#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২০
হিয়া আজ কলেজে গেলো না এমন কি নিজের রুম থেকেও বের হয় নি। শুভ্রের এমন আচরণ তাকে গভীর ভাবে আঘাত করেছে। সে নিজেও জানে না শুভ্রের এই ব্যাবহারে তার এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে। বার বার শুধু সেদিনের কথা মনে পরছে যেদিন শুভ্র তাকে ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেদিনের সেই শুভ্র কত আলাদা ছিলো। সেদিনের সেই রাগেও একটা ভালোলাগা খুঁজে পেয়েছিল হিয়া। তখন তাকে কোলে নেওয়ায় রাগ হয়েছিল কিন্তু যতবার সেই ঘটনা মনে পড়েছে, অজানা ভালো লাগা তাকে আকড়ে ধরেছে।
হটাৎ কেনো জানি সবকিছুই এখন তার কাছে অর্থহীন। হিয়া নিশ্চুপে বারান্দার এক কোনে বসে বাহিরে তাকিয়ে আছে। আকাশটা আজ পরিষ্কার। হিয়ার ইচ্ছে করছে ওই নীল আকাশে মেঘ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই বিশাল আকাশ নিশ্চই তাকে কষ্ট দিবে না। শুভ্রের প্রতিটি কথা সুচের মতন তার গায়ে বিধেছে। যার যন্ত্রণা হিয়া সহ্য করতে পারছে না। অসহ্য এই ব্যাথা।
ময়মনিংহে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে হিয়ার। সেখানে জিবনটা এতো জটিল ছিলো না। জীবনের এতো জটিলতায় কিছু অদৃশ্য ব্যাথা আজ তাকে গ্রাস করেছে।
শুভ্র নিজের ঘরে বিছানায় গা হেলিয়ে মাথার নিচে দুই হাত রেখে শুয়ে আছে। শুভ্র আসলে কেমন? এতোটাই কি সে রাগী? সে নিজেও জানে না।
আমরা অনেকেই নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে খুব সচেতন। কাকে আমাদের ভালো লাগে কিংবা কে আমাদের দুর্বলতা আমরা জানি। কিছু মানুষ থাকে ভিন্ন। এরা নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে কখনোই ভাবে না। শুভ্র সেই সব মানুষের মাঝে একজন। তবে আজ সে অন্যরকম এক অনুভূতির সন্ধান পেয়েছে। আজই সে অনুভূতি জন্মেছে এমন না, জন্মেছে অনেক আগেই শুভ্র সেটা বুঝে নি। কিংবা বুঝতে চেষ্টাও করেনি।
হিয়ার নিজেকে এমনভাবে আড়ালে রাখাটা শুভ্রর শান্ত মনকে অশান্ত করে তুলেছে। আজ ভার্সিটিতেও যায় নি সে। সকালে হিয়া শুভ্রের মুখোমুখি হয়েও নিশ্চুপে চলে গেছে। একপলক তাকায় নি শুভ্রের দিকে।
✨ দিপা আজ আবার আসলো আর সঙ্গে প্রভাকেও নিয়ে আসলো। হিয়া কলেজে যায় নি ফোনও ধরেনি। রীতিমত চিন্তায় দিবা হিয়াদের বাড়ি এলো।
শুভ্রকে প্রায় টেনে প্রভা নিচে নিয়ে এলো। রায়হান হটাৎ একটা প্ল্যান করেছে। সেই জন্যেই প্রভা এতো তড়িঘড়ি করে শুভ্রকে টেনে এনেছে। শুভ্র নিতান্ত অনিচ্ছায় নিচে এলেও হিয়াকে দেখে সে স্বাভাবিক ভাবেই একটা সোফায় বসলো। হিয়া শুভ্রের উপস্থিতি বুঝেও নিশ্চুপে অন্যদিকে তাকালো।
ম্যারিকে কোলে নিয়ে দিবা হিয়ার কাধে মাথা রেখে বসে আছে।
শুভ্রকে দেখে রায়হান বললো,” আচ্ছা, তাহলে সবাই চলে এসেছে। তাহলে প্ল্যানটা বলি।”
মোহনা হাই তুলতে তুলতে বললো,” তাড়াতাড়ি বল।”
” আজ রাতে সবাই মিলে আমিউজমেন্ট পার্কে গেলে কেমন হয়। হ্যা, আমরা বড়ো হয়েছি। কিন্তু সবাই মিলে এইভাবে তো কখনো যাই নি।”,
দিবা আগ্রহ নিয়ে বললো,” অনেক মজা হবে। সবাই মিলে গেলে।”
” আমার জামাইটা সাথে থাকলে ভালো হতো। ভয় পেলে আরাবের কানের সামনে চিৎকার করা যেতো।”, মোহনার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো, শুভ্র আর হিয়া বাদে।
মোহনা হিয়ার এমন চুপচাপ থাকা দেখে বললো,” কি ব্যাপার তোমাকে কি শুভ্রের জ্বীনে ধরেছে। এমন চুপচাপ কেনো আজ।”
হিয়া তাও কোনো কথা বললো না। দিপা হিয়ার পক্ষে বললো,” পৃথিবীতে কি জ্বিনের অভাব পড়েছে তোমার ভাইয়ের জ্বিনেই কেনো ধরতে যাবে।”
প্রভা রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,” বেশি কথা বলিস।”
প্রভার রাগ দিবা গায়ে মাখলো না।
রায়হান সবাইকে থামিয়ে বললো,” আচ্ছা তাহলে সবাই যাচ্ছি তো?”
উত্তরে হিয়া না সূচক মাথা নাড়লো। রায়হান এগিয়ে এসে বললো,” কি ব্যাপার ম্যাডাম? আপনার কি মন খারাপ?”
হিয়া উত্তরে কিছু বললো না। রায়হান আবার বললোl,
” এই স্ট্রবেরি, আমাদের সাথে চলো।মন ভালো হয়ে যাবে।”
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রায়হানকে এবার থামাতে হবে কিন্তু তার আগে হিয়ার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু হিয়া তো কাল থেকেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
হিয়ার প্রতি রায়হানের দুর্বলতা আস্তে আস্তে সবাই দেখতে পাচ্ছে। প্রভা তাই সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,” রায়হানের বুঝি হিয়াকে স্ট্রবেরির মতন লাগে?”
হিয়া সেইসব কথা কানে নিলো না। রায়হান রহস্যময় হাসলো। শুভ্র রেগে উঠে চলে যেতে নিতেই প্রভা শুভ্রের হাত ধরে বসিয়ে রাখলো আর বললো,” প্লীজ উঠে গিয়ে মজাটা নষ্ট করবি না।”
মোহনা আবার বললো,” কি ব্যাপার হিয়া? এতো মন খারাপ কেনো তোমার?”
হিয়া চুপ করে আছে এখনো। একবার শুধু আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রভা শুভ্রের হাত ধরে আছে। হিয়া মোহনার দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়ল মানে তার মন খারাপ নেই।
দিবা বললো,” ধুর ওকে এতো জিজ্ঞাসার কি আছে? আমি যাবো মানে ও যাবে ফাইনাল।” হিয়া কিছু বলার আগেই দিবা কড়া গলায় বললো,” যা বলার বলে দিয়েছি। তুই যাচ্ছিস।”
এই আলোচনায় শুভ্রের কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তবুও সে বসে আছে হিয়ার জন্যে। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক যাবার ইচ্ছেও নেই যাচ্ছে শুধু প্রভার জোরাজুরিতে আর রায়হানের আচরনে এতো পরিবর্তন দেখে যাচ্ছে।
✨আমিউজমেন্ট পার্কে আজ অনেক ভিড়। আজ হটাৎ এতো ভিড়ের কারণটা প্রথমে ঠিক আন্দাজ করতে না পারলেও এখন ঠিক বুঝতে পারছে। হাতি আনা হয়েছে ভিতরে। সে হাতির পিঠে চরতেই এতো ভিড়। এমন জায়গায় হটাৎ হাতি!
রায়হান হিয়ার পাশে পাশে রয়েছে। শুভ্র সবার পিছনে। প্রভা হাত টেনেও শুভ্রকে সামনে নিয়ে আসতে পারলো না। প্রচন্ড মাথা ধরেছে তার।
সামনে হাতিকে ঘিরে এক বিশাল ভিড়। হিয়া অন্যমনস্ক ছিলো। হটাৎ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ভিড়ের মাঝে সে একা। আশেপাশে কেউ নেই। বাড়ির সবাই ভিড় ঠেলে হাতিকে দেখতে ব্যাস্ত শুধু হিয়া অন্যমনস্ক থাকায় পিছে রয়ে গেলো। এখন হিয়া ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে সবাইকে খুঁজছে। শুভ্র চুপচাপ এগিয়ে এসে হিয়ার মুখ চেপে অন্যদিকে নিয়ে এলো। প্রথমে হিয়া ভয়ে ছটফট করতে থাকে কিন্তু শুভ্রের উপস্থিতি কিভাবে যেনো টের পেয়ে শান্ত হয়ে যায় হিয়া। শুভ্র হিয়াকে অন্ধকার একটা জায়গায় নিয়ে এলো। পুরোনো টিকিট কাউন্টার মনে হচ্ছে।
বাহিরের হালকা আলোয় হিয়া শুধু শুভ্রের চেহারা দেখতে পাচ্ছে। শুভ্র হিয়ার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই হিয়া সঙ্গে সঙ্গে রেগে পাশ কাটিয়ে চলে নিলো। শুভ্র শক্ত করে হিয়ার হাত ধরে ফেললো। হিয়া শান্ত গলায় বললো,” ছাড়ুন আমায়। আমাকে এইখানে এনেছেন কেনো?” বলেই নিজের হাত ছাড়াতে ছটফট করতে লাগলো।
হিয়াকে এমন ছটফট করতে দেখে শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে একটা টেবিলের উপর বসিয়ে দিতেই টেবিলটা নড়ে উঠলো। টেবিলটা ভাঙ্গা ছিলো শুভ্র সেটা খেয়াল করেনি। আর কি বা করতো সে? হিয়াকে আটকানোর একটাই উপায়। তবে টেবিলের এমন নড়ে উঠায় হিয়া আরো বেশি ভয় পেয়ে বললো,” এই টেবিল ভাঙ্গা আমি পড়ে যাবো। নামান আমাকে।”
শুভ্র হিয়ার কোমর ধরে বললো,” আমি আছি…।”
শুভ্রের স্পর্শে সাড়া শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো হিয়ার। হিয়া জামার প্রান্তভাগ শক্ত করে ধরে আছে। হিয়ার অসস্তি হচ্ছে, শুভ্রের এমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তার মূল কারণ। হিয়া মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আবার এইখানে তাকে কেনো এনেছে? আবার বকবে তাকে, ভেবেই হিয়ার কান্না পেলো। চোখ ছল ছল করে উঠলো।
হিয়ার চোখে পানি দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো শুভ্র। কিছুক্ষণ নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুভ্র খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,” কাদছো কেনো তুমি? আমি তো কিছুই বলিনি।”
হিয়া বাচ্চাদের মতন চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,” বলতে বাকি রেখেছেন কি? আপনি তো সবসয়ই আমাকে বকেন।আবার কি করেছি আমি? কেনো তুলে এনেছেন?”
শুভ্র পলকহীন দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।তারপর পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে হিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” নাও। চোখের পানি মুছ। তোমাকে আর বকবো না।”
” আপনার রুমাল আমি নিবো না।”,বলেই হিয়া ওড়নার প্রান্তভাগ দিয়ে চোখের পানি মুছে আবার মাথা নুইয়ে রাখলো। শুভ্রের হটাৎ খুব মায়া হলো হিয়াকে দেখে। শুভ্র দূরত্ব কমিয়ে আরেকটু কাছে এসে বললো,” সরি।”
সরি শব্দটা হিয়ার কানে পৌঁছাতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। তাকাতেই বুঝলো শুভ্র তার একদম কাছে। হিয়ার বিস্ময় কাটছে না। চোখ মুখে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো,” কি বললেন?”
হিয়ার চোখে মুখে এতো বিস্ময় দেখে শুভ্র ভ্রূ কুচকে বললো,” কিছু না।”
” কিছু না মানে? আমি যে শুনলাম আপনি সরি বললেন। তাহলে আমি কি ভুল শুনলাম?”, শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো হিয়া।
শুভ্র এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আর হয় নি। শুভ্র ভীষন অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো হিয়ার দিকে। তারপর শুভ্র হিয়াকে ছেড়ে দিয়ে দাড়াতেই টেবিলটা আবার কেপে উঠলো। হিয়া ভয়ে শুভ্রের হাত ধরে ফেললো। তারপর চেঁচিয়ে বললো,” আমাকে এইখানে বসিয়ে দিয়ে কি মেরে ফেলতে চাইছেন? আমি পড়ে যাবো তো….”
শুভ্র দ্বিতীয়বারের মতন এগিয়ে এসে হিয়ার কোমড় ধরতেই হিয়া কেপে উঠলো। হিয়ার এমন কেপে উঠা দেখে শুভ্র চোখে হাসলো। সে হাসি দেখে হিয়া অনেক হকচকিয়ে রইলো।
তারপর শুভ্র কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,” রায়হানকে কি তোমার পছন্দ?”
সরল মনে শুধু হিয়ার অনুভূতি সম্পর্কে জানার জন্যে শুভ্র প্রশ্নটা করলেও, হিয়া ভরকে গেল।
” আমার ওনাকে পছন্দ মানে? আপনি আবার আমাকে নিয়ে উল্টা পাল্টা কথা ভাবছেন। আমি এইখানে থাকবো না। ছাড়ুন আমাকে।”, বলেই হিয়া তড়িঘড়ি করে শুভ্রের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলো। যার কারণে টেবিলটা অস্বাভাবিকভাবে নড়ছে। শুভ্র হালকা ধমকের সুরে বলল,” নড়ছো কেনো। পড়ে যাবা তো।”
” পড়ে গেলে পড়ে যাবো। আমি এইখানে থাকবো না। আমাকে আপনি কি মনে করেন?”, ভীষন রেগে গিয়ে বললো হিয়া।
“আমি কোনো সন্দেহ থেকে তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি তোমাকে শুধু একটা প্রশ্ন করছি। উত্তর না দিয়ে কোথাও যেতে পারবে না তুমি?”, কথাটা শুভ্র গলা উচু না করেই বললো।
কিন্তু হিয়া তাতেও রেগে গিয়ে বললো,” বলবো না আমি। ”
শুভ্র বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,” তারমানে তোমার ওকে অনেক পছন্দ। ”
” আমার যাকেই পছন্দ হোক না কেনো তাতে আপনার কি?”, কটমট করে তাকিয়ে বললো হিয়া।
” আমার কিছু না। বাবা জানতে চাইলো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”, এতটুকু বলতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো।
” বাবা জানতে চাইলো মানে?”, রীতিমত ভয়ার্ত চোখে তাকালো হিয়া।
” আমি কিভাবে জানবো। আচ্ছা বলতে লজ্জা হলে থাক আমি বলে দিবো যে তোমার অনেক পছন্দ হয়েছে রায়হানকে।”, শুভ্র হিয়ার মুখ থেকে কথা বের করতেই মিথ্যেটা বললো।
হিয়া রীতিমত চেঁচিয়ে বললো,” নাহ্, একদম না। আমি মোটেও ওনাকে পছন্দ করি না। একদম আজে বাজে কথা ছড়াবেন না। আর আপনি আমাকে এইখানে এনেছেন কেনো?”
” যেই জন্যে এনেছি সেটা হয়ে গেছে এইবার নামো এইখান থেকে।”, বলে হিয়াকে নামিয়ে দিবে এমন সময়ে কিছুর বিকট আওয়াজে হিয়া সামনে আরো কিছু ঝুকে সামনে তাকালো। শুভ্র ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দরজার দিকে তাকালো। কেউ নেই তাহলে কিসের শব্দ হলো? শুভ্র ঘাড় ফিরিয়ে হিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো হিয়া শুভ্রের একদম কাছে।
শুভ্রের মনে দুষ্ট একটা ইচ্ছে জাগতেই শুভ্র হিয়ার কোমড়ে থেকে হাতটা হালকা সরিয়ে আনলো হিয়া ব্যালেন্স হারিয়ে আরো সামনে ঝুঁকে আসতেই শুভ্রের সাথে হিয়ার ঠোঁট মিলে গেলো। হিয়ার কাছে পুরো বিষয়টা অপ্রত্যাশিত হলেও শুভ্রের কাছে এটাই প্রত্যাশিত ছিল…।
[ #চলবে ]
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২১
শুভ্রের মনে দুষ্ট একটা ইচ্ছে জাগতেই শুভ্র হিয়ার কোমড়ে থেকে হাতটা হালকা সরিয়ে আনলো হিয়া ব্যালেন্স হারিয়ে আরো সামনে ঝুঁকে আসতেই শুভ্রের সাথে হিয়ার ঠোঁট মিলে গেলো। হিয়ার কাছে পুরো বিষয়টা অপ্রত্যাশিত হলেও শুভ্রের কাছে এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে হিয়া থমকে গেলো, শুভ্রের চোখে চোখে পড়তেই পরক্ষণে সে শুভ্রের কাধ থেকে দুহাত সরিয়ে নিজেও সরে এলো।হিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। এটা কি হলো একটু আগে। যতবার চিন্তা করছে ততোবার যেনো নতুন করে সবটা অনুভব করছে সে।
এইসবের মাঝে শুভ্র নির্বিকার দৃষ্টিতে হিয়ার লজ্জায় রক্তিম চেহারাটা উপভোগ করছে। হিয়া অনেক কষ্টে নিজেকে বুঝিয়ে শান্ত করলো যে এইটা একটা অ্যাকসিডেন্ট, শুধু অ্যাকসিডেন্ট। তার মধ্যেই শুভ্র হটাৎ হিয়ার কোমড় জড়িয়ে টেবিল থেকে নীচে নামিয়ে দিতেই আবারো কেপে উঠলো হিয়া। নিচে নামতেই কোমড় থেকে শুভ্রের হাত সরিয়ে অনেকটা দূরে সরে দাঁড়ালো সে। কি করবে,কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না হিয়া। মাথাই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। শুভ্র নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে বললো,” লাফালাফি একটু কম করতে পারো না।”
হিয়া লজ্জায় আরো লাল হয়ে গেল। এখন তার সত্যি মনে হচ্ছে এইটা তার ভুল। কি করে এমন একটা ভুল করলো সে? শুভ্রকে নিজের মুখ আর কোনোদিন দেখাবে না সে। ইস কি লজ্জা !
🦋
শুভ্র পকেটে দুই হাত ভরে হাঁটছে। হিয়া তার কিছুটা সামনে জড়সড় হয়ে হাঁটছে। হাত দুটো সামনে এনে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। নিজেকে অদৃশ্য চাদরে মুড়িয়ে যদি লুকিয়ে ফেলা যেত, খুব ভালো হতো।
সবাই রীতিমত ব্যাস্ত হয়ে ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। রায়হান তখন থেকে ছুটছে। হিয়াকে দেখে হাপাতে হাপাতে এগিয়ে এলো রায়হান তারপর সামনে এসে থামলো। দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল,” কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। হিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই পিছন থেকে শুভ্র বললো,” আমার সাথে ছিলো।”
হিয়া সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে শুভ্রের দিকে তাকালো। লোকটা কি আজ তাকে বদনাম করে ছাড়বে?
রায়হান ভ্রু কুঁচকে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রের কথাটা কেমন যেনো লাগলো তার কাছে। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে দাড়ালো। রায়হান হিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলো,” কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?”
হিয়ার প্রচন্ড অসস্তি হলো কি শুরু করেছে এরা! শুভ্রের কাছাকাছি থাকতেও তার লজ্জা লাগছে। হিয়া কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে সামনে হেঁটে দিবার কাছে চলে এলো।
শুভ্র আর রায়হান একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান তৃতীয়বারের মত প্রস্ন করলো,” কোথায় ছিলি তোরা?”
” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।”, ভ্রু কুঁচকে বললো শুভ্র। চোখে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
রায়হান শুভ্রের এমন ব্যাবহারে রীতিমত অবাক হয়ে বললো,” হোয়াট ননসেন্স? অ্যাম গোয়িং টু ম্যারি হার। আর তুই আমাকে বলিস এইটা আমার বিষয় না। তুই এইভাবে কথা বলছিস কেন?”
শুভ্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো তারপর বললো,” এভাবে কেনো বলছি সেটা খুব তাড়াতাড়ি তুই বুঝতে পারবি।” বলেই শুভ্র রায়হানকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
শুভ্রের এমন ব্যাবহারের কারণ রায়হান ঠিক ধরতে পারছে না। খুব অদ্ভুত লাগছে সত্যি কিন্তু রাগও হচ্ছে প্রচুর। রায়হানের মনে ক্ষীণ এক সন্দেহ জাগলো।
তার মা যখন হিয়াকে বিয়ের কথা বলেছিল রায়হান সময় চেয়েছে কিছুদিন। কারণ হিয়াকে সে নিজের মনের কথা বলতে চায় কিন্তু তার আগে হিয়ার মনের কথাও তার জানা দরকার।
রায়হান বাড়ি ফিরে সোজা নিজের মায়ের ঘরে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের আয়োজন করতে বললো।
এতো রাতে ছেলের মুখে বিয়ের কথা শুনে তিনি কিছুটা চমকালেন। এতকাল বিয়ে করতে চায় নি হটাৎ এতোই বিয়ে করতে ইচ্ছে হলো যে এত রাতে এসে বলছে তাড়াতাড়ি বিয়ের আয়োজন করতে।
সকালে উঠে রবীউল সাহেব এমন একটা পরিস্থিতির স্বীকার হবেন ভাবতে পারেন নি। হটাৎ করেই তার বোন উঠে পড়ে লেগেছে বিয়ের আয়োজন করতে। হিয়ার মামাকে ফোন করাতে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছেন। হিয়ার মামা এমন একটা খবর শুনলে কি মনে করবে সেটা ভেবেই রবীউল সাহেব কিছু বলছেন না। নিজের বোনকে ম্যানেজ করছেন নানা রকমে।
হিয়া আর শুভ্রের বিয়ের কথাটা জানানো বাকি। বোনকে শান্ত করতে কথাটা বলেই দিলো রবীউল সাহেব।
হিয়া আর শুভ্রের বিয়ে হয়েছে কথাটা শুনে ঘণ্টা খানেক চুপ থেকে আবার রেগে উঠে বললেন,” বিয়ে কিসের বিয়ে? আলাদা আলাদা থাকে এইটা কোনো বিয়ে হলো নাকি? কবে না কবে ডিভোর্স হবে ততদিন অপেক্ষা করবে আমার ছেলে? শোন তুই জলদি লয়ার সাথে কথা বল। দুদিনেই ডিভোর্সের ব্যাবস্থা হবে, যত টাকা লাগে আমি দিবো।”
সবক্ষেত্রেই তার বোনের এমন বাড়াবাড়ি। তবে মনটা খারাপ না তার বোনের, হিয়াকে যত্নেই রাখবে যদি হিয়া তার বউ হয়। এ বাড়ির মানুষগুলোর মতন ওকে হেলাফেলা করবে না। নিজের বলা কথায় নিজেই এতো বাজে ভাবে ফেঁসে যাবেন রবীউল সাহেব চিন্তাও করতে পারেন নি। কি বলে হিয়ার মামাকে বুঝ দিবেন। সেই লোকটাকে মুখ দেখাবেন বা কি করে?
সাহারা খাতুন ভেবেই রেখেছেন। এই নাটক তিনি বেশিদিন চলতে দিবেন না। তার ছেলের সংসার তিনি ভাঙতে দিবেন না। রাবেয়া আক্তার বেশি বাড়াবাড়ি করলে কাজী ডেকে দরকার প্রয়োজনে হিয়া আর শুভ্রের আবার বিয়ে দিয়ে দিবেন। তখন এই বিয়ে সবাইকে মানতে হবে। লোকে শুনলে কি বলবে এইটা কি সিনেমা? সিনেমাতেও এতো নাটক হয় না। আর এরা ভাই বোন যা শুরু করেছে।
যাকে নিয়ে এতো কিছু সে গালে হাত দিয়ে কলেজে ধর্ম স্যারের কথা শুনছে। ক্লাস শেষের বেল পড়তেই হাসান স্যার চলে গেলো। দিবা হিয়ার এমন হাল দেখে বললো,” কি রে কি হয়েছে তোর?”
হিয়ার ভীষন লজ্জা লাগছে। কালকের ঘটনা তো হলোই সকালে শুভ্রকে স্বপ্নে দেখছে সে। সেই স্বপ্ন কাউকে বলার মতন না। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে হিয়ার।
কালকে হটাৎ কোথায় হারিয়ে গেছে জানতে চাইলে হিয়া অনেক কিছু বলে সবাইকে বুঝ দিয়েছে। কিন্তু সত্যিটা দিবা থেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না সে। নিচু স্বরে আস্তে আস্তে দিবার কানে কানে বলতেই দিবা রসগোল্লার মতন চোখ করে বললো,” কি? তুই আর শুভ্র ভাইয়া…..! এই তুই আমাকে আগে বলবি না আমি একটা ছবি তুলে আমার বোনটাকে দেখতাম।”
হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” আগে বলবো মানে? আমি কি ইচ্ছে করে করেছি নাকি?”
দিবা কান্নার ভান করে বললো,” আমার বিয়ে হবে কবে? একটা জামাই পেলে আমিও রোমান্স করতে পারতাম। ওই চশমিশ বিলাইটা তো আমাকে দেখলেই উল্টো দিকে হাটা দেয়। ভাল্লাগে না।”
” তুই এখনো ওই বিলাইয়ের পিছনে আছিস?”,হিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
” হ্যা, ওই চশমিশ বিলাই ইভানকে তো আমি ছাড়ছি
না।”,মুখ বাঁকিয়ে বললো দিবা।
হিয়ার এবার সত্যি মনে হচ্ছে দিবার জন্যে একটা বর খুঁজতে হবে। বরের শোকে মেয়েটা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। বলেই হিয়া মনে মনে হাসলো।
ছুটির পর হিয়া নাচতে নাচতে বের হলো।আজ বাড়ি গিয়ে ম্যারিকে সাথে নিয়ে গোসল করবে। ম্যারি এতো কিউট। হিয়ার ইচ্ছে করে কলেজে তাকে সঙ্গে করে আনে। কিন্তু দারোয়ান তো ঢুকতেই দিবে না আর প্রিন্সিপাল তো আছেই। হিয়া বের হয়ে গাড়ির সামনে এসে দেখে শুভ্র দাড়িয়ে আছে।
হিয়া ঘন ঘন দুবার পলক ফেললো। কি যে হয়েছে তার? স্বপ্নেও শুভ্রকে দেখে ঠিক আছে তাই বলে যেখানে সেখানে দেখবে? ঠিক আছে যেহেতু এইটা তার হেলসিনেশন তাহলে লোকটাকে গিয়ে কিছু কথা শুনিয়ে দেই। বাস্তবে তো বলতে পারি না সপ্নে তো আরো পারি না। হেলসিনেশনে পারতেই হবে। হিয়া হনহনিয়ে এগিয়ে এলো। ভ্রু কুঁচকে শুভ্রের সামনে কোমরে দুই হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
শুভ্র হটাৎ হিয়ার এমন আচরণ দেখে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। হিয়া ভ্রু তুলে আবার নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কি?…. কি সমস্যা আপনার? যেখানে যাই সেইখানে আপনি। বাড়িতে আপনি, ঘুমাতে গেলে স্বপ্নেও আপনি, কলেজে এসেছি এইখানেও আপনি। আর কত জ্বালাবেন আপনি আমাকে?”
শুভ্র হিয়ার এমন আচরণে শুভ্র এদিক সেদিক তাকালো। লোকজন তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
” মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে তোমার? রাস্তায় কি শুরু করেছো?”,একটা ভ্রু তুলে বললো শুভ্র।
হিয়ার রীতিমত হা করে তাকিয়ে আছে। এর আগেও হেলোসিনেশনের সাথে সে ঝগড়া করেছে কিন্তু কখনো জবাব পায় নি। কিন্তু একি আজ দেখি কথাও বলছে। হিয়া শুভ্রের সামনে ঘন ঘন হাত নাড়লো। শুভ্র রাগী চোখে হিয়ার দিকে তাকালো। তারপর চারপাশে তাকালো। কলেজের ছেলে মেয়েরা রীতিমত হাসাহাসি করছে। শুভ্র হিয়ার হাতটা ধরে নামিয়ে রাখতেই হিয়া চোখ ছানাবড়া করে ফেললো।
তার মানে কি? তার সামনে শুভ্র দাড়িয়ে আছে। হিয়া দুবার চোখের পাতা ফেলে একটা ঢোক গিলে বললো,” তারমানে আপনি সত্যি…। হে হে আমি তো বুঝিই নাই।”
শুভ্র নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হিয়ার হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বললো,” হুম, আমি সত্যি। তোমার কোনো হেলোসিনেশন না কিংবা তোমার রাতের বেলার স্বপ্ন না।” শেষের কথাটা শুনেই হিয়ার গা শিউরে উঠলো। হিয়া বিষয়টাকে কিভাবে ঢাকা দিবে সেটা মনে মনে সাজাতে লাগলো। এর মাঝে সিটবেল্ট লাগাতে গিয়ে শুভ্র আরেকটু কাছে এসে হিয়ার চোখের দিকে তাকাতেই মাথায় সাজানো সব কথা ভুলে গেলো সাথে হার্ট বিট অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেলো তার। শুভ্রের শীতল চাহনিতে ছটফট হিয়া একদম শান্ত হয়ে গেল।
শুভ্র সেই দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে নীচের ঠোঁট কামড়ে বললো,” রাতের বেলায় আমাকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখো তুমি?”
হিয়া শুভ্রের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। কিছু যে বলবে গলা দিয়ে আওয়াজ পর্যন্ত বের হচ্ছে না তার। শুভ্র দৃষ্টি সরিয়ে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি রেখে বেড়িয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো।
[ #চলবে ]