাল। চোখ নামিয়ে নিলো মূহুর্তেই। তুলিকার বিব্রত অবস্থা দেখে স্বশব্দে হাসলো। তারপর পা বাড়ালো গন্ত্যব্যে____

*****

রাত গড়িয়ে দশটায় পৌছালো। দক্ষিণ অম্বরে এক ফালি রুপালি চাঁদ উঁকি দিয়েছে মেঘের আড়ালে। কালো মেঘের পরদেও জ্যোৎস্না ঢাকা পরলো না। খুব দারুণ হবে যদি বৃষ্টি হয়। ভিজে যাবে ব্যস্ত শহর। ইট পাথরের দালানের হাসফাঁসের অন্ত হবে। মন্দ হবে না। জ্যোৎস্নাবিলাস এবং বৃষ্টিবিলাস একত্রেই করা যাবে। এমন ই কিছু ভাবলো শাফিন। সিনেমা শেষ হতে হতে এতো দেরি হবে জানতো না তুলিকা। একবার সুরভীকে ফন করে জানিয়েছে। বেশ রয়ে সয়ে বলেছে,
“ভাবী দেরি হবে, আসলে সে সিনেমা দেখার জিদ করেছে। আমি মানা করতে পারি নি। শোটা সাতটার ছিলো। সেটা শেষ হতেই এতো সময় লাগলো। আসছি ভাবী”
“খেয়ে আসছিস?”
“উনি বলছিলেন!”
“বোকা মেয়ে, আমি সামলে নিবো। খেয়ে দেয় আয়”

সুরভীর কথায় ঠোঁটের কোনে হাসি ভেসে উঠলো তুলিকার। কেনো যেনো লজ্জা ভর করলো তাকে। এমনটা আগে হতো না। এতো লজ্জা তুলিকার ইহকালেও কাবু করতো না। কিন্তু স্বপ্ল সময়ে যেনো সব বদলে গেলো। রাতের আঁধারে স্বপ্ল চেনা মানুষটির হাত ধরে হাটছে কিন্তু ভয় হচ্ছে না। খারাপ লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে সময়টা এভাবেই চলুক না। এর মাঝেই তীব্র গর্জন শোনালো। মেঘের বিদ্রোহ শোনা যাচ্ছে। তীব্র অহমিকার পরিচয় দিচ্ছে। দেখতে দেখতেই শুরু হলো শীতল বারিবর্ষণ। শাফিনের শার্ট ভিজে গেলো। লোকেদের ছোটাছুটি শুরু হলো। অতর্কিত হামলায় তারা কুপোকাত। শাফিন তুলিকার হাত ধরেই ছুটলো যাত্রী ছাউনির নিচে। তীব্র বৃষ্টি, সাথে বাতাসের তুমুল উন্মাদনা। ধুলো উড়ছে ক্রমশ। পাশের গাছ নুইয়ে যাচ্ছে। ঝড়ের প্রকোপে চোখের সামনে ঝাপসা দেখাচ্ছে। রাতের আঁধারের সাথেই নীরবতার গাঢ়ত্ব বাড়লো। তুলিকার এটেসেটে দাঁড়িয়ে আছে। শাফিন খেয়াল করলো রমনী কাঁপছে ঈষৎ। তাই ঢাল হয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। ফলে চোখে চোখ আটকালো। নীরবতায় ব্যক্ত হলো শত কথা_____

বৃষ্টির বেগ মন্থর। ক্লান্ত মেঘের বিদ্রোহ ক্ষান্ত হলো কিছুটা। শাফিন ঘড়িতে চোখ বুলালো। রাত সত্যি হয়েছে। এখন বাড়ি ফেরাই শ্রেয়। তাই বাকি পরিকল্পনায় ইতি টানলো। খুঁজতে লাগলো যান। রাস্তায় যানের চলাচল কম, যাও মিলছে সেটাই যাত্রী আছে। ফলে শাফিন বললো,
“হাটবে?”
“আমার সমস্যা নেই”
“তুমি খুব আজব জানো তো, তোমার কিছুতেই সমস্যা নেই”

হাসতে হাসতে বললো শাফিন। তারপর পা বাড়ালো তারা। হাটতে হাটতে একটি গলিতে ঢুকলো। শুনশান গলি, আঁধারের নির্মমতা। নিগূঢ় অন্ধকারে জনমানবের চিহ্ণ নেই। সানসেটে জমা পানি পতনের শব্দ কানে আসছে। তুলিকার বুকে সুপ্ত ভয়গুলো ডানা বাধলো। কেনো যেনো গা ছমছম করছে। ভয়টা দৃঢ় হলো কিছুটা দূরে। যখন নিস্তব্ধতা চিরে কানে এলো হিংস্র হাসি। বিশ্রী কর্কশ কন্ঠ কানে এলো,
“আরে সুশীল নাগর তার কচিকে নিয়ে হাজির”

ভালো করে দেখতেই নজরে পড়লো সেই ছেলেগুলো। যারা লোকলজ্জার ভয়ে লেজ গুটিয়েছিলো এখন হিংস্র হা্যেনার মতো গর্জন করছে। তুলিকা শক্ত করে শাফিনের বাহু আকড়ে ধরলো। শাফিন গাঢ় কন্ঠে বললো,
“ভয় পেও না”

তারা ছেলেগুলোকে এড়িয়ে এগোতে নিতে বাঁধা দিলো তাদের একজন। গায়ে মদের তীব্র কটু গন্ধ। চোখজোড়া লাল। তুলিকার মুখের সামনে এসে বলল,
“ঘোরাঘুরি শেষ নাকি?”

ছেলেটিকে বাঁধা দিলো। শীতল স্বরে বললো,
“পথ ছাড়ুন”
“এতো তাড়া? তা রাতে কি করবি! অবশ্য এমন একটা মাল থাকলে আমাদের তাড়া থাকলো। দিবি নাকি এক রাতের জন্য”

বিশ্রী কথাটায় গা গুলিয়ে এলো। তুলিকার মনে হলো কেউ তার কানে টগবগে শলাকা ঢেলে দিলো। শাফিনের শান্ত রুপের যেনো বাঁধ ভাঙ্গলো। কলার টেনে ধরলো ছেলেটির। এলোপাতাড়ি চ/ড় ঘু/ষি চালালো। ফলে হায়েনার দল উগ্র হয়ে উঠলো। শাফিনকে ছাড়ালো তারা। একত্রে প্রহার শুরু করলো তাকে। তাদের কাছে থাকা লুকায়িত অ/স্ত্রের প্রহার চললো। লোহার আঘাতে গলগল করে বের হতে লাগলো র/ক্ত। অবস্থায় অবনতিতে তুলিকার মস্তিষ্ক যেনো অচল হয়ে গেলো। সে তাদের বাঁধা দিতে গেলে একজন খপ করে ধরলো তাকে। বিশ্রী কামুক স্পর্শ করতে লাগলো, তুলিকাকে সে। জীর্ণশীর্ণ নারীর আর্তনাদে কেঁপে উঠছিলো নিস্তব্ধ গলি। শাফিনের সামনে নিজের নারীরটি অবমাননা যেনো সে মানতে পারলো না। কিন্তু হায়েনাদের সামনে ছেলেটা যেনো দূর্বল হয়ে পড়লো। হাটু ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়লো শরীরটি। চামড়া চিরে গলগল করে পড়ছে র/ক্ত। কন্ঠে জোড় নেই। শরীরের লাথি, প্রহারে অসহনীয় ব্যাথার চেয়ে এই যন্ত্রণা যেনো বেশি। এক সময় রক্তের বমি হলো শাফিনের। নিথর হয়ে পড়লো সেই শরীর। এদিকে একের পর নরম শরীরটি খুবলে খেলো হায়েনারা। কামড়, আঘাতের যন্ত্রণায় মূর্ছা গেলো তুলিকা। গলায় আর্তনাদ নেই, নির্লিপ্ত চোখজোড়া দেখলো শুধু প্রিয় মানুষের নিথর শরীর।

রাত বাড়ছে অথচ এখন তুলিকার আগমণ হলো না। তুরানের চিন্তা বাড়লো। শফিক সাহেব মেয়েকে ফোন করছে, ফোনটি বন্ধ। শাফিনের ফোন বাজছে ঠিক কেউ ধরছে না। এদিকে ও বাড়ির থেকে ফোন আসছে এখনো ছেলে মেয়ে দুটো বাড়ি ফিরে নি। চিন্তা দুশ্চিন্তায় পরিণত হলো। অবশেষে তারা পুলিশের সরনাপন্ন হলো। কিন্তু লাভ হলো না। কারণ চব্বিশ ঘন্টার আগে রিপোর্ট লেখাবে না। রাতটি চিন্তায় কাটলো। হিমা বেগম একটু পর পর মেয়ের চিন্তায় মূর্ছা যেতে লাগলো। কিন্তু সামান্য মধ্যবিত্তদের তো অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই

সকালে গলির নর্দমায় একটি নিথর লা/শ এবং ন/গ্ন ক্ষ/ত বিক্ষত নারীকে পাওয়া গেলো। সকলের মাঝে গুঞ্জন শুরু হলো। মেয়েটিকেও ভেবেছিলো মৃত কিন্তু ক্ষণ শ্বাস যে এখনো চলছে তার। পিচাশের দল তাকে মৃত ভেবে ওভাবেই র/ক্তা/ক্ত হালে ফেলে চলে গিয়েছিলো। পুলিশ এলো। নারীকে পাঠানো হলো হাসপাতালে। পরিবারের সামনে প্রকাশ পেলো হৃদয়বিদারক ঘটনা। শফিক সাহেব ভেঙ্গে পড়লেন। মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টায় জুড়লেন। অন্যদিকে একটি পরিবার হারালো তার সন্তান। শাফিনের মা হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। তারা চাইলো অপরাধীর শাস্তি হোক। কিন্তু ভাগ্যের হয়তো সেটা মঞ্জুর ছিলো না। যখন জ্ঞান ফিরলো তুলিকার, সে অপ্রকৃতস্থ আচারণ করতে লাগলো। নিজেকে মানতে যে তার কষ্ট হচ্ছিলো। শেষ করে দেবার চেষ্টাও চালালো, ব্যর্থ হলো। তবে তুলিকা নামক সতেজ ফুলটি অচিরেই ঝড়ে পড়লো। একটি কালো রাত তার সবকিছু কেড়ে নিলো। লোকের কথার বান ছুটলো। ফলে তুরান বাড়ি বদলালো। এমন জায়গায় এলো যেখানে কেউ তাদের চিনবে না। বোনটি নাহয় থাকলো পাগল রুপে। অন্তত বেঁচে তো আছে।
.
******

রোদ্দুর স্তব্ধ। তার কাছে এখন অনেক কিছু স্পষ্ট, কেনো তুলিকার স্পর্শে ভীতি। কেনো সে আঁধারে কাঁপে। কেনো তার মনে হয় কেউ তাকে মে/রে ফেলবে! তিমিরের চোখে নোনাজল। কন্ঠ দলা পাকাচ্ছে। ধীর স্বরে বললো,
“তুমি হয়তো জানো না, প্রায় দুমাস অন্তর অন্তর পুলিশ আমাদের বাড়ি তদন্তে আসে। খোঁজ নেয় আমার বোনটি ভালো হয়েছে কিনা। কারণ এসবের প্রত্যক্ষদর্শী আমার বোন। তাই আমরা কেউ চাই না আমার বোন সুস্থ হয়ে সেই যাতাকলে পিষুক। একটাই তুলিকা আমাদের। সত্যের যাতাকলে ওকে বলি করি কি করে? যারা অচিরেই খু/ন করতে পারে তাদের কি ভরসা?”
“তাই অসুস্থ জীবন উপহার দিচ্ছো? বেরঙ্গ ছন্নছাড়া জীবন? এই জীবন কি তুলিকার প্রাপ্য?”
“আমি জানি তোমার কাছে আমি ভাই হিসেবে একজন স্বার্থপর মানব। ভীত, শিরদাঁড়াহীন, ব্যর্থ মানব, যে বোনকে নিরাপত্তার বদলে অসুস্থ জীবন দিতে বেশি প্রসন্নবোধ করছে। কিন্তু সত্যি করে ভেবে বলতো, তুলিকা স্বাভাবিক জীবনে আসলে আদোও সুখ পাবে? সেই কালো রাতের নৃশংস স্মৃতি তাড়া করবে না? নিজের চোখের সামনে শাফিনের হত্যার স্মৃতি তাকে গিলে খাবে না? নিজের সাথে হওয়া সেই বিশ্রী ঘটনা ওকে বাঁচতে দিবে? ও ঘুমোতে পারবে তো? পারবে না। তাই জেদ ছাড়ো ডাক্তারবাবু”

রোদ্দুর চুপ করে রইলো। উত্তর তার কাছেও নেই। কিন্তু তুলিকাকে একটি সুন্দর জীবনে দেখতে যে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। সেই লোভ থামায় কিভাবে! তিমির হাসলো। সেই হাসিতে কিঞ্চিত বিদ্রুপ, কিঞ্চিত ভাগ্যের কাছে হেরে যাওয়ার বেদনা। ধীর স্বরে বললো,
“ডাক্তারবাবু, ধরো আমার বোন স্বাভাবিক হলো। ওকে বাঁচতে শেখাবে কে?…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি