নীড় হারা পাখি পর্ব-১৩+১৪

0
296

#নীড়_হারা_পাখি
#১৩তম_পর্ব

রোদ্দুর চুপ করে রইলো। উত্তর তার কাছেও নেই। কিন্তু তুলিকাকে একটি সুন্দর জীবনে দেখতে যে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। সেই লোভ থামায় কিভাবে! তিমির হাসলো। সেই হাসিতে কিঞ্চিত বিদ্রুপ, কিঞ্চিত ভাগ্যের কাছে হেরে যাওয়ার বেদনা। ধীর স্বরে বললো,
“ডাক্তারবাবু, ধরো আমার বোন স্বাভাবিক হলো। ওকে বাঁচতে শেখাবে কে? কে আগলে রাখবে ওর ক্ষত বিক্ষত হৃদয়টাকে? ওর দেহের সেই ক্ষতগুলো ভরে গেছে কিছু এই দাগ এখনো চিৎকার করে জানান দেয় সেই কালো রাতের তিক্ত স্মৃতি। সেই স্মৃতির মেঘ কাটিয়ে কুসুম প্রভার দর্শন করাবে কে? কি হলো ডাক্তারবাবু চুপ যে, উত্তর নেই?”

তিমিরের হাসিটি মিলিয়ে গেলো। মনটা ভরাক্রান্ত হয়ে আছে। দাঁড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঝাড়ুদাররা নিজেদের কাজে প্রস্থান করছে। এখন তার প্রস্থানের পালা। রোদ্দুর এখনো বসে রয়েছে। তার দৃষ্টি পিচের রাস্তার দিকে। হয়তো উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে। তিমির তাকে ঘাটালো না। পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। তখন কত বয়স তার? মাত্র একুশ, চোখের সম্মুখে শাফিনের নিথর দেহ দেখেছিলো। শ্যাম সুঢৌল বদনে কিছু কালচে দাগ, ক্ষত বিক্ষত সেই দেহ। ময়নাতদন্তে জানা গেছিলো পাজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছে। ইন্টার্নাল ব্লি/ডিং হওয়ায় মৃ/ত্যু হয়েছে। কতটা মর্মান্তিক! তুলিকা হাসপাতালে ছিলো প্রায় একমাস। নিস্প্রভ চোখজোড়ায় বাঁচার আশা ফুরিয়ে গিয়েছিলো। তুরান চেয়েছিলো এর শাস্তি হোক, অপরাধী ধরা পড়ুক কিন্তু তাতে প্রতিনিয়ত মিডিয়া, সংবাদপত্র তার বোনকে ন/গ্ন করতো। একই যন্ত্রণা প্রতিটিবার সহ্য করতে হতো অপ্রকৃতস্থ বোনটিকে। তাই তো পিছিয়ে যাওয়া। শফিক সাহেব ভেঙ্গে পড়েছিলেন। প্রাণবন্ত তুলিকাটির মৃত্যু যেনো মানতে পারছিলেন না তিনি। চঞ্চল মেয়েটি কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছিলো। ছিলো একটি অসুস্থ ফুল, যে ভীত, সন্ত্রস্ত। আজও মনে পড়লে কেঁপে উঠে ভেতরটা। তুলিকাকে আবারো মরণ যন্ত্রণা সইতে দেখতে পারবে না তারা। ভালোই তো আছে, হ্যা, ভালো আছে তারা।

দরজা খুলতেই অভিলাষা খানিকটা চমকালো। তিমিরের চোখজোড়া লালচে হয়ে আছে, ঠোঁটজোড়া শুষ্ক। মুখখানা মলিন। হয়তো নির্ঘুম রাতের ফল এটা। অভিলাষা তবুও শুধালো,
“কান্ত লাগছে কি খুব?”

তিমির উত্তর দিলো না। শুধু মাথা ঠেকালো অভিলাষার কাধে। উষ্ণ নিঃশ্বাস কাপড় ভেদ করে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো অভিলাষার কাধে। কিছুক্ষণের মাঝেই অনুভূত হলো উষ্ণ তরল তার কাঁধ ভেজাচ্ছে। অভিলাষা অবাক হলো, অসাড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তিমির ছেলেটি ভঙ্গুর নয়, বরং সে কঠিন। খারাপ থেকে খারাপ পরিস্থিতিতেও সে কঠিন। জেদী ছেলেটিকে কখনোই বিচলিত দেখায় না। বাচ্চা নিয়ে ঝামেলার মাঝেও তাকে বিচলিত দেখায় নি। অভিলাষা যখন রাতের পর রাত অশ্রু বিসর্জন দিলো তখন তিমির তাকে আগলে রাখতো নিজের সুঠাম বুকে। তার ধীর স্বরে বলতো,
“আমি আছি, চিন্তা নেই”

অথচ আজ সে কাঁদছে। অভিলাষা চিন্তিত স্বরে বললো,
“কি হয়েছে তোমার?”
“কিছু না”
“কাঁদছো যে?”
“ক্লান্ত লাগছে। নড়ো না, একটু এভাবেই থাকো।”

অভিলাষা কথা বাড়ালো না। দাঁড়িয়ে রইলো সে। সময় পার হলো। একটা সময় তিমির সোজা হয়ে দাঁড়ালো, সোজা চলে গেলো নিজ ঘরে। অভিলাষা তাকিয়ে রইলো তার বরের দিকে। ছেলেটিকে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না। খুব অচেনা লাগে। চিরচেনা মানুষের আদলে অচেনা চরিত্র______

*******

অভিলাষার এখন চতুর্থ মাস চলছে। বমিটা একটু কমেছে ঠিকই কিন্তু খাবারের রুচি ফিরে নি। খুবই অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস খাবার ইচ্ছে জন্মায় তার। এই তো আজকে সকালের কথা, তার খুব ইচ্ছে করছিলো বেশি বেশি রসুন দিয়ে শুটকি ভর্তা খেতে। হ্যা, শুটকি ভর্তা। অথচ হিমা বেগমের শুটকির গন্ধে বমি পায়। তিনি শুটকি মাছ ঘরে আনাই বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে অভিলাষার ইচ্ছেপূরণের উপায় নেই। সুরভীকে কথাটা বলতেই সে হাসিতে ফেটে পড়লো। বিয়ের পর থেকে এ বাড়িতে শুটকির প্রচলন দেখে নি। ফলে এই শুটকি ভর্তা খাবার ইচ্ছে প্রকাশে সে হাসতে হাসতে বললো,
“মা ঘর মাথায় তুলে ফেললে এই শুটকি ভর্তা খাবার কথা শুনলে। মানিয়ে নিতেই হবে গো অভিলাষা। আমি কখনোই শুটকি আনতে দেখি নি এই বাড়িতে”
“আমি কি জানি না তা? কিন্তু মন তো মানে না। জানো, আমাদের বাসার পাশে হাসি খালা থাকতো। যখনই ভর্তা করতেন এক বাটি দিয়ে যেতেন। তখন আমি খেতাম না। এখন আফসোস হচ্ছে”
“মা হওয়া দেখছি সোজা নয়, শুটকি ভর্তা খাবার ইচ্ছে ও জাগে”
“জাগে তো, আরোও কত কিছু খেতে ইচ্ছে করে! সেদিন পুইশাকের বিচি দিয়ে চিংড়ি মাছের তরকারী খেতে ইচ্ছে করছিলো। তারপর পরশু রাতে হুট করেই চুইঝালের মাংস খেতে ইচ্ছে করছিলো। বলো না, শুধু খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু খাওয়ার সময় রুচি থাকে না”

অভিলাষা বলতে বলতেই হেসে দিলো। সুরভী ম্লান হাসলো। নিস্প্রভ স্বরে বলে,
“ও নড়ে?”
“বুঝি না, আসলে ছোট তো। তাই বুঝতে পারি না। তবে খুব ভালো লাগে জানো। সকাল হতে না হতেই তার জানান পাই, সে আছে। অন্যরকম অনুভূতি”

সুরভী চেয়ে আছে অভিলাষার দিকে। মেয়েটি দিন যাচ্ছে তার সুন্দর হচ্ছে। অনেকে বলে মাতৃত্বে মেয়েদের সৌন্দর্য্য বর্ধিত হয়, আজ স্বচক্ষে দেখছে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপ্ন করে বললো,
“চিন্তা করো না, তুরানকে বলবো শুটকি নিয়ে আসতে”
“মা?”
“লুকিয়ে লুকিয়ে”

অভিলাষার হাসি প্রসারিত হলো। চোখজোড়া চকচক করছে। সুরভীকে এজন্যই তার এতো ভালো লাগে, সে যেনো সবার চাবির কাঠি। খাবার টেবিলে খেতে বসার সময় সুরভী এবং অভিলাষা দুজন ই হতবিহ্বল হয়ে রইলো। টেবিলের উপর শুটকি ভর্তার একটি ছোট্ট বাটি। দুজন দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকলো। হিমা বেগম দুজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
“কেয়া ভাবী দিয়েছেন। শুটকি ভর্তা এতো ঘটা করে দেওয়ার কি আছে জানি না। সেটা তো মুখের উপর বলা যায় না তাই নিয়েছি। যার খেতে ইচ্ছে করবে খেও”

হিমা বেগমের কন্ঠে রুক্ষতা। সুরভী অভিলাষার কানে কানে বললো,
“মেঘ না চাইতেই তো বৃষ্টি হলো”
“সেটা তো আমিও ভাবছি”

অভিলাষা খাওয়া শুরু করতেই হিমা বেগম আবারোও রোষ মিশ্রিত স্বরে বললো,
“এই সময়ে খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো না করলে বাচ্চা অপুষ্টিতে ভুগবে। পরে যেনো মানুষ বলবে হিমা তার বউকে খেতে দেয় না। তাই যা খেতে ইচ্ছে করবে তুরান বা তিমিরকে বলে দিলেই হয়”

হিমা বেগমের কথার মাঝে ভালোবাসার ছোয়া নেই, তবে কথাটা অভিলাষা মেঘজমা হৃদয়ে শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। খা খা করতে থাকা মরুভূমিতে যেনো বহুদিন পর সুখবৃষ্টি হলো। অভিলাষার চোখ কেনো যেন অশ্রুসিক্ত হলো। অস্পষ্ট স্বরে সে বললো,
“আচ্ছা মা”

এদিকে তুলিকা খিলখিল করে হাসছে, সুরভীও মুখ টিপে টিপে হাসছে। কঠিন হিমা বেগম কি তবে গলছেন, কে জানে?

*****

সরু ফুটপাথ দিয়ে হাটছে তিতির। কাধে একটি কালো ব্যাগ। গন্তব্য ইংলিশ স্যারের ব্যাচ। এবার ইংলিশে ভালো করে নি। পঞ্চাশে মাত্র পেয়ে পনেরো। যা তাকে ফেলের কাতারে ফেলেছে। তাই তুরান ইংলিশ ব্যাচে ভর্তি করিয়েছে। বাসা থেকে দশ মিনিট হেটে যাওয়ার পথ। কিন্তু এই কুয়াশা ঢাকা সকালে দশ মিনিটও আধা ঘন্টার মতো মনে হয়। ঘুমে চোখ বুজে আসছে তিতিরের। তবুও হাটছে। এর মাঝেই গাঢ় পুরুষালী কন্ঠ কানে এলো,
“চোখ বুজে হাটলে যত বড় গণিতবিদ ই হোক না কেনো ড্রেনে পড়ে যেতে হবে, তখন বড় বড় অক্ষরে লেখা হবে, কৃতী ছাত্রীকে পাওয়া গেছে ড্রেনের কাদাজলে”

কন্ঠটা শুনতেই ঘুম ছুটে পালালো। সত্যি একটু হলে ড্রেনে পরতে হতো। উন্নয়নের নামে আজকাল শহরের সব রাস্তা মনের মাধুরী মিশিয়ে কেটে রাখা, কখনো ওয়াশার পানির লাইনের জন্য, কখনো বা বানানো রাস্তায় পাইপ বসানোর জন্য নয়তো ড্রেইন বর্ধিত করার জন্য। ঘুমের ঘোরে আজ তিতির ও সেই উন্নয়নের কাটা ড্রেইনে পড়ে যেতো। কৃতজ্ঞতার জন্য পিছু ফিরতেই দেখলো বত্রিশটা দাঁত বের করে সৌভিক এবং লিটন বাইকে বসে রয়েছে। এই বাইকটি চেনে না কেউ নেই। এই Honda Dream 110 এর বাইকটি চেনে না এমন কেউ নেই। সেই প্রথম বর্ষ থেকে লিটনের এই বাইকের উপর চড়ে তাদের কলেজ জীবন চলছে। ইকবাল স্যারের ভাষ্যমতে, “ছা’গ’লের কান মুলে দুই আ’হম্মক চল্লেন সফরে, একটু দয়া মায়া কর” আবার কখনো কখনো এই বাইকের উপর তিনজনকেও চড়তে দেখা যায়। তিতির যাও একটু ধন্যবাদ বলতো কিন্তু সেই ইচ্ছে মিয়ে গেলো। তাই ঘাড় সোজা করেই হাটা দিলো গন্তব্যে। পেছন থেকে সৌভিক বলে উঠলো,
“কি দিনকাল পড়লো, একটা ধন্যবাদ দিতেও কার্পন্য”

কথাগুলো কানে আসলেও পাত্তা দিলো না তিতির। পায়ের জোর বাড়ালো। ফলে খুব দ্রুত ই মিলিয়ে গেলো দৃষ্টির অগোচরে। লিটন হাই তুলতে তুলতে বললো,
“এই ভোরে এই অহংকারী মেয়েকে দেখতে ডাকছিস? দেখলি পাত্তাই দিলো না”
“কিছু পেতে হলে যে কিছু খোয়াতে হয়”

লিটন মুখ বিকৃত করলো। সৌভিকের কথার আপাদমস্তক খুঁজে পায় না সে। চেষ্টাও করে না। যা করার করুক।

******

নিজের ছোট্ট কেবিনটিকে বসে রয়েছে রোদ্দুর। সামনে থাকা পেপারওয়েটটির দিকে তাকিয়ে আছে। বুকচিরে সময় অন্তর অন্তর দীর্ঘশ্বাস বের হচ্ছে। মস্তিষ্ক জুড়ে অবান্তর প্রশ্নগুলো জুড়ে বেড়াচ্ছে। শরীরের ক্লান্তি তাকে আরও নিস্তেজ করে দিচ্ছে। এর মাঝেই রবিন ভাইয়ের আগমণ ঘটলো। বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
“রোদ্দুর তুমি তিনশ তিন নম্বর কেবিনের প্যাশেন্টকে কি বলেছো? মহিলা সকলের মাথা চিবোচ্ছে”

রোদ্দুর এখনো নিশ্চুপ। অনিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে পেপারওয়েটের দিকে। রোদ্দুরের উত্তর না পেয়ে রবিন ভাই এর মেজাজ তিরিক্ষি হলো। তেতে উঠে রোদ্দুরের কাঁধে চা’প’ড় বললেন,
“ছ্যাকা খেয়েছো নাকি? খিজ খেয়ে পড়ে আছো কেনো?”

এবার সম্বিত ফিরলো রোদ্দুরের। চমকে উঠে বললো,
“কি… কি হয়েছে রবিন ভাই?”
“সেটাই আমারো প্রশ্ন? কি হয়েছে? প্রেমে টেমে পড়লে নাকি?………..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#নীড়_হারা_পাখি
#১৪তম_পর্ব

রোদ্দুর এখনো নিশ্চুপ। অনিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে পেপারওয়েটের দিকে। রোদ্দুরের উত্তর না পেয়ে রবিন ভাই এর মেজাজ তিরিক্ষি হলো। তেতে উঠে রোদ্দুরের কাঁধে চা’প’ড় বললেন,
“ছ্যাকা খেয়েছো নাকি? খিজ খেয়ে পড়ে আছো কেনো?”

এবার সম্বিত ফিরলো রোদ্দুরের। চমকে উঠে বললো,
“কি… কি হয়েছে রবিন ভাই?”
“সেটাই আমারো প্রশ্ন? কি হয়েছে? প্রেমে টেমে পড়লে নাকি?

রবিন ভাই বেশ সিরিয়াসভাবেই কথাটা শুধালো। রোদ্দুর মোটামোটি রবিন ভাইয়ের প্রশ্নে বিষম খেয়ে একাকার অবস্থা। সে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো রবিন ভাইয়ের দিকে। এদিকে রবিন ভাইয়ের হেলদোল হলো না। তার মুখশ্রী কঠিন, নির্বিকার। সে এখনো উত্তরের প্রতীক্ষায় রয়েছে। যেনো উত্তরটি পাওয়া তার জীবনের অতীব প্রয়োজনীয় ব্যপার। রোদ্দুর নিজেকে সামলালো। চোখ মুখ বাকিয়ে বললো,
“কি যে বলো না রবিন ভাই! তুমি সবসময় ফাও কথা বলো”
“ফাও কথা বলছি?”
“প্রেমে পড়তে যাবো কেনো? একজন রোগী আছে, তাকে নিয়ে ভাবছিলাম”
“ছেলে না মেয়ে?”
“মেয়ে”

কথাটা বলেই রবিন ভাইয়ের দিকে তাকালো রোদ্দুর। রবিন ভাই ভ্রু উচিয়ে ঠোঁটের কোনে গা জ্বালিয়ে দেওয়া হাসি এঁকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ্দুর ব্যাস্ত স্বরে বললো,
“তুমি যা ভাবছো, তেমন কিছুই নয়”
“আমি কিছু বলি নি”
“তাহলে তাকিয়ে আছো কেনো?”
“তাকানো এখন দোষের?”

রবিন ভাইয়ের সাথে তর্কে বেশি এগোলো না রোদ্দুর। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ধীর স্বরে বললো,
“মেয়েটি বড্ড অসহায় রবিন ভাই। নিজেকে হারিয়ে উদ্বাস্তু তার জীবন। বেঁচে আছে ঠিক কিন্তু সেই বাঁচার মানে নেই। বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ মেয়েটিকে ওভাবে দেখতে ইচ্ছে হয় না। মেয়েটির জীবনে রঙ তো আছে, কিন্তু সেই রঙ্গের অস্তিত্ব নেই”
“কে সে?”
“আমাদের প্রতিবেশী। খুব মায়া হয় জানো! অবুঝ চোখে শুন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে নিশিরাতে। একা একাই বিড়বিড় করে কথা বলে। আমাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলো “আমি কি সবার থেকে আলাদা?” আমি উত্তর দিতে পারি নি। আমি চাই ও সুস্থ হয়ে যাক”
“বাধা কোথায়?”

রোদ্দুর কিছু সময় চুপ করে রইলো। তারপর ধীর স্বরে সবটা খুলে বললো। রবিন ভাই চুপ করে শুনলেন। কিছু জিনিস একতা ফাঁকা কাগজেও টুকলেন। রোদ্দুরের কথা শেষ হলো। কেবিনটিতে তখন নীরবতা। নীরবতা ভাঙ্গলো রবিন ভাই। গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তোমার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই রোদ্দুর। তোমার উদ্দেশ্য ভালো। তবে তার পরিবারের সাথেও আমি দ্বিমত পোষন করছি না”
“মানে? এভাবেই তুলিকাকে সারাজীবন থাকতে হবে?”
“দেখো মানুষের মস্তিষ্ক বড় বিচিত্র। তার জটিলতা বোঝার সাধ্য আমাদের মতো নগন্য মানুষের নেই। মানুষ কি ভাবে, না ভাবে তা আমরা বুঝতে পারি না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমরা যেটা করি তাহলো বিভিন্ন মনের মানসিক রোগের চিকিৎসা। সত্যি বলতে সেগুলো কিন্তু পুথিগত বিদ্যাই, হ্যা অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে আমরা তাদের চিকিৎসা করি। তবে সেই চিকিৎসা কতটুকু কার্যকর তা কিন্তু জানি না। তুলিকাকে ভালো করা যাবে না কথাটি ভুল। কিন্তু এই ভালো করতে যেয়ে তার অহিত যেন না হয়। আমাদের মস্তিষ্ক যখন কোনো বাস্তবতা মানতে পারে না তখন ই ভারসাম্য হারায়। তুলিকার সাথে যা ঘটেছে তাতে এমনটি অস্বাভাবিক নয়। সেই স্মৃতিটুকু সে ভুলতে পারে নি বলেই কিন্তু সে আজ এমন। এই স্মৃতি সারাটিজীবন তার মস্তিষ্কে থাকবে। হয়তো এখনো তাকে তাড়া করে, না করলে তো সে অন্ধকার ভয় পেতো না, মৃত্যু ভয়ে কাঁপতো না। ওকে যখন স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা হবে তখন স্মৃতিগুলো আরোও প্রবল হবে। এমন রোগীরা নিজেদের শেষ করে দিতেও দু বার ভাবে না। কারণ সেই বিশ্রী স্মৃতি নীল যন্ত্রণা তারা সইতে পারে না। কেবিন নম্বর পনেরো এর সাথে কিন্তু সেটাই হয়েছিলো। আশরাফ নিজের জীবন নিয়ে নিয়েছিলো। এটা প্রথম রিস্ক। দ্বিতীয় রিস্ক, এমন প্যাশেন্টরা ডিপ্রেশনে চলে যায়। নিজেকে মেনে নেবার লড়াইটা তাদের দূর্বল করে দেয়। ফলে সুস্থ হলেও খুব একটা পার্থক্য হয় না। হ্যা, এমন হতো কেউ তাকে আগলে রেখেছে। তার মনের ক্ষতগুলোর উপর নিয়মিত স্যাভলন নিচ্ছে, তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। আফসোসের ব্যাপার, এমনটা খুব কম হয়। তুমি ডাক্তার রোদ্দুর। আই ডোন্ট থিংক আই হ্যাভ টু এলাবোরেট মোর। থিংক ইউরসেলফ। আর তিনশ তিন নম্বরের মহিলাকে বলে দাও সে এভারেস্টে যাবে না। পারলে এখন ই হাইকিং এ নেমে পড়ছে”

রবিন ভাই উঠে দাঁড়ালেন। রোদ্দুর ঠায় বসে রইলো। গাঢ় নয়নে দেখছে পেপারওয়েট টি। মনের মাঝে ঝড় উঠেছে। রবিন ভাই এর কথাগুলো তার অজানা নয়। তবে কেনো যেন মন মানতে নারাজ। সে দৃঢ় ভাবে চাইছে তুলিকা স্বাভাবিক হোক। রোদ্দুরকে দ্বিধা দন্দে দেখে স্মিত হাসলো রবিন ভাই। যাবার আগে খুব শান্ত ভাবেই বললেন,
“তুলিকার একজন ডাক্তার নয়, একজন বন্ধু দরকার। একজন এমন বন্ধু যে তার হৃদয়ের ক্ষত গুলোয় মলম দিবে। স্মৃতি ভোলা যায় না, কিন্তু সেই স্মৃতির যন্ত্রণা ভোলা যায়”

*******

আলোর তাপ মিয়ে আসছে। দিবার অবসান ঘটাতে প্রকান্ড সূর্য এখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। ফলে তার অভিমানী তেজ এখন নেই। নীলাম্বরে তখন লাল, কমলার ছড়াছড়ি। নীল রঙ্গের সাথে মিলে চমৎকার রংঙ্গের সৃষ্টি করেছে। এই চোখ ধাধানো রঙ্গ মিলিয়ে ছাই হয়ে যাবে কয়েক মূহুর্ত বাদে। বাতাসে শীতলতা। ভেজা ভেজা শিশিরের গন্ধ ও আসছে। কালো জ্যাকেটটি তাই ভালো ভাবেই জড়িয়ে নিলো রোদ্দুর। আজ কাজে মন নেই। মস্তিষ্কটা ভার ভার লাগছে। ঘুমের প্রয়োজন। নিখাদ ঘুম। নিজের বাড়ি মুখী রাস্তার মধ্যিখানেই থেমে গেলো পা। চোখ আটকে গেলো গোধুলী রাঙ্গা মেয়েটির এলোকেশে। স্কার্ট এর তলদেশে ঘষছে ময়লা রাস্তায়। কিন্তু বেপরোয়া নারীর সেদিকে নজর নেই। সে ব্যস্ত সামনের কুকুর ছানাকে পাউরুটি খাওয়াতে। শীতকালে বিনা নোটিশেই বেশ কটা ক্ষুদে কুকুর ছানা পাড়ায় ঘেঊ ঘেঊ করতে দেখা যায়। তাদের মায়ের খোঁজ নেই। উদ্দেশ্য একটু খাবারের। হয়তো তারা খাবারের খোঁজ ও পেয়ে গেছে। উৎফুল্ল মুখখানা বেশ আগ্রহেই তাকে খাওয়াচ্ছে। অথচ তার মানুষে কত ভয়। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রোদ্দুর। হাটু গেড়ে বসলো তার পাশে। গাঢ় কন্ঠে বললো,
“”মাঝে মাঝে তোমাকে আড়াল করতে ইচ্ছে করে, লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে সকলের অগোচরে। কিন্তু আফসোস, আমার সেই অধিকার নেই”…………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি