#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২২
হিয়া বাহিরে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ বসে আছে। অন্যদিন গাড়িতে বসলে ঘুমে ঢলে পড়লেও আজ সে একদম সজাগ। শুভ্র এর মধ্যে বাড়ির দিকে যাবার রাস্তাটা পাশ কাটিয়ে অন্য মোড়ে ঢুকেছে। হিয়ার মনে প্রস্ন তো জেগেছে কিন্তু সে চুপচাপ। শুভ্রকে প্রশ্ন করতেও কেমন জানি ইতস্তত বোধ করছে সে। আচ্ছা এর আগে তো কোনোদিন এই হিয়া এতো ভাবেনি কোনো ছেলেকে নিয়ে। অথচ এখন কিনা প্রতিটা মুহূর্তে শুভ্রের চিন্তা তার মাথায়। হিয়া আড় চোখে একবার শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্রের দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির।
প্রশ্ন করার চিন্তা হিয়া মাথা থেকে দূর করলো। যেখানে ইচ্ছে যাক, দিন শেষে বাড়ি পৌঁছালেই হলো।
শুভ্র গাড়ি থামালো শহর থেকে দূরে কোলাহল বিহীন নির্জন এক বিলের ধারে। বিলের একপাশে বিশাল খালি মাঠ। সেই মাঠের পাশ দিয়ে রাস্তা।
শুভ্র কোনো কিছু না বলেই গাড়ি থেকে নামলো। তারপর ঘুরে এসে হিয়ার পাশের দরজাটা খুলে ঝুকে এসে বললো,” সিটবেল্ট কি নিজে খুলবে নাকি আমায় খুলে দিতে হবে?”
হিয়া রীতিমত হকচকিয়ে তাকালো। শুভ্র চোখে হাসছে। হিয়া চটজলদি সিট বেল্ট খুলতেই শুভ্র গাড়ির সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। হিয়া গাড়ি থেকে বেরিয়ে এমন মনোরম দৃশ্য দেখবে কল্পনাও করেনি। কি সুন্দর জায়গাটা! হিয়া অবাক হয়ে চারিপাশ দেখতেই শুভ্র হিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। হিয়া পলক ফেলে শুভ্রের বাড়িয়ে দেওয়া হতের দিকে তাকালো। শুভ্র কি তার হাত ধরতে চাইছে? হিয়া চোখ তুলে একবার শুভ্রের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা ধুক করে উঠলো তার। হিয়া হাত বাড়াতে গিয়ে সংকোচ বোধ করছে।
শুভ্র পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজেই হাত বাড়িয়ে হিয়ার হাতটা ধরলো। তারপর হাতটা শক্ত করে ধরে সামনে যেতে লাগলো।
কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো কয়েকটা জলকুটির। দেখেই হিয়ার চোখ মুখ আনন্দে ভরে গেল। জায়গাটা এতো সুন্দর যে হিয়া সারাবেলা এই কুটিরে বসে কাটিয়ে দিতে পারবে।
জায়গাটা শুভ্রের খুব পছন্দের। এতো সুন্দর জায়গায় প্রচুর ভিড় থাকার কথা হলেও যারা এখনে আসে তারা কেমন জানি শান্ত হয়ে যায় প্রকৃতির এই রূপে।
এই কুটিরে মাত্র একজন বৃদ্ধ আছে তাদের ছাড়া। হিয়া এতক্ষণ এদিক সেদিক হেঁটে পুরো জায়গাটা সুন্দর করে দেখেছে। এখন সে কুটিরে একপাশে দাড়িয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার দুপাশে কুটিরের রেলিংয়ে হাত রেখে দাড়ালো। তারপর হিয়ার কাছাকাছি এসে বলো,” এইটা আমার প্রিয় একটা জায়গা।”
হিয়া শুভ্রের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। শুভ্রর দৃষ্টিতে যে তার দিকেই স্থির ছিলো। না তাকালে হয়তো সে বুঝতে পারতো না। এবার চেস্টা করেও হিয়া চোখ ফিরাতে পারলো না শুভ্রের সে দৃষ্টি থেকে। নেশার মতন তাকে গ্রাস করেছে সে দৃষ্টি। হিয়া শুভ্রের দিকে তাকিয়েই বললো,”হুম্, অনেক সুন্দর জায়গাটা। কিন্তু আপনি আমাকে এইখানে এনেছেন কেনো?” খুব সাহস করে প্রশ্ন করলো হিয়া।
শুভ্র মুখটা আরেকটু এগিয় আনতেই দুরুত্ব যেনো একেবারে কমে গেলো। শুভ্রের নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে হিয়ার ঘাড়ে আর গলায়। শুভ্রকে নিজের এতো কাছে আবিষ্কার করেও হিয়া নড়তে পারলো না। গোধূলির এই হলদে আভায় কেনো জানি শুভ্রের গাল ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। সেই নেশা আরো গভীর ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে শুভ্রের চোখে।
শুভ্র ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,” তুমিই একমাত্র যাকে আমি এই জায়গায় এনেছি।”
কথাটা যেনো হিয়াকে একদম অবশ করে ফেলেছে।
শুভ্রের চোখের ভাষা যেনো সে পড়তে পারছে। শুভ্রের এই ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসা দরকার কিন্তু কিছুতেই সে তা পরছে না। হয়তো সে চাইছেও না।
শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়া ঠোঁট স্পর্শ করার আগে সেই বৃদ্ধ লোকটা হালকা কাশির আওয়াজ করলো। এতে হিয়ার ঘোর ভাঙলো। চোখ বড় বড় করে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো সে। হিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। এমন একটা জায়গায় সবার সামনে কি করতে যাচ্ছিল।
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বৃদ্ধ লোকটার দিকে একবার তাকালো। লোকটা মিট মিট করে হাসছে। হিয়া রীতিমত শুভ্রের হাতের নিচে দিয়ে বেরিয়ে অন্যদিকে এসে দাড়ালো।
ফেরার সময় হিয়া কোনো কথা বললো না। সবটা সময়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। তবে শুভ্রের বলা শেষ কথাটা ভাবতেই ভালোলাগছে তার।
হিয়া গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে নিজের রূমে চলে গেলো। রুমে ঢুকে বাতি জ্বেলে দিতেই, বড় রকমের একটা শক খেলো সে। রীতিমত চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে নিলো হিয়া। রায়হান ম্যারিকে কোলে করে টেবিলের পাশে দাড়িয়ে আছে। হিয়াকে এমন চমকে উঠতে দেখে বললো,” রিলাক্স। ভয় পেয় না।”
” আপনি তো আসলেই একটা এলিয়েন। এভাবে হুটহাট সামনে আসেন কেনো?”, ভয়ার্ত গলায় বললো হিয়া।
” এলিয়েন? বাহ্ নামটা তো সুন্দর। তোমার চয়েস অফ ওয়ার্ড অনেক ভালো।”,বলেই হাসলো সে।
হিয়া হা করে তাকিয়ে আছে। তারপর নিজেকে শান্ত করে বললো,” আপনি এই অন্ধকার রূমে কি করছিলেন?”
” কিছুই না তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর আমার অন্ধকার একটু বেশি পছন্দ।”,বলতে বলতে এগিয়ে এলো রায়হান।
” আমার জন্যে? কেনো?”,অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো হিয়া।
” তোমার সাথে কিছু কথা বলার ছিলো।”, বাকিটা বলার আগেই শুভ্র দরজার পাশে এসে দাড়ালো। দেখে তো মনে হচ্ছে এক্ষুনি বাহির থেকে এসেছে। রায়হান শুভ্রর দিকে তাকিয়ে রক্তিম চোখে বললো,
” তোমরা দুজন কি একসাথে ফিরলে?”
রায়হানের প্রশ্নে হিয়া পিছনে তাকালো। পিছনে শুভ্রকে দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। হিয়া কিছু বলার আগেই শুভ্র রায়হানের উদ্দেশ্যে বললো,” একচুয়ালি আমি তোকেই খুঁজছিলাম। তোর সাথে আমার কথা আছে। আমার রুমে আয়।”
” কিন্তু আমি এখন হিয়ার কাছে এসেছি। তোর কথা না হয় পরেই শুনলাম।”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো রায়হান।
শুভ্রের রাগ হলো প্রচুর শুধু হিয়া আছে বলে সে রাগটা দমিয়ে রেখেছে। হিয়া নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। এরা কি এমন গম্ভীর ভাবেই একে অপরের সাথে কথা বলে? এদের এই ঘর থেকে বিদেয় করা লাগবে। এদের এমন রোবোটিক কথা শুনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই তার।
হিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,” আপনারা দুজনেই এখন নিজ নিজ রুমে চলে যান। আমি ফ্রেশ হবো।” কথাটা বলে শেষ করার আগেই শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো।
হিয়া কথাটা শেষ করে পিছনে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র নেই। রায়হান হালকা হেসে সহজ গলায় বললো,” আচ্ছা, তাহলে তুমি ফ্রী হলে আসবো। তবে একটু ডিস্টার্ব করি। ম্যারিকে রেখে যাই তোমার কাছে।”
হিয়া খুশি হয়ে গেলো। ছুটে এসে হাত বাড়িয়ে ম্যারিকে কোলে নিয়ে নিলো। রায়হান কয়েক সেকেন্ড হিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। রায়হান চলে যেতেই হিয়ার নিজের রুমের দরজা আটকে দিলো। তারপর ম্যারিকে সাথে করে শাওয়ারে ঢুকলো।
রাতে শুভ্র রায়হানের ঘরে এলো। রায়হান কাউচে বসে ভিডিও গেম খেলছিল। শুভ্রকে দেখে বললো,” বাহ্ সূর্য কোন দিকে অস্ত গিয়েছে? তুই আমার ঘরে?” দৃষ্টি তার গেমের দিকে। শুভ্র ঘরে এসেই টিভিটা বন্ধ করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রায়হান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শুভ্র টিভির সামনে পকেটে হাত ভরে দাড়ালো।
রায়হান বিরক্তির সুরে বলল,” তুই এটা কি করলি?”
শুভ্র রায়হানের প্রশ্ন সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বললো,
” তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে?”
” আচ্ছা, বল শুনি তোর ইম্পর্ট্যান্ট কথা। নাহলে তো আমাকে গেমটাও খেলতে দিবি না।”, কাউচে গা এলিয়ে দিয়ে বললো রায়হান।
শুভ্র গম্ভীর গলায় বললো,” সবটা জেনেও তোর আর ফুফুর এমন ছেলে মানুষির মনে কি?”
রায়হান তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো। তারপর উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো,” আমি আর আমার মা কি এমন ছেলেমানুষী করেছি যে তুই এতটা বিরক্ত?”
” একদম না বোঝার ভান করবি না। হিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে জেনেও এমন পাগলামির মানে কি?”, কঠিন গলায় বলল শুভ্র।
” আচ্ছা এই ব্যাপার? বিয়েটা তো তোরা দুজনেই বাধ্য হয়ে করেছিস। তুই তো হিয়াকে বউ বলে মেনেও নিবি না বলেছিস। আলাদা আলাদা ঘরে থাকিস। তারপর ও আমাকে এই প্রশ্নটা করা কি তোর পাগলামি না?”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বললো রায়হান।
শুভ্র আবারো কঠিন গলায় বলল,” সেটা আমাদের পার্সোনাল ম্যাটার। তুই কেনো ইন্টারফেয়ার করবি।”
রায়হান শুভ্রের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে জোর গলায় বলল,” অবশ্যই করবো। বিকজ আই লাভ হার। আই এক্সট্রিমলি…….” বাকিটা বলার আগেই শুভ্র রায়হানের কলার চেপে ধরলো। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” শাট আপ রায়হান। জাস্ট শাট আপ। তুই যা করছিস এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।”
রায়হান কলার থেকে শুভ্রের হাত সরিয়ে দিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” ফল যেটাই হোক। এতো সহজে তো আমি হাল ছাড়ছি না। ডিভোর্স প্যাপার রেডি হচ্ছে ডাক্টার সাহেব। তোর বাবাই সবটা করছে। গুটি কিন্তু ওনার হাতে আমি তো শুধু বিয়েটা এগিয়ে এনেছি। থাটস ইট।”
শুভ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো। নিজেকে কথা সম্ভব সামলানোর চেষ্টা করছে। শুভ্র চোয়াল শক্ত করে বললো,” জাস্ট স্টপ টকিং নোনসেন্স। ইউ আর ডে ড্রিমিং।”
” নো, দিস ইজ রিয়ালিটি ব্র। জাস্ট ভাব হিয়া তোর বাবাকে কতটা শ্রদ্ধা করে। তোর বাবা যা বলবে হিয়া কিন্তু সেটাই করবে। আসলে ফল্টটা কার বলতো? তোর। তুই ওকে অবহেলা করেছিস। হিয়া নিশ্চই তোর কাছে থাকতে চাইবে না মামার কথার বাইরে গিয়ে। নাউ ইউর টাইম ইজ অভার মিস্টার শুভ্রনীল আহমেদ।”,
” তুই যে আকাশ কুসুম চিন্তা করে আছিস না এইসবের কিছুই হবে না। আই গ্যারান্টি ইউ। ইউ আর মেসিং উইথ দা রং পারসন।”, কঠিন গলায় বলেই শুভ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আর কিছুক্ষণ রায়হানের সামনে থাকলে হয়তো শুভ্রের হাত উঠে যেতো। তার বাবা কেনো যে এইসব সাড়া দিচ্ছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না।
শুভ্র রেগে নিজের বাবার ঘরে ঢুকলো। রবীউল সাহেব সবে নিজের ঘুমের ওষুধ খাচ্ছেন। একপাশে সাহারা খাতুন কাপড় ভাজ করছেন। শুভ্র ঘরে ঢুকেই বললো,
” বাবা তুমি কি শুরু করেছো? তুমি তোমার বোন আর বোনের ছেলে কি পাগল হয়ে গেছো?”
সাহারা খাতুন আর রবীউল সাহেব চমকে তাকালেন। রবিউল সাহেব মনে মনে হাসলেন। এতোক্ষণে তার ছেলের টনক নড়েছে। রবীউল সাহেব ঠিক কি করবেন সেটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। হিয়ার মতের বিরুদ্ধে কিছুই হবে না। ততক্ষন যে যত পারে আকাশ কুসুম চিন্তা করে লাফালাফি করুক। তার কি? যে মহিলা তাকে বারন করেছে এই বিয়েটা যেনো কেউ না জানে অথচ সে এখন মুখ কালো করে আছে। করুক মুখ কালো। সবার একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। তবে জলটা হিয়ার মামার কাছে পৌঁছানোর আগেই এসব বন্ধ করা দরকার। চিন্তা তো হয় এই ছেলেটাকে নিয়ে, রেগে গিয়ে আবার কি করে?
থাক করুক। এখন খুব মেজাজ দেখাতে রূমে এসেছে। রবীউল সাহেব ঠিক করে নিয়েছেন এইসবের পর হয়তো এই বিয়ে টিকবে নয়তো ভাঙবে। এই যন্ত্রণা তার আর ভালো লাগছে না।
[ #চলবে ]
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৩
“তোমার এতো সমস্যা কেনো হচ্ছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই যাও ঘুমাও।”, নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন রবীউল সাহেব।
” তার মানে এইসবে তোমার সায় আছে। আমার শুধু এইটাই জানবার ছিলো। তুমি ভুলে যেও না আমি কিন্তু তোমারই ছেলে। যা হবে তার জন্যে প্রস্তুত থেকো।”, বলেই শুভ্র বেড়িয়ে গেলো।
রবীউল সাহেব গা ছাড়া ভাব নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় শুতে এলেন। সাহারা খাতুন আড় চোখে সবটা দেখছেন। রীতিমত গা জ্বালা করছে তার। এমন মানুষ সে তার জিবনে দেখেনি।
🦋 রবীউল সাহেব হিয়ার ঘরে এলেন।হিয়ার ঘরের বাইরে দাড়িয়ে দরজার নক করলেন। যাকে নিয়ে এতো কিছু তাকে তো সবটা জানাতে হবে। হিয়া পড়ার টেবিলে বসেছিল। দরজায় টোকা পড়তেই সে পিছনে ফিরে রবীউল সাহেবকে দেখে এগিয়ে এসে রবীউল সাহেবকে এনে ঘরে বসালো।
রবীউল সাহেব পড়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললো,” পড়ছিলি বুঝি? ডিস্টার্ব করলাম নাকি?”
” না, না কিসের ডিস্টার্ব। সারাক্ষণ পড়তে কি আর ভালো লাগে?”,
” আচ্ছা। কিছু কথা বলতাম তোকে। কিভাবে যে শুরু করি।”, রবীউল সাহেব ইতস্তত বোধ করলেন।
” এতো ভাবা লাগবে না। আমি না তোমার মেয়ে,তুমি বলো আমাকে।”
” আমার বোন মানে তোর ফুফু।”,এতটুকু বলেই তিনি থামলেন।
“হ্যা, কি হয়েছে ফুফুর?”, চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো হিয়া।
রবীউল সাহেব সবকিছু খুলে বললেন। হিয়া প্রথমে ঠিক বুঝলো না। রবীউল সাহেব সবটা বুঝিয়ে বলতেই হিয়া রীতিমত চমকালো। এতকিছু হয়ে গেলো অথচ সে কিছুই জানে না। হিয়া করুন দৃষ্টিতে রবীউল সাহেবের দিকে তাকালো। কি বলবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
রবীউল সাহেব হিয়ার এমন অবস্থা দেখে বললেন,” এতো চিন্তা করতে হবে না। তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু হবে না। এই বিয়েতে তুই রাজি থাকলে তবেই হবে। আর রইলো ডিভোর্স। সেইটা তো একদিন হবার কথাই ছিলো।” বলেই তিনি থামলেন।
হিয়া গভির চিন্তায় পরে গেলো। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,” এইসব আমার ভালো লাগছে না। এগুলো কি বন্ধ করা যায় না। এই বিয়েটা আমি করতে চাই না।”
” হুম্ তাহলে তো হয়েই গেলো। কিন্তু তোকে একটা কষ্ট করতে হবে। এই কথাটা নিজের মুখে রায়হানকে বলতে হবে। রায়হান বিয়ে থেকে সরে এলেই তোর ফুফু শান্ত হবে।”,
হিয়া সবটা শুনে ভাবনায় পরে গেলো। এই কঠিন কাজটা তাকেই কেনো করতে হবে? হিয়া ভয়ার্ত গলায় বললো,” আমাকেই বলতে হবে?”
” হ্যা, তোকেই বলতে হবে। আর ডিভোর্সের কি করবো?”,বলেই হিয়ার দিকে তাকালো।
হিয়া রীতিমত চিন্তার গভির সাগরে পরে গেলো। এ কোন দ্বিধায় পরলো সে। হিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,” আমি জানি না।”
হিয়ার মধ্যে কেনো অনুভূতি কাজ করছে না কেনো জানি। যা হবার হবে। বেশি ভাবতেও পারছে না। ভাবতে গেলেই কেমন অদ্ভূত খারাপ লাগা কাজ করছে। হারিয়ে ফেলার ভয় তার নেই, কিন্তু তাও কেনো এমন লাগছে। হিয়া চুপ করে রইলো। রবীউল সাহেব আর কিছু বললেন না। হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।
হিয়া নিশ্চুপে বসে রইলো। ডিভোর্স হলে কি হবে? শুভ্র আবার বিয়ে করবে? এমনিতেও সে শুভ্রের বউ ছিলো কবে? যা হবার হবে। সে আর ভাববে না। ভেবেও যে সে কিছু করতে পারবে তা তো না।
✨ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাবেয়া ফুফুকে নিজের ঘরে দেখে বেশ চমকালো। উনি এই সকালে তার ঘরে কি করছেন। ম্যারিকে রায়হানের কাছ থেকে নিয়ে নিজের কাছে রেখেছে। ম্যারিকে খাটের পাশেই বিছানা করে ঘুমাতে দিয়েছিল হিয়া কিন্তু ম্যারি উঠে হিয়ার মাথার কাছে নাচানাচি করছে। হিয়া চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো।
কিছুক্ষণ পর পুরো ব্যাপারটা হিয়ার কাছে পরিষ্কার হলো। ফুফু কিছু শাড়ি সঙ্গে করে এনেছেন। হিয়াকে শাড়িগুলো থেকে একটা পড়তে হবে। কি যন্ত্রণা!রাবেয়া ফুফুর মতন এমন গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ এমন ছেলে মানুষী কেনো করছে তার সঠিক কারণ হিয়া বুঝতে পারছে না।
হিয়া মলিন চোখে শাড়ী পড়তে না জানার অক্ষমতা জানিয়ে ভেবেছিল বেচেঁ যাবে। কিন্তু না ফুফু নিজেই হিয়াকে শাড়ি পরিয়ে দিল। নিজের মুখে কিছু বলতেও পারছে না হিয়া। সকালে ঘুম থেকে উঠে এমনভাবে তাকে শাড়ি পড়তে হবে কোনোদিন চিন্তাও করেনি সে।
ফুফু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই হিয়া যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এই বিয়ে ভাঙতেই হবে। এই এলিয়েনটাকে সে কই পাবে। হিয়া ঘর থাকে বেড়িয়ে এলো শাড়ী পড়ে। এলিয়েনটাকে কোথায় যে পাবে? রায়হানকে না পেয়ে হিয়া নিজের রুমে ফিরে যাচ্ছিল। শুভ্রের রুম পেরিয়ে যেতেই হিয়ার একটা ইচ্ছা জাগলো মনে। হিয়া দেওয়াল ঘেঁসে দাড়িয়ে আস্তে করে দরজার পাশ থেকে ঘাড় কাত করে শুভ্রের রূমে উকি দিলো। সে জানে শুভ্র তাকে দেখলেই রেগে উঠবে কিন্তু সকাল সকাল শুভ্রকে রাগিয়ে দিতে খুব ইচ্ছে হলো তার।
শুভ্র টেবিলের থেকে সবেমাত্র নিজের চশমাটা নিয়ে চোখে পড়েছে এর মাঝেই হিয়ার কাত করে থাকা মাথাটা তার চোখে পড়লো। হিয়ার দৃষ্টি বারান্দার দিকে, শুভ্র উঠে এসে একদম হিয়ার সামনে এসে দাড়াতেই হিয়া ভয় পেয়ে ছিটকে সরে দাঁড়ালো। শুভ্র হিয়াকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সাত সকালে এমন শাড়ী পরে ঘুর ঘুর করছে কেনো এই মেয়ে। শুভ্র হিয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বললো,” এই ভাবে বউ সেজে সকাল সকাল আমার ঘরে উকি মারছ কেনো? বউ হতে ইচ্ছে করছে?”
হিয়া চোখ কপালে তুলে ঘন ঘন না সূচক মাথা নেড়ে বললো,” ভুল ভাল কথা বলবেন না। আমি তো ম্যারিকে খুঁজছিলাম।”
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো তারপর বললো,” শাড়ী পড়েছো কেনো?”
হিয়া উপহাস মুলুক হেসে বললো,” কিছু না এমনি। ফুফু বলেছে পড়তে।” এতটুকু বলতেই শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
হিয়ার ভয় লাগলো সে আমতা আমতা করে বলল,” আমি যাই আমার খুব খিদে পেয়েছে। ম্যারিকে দেখলে আমার রুমে যেতে বলবেন।” বলেই কেটে পড়তে নিলো।
শুভ্র রাগী গলায় বললো,” তোমার খরগোশ কি তোমার সাথে থেকে থেকে কথা বলাও শিখে গেছে?”
হিয়া চলে যেতে গিয়েও থামলো তারপর আড় চোখে একবার তাকিয়ে বললো,” ঈশারা করে দিবেন তাহলেই হবে, ও বুঝে যাবে।”
শুভ্র কিছুক্ষণ কঠিন দৃষ্টিতে হিয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকালো।তারপর সজোরে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিল। সিড়ি দিয়ে নেমে যেতেই সেই শব্দে হিয়া চোখ বড় বড় করে পিছনে তাকালো। এই লোকের রাগের চাপে কোনদিন দড়জাটা ভেঙে পড়ে।
হিয়া রান্না ঘরে মোহনার সাথে কথা বলছিলো। রায়হান একটা গাজর খেতে খেতে এগিয়ে আসলো। তারপর মোহনার দিকে তাকিয়ে বললো,” আপু আমার বেবিকে দেখেছো?”
মোহনা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বদমাইস ছেলে বলে কি? হিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,” বেবি? আপনার বাচ্চা আছে?”
রায়হান হিয়ার দিকে খেয়াল করতেই হিয়ার পরনে শাড়ি দেখে বিমোহিত হয়ে গেলো। মোহনা সজোরে পিঠে একটা থাপ্পর দিয়ে বললো,” আমি তোর বড় না? আমাকে তুই কী জিজ্ঞেস করিস?”
রায়হান পিঠের সে জায়গা ডলতে ডলতে বললো,” আরে, আমি ম্যারির কথা জিজ্ঞেস করেছি।”
হিয়া খিল খিল করে হেসে উঠে বললো,” ও আমার ঘরে আছে।”
রায়হান হিয়ার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,” তোমাকে কিন্তু শাড়িতে সুন্দর লাগে। আই মিন বাচ্চা লাগে না।”
হিয়া রায়হানের এমন মন্তব্যে মোহনার সামনে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মোহনা আস্তে করে হিয়ার কানের কাছে এসে বললো,” তোমার বরের মনে হয় অনেক হিংসে হচ্ছে।”
হিয়া ভ্র কুচকে মোহনার দিকে তাকালো তারপর ফিসফিসিয়ে বললো,” কে বর? কার কথা বলছো?”
মোহনা ফ্রিজের দিকে ঈশারা করতেই হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়া মোহনার কানে কানে বললো,” আমি তো ভুলেই গেছিলাম উনি আমার বর।” বলেই হিয়া হেসে ফেললো। রায়হান মোহনা আর হিয়ার এমন ফিসফিস করে কথা বলার মাঝে বললো,” আচ্ছা আমি ম্যারির কাছে গেলাম। তোমাদের ফিসফিসিয়ে কথা ততক্ষনে শেষ করো।”
এর মাঝে শুভ্র রেগে নিজের ঘরে চলে গেল। নিজের বাড়িটা এখন অসহ্যকর লাগছে।
শুভ্র চলে যেতেই মোহনা বলল,” তুমি রায়হানকে বলবে কখন?”
মোহনার প্রশ্নে হিয়া চিন্তিত গলায় বললো,” বুঝতে পারছি না। কিভাবে বলবো?”
” এইসব শেষ করো যত তাড়াতাড়ি পারো। ভাল্লাগছে না আর।”, বিরক্তি প্রকাশ করে বললো মোহনা।
হিয়া হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। আজকেই এই বিয়ের কথা শেষ করতে হবে।
সন্ধায় হিয়া ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। রায়হানকে কি বলবে সেটাই মাথায় গুছিয়ে নিচ্ছে। কি অপ্রীতিকর একটা অবস্থা! রায়হান ম্যারিকে কোলে করে ছাদে উঠলো। আকাশটা আজ তারায় ভরা। রায়হান এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে দাঁড়ালো তারপর বললো,” কি ব্যাপার? শুনলাম স্ট্রবেরি আমার খোঁজ করছে?”
হিয়া অন্যমনস্ক ছিলো, রায়হানের কণ্ঠে পাশে তাকাতেই দেখলো রায়হান রেলিংয়ে হাতের ভার দিয়ে দাড়িয়ে আছে। হিয়া ইতস্তত করে বললো,” আমার আপনাকে কিছু বলার ছিলো।”
রায়হান ম্যারিকে ছাদের ছেড়ে দিয়ে বললো,” হুম্, তোমার কথা শুনতেই তো আমি এসেছি।”বলেই পলকহীন দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
হিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” আসলে এই বিয়েটা! মানে….. আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই না।”
রায়হান নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” কারণটা কি জানতে পারি?”
হিয়া একবার রায়হানের দিয়ে তাকালো। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,” আমি না সবটা হারিয়েছি। বাবা, মা আমার ছোট ভাইটা সব হারিয়েছি। আমার জীবনে অনেক শুন্যতা ছিলো। কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর সেই শুন্যতা ধীরে ধীরে যেনো হারিয়ে গেছে। আর বিয়ে নামক এই সম্পর্কটাতে আমি একবার জড়িয়েছি দ্বিতীয়বার আর জড়াতে চাই না। আর নতুন কাউকেও নিজের জীবনে চাই না।”
” আর যে তোমার জীবনে জড়াতে চায় তার কি হবে?”, সহজ গলায় প্রশ্ন করলো রায়হান।
” মানে?”, ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো হিয়া।
রায়হান সিরিয়াস হয়ে বললো,” আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি।”
হিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকালো। রায়হানের এমন ভাবহীন ভাবে ভালোবাসার অভিব্যাক্তি হিয়াকে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে নিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ নিরবতা থাকলেও রায়হান নিরবতা ভেঙে বললো,” তুমি আমায় ভালোবসো?”
হিয়া অবাক হয়ে তাকালো। রায়হান হটাৎ এমন প্রস্ন করছে কেনো? হিয়া গম্ভীর গলায় বললো,” নাহ্।”
” শুভ্রকে ভালোবাসো?”, আবারো কঠিন গলায় বলল রায়হান।
হিয়া দৃষ্টি সামনে রেখে অস্পষ্ট গলায় বললো,” জানি না।”
রায়হান ব্যাথিত সুরে হাসলো তারপর বললো,” হুম। আমার আর শুভ্রের মধ্যে পার্থক্য শুধু একটা শব্দের। এই একটা শব্দের জন্যে আমি আজ হেরে গেলাম।”
হিয়া চুপ করে আছে। এই মুহূর্তে কি বলবে সে সেটা জানে না। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে জানলে হয়তো সে আসতো না।
রায়হান নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,” আমি তাহলে একটাও সুযোগ পাচ্ছি না।” বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
হিয়া শাড়ির আঁচল মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,” আপনি আমাকে যেই কথাটা বলেছেন সেটা আর কাউকে, বলবেন না। আপনার কাছে অনুরোধ রইল।”
রায়হান রহস্যময় হাসি হাসলো তারপর বললো,” তোমাকে যে আমি ভালোবাসি এই কথাটা কেউ জানবে না। শুধু আমি আর আমার এই আকাশ জানবে।” তারপর আকাশের নীল তারাটা দেখিয়ে বললো,” তবে আজ থেকে আকাশের ওই নীল তারাটা আমার।”
হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। নীল তারার কথা রায়হান কিভাবে জানে। রায়হানের তো এই গল্পটা জানার কথা না। হিয়া বিস্ময় নিয়ে বললো,” আপনি কিভাবে….?” বাকিটা বলার আগেই রায়হান রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে গেলো। হিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
রায়হান সেদিন হিয়ার ঘরে হিয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে গিয়ে হিয়ার ছোট্ট ডায়রিটা পড়েছে। সেখানে হিয়া লিখেছিলো। ছোটো বেলায় যখন সে কাঁদতো তখন তার বাবা আকাশের নীল তারাটা দেখিয়ে তার কান্না থামাতো। সেই ছোটবেলা থেকে ওই নীল তারাটাকে নিজের বলে দাবি করে হিয়া। ময়মনসিংহে নিজের ঘরটা তাইতো এতো নীল তারা দিয়ে সাজিয়েছে সে। রাতের অন্ধকারে এই তারাগুলোই তার কান্না থামাতো।
[ #চলবে ]