নীলচে তারার আলো পর্ব-৪৩ এবং শেষ পর্ব

0
1228

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#সমাপ্ত_পর্ব

কয়েক বছর পর,

দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর জীবন থেকে হারিয়ে গেলো। এই বছরে গুলো যেনো একটা স্রোতের মতে তাদের জীবন থেকে চলে গেছে, নিয়েগেছে অনেক কিছু।

হিয়া তার মামাকে হারিয়েছে। সেই বছরটা যেনো দুঃস্বপ্নের মতন রয়ে গেছে তার জীবনে।
হিয়া অনেক কিছু শিখেছে আরো বড় হয়েছে। তাই ভালোবাসার মানুষগুলোকে সে খুব শক্ত করে আকড়ে ধরে বেচেঁ আছে। সবটা সময় সে একটা ভয়ের মধ্যে বাস করে, ভালোবাসার মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলার ভয়।

সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা যে কিনা রাগ হলে ঠোঁট উল্টে বসে থাকতো সে আজ উকিল হয়েছে। সময় কতো কিছু বদলে দেয় তাই না। হিয়াকে ও বদলে দিয়েছে কিন্তু শুভ্র তো পাশে ছিলো, সে আগলে রেখেছে সারাক্ষণ।

শুভ্র সবে এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছে আজকের ফ্লাইটে সে দেশে ফিরবে। হসপিটালের কাজে তাকে দেশের বাহিরে যেতে হয়েছে তিন দিনের জন্যে।

শুভ্র ভীষন চিন্তায় আছে। যদিও চিন্তাটা তার নিজের জন্যে না, হিয়ার জন্যে। হিয়া যেই মামলা নিয়ে উচ্চ আদালতে লড়ছে সেই মালমা নিয়েই সে নিম্ন আদালতে হেরে গেছে। আজ সে মামলার রায় বের হবে। তাই শুভ্রের এতো চিন্তা, সে হিয়ার কাছে থাকতে পারলে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারতো।

হিয়াকে সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু মেয়েটার ফোন ধরার নাম নেই।

আর কিছুক্ষণের মধ্যে রায় বের হবে। হিয়া নিশ্চিৎ এইবার সে আসল অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে পেরেছে এইবার তারা হারবে না। এর আগের আদালতে দোষীরা যতই নকল রিপোর্ট আর প্রমাণ জোগাড় করে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করুক না কেনো এইবার হিয়া আট ঘাট বেধে তবেই নেমেছে।

মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বড়লোকের এই ছেলেরা একটা ছাত্রকে দিনে দুপুরে গাড়ী চাপা দিয়ে মেরে ফেললো অথচ এর কোনো বিচার হবে না? এদের শাস্তি তো পেতেই হবে। আর সেটাই হলো হিয়া প্রমাণ করতে পেরেছে, আদালত ছেলে দুটোকে দোষী সাব্যস্ত করে যথাযথ শাস্তির আদেশ দিলেন।

সন্তানহারা বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছে সে। এই মামলা তো তাকে জিততেই হতো। তার বাবা মা আর ভাইটাকেও তো সে একদিন এমন এক অসাবধান চালকের জন্যে সারাজীবনের মত হারিয়েছে।

হিয়া গায়ের কালো কোর্টটা খুলে হাতে নিতেই তার চোখ ভিজে এলো। হিয়া চোখের পানি মুছে গাড়িতে উঠতে যাবে হটাৎ শিল্পপতি আকরাম হোসেন তার সামনে এসে দাড়ালেন। তার চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ, অবশ্য রাগ থাকবে নাই বা কেনো? এতো টাকা থাকতেও তার ছেলেদের জেলে গিয়ে থাকতে হচ্ছে।

আকরাম হোসেন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,” অ্যাডভোকেট হিয়া আহমেদ কাজটা কি আপনি ঠিক করলেন? এক বাবা মার কোল খালি হয়েছে বলে আরেক বাবা মায়ের সন্তান ছিনিয়ে নিবেন?”

হিয়া ভ্রু কুচকে বললো,” আপনি ভুল করছেন। আপনার সন্তান আপানাদের কাছেই ফিরে আসবে। হ্যা, সে যে ভুলটা করেছে তার উপযুক্ত শাস্তি পেয়ে তবেই। কিন্তু যারা একবার হারিয়েছে তারা কি আর ফিরে পাবে? আপনার ছেলে জেলে থাকবে বলে আপনার এতো কষ্ট হচ্ছে আর ওনাদের ছেলেটা যে মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করেছে? তাদের কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা ভেবে দেখেছেন?”

” এতো কৌশলে খেলাটা তো খেললেন। আপনার বুদ্ধি দেখে আমি অবাক। কিন্তু কি লাভ হলো বলুন তো? আমার ছেলেকে তো আমি ঠিক ছাড়িয়ে নিয়ে যাবো।”, বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন তিনি।

হিয়া খুব সুন্দর করে হেসে বললো,” স্যার, সে ক্ষমতা যে আপনার আছে সেটা আমি জানি। কিন্তু এই বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেই আমি খুশি। যতদিন আপনাদের মত মানুষদের হাতে এমন ক্ষমতা থাকবে, আমরা সারা জীবন লড়ে গেলেও দিন শেষে আপনদের ক্ষমতার কাছে হেরে যাবো। পারলে নিজের ছেলেকে একটু বোঝাবেন। আপনি এতটা খারাপ মানুষ বলে তো মনে হয় না। শুনেছি সব খারাপ মানুষেরও একটা ভালো দিক থাকে। আচ্ছা আজ, তাহলে আসি।” বলে হিয়া গাড়িতে উঠলো।

আকরাম হোসেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার হাসি মুখে কি সুন্দর করে সত্যি কথাটা তার মুখের উপর বলে গেলো। কিন্তু কেনো জানি তার রাগ লাগছে না। মেয়েটার চোখের স্পষ্ট ব্যার্থতা ফুটে ছিলো। সে ব্যার্থ হবে জেনেও এতো পরিশ্রম করেছে শুধু এই মা বাবার মুখে হাসি ফুটাতে? কয়েক মুহূর্তে তার নিজের জন্যে নিজেরই খারাপ লাগলো। পৃথিবীর সব খারাপ মানুষরা জানে তারা খারাপ কিন্তু একবার সে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলে যে আর পিছন ঘুরে তাকানো যায় না।

হিয়া গাড়িতে উঠে ড্রয়ার থেকে ফোনটা বের করে দেখে শুভ্রের এতগুলো কল। আদালতে আসার আগে শুভ্রের ঘুম নষ্ট হবে তাই সে ফোন করেনি। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে কয়েকবার কল ব্যাক করলো। কিন্তু ফোন বন্ধ তাহলে কি ফ্লাইটে উঠে পড়েছে? হিয়া সময় দেখলো।

হ্যা শুভ্রের ফ্লাইট তো আরো ঘণ্টা খানেক আগেই ছিলো। হিয়া গাড়িতে গাল ফুলিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। ভালো লাগে না, কত কথা বলার ছিলো। এবার আরো কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে কখন ডাক্তার সাহেব ফ্লাইটে করে ঢাকায় ফিরবে। হটাৎ হিয়ার একটা কথা মনে পড়লো। আজ না তার টেস্টের রিপোর্ট দেওয়ার কথা? কালকেই তো সে টেস্ট করলো। শরীরটা কেমন জানি করছিলো। শুভ্রকে সে জানায় নি জানলে তো হয়েছে, কিন্তু শুভ্র আসার আগেই তাকে রিপোর্ট নিয়ে আসতে হবে। হনুমানটাকে কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না।

হিয়া গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। সে বাড়ি ফিরবে না। দিবার সাথে দেখা করে রিপোর্ট নিয়ে সে সোজা এয়ারপোর্টে যাবে। হিয়া গাড়ি চালানো শিখেছে কয়েকমাস হলো। খুব ভালো পারে না সে কিন্তু ঠিক ঠিক হয়। দিবার বাড়ির সামনে এসে হিয়ার গাড়ি থামলো। সামনে দিবার বিয়ে, সেসব নিয়ে জমিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়া যাবে। হ্যা সেই দিবার ইভানের সাথেই। দিবা বিয়ে করেই ছেড়েছে।

✨ ডাক্তার রায়হানের হাত ব্যান্ডেজ করতে করতে বললো,” হুট হাট রাগ হবে তাই বলে এমন অবস্থা করবেন হাতের। এমনিতেই তো কম মেয়েরা আপনার জন্যের পাগল না। আর কটা মেয়েকে পাগল করতে চান, যে এইসব শুরু করেছেন।”

রায়হান ডাক্তারের কথায় হাসছে। রিমি ভ্রু কুঁচকে পাশে দাড়িয়ে আছে। আজ রায়হানের ফিরে যেতে হবে অথচ আজ এই রায়হান প্রকাশনীর উপর রেগে কি একটা অবস্থা করলো। রিমি চিন্তিত হয়ে বললো,” বেশি কিছু হয়েছে ডাক্তার?”

ডাক্তার সাহেব তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললেন,” হতে হতে বেচেঁ গেছে। উনি যেভাবে হাসছে, তাকে মনে হচ্ছে রোজ এমন ব্যান্ডেজ বাঁধা তার অভ্যাস আছে।”

রায়হান হাসি থামিয়ে বললো,” আরে ডাক্তার সাহেব রাগ করলেন নাকি? রাগ করবেন না। আর আপনার শেষের কথা কিন্তু ঠিক বলেছেন। এইসবের অভ্যাস আছে আমার। ”

” হ্যা, সে আপনাকে দেখেই টের পেয়েছি।”, আড় চোখে তাকিয়ে বললো ডাক্তার। রায়হান ঠোঁট চেপে নিজের হাসি থামালো। লোকটা সেই বিরক্ত হয়েছে তার এমন হাসিতে। ডাক্তারের ভিসিট দিয়ে তারা বেড়িয়ে এলো।

” তুমি তো আমাকে তোমার সাথে নিবে না আর। তাই বলছিলাম নিজের একটু খেয়াল রেখো?”, অনুরোধ করে বললো রিমি।

” কেনো? তোর বুঝি চিন্তা হয়?”, আড় চোখে তাকিয়ে বললো রায়হান। রিমি অপ্রস্তুত হয়ে বললো,” জ্বি না, তোমার মেয়ে ভক্তরা তো আবার তোমার কিছু হলে হার্ট অ্যাটাক করে তাই বললাম।”

রায়হান হেসে উঠে বললো,” তোর আমার ভক্তদের নিয়ে খুব চিন্তা।” বলে সামনে তাকাতেই রায়হানের হাসি আস্তে আস্তে সংকুচিত হলো। সে থমকে দাড়িয়ে পড়লো।

এটা তো সে চায় নি? হিয়াকে আবার সে দেখবে তার জন্যে তো সে ফেরেনি! তাহলে কেনো? রায়হান পাশের একটা বেডে ঢুকে নিজেকে হিয়ার চোখের থেকে আড়াল করলো। পোশাক দেখে তো মনে হচ্ছে স্ট্রবেরী আইজীবি হয়ে গেছে। কিন্তু এই ক্লিনিকে হিয়া কি করছে? এতো ব্যাস্ত হয়েই বা ছুটছে কেনো? রায়হান রুম থেকে বের হলো না সেইখানেই অপেক্ষা করলো। হিয়া নিশ্চয় এইখানে দিয়েই ফিরবে।

রিমি ফোন নিয়ে ব্যাস্ত হওয়ায় খেয়াল করেনি রায়হান কোথায় গেছে। এবার সে ব্যাস্ত হয়ে রায়হান কে খুঁজতে লাগলো। হুট করে আবার কোথায় চলে গেলো রায়হান।

রায়হান বুঝতে পারছে এই বেডের বুড়ো লোকটা তার এইভাবে ঢুকে পড়ায় বেশ বিরক্ত। রায়হান হাসি মুখ করে তার দিকে তাকালো। কিন্তু লোকটা তাও তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। রায়হান বৃদ্ধ লোকটার থেকে চোখে সরিয়ে বাহিরে তাকাতেই দেখলো। হিয়া ফিরে যাচ্ছে, হাতের রিপোর্ট গুলো বুকের সাথে জড়িয়ে রেখে খুব সাবধানে প্রতিটি পা ফেলছে। চোখ মুখ তার হাস্যোজ্জ্বল।

রায়হান অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিরবে হাসলো। হিয়া চলে যেতেই সে বেড়িয়ে এলো। রিমি এইদিকে রায়হানকে ফোন করতে ব্যাস্ত। রায়হান রিমির সামনে এসে দাড়াতেই সে চমকে তাকালো। তারপর রায়হান রিমিকে তাড়া দিয়ে বললো,” এদিক সেদিক চলে যাস কেনো? দেখলি তোর জন্যে কত দেরি হয়ে গেছে। চল জলদি।”

রিমি থ মেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” আচ্ছা চলো। আমি তো এইখানেই ছিলাম।” বলেই রায়হানের পিছু পিছু এলো।

হিয়া এয়ারপোর্টের সামনে গাড়ি থামলো। খুব সাবধানে আজ সে গাড়ি চালিয়েছে। রিপোর্ট টা যত্ন করে ড্রয়ারের রেখে গাড়ি লক করে বেরিয়ে এলো। হিয়া নিজের খুশী সামলাতে পারছে না। একপাশে দাড়িয়ে এবার শুভ্রের জন্যে অপেক্ষা।

হটাৎ তার কাছ ঘেঁষে হুডি পড়া একটা ছেলে গেলো। হিয়ার এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো সে ছেলেটাকে হয়তো চেনে। তার কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে হিয়ার পাশে এসে দাড়ালো। মেয়েটা হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

হিয়া কিছুক্ষণ তাকানোর পর চিনতে পেরে অবাক হয়ে বললো,” তুমি রিমি না?”

রিমি মলিন হেসে বললো,” চিনতে পেরেছো বুঝি? এতো বছর পর মনে আছে আমার কথা?”

” হ্যা, মনে আছে। কিন্তু.. তুমি এইখানে কি করছো? কাউকে নিতে এসেছ?”, আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো হিয়া।

” নাহ্, সী অফ করতে এসেছিলাম একজনকে। বাই দ্যা ওয়ে তুমি বই পড়ো?”, বলেই রিমি নিজের ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে এগিয়ে দিলো হিয়ার দিকে, হিয়া হাত বাড়িয়ে বইটা নিলো। বইটার দিকে তাকানোর আগে রিমি বললো,” বই পড়তে ভালো না লাগলেও বইটা পড়বে, কেমন?”

হিয়া হেসে উঠে বললো,” আচ্ছা, পড়বো।”, তারপর বইটার দিকে তাকিয়ে দেখলো। নীল মলাটের বইটায় সাদা সাদা অক্ষরে লেখা #নীলচে_তারার_আলো নামটা হিয়ার পছন্দ হয়েছে কার লেখা বইটা সেটা দেখে মুহূর্তের জন্যে থমকে গেলো সে। রায়হান সাদিক, নামটা পড়তেই যেনো জীবনের পাতা উল্টে অনেক বছর পিছিয়ে যেতে হলো তাকে। হিয়া কি বলবে সে ভাষা খুজে পাচ্ছে না, বইয়ের নামটা দেখে একটা ঢোক গিললো সে।

তারপর রিমির দিকে তাকাতেই রিমি বললো,” তুমি আর শুভ্র ভাইয়া খুব লাকি। তোমাদের ভালোবাসা সার্থকতা পেয়েছে। নয়তো কয়জন এমন ভাগ্য নিয়ে জন্মায় যে ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পায়।” বলেই চুপ করে গেলো তারপর গলা ধারিয়ে বললো,” আচ্ছা আমি গেলাম।আবার দেখা হবে।” কথাটা বলে রিমি আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না। রিমির কণ্ঠে যেনো কিসের এক কষ্টের আওয়াজ শুনতে পেলো হিয়া।

হিয়া বইটা হাতে দাড়িয়ে আছে। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বইটা খুলল সে। প্রথমে রায়হানের তোলা অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত কিছু ছবির পিছনের সে ছবির গল্পগুলো লেখা তারপর শেষের দিকে রায়হানের নিজের কিছু কথা। হিয়া শুধু পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছে। শেষ পৃষ্ঠায় শেষ লাইনটা দেখে সে থামলো।

সবাই আমাকে একটাই প্রশ্ন করে যে আমার কি কখনো একা লাগে না? তাই ভাবলাম বইটা এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শেষ করি।
আসলে আমার একদমই একা লাগে না। আমার সাথে তো আকাশের নীল তারাটা আছে আমার একা লাগবে কেনো? কখনই লাগে না। অনেকবছর ধরে এই নীল তারাই তো আমাকে সামলেছে।

এইটুকু পড়ে হিয়া বইটা বন্ধ করে ফেললো। কেমন খারাপ লাগা কাজ করছে তার মাঝে। সে জানে সে একজনকে কষ্ট দিয়েছে কিন্তু হিয়ার প্রতি সেই মানুষের কি অনুভূতি সেটা সে জানতে চায় না। যত জানবে তত ভিতর থেকে নিজেকে তার সামান্য হলেও দোষী মনে হবে।

হিয়ার হুট করে কেমন যেনো লাগছে। হিয়া পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়লো। বইটা একপাশে রেখে দুহাতে নিজের মুখ গুজলো। কিছুক্ষণ পর হটাৎ কারোর হাত নিজের মাথায় অনুভব করতেই হিয়া চোখ তুলে তাকালো। তাকাতেই শুভ্রকে দেখে হিয়া উঠে দাড়িয়ে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলো। হিয়ার বিষণ্ণ চেহারা দেখে শুভ্র চিন্তায় পড়ে গেল হিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,” কি হয়েছে হিয়া?”

হিয়া মুখ তুলে শুভ্রের দিকে কিছুক্ষন তাকালো তারপর শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,” একটা কথা বলার আছে।”

শুভ্র হিয়ার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,” তুমি এইবার ওদের হারাতে পেরেছো, রাইট?”

হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” আপনি কি করে জানলেন?”
” টেলিপ্যাথি।”,বলেই হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া নিচের ঠোঁট কামড় হাসলো তারপর বললো,” কিন্তু আমার আরেকটা কথা বলার আছে। খুব স্পেশাল কিছু।”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,” কি স্পেশাল কথা?” শুভ্রের প্রশ্নে হিয়ার মুখের হাসি আরো প্রসারিত হলো। পরক্ষনেই নিজের হাসি আটকানোর ব্যার্থ চেষ্টা করলো সে। হিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,” আ..ম..আমি…..” এতটুকু বলেই হিয়া নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো।

শুভ্র আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। হিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে অস্পষ্ট করে বললো,” আমি প্রেগনেন্ট।” বলেই হিয়া এলোমেলো দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকালো।

শুভ্র কথাটা শুনে দুবার চোখের পলক ফেললো। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথাটা কাত করে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” তুমি প্রেগনেন্ট?” কথাটা শেষ করতেই শুভ্রের ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হলো।

হিয়া কোনো কথা বলছে না অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজের হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়া গাল দুটো ধরে উপরে তুলে বললো,” দেখি আমার দিকে তাকাও।” হিয়া লজ্জায় তাকালো না। শুভ্র ঝুকে আসতেই হিয়া চমকে নিজের ঠোট চেপে ধরে বললো,” কি করছেন এইখানে?”

শুভ্র ঠোঁট চেপে নিজের হাসি থামিয়ে ঝুকে এসে হিয়ার কপালে অধর ছুয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বললো,” আজ থেকে তোমার লাফালাফি বন্ধ। আর একা একা এসেছো কেনো এইখানে?”

হিয়া ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এইযে শুনতে না শুনতেই শাসন শুরু করেছে। শুভ্র হিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,” ড্রাইভার কাকু কোথায়?” হিয়া মুখ ভার করে বললো,” আমি নিজে ড্রাইভ করে এসেছি।”

শুভ্র কড়া চোখে তাকাতেই হিয়া বললো,” একদম আমাকে বকবেন না। ” শুভ্র নিজেকে শান্ত করে হিয়ার হাত ধরে গাড়ির সামনে নিয়ে এলো তারপর হিয়ার সিটবেল্ট পরিয়ে দিতে দিতে বললো,” দিস ইস লাস্ট টাইম। এরপর আমাকে ছাড়া তুমি বাড়ির বাহিরে বের হবে না।” কথাটা শুনে হিয়া রেগে কিছু বলার আগেই শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিলো।

হিয়া চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। ভরা রাস্তায়,কি করছে শুভ্র। হিয়া হাত মুষ্টিবন্ধ করে ফেললো।

শুভ্র কিছুক্ষণ পর সরে এসে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” দেটস লাইক এ গুড গার্ল। এভাবেই চুপ করে আমার সব কথা শুনতে হবে তোমাকে।”,বলেই শুভ্র হেসে গাড়ি থেকে বের হয়ে এসে নিজের সিটে বসলো। হিয়া আস্তে করে চোখ খুলে আশে পাশে তাকাতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। আপাদত নিজের দুই হাত দিয়ে নিজের মুখটা আড়াল করার চেষ্টায় আছে।

শুভ্র গাড়ি স্টার্ট দিতেই এয়ারপোর্ট ছেড়ে তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কিন্তু হিয়া বেখেয়ালে ফেলে গেলো রিমির দেওয়া বইটা।

⭐ বাতাসে বইয়ের পাতা উড়ছে সঙ্গে পাতা ঝাপটানোর মতন শব্দ হচ্ছে। প্রভা এগিয়ে এসে জানালা বন্ধ করে দিলো। আজ মনে হচ্ছে ঝড় হবে। প্রভা চুলে বেনি করতে করতে বইটার দিকে চোখ পড়লো। তারপর বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রভা বইটা নিয়ে বসলো। বইটা এই গ্রামের লাইব্রেরি থেকে আজ সকালে পাঠিয়েছে। প্রভার বলা আছে নতুন সব বই যেনো তার বাসায় পাঠিয়ে দেয়।

বইয়ের নাম টা ভারী সুন্দর নীলচে তারার আলো। তাই সে মাঝ থেকেই একটা পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করলো, এটাই তার অভ্যাস।

” সব ভালোবাসায় কি প্রাপ্তি হয়? হয় না। আমার বেলায় ও হয়নি। তাতে আমি মোটেও দেবদাস হয়ে যাই নি। এইতো কতো ভালো আছি। রায়হান সাদিক আজ নিজের ক্যারিয়ারে সাফল্যের চূড়ায় আছে।

কিন্তু একটা আক্ষেপ কি বলুন তো। আমার গল্পে আমি মূল চরিত্রটা হয়ে পারিনি, কথাটা হাস্যকর লাগছে কিন্তু এর বাস্তবতা বড়ই কঠিন। বিশেষ করে যখন আপনি পরিস্থিতি আর সময়ের কাছে হেরে গিয়ে ভালোবাসার মানুষটার হাতটা ছেড়ে দিয়ে আসেন। কিন্তু আমি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম যদিও সে আমাকে চায় নি।

সে আমাকে চায় নি বলে তার প্রতি আমার ভালোবাসা একটুও কমেনি। সত্যিই বলছি, আমি ভুলিনি তার হাসি, ভুলিনি তার নূপুরের শব্দ, ভুলিনি তার সরল চাওনি। তাকে নিজের করে পাইনি ঠিক কিন্তু সে রয়ে গেছে আমার অনুভবে। মিথ্যে বলবো না আমি ভালো আছি। কিন্তু এক পাক্ষিক ভালোবাসাগুলো আপনি চাইলেও মুছে ফেলতে পারবেন না, এরা লুকিয়ে থাকে মনের অন্তরালে………….।

প্রভার ফোন বেজে উঠলো সে বইটা রেখে উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলো। দিবা ফোন করছে। আজও সে এক কথা জানার জন্যেই ফোন করেছে নিশ্চয়ই। প্রভা ফোনটা ধরতেই দিবা বলল,” আপু কি করছো?”

প্রভা হেসে বললো,” এইতো বই পড়ছিলাম।”

দিবা চুপ করে রইলো তারপর করুন গলায় বললো,” আপু তুমি কি সত্যি আমার বিয়েতে আসবে না?”

উত্তরে প্রভা কিছু বললো না। প্রতিবার দিবাকে না বলতে তার খারাপ লাগে। দিবা তার বোনের নিরবতা দেখে বুঝে ফেললো তারপর অভিমান করে ফোনটা কেটে দিলো।

প্রভা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখলো। তারপর জানালা খুলে চেয়ার নিয়ে তার সামনে বসলো। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোঁটা তার গায়ে এসে পড়ছে। দিবার কথা ভেবেই প্রভার চোখে জল এলো। ছোট বোনটার এই আবদার সে রাখতে পড়লো না।সে চাইলেও পারবে না। সে শহরে সে ফিরে যেতে চায় না।

বড্ড ভালোবাসার শহর যে সেটা। এক সময় সে খুব ভালোবেসে ছিলো এই শহরটাকে কিন্তু বিনিময়ে সে শুধু অবহেলাই পেয়েছে। সে অবহেলা যে আর সহ্য করবার ক্ষমতা তার নেই। নিজেকে ভেঙে যে আবার নতুন করে গড়েছে। একা থাকতেও শিখে গেছে আবার মায়ার জালে পড়তে যে ভীষন ভয় লাগে তার। দিবার কাছে ক্ষমা চাইতে পারলে ভালো হতো।

দিবা লক্ষ্মী বোন আমার ক্ষমা করে দিস আমাকে।তোর এই ছোট্ট আবদার রাখার ক্ষমতা যে আমার নেই। আমি হারিয়ে ফেলেছি সবটা।

[ সমাপ্ত ]

জানি গল্পটার শেষটা অনেক আলাদা। কিন্তু গল্পটা আমি এইভাবেই লিখতে চেয়েছিলাম। কারণ সবসময় ভালোবাসার গল্পে সার্থক ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে শেষ হয়।

কিন্তু সবাই কি ভালোবাসার মানুষকে পায়। অনেকের জীবনই তো বদলে যায়। তার মানে কি তারা ভালোবাসতে জানে না। জানে,কিন্তু বাস্তবে সবাই ভিলেন হয়ে উঠে না। প্রভা, রায়হানের মতো অনেকেই সরে দাড়ায়। তাদেরও একটা গল্প থাকে সে গল্পটা কারোর জানা হয় না। আমরা জানতেও চাই না। তাই জন্যে আমার এই গল্প লেখা। কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারলাম জানি না।

এই গল্পটা আমার খুব কাছের একটা গল্প হয়ে থাকবে। আপনাদের সবার অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। আশা করি ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আমি নিজেও মিস করবো এই জুটি টাকে, শুভ্র আর হিয়া।

ভালো থাকবেন সবাই।💜💜