নীলচে তারার আলো পর্ব-২৪+২৫

0
883

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৪

হিয়া ছাদ থেকে নামছিলো। নামার সময় শাড়িতে পেঁচিয়ে পরে গিয়ে ভীষণভাবে পায়ে ব্যাথা পেলো। হাঁটতে গেলেই ব্যাথা হচ্ছে পায়ে। নিজের উপরেই এখন রাগ লাগছে। কোনোভাবে নিজের রুমে যেতে পারলেই হলো। কিন্তু হটাৎ নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করতেই দেখলো শুভ্র তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। হিয়া চোখ বড় বড় করে শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্র রাগী গলায় বললো,” লাফালাফি একটু কম করতে পারো না।”

হিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শুভ্র কখন এলো। হিয়া বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যখন শুভ্র তাকে কোলে করে নিজের রূমে ঢুকলো। হিয়া চোখ পিট পিট করে শুভ্রের দিকে দুইবার তাকালো। তারপর ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,” আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন।” বলতে বলতে শুভ্র হিয়াকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।

হিয়া হা করে তাকিয়ে আছে। এইটা কি স্বপ্ন? এই বনমানুষ তাকে নিজের ঘরে এনেছে তাও আবার নিজের বিছানায় এনে বসিয়েছে। হিয়া ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। পা টা কি ভেঙে গেলো নাকি? কয়েকবার আর্তনাদ করতেই শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পায়ে স্পর্শ করলো। হিয়া পা সরিয়ে ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বললো,” কি করছেন? পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,” স্টুপিডের মতোন কথা বলবে না। দেখি পা এইদিকে আনো।”

হিয়া রাগী গলায় বললো,” না।” শুভ্র বিরক্ত হয়ে নিজেই এগিয়ে এসে হিয়ার পা থেকে শাড়িটা হালকা উপরে তুলতেই হিয়া ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে শাড়ী নামিয়ে বললো,” আমি আপনাকে দেখাবো না। আপনি কোনো মহিলা ডাক্টারকে ডাকুন।”

শুভ্র ভীষন রেগে গিয়ে বললো,” শাট আপ। একটাও কথা যদি আর বলেছো।”

শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার পা মচকে গেছে কিনা দেখছে। হিয়া শাড়ির আঁচলটা শক্ত করে ধরে নাক মুখ কুচকে আছে। পায়ে তার ভীষন সুড়সুড়ি কিন্তু এই লজ্জার কথা এই বনমানুষটাকে বলবেই বা কি করে? লোকটা কিছুই বুঝে না। হিয়া কিছুক্ষণ পর হটাৎ ব্যাথাটা আর অনুভব করছে না। শুধু পা নাড়াতেই রগে ব্যাথা হচ্ছে। হিয়া আস্তে করে শাড়ী দিয়ে নিজের পা ঢেকে ফেললো। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো ,” চুপচাপ এইখানে বসে থাকো আমি আসছি।” বলেই শুভ্র বেড়িয়ে গেলো।

হিয়া বসে আছে, শুভ্রের ঘরটা দেখছে। দেওয়াল গুলো একদম সাদা। শুধু একটা দেওয়াল ধূসর রঙের। আর পর্দাগুলো হালকা নীল রঙের। খুব গুছানো একটা ঘর। মেয়ে হয়েও তো সে নিজের ঘর এমন সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে না। হটাৎ কেনো জানি তার এই ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে। ঘর সাজানো হিয়ার তেমন পছন্দ হয়নি কিছু ওয়ালম্যাট থাকলে ভালো হতো। কিন্তু তাও শুভ্রের সাথে থাকটে ইচ্ছে করছে। অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা থাকলে সে এই ঘরে থেকে দেখতো লোকটা সারাদিন এই ঘরে কি করে।

শুভ্র কিছুক্ষণ পর আইস কিউব নিয়ে ঘরে ঢুকলো। তারপর হিয়ার পাশে বসে হিয়ার পা নিজের কোলে নিতেই হিয়া বেশ চমকালো। শুভ্র খুব যত্ন করে লাল হয়ে যাওয়া জায়গায় বরফ দিচ্ছে। ছোটো বেলা থেকে একটু পরে গেলেই হিয়ার ফর্সা গায়ে সেটা রক্তিম বর্ন ধারণ করতো। শুভ্র একবার হিয়ার দিকে তাকিয়ে ব্যাথা কমেছে কিনা জানতে চাইলো। হিয়া বললো ব্যাথা কমেনি কিন্তু ব্যাথাটা অল্প আছে। মিথ্যে বলেছে কেনো সে জানে না। হয়তো শুভ্রের তার প্রতি এই যত্ন তার ভালোলাগছে।

শুভ্র আবারো জিজ্ঞেস করলো,” একটুও ব্যাথা কমেনি?” শুভ্রের ধারণা অনুযায়ী ব্যাথাটা কমে যাওয়ার কথা।

হিয়া না সূচক মাথা নাড়লো। তারপর ব্যাথাতুর মুখভঙ্গি করলো। শুভ্র কয়েকবার পলক ফেলতেই রবীউল সাহেব আর সাহারা খাতুন ঘরে ঢুকলেন। দুজনেই হিয়াকে শুভ্রের ঘরে দেখে চমকালেন। হিয়ার তাদের চেহারার সে চমক দেখতে পাচ্ছে।

সাহারা খাতুন অবাক ভঙ্গিতে বললেন,” ওর পায়ে কি হয়েছে?”

শুভ্র বরফের বাটিটা একপাশে রাখতে রাখতে বললো,” সিড়িতে পড়ে গেছে।”

রবিউল সাহেবের সেইদিকে কোনো চিন্তা নেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,” হিয়া এইঘরে কি করে এলো?” এই প্রশ্নে হিয়া বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ইস নিজের রুমে চলে যাওয়া উচিৎ ছিলো।

শুভ্র নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,” আমি এনেছি। কেনো তোমার কোনো সমস্যা?”

শুভ্রের এমন প্রশ্নে রবীউল সাহেব রেগে গিয়ে বললেন,” সামনে ওর বিয়ে আর তুমি ওকে কেনো তোমার ঘরে এনেছো? এই রহিমা, রহিমা।” বিয়ের প্রসঙ্গটা শুধু শুভ্রকে রাগাতে বলেছেন তিনি। ঈশারায় হিয়াকে বুঝ দিলেন। খালা রীতিমত ছুটে আসতেই রবীউল সাহেব বললেন,” হিয়াকে ধরে নিজের রুমে দিয়ে আয়।” আর কিছু বলার আগেই শুভ্র কঠিন গলায় বললো,” হিয়া কোথাও যাবে না।”

শুভ্রের মুখে নিজের নাম শুনে হিয়া ভীষন অবাক হলো। কিন্তু ছেলের এমন উক্তিতে রবীউল সাহেব বললেন,” হিয়াকে তোমার ঘরে রাখার অনুমতি আমি কখনোই দিবো না।”

শুভ্র একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,” তোমার কাছে অনুমতি চেয়েছে কে?”

সাহারা খাতুন কঠিন গলায় তার স্বামীকে বললেন,” বুড়ো হয়েছো। কিন্তু বুদ্ধি জ্ঞান সব কি দিন দিন হারাচ্ছো? চুপ চাপ নিজের ঘরে এসো। হিয়া এখন থেকে এই ঘরেই থাকবে।” বলেই রবীউল সাহেবকে টেনে ঘর থেকে বের করে আনলেন। তারপর বেড়িয়ে এসে আরো বললেন,”এই বিয়ের চ্যাপ্টার বাদ। এই নিয়ে যদি আর কোনো বাড়াবাড়ি তুমি করেছো। আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তুমি আর তোমার বোন থেকো।” সাহারা খাতুনের এমন রূপ রবীউল সাহেব এর আগে দেখেনি।

হিয়া শেষের কথাটা শুনেই লাফিয়ে খাট থেকে নেমে পড়লো। লাফাতে গিয়ে পায়ে একটু ব্যাথা অনুভব হলো। অ্যহায় শাশুড়িটা বলে কি? হিয়া শুভ্রের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার সামনে আসতেই শুভ্র দরজা লাগিয়ে দিয়ে কড়া চোখে হিয়ার দিকে তাকালো।

হিয়া ভয়ার্ত গলায় বললো,” আমার পা ঠিক আছে। আমি হেঁটে হেঁটে নিজের রুমে যেতে পারবো। আমার প্রতি এতো সহমর্মিতা দেখানোর জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।” শেষের কথাটা শুনে শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ফেললো তারপর বললো,” চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসো। একদম দরজা খোলার চেষ্টা করবে না।”

” মানে? কি আশ্চর্য। আমাকে যেতে দিন।”,বলেই এগিয়ে এসে দরজা খোলার চেষ্টা করলো। শুভ্র এক হাত পকেটে ভরে অন্যহাতে দরজার লক ধরে আছে। হিয়া নিজের সর্ব শক্তি দিয়েও পারছে না। এতক্ষণ এই ঘরে থাকার ইচ্ছে হলেই শাশুড়ির শেষ বাক্যটি কানে আসতেই সে ইচ্ছে কর্পুরের মতন উড়ে গেছে।

শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। পায়ে ব্যাথা নিয়েও কিভাবে দরজা খোলার জন্য এই মেয়ে লাফাচ্ছে। শুভ্র তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” তুমি নিজে গিয়ে বিছানায় বসবে নাকি আমায় নিয়ে যেতে হবে। তোমার পায়ের ব্যাথা কি উড়ে গেছে?”

” আমি এই ঘরে থাকবো না।”, রেগে বললো হিয়া।

শুভ্র দরজার লক থেকে হাত সরিয়ে শার্টের হাতা ভাজ করে বললো,” আমাকে বলছো কেনো? সাহস থাকে তো আমার মাকে গিয়ে বলো।”

শুভ্র লক থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে, চোখ পড়তেই হিয়া দরজা খুলে পালাবে তার আগেই শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে নিলো। হিয়া পরাজয় মেনে নিলো কারণ তার পায়ে এবার সত্যিই ব্যাথা হচ্ছে। শুভ্র হিয়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,” এবার তো তুলে এনেছি এইখান থেকে নামবে তো পরের বার বেধে রাখবো।”

” আপনি তো আমাকে আপনার রুমে এলেই গেট আউট গেট আউট করতেন এখন আবার আপনি আমাকে যেতে দিচ্ছেন না কেনো?”, বিস্ময় নিয়ে বললো হিয়া।

শুভ্র উত্তরে কিছু বললো না। হিয়া গভির চিন্তায় পড়ে গেলো। শুভ্র কি তাহলে নিজে থেকে চাইছে সে তার কাছে থাকুক। এই বনমানুষটা এমন কিছু চাইতে পারে বলে তো মনে হচ্ছে না। একটু বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়। হিয়ার এইবার রবীউল সাহেবের ঈশারা আন্দাজ করতে পারছে।

হিয়া একটু সাহস জুগিয়ে বললো,” দেখুন কিছুদিন পর আমার বিয়ে আপনি এইভাবে আমাকে আপনার ঘরে রাখতে পারেন না। আর এমনিতেও আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না।”

হিয়ার এমন উক্তিতে শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে বললো,” বিয়ে… তোমার? ভেরি গুড। স্টে ইন ইউর ড্রীমস।”

হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” মানে। কি বলতে চান আপনি?”

শুভ্র পকেটে হাত ভরে শান্ত দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” হু ইজ স্ট্যান্ডিং ইন ফ্রন্ট অফ ইউ?”

হিয়া দুইবার পলক ফেললো এইটা আবার কেমন প্রশ্ন? এই লোকটা কি নিজের নাম ভুলে গেছে? হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” শুভ্রনীল আহমেদ।” অনেকটা খাপ ছাড়া ভাবেই বললো হিয়া।

” নো। অ্যাম ইউর হাসব্যান্ড।”, গম্ভীর গলায় বললো শুভ্র। চোখে মুখেই শুভ্রের কথাটার গাম্ভীর্য টের পাচ্ছে হিয়া।

হিয়া এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেলো। শীতল শিহরণ বয়ে গেলো হিয়ার মাঝে। হিয়া জড়ানো গলায় বললো,” আচ্ছা, আমার তো মনেই ছিলো না। অবশ্য মনে থাকার মতো কিছু আপনি করেছেন বলে মনে হয় না।” হিয়া নিজে নিজেই বির বির করছিল।

শুভ্র সবটা শুনে পকেট থেকে হাত বের করে হিয়ার দুপাশে রেখে ঝুকে আসতেই হিয়া হকচকিয়ে উঠে বললো,” কি করছেন আপনি?”

শুভ্র শীতল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। যে দৃষ্টি হিয়াকে অনায়াসে কাবু করে ফেলে। ছটটফট হিয়া তখন শান্ত হয়ে সেই দৃষ্টিতে হারিয়ে গেলো। হিয়ার আঁচলে মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটো নিজের হাতের ভাজে আটকে পরক্ষণেই হিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। তারপর গভীরভাবে কিস করলো। শুভ্রের হটাৎ এমন আচরনে হিয়া পরক্ষনেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। প্রতি মুহুর্তে হৃদ কম্পন যেনো কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।শুভ্রকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো উপায়ও তার কাছে নেই।

কিছুক্ষণ পর শুভ্র সরে আসতেই হিয়া মাথা নিচু করে জোরে জোড়ে নিশ্বাস নিতে লাগলো। লজ্জায় গাল দুটোয় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে।

শুভ্র এক হাত দিয়ে হিয়ার চিবুক ছুঁয়ে মুখটা উপরে তুলেতেই হিয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। শুভ্র তার প্রিয়দর্শিনীর লজ্জায় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে আরেকটু কাছে এসে বললো,” এরপর থেকে মনে রাখবে। শুভ্রনীল আহমেদ, তোমার হাসব্যান্ড।” কথাটা শুনতেই হিয়ার শরীর শিউরে উঠলো।

[ #চলবে ]

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৫

শুভ্র তার প্রিয়দর্শিনীর লজ্জায় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে আরেকটু কাছে এসে বললো,” এরপর থেকে মনে রাখবে। শুভ্রনীল আহমেদ, তোমার হাসব্যান্ড।”
কথাটা শুনতেই হিয়ার শরীর শিউরে উঠলো। শুভ্র চোখে হাসলো তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,” তোমার পায়ে এমনিতেই সমস্যা আছে। তাই চুপচাপ রেস্ট নাও।”,বলেই শুভ্র তোয়ালে নিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।

হিয়া এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। শুভ্র ওয়াশরুমে যেতেই ফট করে চোখে খুলে নিজের দুই গাল স্পর্শ করলো। গাল দুটো দিয়ে তাপ বের হচ্ছে। শুভ্র এই কয়েক মিনিটে যা করলো সেই ঘোর থেকে হিয়া এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। শুভ্র তাকে কিস করেছে? আবার বলেছে শুভ্রনীল আহমেদ তার হাসব্যান্ড মনে রাখতে। লোকটা কি তাকে পছন্দ করে? কথাটা ভাবতেই গাল দুটো আরেক দফায় লাল হয়ে গেছে। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আছে। যেনো অনুভূতির এক ঘূর্ণিঝড় তার মাঝে বয়ে গেলো। কিন্তু তাকে কেনো পছন্দ করবে এই বদমাইস ডাক্তার?
প্রথম থেকে তাকে দেখলেই তো রেগে আগুন হয়ে গেছে। এখন আবার বলছে হাসব্যান্ড। কথাটা কি এমনেই বললো? তাহলে কি কিস……. না না আর ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। পালাতে হবে। আজ রাত এই ডাক্তারের সাথে থাকলে নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাবে সে।

হিয়া সুযোগ বুঝে নিজের রূমে চলে গেলো। গিয়েই দরজা আটকে ফেললো। হিয়া কখনো রুমে দরজা আটকায় না ভয় লাগে কিন্তু আজ সে সব কিছু পরোয়া করে না সে।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখে হিয়া রুমে নেই। দরজাটাও খোলা, বাঁদরটা পালিয়েছে। হিয়ার এমন ছেলে মানুষী দেখলে সত্যি রাগ হয়। পায়ে এমনেই সমস্যা তাও একটু সাবধানে থাকতে পারে না। ঘুরে ফিরেই পায়েই বার বার চোট পেতে হয় মেয়েটার। রাগ দেখালে তো আবার সে খারাপ। কিন্তু নিজে যে সবসময় বাচ্চাদের মতন জেদ করে সেটা বুঝতে পারে না।

শুভ্র কাবাড খুলে বাদামি রঙের একটা টি শার্ট পড়লো তারপর নিজের বিছানায় তাকাতেই দেখলো একটা নূপুর পরে আছে। শুভ্র এগিয়ে এসে নূপুরটা হাতে নিলো। এই যে বাঁদরটা ফেলে গেছে পরে হারিয়ে গেলে তো আবার কেদে কেটে অস্থির হয়ে যাবে। শুভ্র নুপূরটা ট্রাউজারের পকেটে রেখে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

হিয়ার ঘরের দরজা বন্ধ, শুভ্র জানে তার ভয়েই দরজা বন্ধ করে বসে আছে সে। হিয়া যে কেনো শুভ্রকে এতো ভয় করে শুভ্র ভেবে পায় না। কবে যে এই মেয়ের ভয় দূর হবে?শুভ্র চাইলে এক্ষুনি তুলে নিজের রুমে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কি লাভ! নিয়ে এলে তো সেই জড়সড় হয়ে বসে বসে বির বির করবে।

শুভ্র এই মেয়ের প্রতি কিভাবে যে এতটা দুর্বল সে নিজেও জানে না। হিয়া কখন যে শুভ্রের নিজের হয়ে গেছে শুভ্র টের পর্যন্ত পায় নি। নিজের কাছের মানুষদের প্রতি শুভ্রের ভালোবাসার অভিব্যক্তি আলাদা। সে পারে না অন্য সবার মতো নিজের ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করতে। ভালোবাসা কি মুখে বলার জিনিস? সেটা তো একটা অনুভুতি। যাকে তুমি ভালোবাসো সে যদি তা অনুভবই না করে তাহলে তোমার সেই ভালোবাসা কি ব্যার্থ নয়?

শুভ্র সিড়ি বেয়ে নীচে এলো। সন্ধার পর থেকে রায়হানের হদিস নেই। ফোন নাকি ধরছে না এই নিয়ে রাবেয়া ফুফুর হইচই শুরু হয়েছে। ছেলেটা তার এমনই, ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ফটোগ্রাফিতে ব্যাস্ত।মাসের পর মাস ছেলের খোজ পায়না। পাহাড় জঙ্গল ঘুরে বেড়ায়। নেটওয়ার্ক থাকে না। ছেলে বিয়ে দেওয়ার পাগলামিটা এই মায়ের ক্ষুদ্র একটা চেষ্টা ছিলো, ছেলেকে মাসে মাসে হয়তো চোখের দেখা দেখতে পারবেন এই আশায়। ছোটো ছেলেটা তার বড্ড আদরের।

শুভ্র চুপ করে আছে। গ্রিকের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার এর পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার সুযোগ পেয়েছে রায়হান। এইটা রায়হানের ক্যারিয়ারের বড় একটা সুযোগ সে নিশ্চয়ই সেসব ছেড়ে মিথ্যে এক খেলায় নামবে না। শুভ্রের সবটা জানা ছিলো। তাই ঠান্ডা মাথায় সবটা হ্যান্ডেল করেছে সে। কিন্তু ফ্লাইট তো দুদিন পর তাহলে রায়হান এখন কোথায়? ফুফুকে কি কিছুই জানায় নি সে?

শুভ্র ফুফুর বিপি চেক করে, আপাদত ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। এই বয়সে তার ফুফুকে কম কষ্ট করতে হয় নি। শেষ বয়সটা মহিলা একাই কাটাচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো কে কাছে পাচ্ছে না। সবাই বিদেশে সেটেল হয়ে গেছে। আর ফুফার বয়স হয়েছে। তিনি তার সূর্যের হাসি ক্লাব নিয়েই ব্যাস্ত থাকার চেস্টা করেন। সকাল সকাল ব্যায়ামে বের হয় সবাইকে নিয়ে। আর ফুফুর চিন্তায় চিন্তায় দিন কাটে। শুভ্র দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। ফুফুকে এইভাবে কষ্ট পেতে দেখে খারাপ লাগছে তার।


সকালে শুভ্র অনেকবার প্রভাকে কল করেছে। সেই যে অ্যামিউজডমেন্ট পার্কের দিন দেখা হয়েছে তারপর না কোনো কল না কোনো ম্যাসেজ। অসুস্থ হয়ে গেলো নাকি। মেডিক্যাল থেকে শুভ্র সোজা প্রভাদের বাসায় এলো। প্রভা খুব নরম মনের মেয়ে। অল্প কিছুতে খুব ভেঙে পরে এই মেয়ে। কি হয়েছে কে জানে?

প্রভা নিজের রুমে ঘুমিয়ে ছিল। কড়া ঘুমের ওষুধ খাচ্ছে সে। তাই এতো বেলা অবধি তার ঘুম হয়। ঘুম থেকে উঠতেই কাজের মেয়ে সুমি এসে বললো শুভ্র ভাইয়া এসেছে। প্রভা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। শুভ্র ড্রয়িং রুমে বসে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো। সামনে চা নাস্তা দেওয়া। প্রভা স্বাভাবিক ভাবেই বেড়িয়ে এলো। এসে শুভ্রের সামনের চেয়ারে বসলো। প্রভার চোখ মুখের অবস্থা ভয়াবহ। শুভ্র চিন্তিত হয়ে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না।

প্রভা হাসার চেষ্টা করলো তারপর বললো,” কি ব্যাপার? তুই হটাৎ আমার বাসায়?”

শুভ্র প্রভার এমন হাল এর আগে দেখেনি। ইমনের সাথে ব্রেকআপের পরো প্রভার এমন অবস্থা হয় নি। শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” কি হয়েছে তোর? এমন হাল করেছিস কেনো?”

প্রভা উত্তরে হাসার চেষ্টা করলো। তারপর বললো,”কিছু হয় নি। এমনেই ভালো লাগছে না। আসলে যেটা আমার না সেটা আকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। ভুলটা বুঝতে পেরেছি তাই নিজেকে সামলে নিচ্ছি।”

” সাহিত্যিক হয়ে গেলি কবে? যাই হোক ফোন ধরিস নি কেনো?”,রেগে বললো শুভ্র।

” আমি না একা থাকতে চাই। ভালো লাগছে না কিছু। তাই একা আছি।”, ক্লান্ত গলায় বললো প্রভা।

” আচ্ছা, তাহলে আমি আসি।”,রেগে উঠে পড়ল শুভ্র। প্রভাকে এমন অবস্থায় দেখে শুভ্র ধারণা করতে পারছে কড়া ঘুমের ওষুধ খাচ্ছে প্রভা। কি হয়েছে সেটাও বলছে না। শুভ্র জানতেও চাইলো না।

প্রভা সাথে সাথে উঠে দাড়িয়ে বললো,” রাগ করলি? এভাবে চলে যাচ্ছিস কেনো?”

” নাহ্, আসি। তুই রেস্ট নে।”,বলেই শুভ্র বেড়িয়ে গেল।

প্রভা এক দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জীবনের বড় ধাক্কাটা সে পেয়েছে। ইমনের থেকে ধোঁকা পাওয়ার পরো এতটা কষ্ট তার হয়নি। শুভ্র সেই সময়ে যেভাবে প্রভার হেল্প করেছে। এরপর শুভ্ররকে ভালো না বেসে থাকতে পারলো না।

সেদিন শুভ্র আর হিয়াকে এতটা কাছাকাছি দেখে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে প্রভা। যে শুভ্রের ধারে কাছে কোনো মেয়ে ঘেঁষতে পারতো না। যখন সেই শুভ্র কোনো মেয়েকে কাছে টেনে নিচ্ছে তার মানেটা অনেক আগেই হয়তো বোঝা উচিত ছিলো। ভুলটা তো তার। শুভ্র ভীষণ রাগী এই যে রাগ করে চলে গেলো। এই রাগ জমে অভিমান হবে। তারপর দুরত্ব বাড়বে।

✨ দিবার আজ ভীষণ মন খারাপ। তাকে এইবার এই বড় বাড়িতে বাবার সাথে থাকতে হবে। দিদি চলে যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে। এই ভয়েই ছিলো সে। হিয়া দিবার মন খারাপের কারণ জানতে চাইলো কিন্তু দিবা বললো না। হিয়া জোর করতেই দিবা কেদে ফেললো। তারপর সবটা বললো।

হিয়া সবটা শুনে চুপ করে রইলো। পরক্ষণেই মনের কোণে একটা প্রশ্ন জাগলো। প্রভা শুভ্রকে নিজের মনের কথা কেনো জানালো না? যদি জানতো তাহলে কি শুভ্র তাকে ছেড়ে দিতো? জীবনের এই গণিত সে মিলাতে পারছে না। সবটা এতো জটিল কেনো?

প্রভা ট্রেনে বসে, জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। এই শহরে সে আর ফিরবে না। শেষবারের মত শুভ্রের সাথে আর দেখা করা হলো না। শুভ্রের সাথে তার আর দেখা হবে না কোনোদিন। এই শহরে থাকলে সে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। একা থাকা প্রয়োজন, সবটা ভুলে যেতে হবে।

গ্রামে গিয়ে সেইখানে একটা ক্লিনিক খুলবে গরীব মানুষগুলোর সেবা করেই সে কাটিয়ে দিবে বাকিটা জীবন। শুভ্রের কন্ঠটা শেষবারের মতন খুব শুনতে ইচ্ছে হলো। কাপাকাপা হাতে প্রভা শুভ্রের নাম্বারে কল করলো। তিনবার রিং হতেই শুভ্র ফোনটা ধরলো। ধরে হেলো বলতেই প্রভা ফোনটা কেটে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র আবার কল ব্যাক করলো। কিন্তু প্রভা তা কেটে দিয়ে সিমটা খুলে ফেললো।

তারপর ট্রেনের জানালা দিয়ে সেটা বাহিরে ফেলে দিলো। অঝোরে কান্না করতে লাগলো সে। শুভ্রকে তো বলাই হলো না সে তাকে কতটা ভালোবাসে। অবশ্য এখন বলার সুযোগটাও সে হারিয়ে ফেলেছে। হয়তো আরো আগে বলা উচিৎ ছিলো। কিন্তু সময় যে তাকে ফেলে অনেকটা পথ পার করে এসেছে।

প্রভার ফোন না ধরায় শুভ্র রেগে ফোনটা একপাশে রেখে দিলো। কিন্তু এই রাগী শুভ্রের তো জানাই হলো না, শান্ত নিশ্চুপ এই মেয়েটি তাকে কতোটা ভালোবেসেছিলো।

শুভ্রের তো এমনটাই পছন্দ যে, ভালোবাসা অনুভবে রবে। তবে কি এটা প্রভার ব্যার্থতা যে সে শুভ্রকে বোঝাতে পারে নি। সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিন্তু অপূর্ণ ভালোবাসার গল্পগুলো আমাদের কারোর জানা হয় না। সেগুলো শুধু অনুভবেই রয়ে যায়।

[ #চলবে