নীলচে তারার আলো পর্ব-২৬+২৭

0
825

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৬

নূপুরটা কয়দিন হলো হিয়া খুজেই পাচ্ছে না। আজ নিজের পুরো রুমটা ওলোট পালোট করে ফেলেছে সে। নূপুরটা তার বাবার দেওয়া। এটা সে হারিয়ে ফেললো কিভাবে? হিয়া ব্যাস্ত হয়ে সব জায়গায় খুঁজছে। আর ম্যারি চারিদিকে লাফাচ্ছে।

শুভ্র বইয়ের জন্যে সবে মাত্র রুমটায় ঢুকেছে। রূমের অবস্থা দেখেই থমকে গেছে। এই অবস্থা কেনো তার লাইব্রেরী রূমের। হিয়া ফ্লোরে শুয়ে বুকশেলফের নিচে নূপুরটা পড়েছে কিনা সেটা দেখতে ব্যাস্ত,হাতে ফোনের টর্চ।

শুভ্র ভ্রূ কুচকে বললো,” ফ্লোরে শুয়ে কি করছো তুমি?”

হটাৎ শুভ্রের আওয়াজ শুনে হিয়া ধড়ফড়িয়ে উঠতে গিয়ে কাঠের সাথে ঠাস করে একটা বাড়ি খেয়ে মাথায় হাত দিয়ে ব্যাথায় নিচেই শুয়ে রইলো। শুভ্রের উপর এইবার রাগ লাগছে। এখনই আসতে হলো এই হনুমানটাকে? মাথাটা মনে হচ্ছে ফেটে গেছে।

ব্যাথা পেয়েছে কোথায় উঠে বসবে তা না মুখ ফুলিয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছে। শুভ্র হিয়ার সামনে এসে বুকের কাছে হাত ভাজ করে দাড়ালো। হিয়া আড় চোখে একবার শুভ্রের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো।
শুভ্র হাত বাড়িয়ে মাথার উপর রাখা হিয়ার হাতটা ধরে ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে মাথাটা ধরে কাছে আনলো। তারপর মাথাটা এপাশ ওপাশ করে দেখলো ঠিক আছে কিনা।

হিয়া মুখ কালো করে শুভ্রের দুই হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,” মাথাটা কি ঘাড় থেকে খুলে নিতে চাচ্ছেন?”

শুভ্র হাত দুটো পকেটে ভরে একবার পুরো রুমটায় নজর দিতেই হিয়ার টনক নড়লো। এইবার তো তার খবর আছে। এই লোকটা তাকে একশো একটা কথা শুনাবে রূমের এই অবস্থার জন্য। শুভ্র কিছু বলার আগেই হিয়া ফট করে বলে উঠলো,” আমি আপনার বুকশেলফের একটা বই ও কিন্তু সরাই নি। একদম আমাকে রাগ দেখাবেন না।”

শুভরে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে রুমটার এই অবস্থায় সে খুবই বিরক্ত। শুভ্র সে সব বাদ দিয়ে বললো,” এতো ব্যাস্ত হয়ে কি খুঁজছো?”

প্রশ্নটা শুনেই হিয়ার মন খারাপ হয়ে গেলো। হিয়া মন খারাপ করে বললো,” আমার নূপুর হারিয়ে ফেলেছি। এক পায়ে আছে অন্য পায়ের টা খুজে পাচ্ছি না।”

শুভ্র জানতো নূপুর হারিয়ে এই বাঁদরটা এমনই করবে। সে ইচ্ছে করেই নূপুরটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এবার সাড়া বাড়ি খুঁজে বেড়াও। হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। দেখে তো মনে হচ্ছে নুপূর হারিয়ে ফেলায় লোকটা খুব খুশি হয়েছে। হিয়া কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,” আমি নুপূর হারিয়ে ফেলায় আপনি খুব খুশি হয়েছেন তাই না? এটাই তো আপনি চেয়েছিলেন। আপনার কারণে আমি নুপূরটা হারিয়েছি। আপনার…আপনার নজর লেগেছে।”

শুভ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,” শাট আপ। জলদি এই রুমটা ঠিক করো। দেখে তো মনে হচ্ছে এই রুমে গরিলা অ্যাটাক করেছে।” বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে চলে এলো শুভ্র। হিয়ার নুপূরটা যেই প্যান্টের পকেটে ছিলো মা কোনো ভাবে সেই প্যান্ট ধোপার কাছে দিয়ে দেয় নি তো? শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে নিজের কাবাড খুললো।

হিয়ার কেনো জানি মনে হচ্ছে নুপূরটা সে শুভ্রের রুমেই হারিয়েছে। তার সব জিনিস তো এই হনুমানের রুমেই হারায়। এই দুষ্টু ম্যারিটা সুযোগ পেলেই হনুমানের ঘরে হানা দেয়। ভেবেই কড়া চোখে ম্যারির দিকে তাকালো। ম্যারির কি? সে তার ছোট্ট লেজটা দেখিয়ে বসে আছে।

হিয়া আস্তে করে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে শুভ্রের রুমে উকি দিলো। শুভ্র নিজের কাবাডে কি করছে এতো মনোযোগ দিয়ে। অনেক খোজার পর শুভ্র সেই প্যান্টটা খুজে পেলো। পকেটে খুঁজতেই নুপূরটাও পেলো। নুপূরটা হাতে নিতেই হিয়া দরজার বাইরে থেকে দেখলো। দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বললো,” এইটা আমার নুপূর।” বলেই ছুটে রূমের ভিতরে চলে এলো।

হিয়ার আওয়াজ কানে আসতেই শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে কাবাডটা বন্ধ করে ফেললো। ততক্ষনে হিয়াও রূমের ভিতরে হাজির। হিয়ার মেজাজ ভালোই গরম হয়েছে। লোকটা তার নূপুর লুকিয়ে রেখেছে কেনো? সমস্যা কি তার।

শুভ্র কড়া গলায় বললো,” তুমি আমার রুমে এসেছো কেনো?”

” আপনি আমার নূপুর নিয়েছেন কেনো?” প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন ছুড়লো হিয়া। শুভ্র এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” হোয়াট ননসেন্স? তোমার নূপুর আমি নিতে যাবো কেনো?”

শুভ্রের এইভাবে এগিয়ে আসতে দেখে হিয়া পিছাতে পিছাতে বললো,” আমি নিজের চোখে দেখেছি আপনার হাতে আমার নূপুরটা ছিলো।”

” তুমি কি চোখে দূরবীণ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াও?”, ভ্রূ কুচকে বললো শুভ্র।

” হ্যা, আমার চোখ দূরবীণ। আপনার মতন চশমা পড়া লাগে না আমার।”,মুখ বাঁকিয়ে বললো হিয়া।

” তোমার মনে হচ্ছে না তুমি বেশি কথা বলছো?”, কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো শুভ্র।

” আমি জানি না। আমার নুপূর আমাকে ফেরত দিন।”, কথাটা শেষ না করতেই হিয়া পিছনের বিছানায় পরে যেতে নিলে শুভ্রের শার্টের কলার চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিলো। পরক্ষণেই দেখলো শুভ্র হিয়ার দুই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে হিয়া যে শুভ্রের শার্ট চেপে ধরেছে সেটা বুঝতেই পারে নি। শুভ্রের চোখে চোখ পড়তেই হিয়ার বুকের ভিতরটায় ড্রাম বাজাতে লাগলো। হিয়া চোখ বন্ধ করে শার্টের কলার ছেড়ে দিতেই সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে বিছানায় পড়ে গেলো। পড়েই হিয়া চোখ বন্ধ করে রাখলো। তারপর চোখ খুলতেই দেখলো শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

কেমন জামাই এইটা? আবার বলে আমি তোমার হাসব্যান্ড মনে রাখবে। পড়ে গেছি একে তো ধরলো না এখন আবার তাকিয়ে আছে হাত টা বাড়িয়ে দিবে তা না। হিয়া রেগে বললো,” আপনি আমাকে ধরলেন না কেনো?”

শুভ্র হিয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলাতেই হিয়া চটপট উঠে পড়লো। অসভ্য একটা লোক। হিয়া রাগে ফুলতে ফুলতে বললো,” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? আমার নুপূরটা আমাকে ফেরত দিন।”

” তোমার নুপুর আমি কেনো আমার কাছে রাখবো? আর ইউ ম্যাড?”, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললো শুভ্র।

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো তারপর বললো,” তবে যে আমি আপনার হাতে নুপুর দেখলাম?”

” ভুল দেখেছো।”, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো শুভ্র। হিয়া এইবার সত্যি কনফিউজড হয়ে গেছে। তাহলে কি সে ভুল দেখেছে? নূপুর দেখলো তো সে। ধুর বাবা! কি একটা অবস্থা।

হিয়া আড় চোখে একবার তাকিয়ে বললো,” আমি আপনার কাবাডটা একবার খুলে দেখি।” সহজ মনে প্রশ্ন করতেই শুভ্রের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নজরে পড়লো। হিয়া ফট করে উঠে পড়ল তারপর ঘাবড়ে গিয়ে বললো,” থাক। থাক, চলে যাচ্ছি এইভাবে তাকাতে হবে না। তবে আমি নুপুর দেখেছি আপনার হাতে আর আমি সিউর ঐটা আমার নূপুর। আমি তো ঐটা নিয়েই ছাড়বো।”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে কি বলেছে সে নূপুর তাকে কোনোদিন দিবে না। সবকিছুতেই ঝগড়া করতে হবে এই মেয়ের।

✨ দুপুরের পর রায়হানের হটাৎ এমন আগমন সবাইকে অবাক করলো। সবচেয়ে বেশি অবাক করলো শুভ্রকে। আজকে তো রায়হানের ফ্লাইট ছিলো কিন্তু সে এইখানে কেনো? রায়হান প্রথমে এসেই এই বিয়েটা ভেঙে দিলো। তখন থেকে তার মায়ের সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। হিয়া এইসব থেকে দূরে সরে আছে।

রায়হানকে দেখে সে নিজের রূমে চলে এসেছে। নিচে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার কোনো ধারণা নেই। কেনো জানি অকারনেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার। ম্যারিকে কোলে করে বসে আছে সে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হিয়ার দরজায় নক পড়লো। হিয়া চমকে তাকালো। রায়হান দাড়িয়ে আছে মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি। হিয়া একটা ঢোক গিললো। রায়হান এগিয়ে এসে বললো,” ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিয়েটা ভেঙে গেছে। আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে না।”

হিয়া কি করবে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। হিয়া ম্যারিকে কোলে করে উঠে দাড়ালো। তারপর চুপ করে রইলো। রায়হান হাসলো, তারপর বললো,” আমি কিন্তু তোমার থেকে একটা জিনিস ফেরত নিতে এসেছি।”

হিয়া একটা ঢোক গিললো। কাপা কাপা কণ্ঠে বললো,” মানে?”

রায়হানের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,” আমার নিজেকে বড্ড একা লাগছে। কাউকে খুব প্রয়োজন।”, এতটুকু শুনেই হিয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে।

রায়হান থেমে বললো,” তোমাকে তো আমি আর চাইতে পারবো না। ম্যারিকে নিতে এসেছি।”
বলেই ম্যারির দিকে ঈশারা করতেই ম্যারি হিয়ার কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো। হিয়া ম্যারিকে আটকানোর সুযোগও পেলো না। হিয়া ছল ছল চোখে বললো,” আমি কি ওকে রাখতে পারবো না?”

রায়হান মায়ার চোখে তাকালো। তারপর বললো,” অ্যাম সরি , ভালো থেকো।” বলেই রায়হান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো সে। একটু এগিয়ে যেতেই সামনে শুভ্রের মুখোমুখি হলো। শুভ্রকে দেখে থেমে গিয়ে বললো,” কেমন আছিস?”

শুভ্র সেই প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে বললো,” তুই ফ্লাইট ছেরে কি করছিস এইখানে?”

” ফ্লাইট? ছেড়ে দিতাম। যদি হিয়া তোকে ছেড়ে দিতো।”, ব্যাথিত সুরে হাসি মুখে কথাটা বললো রায়হান। তারপর আরো বললো,” আজ রাতেই ফ্লাইট।”

“ফুফু জানে?”, গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো শুভ্র।

” নাহ্, মাকে জানাই নি। পৌঁছে কল করবো।”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ম্যারির দিকে তাকালো। তারপর বললো,” ওকে নিয়ে যাচ্ছিস?”

” হ্যা, কেনো রেখে যাবো? তাহলে তুই ওকে রেখে দে। আমি হিয়াকে নিয়ে যাই। রাজি তুই?”,বলেই হাসতে লাগলো রায়হান। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। রায়হান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” ভালো থাকিস।”,বলেই শুভ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। তারপর শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

রাতে হিয়া কিছু খেলো না। কিছুক্ষণ পর পর শুধু কাদঁছে। ম্যারির জন্যে খারাপ লাগছে তার। কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। অনেক জোর করেও কেউ কিছু খাওয়াতে পারেনি তাকে।

সকালে ঘুম ভেঙে এমন এক চমক দেখতে পাবে হিয়া ভাবতেও পারে নি। তার ঘরে ছোট্ট এক কুকুরছানা। একদম সাদা পমেরিয়ান। এমন কুকুর নিয়ে সে অনেক পড়েছে, খুব আগ্রহ ছিলো তার এই কুকুর নিয়ে। হিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ঘুম থেকে উঠে এমন কিছু সে আশা করেনি। হিয়া লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। এটা কোথা থেকে এলো। কুকুরছানা কে কোলে নিতেই আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো তার। অন্য পায়ে নুপুর এলো কোথা থেকে তার? তাহলে কি শুভ্র রাতে তার রুমে এসেছিল?

[ #চলবে ]

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৭

হিয়া কুকুর ছানার নাম দিয়েছে ইউভি। ম্যারির জন্যে এখনো খারাপ লাগছে তার। ম্যারিকে চাইলেও ভুলতে পারবে না সে। ইউভি এতটাই ছোটো তাকে একটা পকেটে ভরে রাখা যাবে। এই পামেরিয়ান কুকুরগুলো এমন হয়। হিয়ার ভাবতেই অবাক লাগছে এইটা শুভ্র তার জন্যে এনেছে। তারমানে রাতে শুভ্র তার রুমে এসেছে আর পায়ে নূপুরটাও পরিয়ে দিয়েছে। ভাবতেই এক রাশ ভালোলাগা তাকে ঘিরে ধরেছে। এই গোমড়ামুখো ডাক্তারটা মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করে যে হিয়া পারে না প্রেমেই পরে যায়। হিয়া এইবার বুঝতে পেরেছে শুভ্র তার জন্যে কতটা ভাবে।

শুভ্রের তার প্রতি ছোটো ছোট এই খেয়াল গুলো বড্ড ভালোবাসে হিয়া। লোকটা সবসময় এমন থাকতে পারে না। খালি সবসময় প্রিন্সিপাল সেজে বসে থাকা। শুভ্রকে খুব জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। হিয়া ইউভিকে কোলে তুলে নিলো। তারপর শুভ্রের ঘরের সামনে এলো। দরজাটা হাল্কা ঠেলে দিতেই দেখলো শুভ্র তোয়ালে দিয়ে মাথার পানি নিচ্ছে। গায়ে শুধু একটা ট্রাউজার। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়ালো। উফ লোকটা এমন অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায় কেনো? তাও ভালো প্রথমবারের মতন তোয়ালে পড়ে নেই। এমনেই এমন সুন্দর তার উপর বডি দেখিয়ে বেড়ায়। দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেলো ভালো হয়।

কি হবে? বলেছে না হাসব্যান্ড মনে রাখতে। হাসব্যান্ড এর ঘরে তো আর নক করে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

হিয়া বেশ সাহস দেখিয়ে শুভ্রের ঘরে ঢুকলো। শুভ্র সবে সাদা একটা শার্ট গায়ে পড়েছে, বোতাম সব খোলা। হটাৎ সকাল সকাল হিয়ার এমন আগমনের কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না। হিয়া ঘরে ঢুকেই প্রথমে বললো,” শার্টের বোতাম সব খুলে রেখেছেন কেনো?”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,” কি চাই তোমার?”

” আমার আপনার সাথে কথা আছে।”, আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো হিয়া।

শুভ্র বিস্ময় নিয়ে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সকাল সকাল তার ঘরে হানা দিয়ে কি করতে চাইছে হিয়া। শুভ্র কোমরে হাত দিয়ে বললো,” যা বলার জলদি শেষ করো।”

হিয়া আবারো আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। ঠিক মতন তাকানো যাচ্ছে না বার বার খোলা শার্টের দিকে চোখ যাচ্ছে। এইভাবে সে কথা গুলো বলবে কিভাবে ? কিছুক্ষণ যেতেই শুভ্র শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,” তোমাকে কি আমি সাড়া দিন সময় দিয়েছি? এইভাবে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”

হিয়া শুভ্রের দিকে তাকিয়ে সস্থির নিশ্বাস ফেললো। তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে বললো,” আপনি কাল রাতে আমার ঘরে গেছিলেন কেনো?”

শুভ্র ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো হিয়ার দিকে। এই বাঁদরটা টের পেলো কি করে? শুভ্র সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তোমার ঘরে গিয়েছিলাম মানে?”

” আপনি আমার ঘরে গিয়েছেন। আর আমি সিউর এই কুকুর ছানাও আপনি রেখেছেন আমার ঘরে।”, বলেই ইউভিকে বের করলো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ইউভির দিকে তাকালো তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,” মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”

” নাহ্ আমার মাথা মোটেও খারাপ হয়নি। আচ্ছা আপনি বলুন। আমার পায়ে আপনি নূপুর পড়াননি? নূপুরটা তো আপনার হাতেই দেখেছিলাম আমি।”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো হিয়া।

শুভ্র ভেবে পাচ্ছে না হটাৎ হিয়ার এতো সাহস এলো কোথা থেকে। আগে তো কথা বলতে গেলেই কাপতে লাগলো। শুভ্র প্রসঙ্গ ঘুরাতে বললো,” তুমি মেবি ভুলে গেছো আমি কে?”

হিয়া পায়ের পাতায় ভর দিয়ে একটু উচু হয়ে শুভ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,” নাহ্ ভুলিনি। শুভ্রনীল আহমেদ, আমার বর। আমার এই উপহার অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি ওর একটা নামও দিয়েছি ইউভি। সুন্দর না নামটা।”,বলেই লজ্জা পেয়ে হাসলো।

কথাটা শুনে শুভ্রের ঠোঁটের কোণেও হাসি চলে এলো তবে শুভ্র সেটা প্রকাশ না করে বললো,” তোমার সব ভয় উড়ে গেছে, তাই না?”

হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে নিজের হাসি কন্ট্রোল করলো। হিয়া প্রশ্নটা না শুনার ভান করেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বদমাইস ডাক্তার একটা। শুভ্র ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। বাঁদরটা অনেক চালাক।

✨ ইউভি সারা বাড়ি তার ছোট ছোট পা ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই ভীষন অবাক। এই কুকুরছানা এলো কোথা থেকে। শুভ্র চুপচাপ ডায়নিং টেবিলে বসে জুস হাতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইউভি শুভ্রের পায়ের কাছে বসে এক দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র সেটা খেয়াল করলো, এটাও দেখি এক দিনে মালিকের মতন হয়ে গেছে।

হিয়া নিচে নামতেই ইউভি হিয়ার কাছে চলে গেলো। হিয়া রান্না ঘরে আসতেই, ইউভি লেজ নাড়তে নাড়তে তার পিছু পিছু এলো। সাহারা খাতুন ভ্রু কুঁচকে ইউভির দিকে তাকিয়ে আছে। এইটা আবার কোথা থেকে এলো?

সাহারা খাতুন হিয়াকে প্রশ্ন করেই ফেললেন,” এইটা পেলে কোথায়?”

হিয়া একবার চোখ পিট পিট করে তাকালো। শাশুড়ির কি পছন্দ হয়নি। না হলেও ভয় নেই, ইউভিকে তো তার ছেলেই এনেছে। বকা এই লোকটাই খাবে। হিয়া একটা ঢোক গিলে শুভ্রের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,” উনি।” এতটুকু বলেই হিয়া থামলো। সাহারা খাতুন অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।

শুভ্র সেই মুহুর্তে কিচেনে তাকাতেই দেখলো হিয়া তার দিকে আঙুল করে দেখিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রের বুঝতে বাকি রইলো না হিয়া তার দিকে আঙুল দেখিয়ে ঠিক কি বলতে চাইছে। রবিউল সাহেব পত্রিকা হাতে শুভ্রের বরাবর টেবিলে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর পত্রিকা সরিয়ে ইউভির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন।

হিয়া নাস্তা নিয়ে টেবিল পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই রবীউল সাহেব হিয়াকে ডাকলেন। হিয়া থমকে দাড়িয়ে পিছনে ফিরলো। রবীউল সাহেব তার বউয়ের মতন একই প্রস্ন করলেন। উত্তরে হিয়া আবারো শুভ্রের দিকে আঙুল করতেই শুভ্র আড় চোখে তাকালো। সারা বাড়ি বলে বেড়াচ্ছে এই মেয়েটা। শুভ্র সরু চোখে তাকাতেই হিয়া ফিক করে হেসে ফেললো। বলেই উপরে চলে গেলো।

রবিউল সাহেব পত্রিকা সরিয়ে শুভ্রের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। বাহ্ ছেলে তো তার ভালোই লাইনে এসেছে। রবিউল সাহেবের এমন দৃষ্টিতে, শুভ্র বেশ অপ্রস্তুত হয়ে জুসটা রেখেই উঠে পড়লো। সে কি চুরি করেছে? এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো সবাই।

হিয়া সিড়িতে দাড়িয়ে সবটা দেখলো। আহ্ লোকটাকে জ্বালাতে কি যে মজা লাগছে। বেচারা কিছু বলতে পারছে না। শুভ্র নিজের মনের কথা না বললেও হিয়া ঠিকই বুঝে নিয়েছে। কিন্তু এই বদমেজাজি লোকটা কখনো কি মুখে বলবে না?

✨ শুভ্র প্রতিদিন এই সময়ে বাড়িতে আসে কিন্তু আজ এতো দেরি কেনো? হিয়া দোতলার করিডোরে পায়চারি করছে। সঙ্গে ইউভিও আছে, সে বেচারিও পায়চারি করছে হিয়ার সাথে সাথে। ইউভির উপর মায়া লাগলো হিয়ার। এমনিতেই ছোট্ট একটা বলের মতন তার উপর হিয়ার পিছু পিছু পায়চারি করছে। হিয়া হাঁটু ভাজ করে ইউভিকে কোলে তুলে নিলো। হাপিয়ে গেছে বেচারি।

হিয়া হাঁটতে হাঁটতে শুভ্রের রুমে এলো। কেনো জানি সে অকারনেই এখন শুভ্রের রুমে আসে। শুভ্রের রূমের একপাশে কিছু শোপিস আছে। দেখতে বড়ই অদ্ভূত। কাঁচের একটা পুতুলের দিকে হিয়ার নজর আটকে গেলো। সাদা এপ্রন পড়া একজন ডাক্তার, একটু কাছে এনেই দেখলো নিচে খুব সুন্দর করে ইংরেজি শব্দে লেখা ডাক্তার শুভ্রনীল আহমেদ। রহিমা খালা রুমে এলো সব শুভ্রের রূমের সব জানালা সন্ধার পর বন্ধ করার নিয়ম তাই। এসে হিয়ার হাতে পুতুলটা দেখে বললো,” এইটা কিন্তু দাদাবাবুর অনেক পছন্দের।” বলেই জানালা সব আটকে বেড়িয়ে গেলেন।

হিয়া খুব সাবধানে পুতুলটা আগের জায়গায় রাখতে গেলো। কিন্তু ইউভি হটাৎ কেমন ছটফট করে লাফিয়ে নেমে পড়তেই হিয়ার হাত থেকে পুতুলটা পরে গেলো।
মুহূর্তেই চুর্ন বিচূর্ণ হয়ে গেলো পুতুলটা। হিয়া থমকে দাড়িয়ে আছে। কি হলো এইটা! হৃদ স্পন্দন মুহূর্তেই দ্বিগুণ হয়ে গেলো। এটা তো শুভ্রের অনেক পছন্দের, কি হবে এইবার? শুভ্রের নেম প্লেটটা ছাড়া আর কিছুই নেই। হিয়ার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। শুভ্রের পছন্দের পুতুলটা সে ভেঙে ফেললো। হিয়া সামনে এগিয়ে এসে নেমপ্লেটটা হাতে নিতেই কাচের একটা টুকরা হিয়ার হাতে বিধলো। সেদিকে হিয়ার খেয়াল নেই। ইউভি ভয়ে এক পাশে চুপ করে বসে আছে।

শুভ্র ঘরে এসে দেখলো হিয়ার হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো। এগিয়ে আসতেই দেখলো চারিপাশে কাচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে খাটে বসালো। শুভ্রকে দেখে হিয়া কেদেই ফেললো। সে কান্না আর থামছে না। শুভ্র হিয়ার হাত থেকে নেমপ্লেট টা নিয়ে ফেলে দিতেই দেখলো হাতে ভালোই ক্ষত হয়েছে। শুভ্র ভীষণ রেগে গিয়ে বললো,” আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? কাচের টুকরো হাতে নিয়ে বসে আছো কেনো?”

শুভ্রের ধমকে হিয়া চুপ করে রইলো। চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছে। শুভ্র নিজের এপ্রনটা একপাশে রেখে শার্টের হাতা ভাজ করে ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে হিয়ার সামনে বসে হাতটা ভালো করে দেখলো। শুভ্রের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। রুমটার দিকে তাকিয়ে রহিমা খালাকে ডেকে রুমটা পরিষ্কার করতে বললেন। রূমে হাঁটতে গেলেই এখন কাচের টুকরো বিধবে। হিয়া নিশ্চুপে কেঁদেই যাচ্ছে, শুভ্রের ধারণা হিয়া হয়তো ব্যথায় কাদঁছে। শুভ্র অনেকটা সময় নিয়ে হাতের ব্যান্ডেজটা করলো। ব্যান্ডেজ শেষ হতে হতে রুমটাও খালা পরিষ্কার করে ফেলেছে। শুভ্র ফাস্ট এইড বক্স রেখে এসে দেখলো হিয়া এখনো কাদছে।

শুভ্র চিন্তিত হয়ে হিয়ার পাশে এসে বসলো। হিয়ার দুই গাল স্পর্শ করে মুখটা উপরে তুলতেই দেখলো। হিয়া কেদে কেঁদে গঙ্গা যমুনা এক করেছে। শুভ্র খুব কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,” হাতে কি বেশি ব্যাথা করছে ?” হিয়া না সূচক মাথা নাড়তে। শুভ্র একটু ভ্রু কুচকে শান্ত গলায় বললো,” তাহলে তুমি কাদঁছো কেনো স্টুপিড?”

” আমি ওই পুতুলটা ভেঙে ফেলেছি।”, বলেই ফুপিয়ে উঠলো হিয়া।

পুতুলটা শুভ্রের পছন্দের ছিলো ঠিকই কিন্তু এতটা না যে তার মূল্য হিয়ার চোখের জলে ফেলতে হবে। শুভ্র একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো।

” আমার হাত থেকে পড়েগেছে। সরি……”, আর বলার আগেই শুভ্র হিয়ার ঠোঁটের সামনে আঙ্গুল ধরে বললো,” একদম চুপ। আর কাদবে না তুমি।”

[ #চলবে]