#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১৪
শুভ্রের ঘুম ভেঙেছে খুব সকালে। হিয়ার রূমের একটা জানালা খোলা থাকায় ভোরের আলোয় রুমটা আলোকিত হয়ে গেছে। পাখিদের কিচিমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। প্রকৃতির ডাকে কখনই এমনভাবে সে জাগে নি। শুভ্র আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। তারপর নিজের বাম পাশে তাকাতেই দেখলো হিয়া গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। ছোট্ট বাচ্চাদের মতন গালের নীচে একটা হাত রেখে ঘুমাচ্ছে হিয়া।
শুভ্রের বাবা আসতে রাজি না হওয়ায় শুভ্রের মা তাকে জোড় করেছে। মোহনা এসেও হিয়াকে খুঁজেছে। কি অদ্ভূত কয়েক মাসেই মেয়েটা সবার এতো কাছের হয়ে গেলো। এই স্টুপিড মেয়েটার কি এমন ক্ষমতা যার জন্যে শুভ্রনীল আহমেদ এতদূর এসেছে। নাকি এই মেয়েটাকে জ্বালাতে তারও ভাললাগে। হয়তো!
শুভ্র দ্বিতীয়বারের মতো হিয়ার দিকে ফিরলো। হিয়া নড়ে চড়ে উঠে চোখ খুললো কিন্তু শুভ্র চোখ সরালো না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
হিয়া চোখ খুলে শুভ্রকে নিজের সাথে এক বিছানায় দেখে চমকে উঠে দূরে সরতেই হুড়মুড়িয়ে চাদর সহ নীচে পড়ে গেলো। পড়েই আহ্ করে চিৎকার করে উঠলো। বিছানা থেকে পড়ে তার মাথায় এলো সে আর শুভ্র একই ঘরে ছিলো সারারাত। হিয়া কোমড় ধরে আর্তনাদ করে উঠলো।
হিয়ার এমন কান্ড দেখে শুভ্র ভ্রু কুঁচকে উঠে বসলো। এই মেয়েটা অতিরিক্ত পরিমাণে ছটফট করে। শুভ্র ভ্রূ ডলতে ডলতে বললো,” কোমড় কি ভেঙেছে? ভেঙে গেলেও কিন্তু স্ট্রেচারে করে ঢাকায় যেতে হবে।”
হিয়া রাগে কটমট করে শুভ্রের দিকে তাকালো তারপর বললো,” আপনি তো সেটাই চান। আমি কোমড় ভেঙে ঘরে বসে থাকি।”
” সে তোমার কোমড় ভাঙলেও তুমি ভাঙ্গা কোমড় নিয়ে লাফালাফি করবে। ঘরে বসে থাকার মেয়ে তো তুমি না।”, বলতে বলতে শুভ্র খাটের উপর থেকে উকি দিয়ে নিচে তাকালো। হিয়া কোমড়ে হাত দিয়ে বসে আছে আর বির বির করে কি জানি বলছে। শুভ্রকে দেখে কটমট করে তাকালো। তারপর বললো,” তাকিয়ে তাকিয়ে কি মজা নিচ্ছেন?”
শুভ্র হিয়ার কথা সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বললো,” কতক্ষন বসে থাকবা নিচে?”
” সারাদিন বসে থাকবো। আপনার কোনো সমস্যা?”, মুখ বাকিয়ে বললো হিয়া।
” নাহ্, কোন সমস্যা নেই। বসে থাকো।”,বলেই শুভ্র উঠে পড়ল।
হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। এইটা মানুষ নাকি পাথর। কোনো মায়া দয়া কিছু নেই। সে যে পরে গেছে একবার জিজ্ঞেসও করলো না, ব্যাথা পেয়েছে কিনা? উল্টে বলে কিনা কোমড় ভাঙ্গলে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাবে। হিয়া আস্তে আস্তে উঠলো।তেমন বেশি ব্যাথা পায় নি সে। কিন্তু ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই এভাবেই খাট থেকে এর সে পড়েনি কখনো। লোকটার সাথে যে এক বিছানায় ঘুমিয়েছে সেটা তার মাথাতেই ছিলো না।
কি ভয়ানক একটা এক্সপিরিয়েন্স। যাক রাতটা ভালোয় ভালোয় কেটেছে। হিয়া বিছানা গুছিয়ে চট জলদি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এই লোকটার আসে পাশে থাকা মানেই বিপদ।
এতো ভরে এর আগে কোনোদিন উঠেনি শুভ্র। হিয়ার রুমটা খুব সাজানো। পড়ার টেবিলে হিয়ার ফ্যামেলি ফটো। হিয়ার বাবার কথা শুভ্রের মনে আছে। এই ছবিতে স্পষ্ট তাকে সে চিনতে পারছে। শুভ্রের প্রথম সাইকেল চালানো তার কাছ থেকেই শেখা। তখন নয় দশ বছরের হবে হয়তো শুভ্রের। রফিক সাহেবের সাথে সেটাই তার প্রথম আর শেষ দেখা। এমন নির্মম মৃত্যু কেনো এই লোকটার বেলাই হলো।
শুভ্রের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার। তার বাবার না বলা কথা গুলোও আজ তার জানা হয়ে গেলো। বাবার উপর রাগটাও তার অনেকটা কমে গেলো। রফিক সাহেব যে বাবার কতো কাছের সেটা সে জানে। বাবা তাকে সবটা বললে হয়তো পুরো ব্যাপারটা এতো বাজে হতো না। হটাৎ এক বিষণ্ণতায় তার মুখে ভরে এলো। শুভ্র ছবিটা আগের জায়গায় রেখে হাঁটতে বেড়িয়ে এলো।
শুভ্র ফিরে আসতেই হিয়ার মামার সাথে দেখা। তিনি ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। শুভ্রকে আসতে দেখে পত্রিকা নামিয়ে বললেন,” জগিংয়ে গিয়েছিলে নাকি?” বলেই হিয়াকে ডাকতে ডাকতে বললো,” এই হিয়া জামাইকে তোয়ালে দে।”
শুভ্র চলে যাওয়ায় হিয়া এই ফাঁকে নিজের রুমে ঢুকে ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছিলো।” জামাইকে তোয়ালে দে ” মামার মুখে কথাটা শুনেই রাগ লাগলো। এই হনুমাটাকে আবার তোয়ালে দিতে হবে কেনো? কি দরদ! একেবারে জামাই জামাই করে পাগল। সে চলে যাচ্ছে তাতে কারোর কিছু না। হিয়ার আবার ডাক পড়তেই হিয়া উচু গলায় বললো,” আসি….!” জামাই জামাই করে সবাই পাগল হয়ে গেছে।
হিয়া তোয়ালে হাতে মুখ কালো করে এগিয়ে এলো। শুভ্র সোফায় বসে ছিলো। হিয়া তোয়ালেটা এনে একেবারে শুভ্রের মুখের সামনে ধরলো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তোয়ালেটার দিকে তাকালো। একদম মুখের সামনে এনেই ধরতে হবে মেয়েটার। শুভ্র তোয়ালে হাতে নিতেই হিয়া মামার দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে চলে গেলো।
শুভ্র তোয়ালে দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে মামাকে বললো,” আচ্ছা, হিয়ার বাবার কি হয়েছিলো। আমি শুধু দুসংবাদটা জানি এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।”
কথাটা জিজ্ঞেস করতেই হিয়ার মামার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,” কি আর বলবো? সব আল্লাহর ইচ্ছা। যতটুকু শুনেছি গভীর রাতে চালক নাকি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সরু রাস্তায়। তারপর বাস উল্টে খাদে পড়ে যায়। তারপর না হয় নাই বা বললাম। হিয়ার বাবা আইসিইউতে ছিলেন দুই দিন।”, এতটুকু বলেই চোখ ভিজে এলো তার।তিনি চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে বললেন,
” আকাশ আর আমার বোন ওরা তো শেষ চেষ্টাও আমাকে করতে দেয় নি। আর আমি অনেক চেষ্টা করেছি দুলাভাইকে বাঁচানোর কিন্তু পারিনি।” এতটুকু বলেই তিনি কেদে ফেললেন।
শুভ্র উঠে এসে মামাকে ধরলো। তিনি চোখের পানি মুছে বললেন,” আমি ঠিক আছি।” শুভ্র মামাকে ধরে তার পাশে বসলো।
” হিয়াকে আল্লাহ বাঁচাইয়া রাখসে কিন্তু ওর বাম পায়ে বিশাল এক ক্ষতি হয়ে গেছে। অপারেশন করাতে এখন শুধু হাঁটতে পারে। কয়মাস যে মেয়েটা বিছানায় বসে ছিল, চুপ করে শুধু কানতো। কথাও বলতো না ঠিক করে। ডাক্তার ওকে দৌড়াতে বারণ করছে। হিয়ার অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে মেয়ের বিয়ের জন্যে জমানো সব টাকা খরচ করে ফেলায়, তোমার মামীও কম কথা শোনায় নি মেয়েটাকে। সে মহিলাও দুশ্চিন্তায় এমন করতো।”, মামার কথার মাঝেই শুভ্র মামার হাত ধরে বললো,” আপনি চিন্তা করবেন না।আপনার মেয়ের বিয়ের সব ব্যাবস্থা আমি করবো।”
” তোমার বাবাও এক কথা বলছে। তাই তোমার মামী শান্ত আছে। কিন্তু হিয়ার জন্য আমার বড়ো চিন্তা হয়। আমার মেয়ের জন্যে তো আমি আছি।ওর তো কেউ নেই।”,মাথা নিচু করে বললেন তিনি।
” আমরা সবাই আছি।”, শুভ্রের মুখে এমন কথা শুনে মামা কিছুটা স্বস্তি পেলেন। ছেলেটাকে প্রথমে সে যেমনটা ভেবেছিল ছেলেটা আসলে তেমন না।
✨ শুভ্র নাস্তার টেবিলে বসতেই মেসেজের আওয়াজ হলো তার ফোন থেকে। শুভ্র ফোনটা বের করে হাতে নিলো। প্রভার ম্যাসেজ এসেছে। শুভ্র ম্যাসেজ দেখার আগেই হটাৎ হিয়ার মামী এসে শুভ্রের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বন্ধ করে পাশে রেখে দিয়ে বললেন,
” খাবার সময় ফোন টিপা ভালো না। খাবার খাওয়া একটা সওয়াবের কাজ।”
শুভ্রের মুখটা দেখার মতন হয়েছে। মামীর এমন আচরণে সে হতভম্ভ। হিয়া পাশেই বসে ছিল। শুভ্রের চোখ মুখের অবস্থা দেখে সে ঠোঁট চেপে হাসছে। মামী যে কি জিনিস লোকটা এইবার টের পাবে। মামী খাবারের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো,” তোমার নাকি ঢেঁড়স পছন্দ অনেক। তাই ঢেঁড়স করেছি, সবজিও নাকি খাও। সবজিও রান্না করেছি আমি।………….” মামী ক্রমাগত কথা বলতেই থাকলেন।
শুভ্রের রীতিমতন মাথা ধরে গেছে। আর ঢেঁড়স? এইটা কবে তার প্রিয় হলো। অদ্ভূত! চট জলদি নাস্তা করে সে উঠে পড়ল। তারপর নিজের ফোন নিতে ফিরে এসে দেখে হিয়া পুরো ঢেঁড়সের বাটিটা সামনে নিয়ে বসে আছে। আচ্ছা এই বার সে বুঝেছে ঢেঁড়স তার প্রিয় কথাটা হিয়ার মামী কেনো বলেছে। বাঁদরটা নিজের পছন্দ তার উপর চালিয়ে দিয়েছে। শুভ্র চলে যেতেই হিয়ার মামী আবার আসলো। তারপর শুভ্রকে বললো,” আমি এতো কষ্ট করলাম তুমি তো একবার খেয়েও দেখলে না।”
শুভ্র অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো। তারপর মামী হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” তুই পুরো বাটি নিয়ে বসেছিস কেনো? দে জামাইকে একটু খাইয়ে দে।” বলেই তিনি সামনে গেলো।
মামির কথা শুনে হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। মামির কথায় হিয়াকে লজ্জা দিতেই শুভ্র ঝুকে এসে বললো,” দেও। খেয়ে বলি কেমন হয়েছে।”
হিয়া হা করে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। মামীর হাতের ঢেঁড়স হিয়ার অনেক পছন্দ। মামী শুভ্রের প্রিয় খাবার জানতে চেয়েছিল, শুভ্রও বাসায় ছিল না। তাই হিয়ার যেটা খেতে ইচ্ছে করেছিল সে সেটা বলে দিয়েছে। এমন ভেজালে পড়তে হবে কে জানতো।
হিয়া বাটিটা শুভ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” নিজে নিয়ে খান।”
” পারবো না। আমার নামে মিথ্যে কথা ছড়িয়েছ এর ফল তো তোমাকে ভুগতেই হবে। খাইয়ে দেও।” বলেই হিয়ার মামীর দিকে ঈশারা করলো। হিয়া মুখ কালো করে শুভ্রের দিকে তাকালো। পাগল হয়ে গেছে, সবাই পাগল হয়েগেছে। লোকটাকে আবার খাইয়ে দিতে হবে। কেনো? হাত আছে কেনো? সাজিয়ে রাখার জন্যে? দূর থেকে মামী তাকিয়ে আছে।
অসহ্য লাগছে, হিয়া কথা বাড়ালো না চামচে করে এক গাল খাইয়ে দিতেই শুভ্রের চোখে চোখ পড়ল। হিয়ার বুকের ভিতরটা ধুক ধুক শুরু হয়েছে হিয়া সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। শুভ্র যেতে যেতে মামীকে বললো,” দারুন হয়েছে।”
হিয়ার ইচ্ছে করছে ঢেঁড়সটা লোকটার মাথায় ঢেলে দেয়। ইচ্ছে করে এমন করলো। বদমাইস ডাক্তার।
✨ হিয়া গাড়িতে উঠার সময় শুভ্রকে ড্রাইভিং সীটে দেখে হা করে রইলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,
” ড্রাইভার কাকু কোথায়? আপনি একা এসেছেন? আমাকে আপনার সাথে একা একা সাড়া রাস্তা যেতে হবে?”
শুভ্র নিজের চশমাটা পরিষ্কার করছিলো। হিয়ার কথায় সে উত্তর দিলো না। চশমা পড়ে সামনে তাকিয়ে বললো,” কচটেপ আছে?”
উত্তর না পেয়ে হিয়া গাড়িতে উঠে বসছিলো। শুভ্রের এমন প্রশ্নে হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” কেনো? আপনার চশমা ভেঙে গেছে?”
শুভ্র আড় চোখে হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বললো,” যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলো।”
হিয়া রেগে বললো,” আরে আমার কাছে কচটেপ আসবে কোথা থেকে? আমি কি স্টেশনারি দোকান ব্যাগে নিয়ে ঘুরি?”
” এক কাজ করো। তোমার রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে কচটেপ নিয়ে নিজের মুখে লাগিয়ে তারপর আসো।”, গম্ভীর মুখে বললো শুভ্র।
হিয়া রেগে গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার জন্যে সিট বেল্ট খুলতে নিতেই শুভ্র গাড়ী স্টার্ট দিলো। হিয়া কড়া গলায় বললো,” গাড়ি থামান। আমি আপনার সাথে যাবো না, আমি একা একা ট্রেনে করে যেতে পারবো।”,হিয়ার কথার মাঝেই শুভ্র ইয়ারপড কানে দিয়ে এক দৃষ্টিতে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়া মুখ গোমড়া করে বসে বসে শুভ্রকে মনে মনে বকা দিতে লাগলো।
[ #চলবে ]
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১৫
বাড়িতে ফিরে আরেক কান্ড, শুভ্রের ফুফু এসেছেন। রবীউল সাহেবের একমাত্র বড় বোন। রবীউল সাহেব যতটা শান্ত এই মহিলা অতটাই অশান্ত। ভাইয়ের বাড়িতে এসেই হুলোসস্তর শুরু করে দেয় সে। গাড়ী বাড়ির সামনে থামতেই হিয়া নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রের দিকে তাকালো পর্যন্ত না। লোকটা তাকে অনেক কিছু বলছে, এনার সাথে সে আর কথাই বলবে না।
বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে শুভ্রের ফুফুর মুখোমুখি হলো হিয়া। শুভ্রের ফুফুকে সে এর আগে দেখেনি। খুব সাস্থ্যবান মহিলা। গালের দুপাশে বয়সের ছাপ পড়লেও মাথা ভর্তি কালো কেশ। গায়ের রং শ্যামলা।
পাশে সাহারা খাতুন কড়াইয়ে তেল দিচ্ছিল। হিয়াকে দেখে শুভ্রের ফুফু রাবেয়া আক্তার বললেন,” সাহারা.. কে এই মেয়ে।” মহিলার কণ্ঠ এমন যা শত আওয়াজের মাঝেও আপনার কানে বাজবে। হিয়া থমকে দাড়ালো। তারপর সৌজন্যের জন্যে হালকা হেসে তাকালো। সাহারা খাতুন হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বললো,” ও আপনার ভাইয়ের বন্ধুর মেয়ে।”
মহিলাটা আর কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগে সাহারা খাতুন হিয়াকে বললেন,” জার্নি করে এসেছো। যাও রূমে গিয়ে রেস্ট নেও।” হিয়া চুপচাপ সিড়ি বেয়ে উপরে নিজের রূমে চলে গেলো।
হিয়া চলে যেতেই রাবেয়া আক্তার বললেন,” মেয়েটা সুন্দর। বড় বড় চোখ। কি সুন্দর ব্যাবহার! আমার পছন্দ হয়েছে।”
রাবেয়া আক্তারের মুখে এমন কথা শুনে পরক্ষনেই সাহারা খাতুনের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
✨
ক্লাস শেষে ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে ভার্সিটির সামনে দেখে শুভ্র এগিয়ে আসলো। শুভ্রের পিছু পিছু প্রভাও এলো। শুভ্র ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,” কি ব্যাপার তুমি এইখানে কি করছো? তোমাকে আমি কি বলেছিলাম?”
ড্রাইভার মলিন গলায় বললো,” গিয়েছিলাম কলেজের সামনে। আপামনি আসে নাই।”
হিয়ার এমন আচরণে শুভ্রের রাগ হচ্ছে। কোনো কথা শুনে না, নিজের যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়। শুভ্র ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসলো। প্রভা হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
” কলেজে।”, বলতে বলতে সিট বেল্ট পরে নিল শুভ্র।
প্রভা গাড়ীর অন্যপাশের দরজা খুলে শুভ্রের পাশের সিটে বসে পড়তেই শুভ্র অবাক হয়ে তাকাতেই প্রভা বললো,” আমিও যাবো। বাই দ্যা ওয়ে তুই এতো অস্থির হয়ে আছিস কেনো?”
শুভ্র গাড়ির স্টার্ট দিতে দিতে বললো,” অস্থির হয়ে থাকতে যাবো কেনো?”
” নাহ্ তোকে দেখে মনে হলো। কিন্তু কলেজে যাচ্ছিস কেনো?”, মনের কোনের ক্ষীণ সন্দেহ থেকে প্রশ্ন করলো প্রভা।
শুভ্র দৃষ্টি সামনে রেখে বললো,” ওইদিন রাস্তায় কিছু ছেলে নাকি হিয়ার পিছু নিয়েছিলো। তাই সেফটির জন্য গাড়ি পাঠালাম কিন্তু মহারানী তো আবার সোজা কথার মানুষ না।”
শুভ্রের মুখে এমন কথা শুনে প্রভার বুকটা ধক করে উঠলো। শুভ্রের হিয়ার জন্যে এতো অস্থির হয়ে আছে। কই তার জন্যে তো শুভ্রকে কখনো এমন অস্থির হতে দেখেনি। প্রভা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো,” তোর কি হিয়ার জন্যে চিন্তা হচ্ছে?”
শুভ্র হা বা না কিছু বলার আগেই শুভ্র জোরে ব্রেক কষলো। তারপর গাড়ী থেকে নেমে গেলো। প্রভা অবাক হয়ে শুভ্রের ছুটে যাওয়া দেখছে।
আজ ছেলেগুলো ফাঁকা জায়গা পেয়ে হিয়ার পথ আটকে দাড়িয়েছে। হিয়া ভয় পেলেও চোখে মুখে সে ভয়ের ছাপ প্রকাশ করেনি। তিনজনের মাঝের সুন্দর ছেলেটা এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” কি ভেবেছো? কয়েকদিন কলেজে না আসলে আমরা ভুলে যাবো যে তুমি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলে।”
হিয়া দু পা পিছালো। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে।ছেলেটা আরো বললো,” এতদিন কিছু করিনি কিন্তু আজ করবো।”,বলেই পাশের ছেলেটাকে ঈশারা করতেই সে এসে হিয়ার হাতের কব্জি চেপে ধরলো।
ভয়ে হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর কড়া গলায় বললো,” আমি কে তোমরা জানো? আমার যদি কিছু হয়েছে না তোমাদের এমন হাল হবে ভাবতেও পারছো না। আমাকে ছেড়ে দেও।” আত্মরক্ষায় বানিয়ে বানিয়ে কিছু মিথ্যে কথাও বললো। তাতে কোনো লাভ হলো না। ছেলে গুলো উচু গলায় হাসতে লাগলো। তারপর হিয়ার হাত ধরে টানতে লাগতেই হিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলো। তবুও সাহস করে ছেলেটার হাতে সজোরে এক কামড় বসিয়ে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলো। পিছনে ছেলে গুলোও ছুটছে, হিয়ার পায়ে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে কিন্তু এ ব্যাথা এখন তার কাছে কিছুই না।
চিপা গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তায় আসতেই হটাৎ একটা বাসের সামনে এসে পড়লো হিয়া। হিয়া চোখ মুখ কুচকে ফেলতেই মনে হলো কে যেনো তাকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে নিয়েছে।
শুভ্র দৌড়ে এসে হিয়াকে নিজের বুকে টেনে সরিয়ে আনলো বাসের সামনে থেকে। হিয়া শক্ত করে শুভ্ররের শার্ট চেপে ধরলো, শুভ্রের বুকে মাথা রাখতেই হিয়া শুভ্রের হৃদ কম্পন অনুভব করতে পারলো। প্রচন্ড গতিতে শুভ্রের হার্ট বিট করছে।
বাস চালক ব্রেক কষে জানালা দিয়ে মাথা বের করে কড়া গলায় বললো,” এমন রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করেন কেন? যত্তসব,পরে দুর্ঘটনা হইলে তো ড্রাইভারের দোষ।” বলেই তিনি বাস স্টার্ট দিলেন।
বাস চালকের এমন উক্তিতে হিয়ার হুস ফিরল। হিয়া শুভ্রের বুক থেকে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো। শুভ্র চোয়াল শক্ত করে রাগে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। শুভ্র হিয়ার দুই বাহু শক্ত করে ধরে ধমক দিয়ে বললো,” তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? এভাবে কেউ রাস্তার মাঝে দৌড়ায়?”, হিয়া মাথা নিচু করে রইলো কোনো উত্তর দিলো না খালি একবার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চিপা গলিটার দিকে তাকালো। হিয়ার এই তাকানোতেই শুভ্র সবটা বুঝে গেলো। শুভ্র সেদিকে তাকালো কিন্তু আসে পাশে কাউকে দেখলো না।
শুভ্র আরো রেগে গিয়ে বললো,” গাড়ি পাঠিয়েছিলাম না। এতো কিসের জেদ তোমার?”
এতক্ষণে প্রভা গাড়ি থেকে নেমে ছুটে এলো। প্রভাকে দেখে হিয়া শুভ্রের শার্ট ছেড়ে কিছুটা পিছিয়ে দাড়ালো। এর মাঝেই শুভ্র আবার ধমক দিয়ে বললো,” চুপ চাপ দাড়াও। এক পাও নড়বে না।”
হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। হিয়ার ভয় লাগছে। এমন রেগে আছে কেনো লোকটা? হিয়ার কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে শরীরটা কাপছে, পায়েও প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে। দাতে দাত চিপে সে ব্যাথা সহ্য করছে হিয়া।
প্রভা এগিয়ে এসে বলল,” কি হয়েছে? হিয়া তুমি ঠিক আছো?” বলেই শুভ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলো শুভ্রের রক্তিম চেহারা।এসব ব্যাপারে শুভ্র একটু বেশি রাগী। শুভ্র যদি হাতের কাছে ছেলেগুলোকে পেতো তাহলে প্রথমে মেরে হাড় ভেঙ্গে তারপর নিজেই ব্যান্ডেজ করে বাড়িতে পাঠাতো।
শুভ্র তো এমনই রাগী। প্রভা এগিয়ে গিয়ে হিয়ার হাত ধরে ওকে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতেই হিয়া এক পা ফেলেই ব্যাথায় আর্তনাদ করে, আবার ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করলো।
প্রভা বললো,” তুমি কি ব্যাথা পেয়েছো কোথাও? ওরা কি কিছু করেছে?” তারপর পাশেই একটা বেঞ্চ দেখতে পেয়ে হিয়াকে সেখানে বসালো। তারপর প্রভা ভালো করে দেখলো হিয়ার হাতে চাপের দাগ পরে গেছে। কেউ শক্ত করে ধরলে যা হয়।
হিয়া পায়ে হাত দিয়ে ব্যাথায় নাক মুখ কুচকে আছে। উফফ অসহ্য এই ব্যাথাটা আবার শুরু হয়েছে। শুভ্র কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে নিশ্চুপে তাকিয়ে থেকে নিজের শার্টের হাতা ভাজ করে এগিয়ে এসে হিয়াকে কোলে তুলে নিতেই, হিয়া হকচকিয়ে উঠলো। ভরা রাস্তায় লোকটা কি করছে? হিয়া লজ্জায় মাথা নামিয়ে বললো,” নামান আমাকে, মানুষ দেখছে।”
শুভ্র হিয়ার দিকে একবার রাগী চোখে তাকাতেই হিয়া চুপ করে থেকে নিজের মুখটা শুভ্রের শার্টে লুকিয়ে ফেললো। আশেপাশের অনেকেই হা করে তাকিয়ে দেখছে, ব্যাপারটায় যেনো তারা খুব মজা পাচ্ছে।
প্রভা সেই মানুষের ভিড়ে দাড়িয়ে আছে নিশ্চুপে। হটাৎ কেমন একটা অদৃশ্য ব্যাথা তার শরীরে বয়ে যাচ্ছে। ব্যাথাটা আরো তীব্র হলো যখন শুভ্র হিয়াকে প্রভার জায়গায় বসালো। সময় যেনো সেইখানেই থমকে গেছে প্রভার। শুভ্র ড্রাইভিং সিটে বসার আগে প্রভাকে খুঁজলো কিন্তু হটাৎ প্রভা এই ভিড়ের মাঝে নেই। তাহলে কি প্রভা চলে গেছে।
শুভ্র ড্রাইভিং সিটে বসে একবার হিয়ার দিকে তাকালো। ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে মাথা নুইয়ে আছে সে। শুভ্র গাড়ি থামতেই হিয়া চোখ খুললো। তারপর বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। এইটা তো বাসা না, ক্লিনিক। হিয়া কৌতূহল চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো ততক্ষনে শুভ্র গাড়ি থেকে নেমে গেছে। হিয়া চুপ চাপ শুভ্রের কান্ড দেখছে। শুভ্র কিছুক্ষণ পর এসে হিয়ার পাশের দরজাটা খুললো। দরজা খুলে বের হতে গিয়ে দেখলো শুভ্র একটা হুইলচেয়ার সামনে এনে রেখেছে। হিয়া হকচকিয়ে তাকালো তারপর বললো,” এটা এনেছেন কেনো? আমি এটাতে বসবো না। আর ক্লিনিকেও যাবো না।”
শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তুমি যাবা না তোমার ঘাড় যাবে।”
” নিয়ে যান। আমার ঘাড় নিয়ে যান কিন্তু আমার পা যাবে না।”, আসে পাশে তাকিয়ে বললো হিয়া।
শুভ্র ধমকের সুরে বললো,” সাট আপ।”
হিয়া হুইলচেয়ারে বসতে একদম পছন্দ করে না। এর আগেও তাকে বসতে হয়েছে। আর সে তো হাঁটতে পারে তাহলে কেনো হুইচেয়ারে যাবে। হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” ধমক দিয়ে কাজ হবে না। আমি হুইলচেয়ারে করে যাবো না, ব্যাস।”
” বসতে বলেছি। নাহলে সবার সামনে কোলে তুলে নিবো।”,বলেই শুভ্র এগিয়ে আসতেই হিয়া ফট করে হুইলচেয়ারে বসে পড়লো। এই ছেলের কোলে বসার তার কোনো শখ নেই। যে ভরা রাস্তায় কোলে নিতে পারে সে যে এইখানে নিবে না তার কি গ্যারেন্টি!
[ #চলবে ]