#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩৪
হিয়া নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে থেকে ধরা গলায় বললো,” জানি না।”, বলেই কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থেকে আবার বললো,” ওই মেয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরলে আমার ভালো লাগে না।”, শুভ্র খেয়াল করলো হিয়ার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা মুক্ত তার গাল বেয়ে গড়িয়ে শাড়ী ভিজিয়ে দিচ্ছে। নিজের অনুভূতির এমন বহিঃপ্রকাশে রাগ, ক্ষোভ আর লজ্জায় চোখ ভিজে এসেছে তার। হিয়া পরক্ষনেই চোখের জল মুছে ফেললো। নিজের দুর্বলতা সে কেনো দেখাবে?
শুভ্র হিয়ার কাছে এসে হিয়ার গাল স্পর্শ করার আগেই হিয়া শুভ্রের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,” একদম আমাকে ধরবেন না। আপনি যান, নিচে গিয়ে আপনার ঐ বন্ধুবিকে জড়িয়ে ধরুন। সেও আপনাকে জড়িয়ে ধরুক।”, বলেই রাগী চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো।
শুভ্রের প্রতি হিয়ার এই অভিমানটা তার ভালো লাগছে। কিছু কিছু অভিমান ভাঙাতে ভালোই লাগে। হিয়াকে আপাদত কিছুক্ষণ জ্বালাতে ইচ্ছে করছে তার। শুভ্র নিচের ঠোঁট কামড়ে আরেকটু এগিয়ে এসে হিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখে হাসলো। হিয়ার রাগ আরো বেড়ে গেলো, সকালের রাগ তো জমে ছিলোই এখন আবার লোকটা মজা নিচ্ছে।
” আপনার খুব মজা লাগছে তাই না?”, রাগে ফুলতে ফুলতে বললো হিয়া। শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার কপালের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,” নাহ্, একদমই না।” বলেই ঠোঁট চেপে ধরলো কারণ শুভ্রের হাসি পাচ্ছে। শুভ্র রিমিকে নিজের ছোট বোনের মত দেখে। ছোটবেলায় রিমির জন্মের সময় রিমির মা মারা যায় তখন থেকে রিমির বুঝ হওয়ার আগ পর্যন্ত সাহারা খাতুনই রিমিকে বড় করেন। কিন্তু শুভ্রের সাথে রিমির এই সম্পর্টাকে হিয়া ভুল বুঝে বসে আছে। ব্যাপারটা যে খুব খারাপ হয়েছে তা না, রাগটা ভালোই লাগছে তার। তার প্রতি মেয়েটা প্রটেক্টিভ হয়ে উঠেছে।
শুভ্রের এমন খাপছাড়া ভাব দেখে হিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” আপনার খুব হাসি পাচ্ছে, তাই না? ঠিক আছে হাসুন। নিচে গিয়ে হাসুন। ওই মেয়ের সামনে গিয়ে হাসুন।”
শুভ্র বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে বললো,” উহু, নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না এখন।”
লোকটার তাকে নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কি সুন্দর নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়েছে। আর সে এইদিকে কেদে কেটে ভাসিয়ে দিয়েছে এই লোকটার জন্যে। নিলজ্জের মতন বলেও দিয়েছে নিজের কথা। আর ইনি হাসছেন। ইচ্ছে করছে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেয়।
হিয়া রেগে বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,” ঠিক আছে আপনি থাকুন। আমিই যাচ্ছি, আপনার সাথে আমি থাকবো না।” বলে চলে যেতে নিলো। শুভ্র হিয়ার হাত ধরে টান দিতেই হিয়া শুভ্রের বুকের উপর এসে পড়লো। হটাৎ শুভ্রের এমন কাজে হিয়া চমকে তাকালো কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।
শুভ্র এক হাত হিয়ার কোমড়ের পাশে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,” আমি একা একা কি করবো? আমার তো তোমাকে লাগবে।”
” আমাকে লাগবে মানে?এতক্ষণ একা একা বাইরে ছিলেন না। তখন তো আমাকে প্রয়োজন হয় নি। এখন আমাকে লাগবে কেনো?”, শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। মেয়েটার ভালোই রাগ হয়েছে। হিয়া সরে যাওয়ার জন্যে হাত ছোড়াছুড়ি করতেই শুভ্র হিয়াকে বিছানার সাথে মিশিয়ে দুই হাত চেপে ধরলো। হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। শুভ্রের নিশ্বাস হিয়ার গলায় আছড়ে পড়ছে।
এতক্ষণ শুভ্র যে তার এতো কাছে ছিলো হিয়া ঠিক সেটা খেয়াল করেনি। কিন্তু এখন তার প্রতিটা ইন্দ্রিয় সে ব্যাপারে সজাগ। হৃদ কম্পন যেনো ধীরে ধীরে বাড়ছে। শুভ্র তাকিয়ে আছে শীতল দৃষ্টিতে। তারপর হিয়ার একদম কাছে চলে আসতেই হিয়ার নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। শুভ্র হিয়ার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,” আমার তোমাকে কেনো লাগবে বুঝো না।” কথাটা কর্নগোচর হতেই চোখ বড় বড় করে তাকালো হিয়া। শুভ্রের তপ্ত নিশ্বাসে তার সাড়া শরীর বারে বারে শিউরে উঠছে।
হিয়া কিছু বলার আগেই শুভ্র হিয়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। হিয়া চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে শুভ্রের শার্টের অংশ খামচে ধরলো। হটাৎ শুভ্রের এতটা কাছে চলে আসায় সব রাগ গলে যেনো রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তবে অভিমানটা মনের কোণে জমে আছে।
শুভ্র হিয়ার গলা থেকে মুখ সরিয়ে এনে হিয়ার রক্তিম চেহারার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। হিয়া কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে চোখ খুলে শুভ্রের শীতল দৃষ্টির মুখোমুখি হতেই নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। শুভ্রের দিকে তাকিয়ে এই হাসি দেখবার সাহস তার নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। লোকটা কি করতে চাইছে? এইভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?
শুভ্র হিয়ার আরো কাছে এগিয়ে আসছে সেটা শুভ্রের দিকে না তাকিয়েও হিয়া বুঝতে পারছে। হিয়া চাদরটা শক্ত করে ধরে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো।
শুভ্র হিয়ার এক হাত ছেড়ে দিয়ে মুখের সামনের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,” তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, তোমার রাগ এখনো কমেনি।তোমার রাগ কমানোর একটা উপায় আমার কাছে।” বলেই আরেকটু কাছে আসতেই হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” মানে? কিসের উপায়।” হিয়ার মনে সন্দেহ হতেই হিয়া বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো।
” কিস মি। ইউ উইল ফীল ব্যাটার।”, ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি দিয়ে বললো শুভ্র। কথাটা কর্নগোচর হতেই হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” আপনি আপনার মত নিলজ্জ নই। সরুন।” বলেই শুভ্রকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়লো। শুভ্র চাইলে আটকে রাখতে পারতো কিন্তু হিয়া কি করে সেটাই সে দেখতে চায়।
হিয়া শাড়িটা ঠিক করতেই দেখলো শুভ্র তার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো। কখন আবার এই লোকের মাথায় কি আসে! বলে কিনা তাকে কিস করতে। সে কি তার মতন বেহায়া নাকি। কিস করলে রাগ কমে এইটা আবার কেমন সাইন্স।
লোকটা প্রসঙ্গটাই ঘুরিয়ে নিয়ে, হুট করে একদম কাছে চলে এলো। যতবার মনে পড়ছে, গা শিউরে উঠছে তার। অসভ্য একটা লোক। তার যা বলার ছিল সবটাই গুলিয়ে ফেলেছে শুভ্রের এমন আচরণে। গাল দুটো দিয়ে তাপ বের হচ্ছে।
হিয়া নিচে নেমে একপাশে দাড়িয়ে আছে। বড়রা বসে আছে বাঁশের তৈরি বেঞ্চে। ছোটরা সবাই গোল হয়ে বসেছে নিচে। বাড়ির এই উঠানটায় আলো জ্বালিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে।
আরমান, শুভ্রের এক কাজিন গিটার হাতে গান গেয়ে যাচ্ছে। গানটা যেনো পুরো পরিবেশটা রোমাঞ্চে ভরিয়ে দিয়েছে। হিয়া একপাশে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গানটা অনুভব করছে। শুভ্র আস্তে করে সিড়ি বেয়ে নামছে। হিয়াকে দেখে থেমে দাড়ালো,
বকুলের মালা শুকাবে
রেখে দেবো তারই সুরভী।
দিন গিয়ে রাতে লুকাবে
মুছো নাকো আমারই ছবি।
আমি মিনতি করে গেলাম
শুভ্র নিশব্দে পা ফেলে হিয়ার কাছে এগিয়ে এসে হিয়ার কানের কাছে ঠোঁট এনে বললো,” সরি। ” শুভ্রের কণ্ঠে হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। শুভ্র তাকে সরি বলছে? হিয়ার মুখ হা হয়ে গেলো। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার গালে কিস করতেই হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। লোকটা সবার সামনে কি করছে। হিয়ার অবিশ্বাস্য লাগছে। গানের সুরে সুর মিলিয়ে শুভ্র ঠোটে হাসি রেখে দুই লাইন হিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে গাইলো,
তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কি বা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম।
হিয়া বিমোহিত হয়ে শুনছে। এই রাগী ডাক্তার গান গাইতেও জানে? তাও আবার এতো সুন্দর! শুভ্র আস্তে আস্তে পা ফেলে সবার মাঝে গিয়ে বসলো আর গানটায় আয়মানের সাথে গলা মেলাতেই চারদিকটা যেনো অসম্ভব এক ভালোলাগায় ভরে গেলো। শুভ্রের প্রতি মুগ্ধতা আরো বেড়ে গেলো তার। লোকটা এতো সুন্দর গাইতে পারে। বাতাসে যেনো সত্যি আজ বকুলের সুগন্ধ পাচ্ছে সে। মুগ্ধ যে আজ একা হিয়া হয়েছে তা না। উপস্থিত সবাই শুভ্রের এইভাবে গান গাওযায় মনোমুগ্ধ। সেই যখন কলেজে থাকতো তখন গাইতো। শুভ্রের মা হটাৎ শুভ্রের এই গান গাওয়ার কারণটা ধরে ফেললেন হিয়াকে একপাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। তার ঠোঁটেও হাসি চলে এলো।
হিয়া একরাশ ভালোলাগা নিয়ে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছুদূরে রিমিকে দেখেই হিয়ার মুখের হাসি চলে গেলো। হিয়া এগিয়ে এসে শুভ্রের পাশে বসে পড়লো। মেয়েটাকে সে শুভ্রের আশেপাশেও আসতে দিবে। এই বদমাইস ডাক্তারের প্রতি এখন তার অধিকারবোধ আরো বেড়ে গেছে। গানের শেষের দিকে ছোট, বড়, বুড়ো সবাই কণ্ঠ মিলিয়ে গাইলেও শুভ্র শেষের দুই লাইন হিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে গাইলো। যেনো এই দুই লাইন শুভ্র শুধু হিয়ার জন্যেই গাইছে।
এই মন তোমাকে দিলাম,
এই প্রেম তোমাকে দিলাম।
হিয়ার মুগ্ধতা আরো বাড়লো। শুভ্র গানের শেষে হিয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিলো। ঠোঁটের কোণে হালকা একটু হাসির ঝিলিক। হিয়ার বুকের ভিতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। অন্যরকম এক আনন্দে চোখ মুখ জল জল করছে হিয়ার। শুভ্র কি তার মনের কথাগুলো গানের লাইনে অভিব্যাক্ত করলো। হিয়া ঠোঁট কামড়ে নিজের অনুভূতিগুলো সকলের আড়াল করতে চাইছে। শুভ্রের এই কাজগুলোর জন্যেই এই চশমা পড়া ছেলেটার প্রতি সে এতো দুর্বল, সব কিছুর মূল্যেই হিয়া এই শুভ্রনীল আহমেদকেই চায়।
[ #চলবে ]
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩৫
হিয়ার ঘুম ভাঙতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে হিয়া হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ল। সে ঘরে এলো কখন? কাল রাতে তো সে গানের আসরে সবার সাথে ছিলো। তারপর যদিও হালকা ঘুম ঘুম পেয়েছিল তার। তাহলে কি ঘুমের মাঝে হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছে সে? নাহ্ এটা আবার কি করে সম্ভব।
হিয়ার নিজের মাথার চুল শক্ত করে টেনে ধরলো। সে এই ঘরে এলো কি করে? শুভ্র তাকে এনেছে? শুভ্র কোথায়? নাহ্, তাহলে আশে পাশে তো শুভ্র থাকতো। কোথাও তো নেই? হিয়ার অস্থিরতা বাড়লো। দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেলো। সাড়ে নয়টা বাজে..! হায় আল্লাহ! এতক্ষণ সে ঘুমিয়েছিল।
হিয়া গায়ের উপর থেকে চাদরটা সরাতেই দেখলো শাড়ির আঁচলটা জায়গায় নেই, সরে আছে একপাশে। হিয়ার বুকের ভিতরটা ধুক করে উঠলো। সে কি সারারাত এইভাবে ছিলো? শুভ্র কি তাকে এইভাবে….. ছি! ছি! কাল রাতে এসে তো সেফটিপিন গুলো খুলে রেখেছিল সে, নাহলে আজ এমন দিনের মুখোমুখি হতে হতো না।
হিয়া আঁচলটা ঠিক করে, বিছানা থেকে নেমে পড়লো। তারপর চট জলদি ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই খাবারের গন্ধে তার খিদে পেয়ে গেলো। মনে হচ্ছে ঘি ভাজা পরোটা বানাচ্ছে। কিন্তু খাওয়ার কথা পরক্ষনেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো কারণ যতক্ষণ না সে জানতে পারছে সে ঘরে গেলো কিভাবে ততক্ষন পর্যন্ত কোনো খাবারই তার হজম হবে না। হিয়া কিচেন ঘরে ঢুকতেই মোহনাকে দেখলো। সেখানে রিমি, নিধি আরো অনেকেই ছিলো। তারা সবাই কিছু একটার ফর্দ বানাচ্ছে মনে হলো।
হিয়া এগিয়ে আসতেই রিমি হেসে বললো,” রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তো?” এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই মূচকি হাসলেও মোহনা কড়া চোখে তাকালো। হিয়া হতবুদ্ধির মতো হা সূচক মাথা নাড়লো। কারণ রিমির প্রশ্নে তার মনে হয়েছে এরাই হয়তো তাকে রুমে রেখে এসেছে। এমনিতেও সে কুম্ভকর্ণের মতন ঘুমায় তার জন্যেই হয়তো এরা হাসছে। এর মাঝে আরেকজন বললো,” হুম সেটা তো আমরা কাল রাতেই বুঝেছি।”
হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। মানে? কাল রাতে কি বুঝে ফেলেছে…! এটাও কি কোনো রসিকতা ছিলো নাকি? হিয়া প্রসঙ্গ বদলে বললো,” তোমরা কি করছো? ”
মোহনা হেসে উঠে বললো,” আজ দুপুরের বাড়ির সব ছেলেরা মিলে রান্না করবে আমাদের জন্যে। বেড়াতে এসে প্রতি বেলা আমরা কেনো খেটে মরবো?” কথা শেষে নিধিকে ফর্দটা দিলো। নিধি ফর্দটা হাতে নিয়ে চোখ মেরে বললো,” সবাইকে আজ কাদিয়ে ছারবো, বুঝলে।”
মোহনা উঠে দাড়িয়ে বললো,” হিয়া আমার সাথে আয়। আর এইযে বাচ্চা পার্টি আমার পারমিশন ছাড়া যদি কোনো পাকনামি করেছো তো খবর আছে।”
মোহনা হিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে আসতে আসতে বললো,” তোমাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে?”
হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। হটাৎ এমন প্রশ্নের উত্তরে কি বলা যায়। সেটা নিয়েই সে ইতস্তত বোধ করলো। হিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে মোহনা হেসে উঠে বললো,” কালকে দেখে তো মনে হলো সব ঠিকই আছে। ঘুম ভাঙ্গবে দেখে কোলে করে রুমে নিয়ে গেলো। বাহ্ আমার ভাই দেখি তোমার ভালোই খেয়াল রাখছে।”
হিয়া চুপ করে আছে। মনে মনে ভালো লাগছে কিন্তু রুমে নিয়ে গেলো মানে কি? মেয়েগুলো কি তাহলে এই কারণে হাসছিলো? শুভ্র তার সাথে এক ঘরে ছিলো। তার মানে কি শুভ্র তাকে কোনো ভাবে তাকে ওই অবস্থায় দেখেছে? হিয়া একটা ঢোক গিললো।
বাহ্ হিয়া, কি ঘুম রে তোর..! একটা মানুষ সারারাত তোর সাথে এক ঘরে ছিলো অথচ তুই টেরই পেলি না! কুম্ভকর্ণও তো দেখি ফেইল তোর কাছে।
⭐ হিয়া রুমে বসে আছে। নিচে থাকতে ভালো লাগছে না, সবাই কিভাবে কিভাবে যেনো তার দিকে তাকাচ্ছে। হিয়ার বারে বারে খালি মনে হচ্ছে সকলের এই ঘটনা হয়তো তাদের জানা। এদিকে শাড়ী জিনিসটার প্রতি যত ভালোলাগা ছিলো তার সঙ্গে এখন ভয় জিনিসটাও যুক্ত হয়েছে। তার শাশুড়ি একটা শাড়ি দিয়ে গেছে। এতো পাতলা শাড়ি বানানোর কি দরকার ছিল? আজব। আর তার শাশুড়িই বা এমন শাড়ী পেলো কোথায়? হিয়া রুমে বসে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে শাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন পাতলা শাড়ি সে কিভাবে পড়বে। এইটা পড়লে তো সবই বুঝা যাবে। কি যন্ত্রণা..!
হিয়া আর কোনো উপায় না পেয়ে শাওয়ারে ঢুকলো। মাথা থেকে সকালের ঘটনাটা সে কিছুতেই দূর করতে পারছে না। গোসল শেষে হিয়া দেখলো সে তোয়ালে আর শাড়ী দুটোই ভুলে গেছে আনতে। এইবার কি হবে? অন্যমন্ক ছিলো তাই হয়তো খেয়াল করেনি। এবার সে কি করবে? কি এক যন্ত্রণা! এইবার সে কি করবে? হিয়া আস্তে করে দরজাটা অল্প খুলে পুরো রুমটায় চোখ বুলিয়ে নিতেই দেখলো। শুভ্র বিছানায় ফোন হাতে বসে আছে। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
হটাৎ এমন আওয়াজে শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ওয়াশরুমের দিকে তাকালো। ভিতরে কি যুদ্ধ চলছে? হিয়া মাথায় হাত দিলো। এইবার কি হবে? শুভ্র তো ঘরেই আছে। একবার বলে দেখবে? যদি না দেয়? কি হবে তার? এই ওয়াশরুমে কি জীবন পার করতে হবে তার? ঠান্ডায় তো হাত পা বরফ হয়ে গেছে তার। প্রচুর ঠান্ডা লাগছে। হিয়া উপায় না পেয়ে আস্তে করে দরজা খুলে মুখটা একটু বের করে আবার উকি দিলো।
শুভ্র হিয়াকে এমনভাবে উকি দিতে দেখে বললো,” কিছু কি লাগবে? এভাবে ভেজা বিড়াল হয়ে আছো কেনো?”
হিয়া কাপা কাপা গলায় বললো,” শাড়ি আর তোয়ালেটা একটু দিবেন?”
শুভ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। বিছানার একপাশে তোয়ালে আর শাড়ী রাখা। শুভ্র শাড়িটা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে সেগুলো বাড়িয়ে দিতেই হিয়া হাত বের করে নিয়ে নিলো। শুভ্র এতো সহজে দিয়ে দিবে সেটা সে ভাবেনি। হিয়া চটজলদি তোয়ালে দিয়ে মাথা মুড়িয়ে নিলো। ব্লাউজ টা পড়ে যেই শাড়িটা হাত বাড়িয়ে নিতে যাবে পিচ্ছিল শাড়িটা গড়িয়ে পড়ে গেলো পানি ভর্তি বালতিতে। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে একটা চিৎকার করলো।
হিয়ার হটাৎ এমন চিৎকারে শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে উঠে দাড়ালো। তারপর একটু এগিয়ে এসে দরজায় নক করে বললো,” ঠিক আছো?” হিয়া উত্তর দিলো না। সে শাড়িটা তুলতে ব্যাস্ত। শুভ্র আবার নক করে হিয়াকে কয়েকবার ডাকলো। হিয়া কাদো কাদো গলায় বললো,” শাড়িটা একদম ভিজে গেছে…. এইবার আমি কি পড়বো?”
” তুমি ঠিক আছো?”, উত্তরে শুভ্র আবার প্রশ্ন করলো। কিন্তু ইতিমধ্যে হিয়া কাদো কাদো গলায় বলতে শুরু করেছে,” আমার সাথেই এইসব হতে হয়। সব কিছুতে একটা না একটা ঘাপলা থাকতেই হবেই? শাড়িটা তো পরে গেলো এইবার আমি কি করবো? আমার কি হবে।”
শুভ্র বাহির থেকে ধমক দিয়ে বললো,” হিয়া জাস্ট শাট আপ। দরজা খোলো।”
হিয়া ভ্রু কুঁচকে বিলাপ থামিয়ে বললো,” কেনো? দরজা খুলবো কেনো?”
” আমি খুলতে বলেছি। জলদি করো, আদার ওয়াইজ এই দরজা আমি একটা ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। সো ডু ইট ফাস্ট।”, শুভ্রের এমন হুমকিতে হিয়া লাফিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। এমন একটা অবস্থায় এই লোকটা হুমকি দিচ্ছে। অসভ্য একটা ডাক্তার।
হিয়া অল্প একটু দরজা খুলে মুখটা বের করতেই শুভ্র নিজের শার্টটা খুলে হিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,”এইটা পরে, জলদি বের হও।” হিয়া আড় চোখে একটু শুভ্রের দিকে তাকিয়ে শার্টটা নিয়ে নিলো। লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিল এতটা না। এমন হুট হাট হুমকি দিয়েই মেজাজ খারাপ করে দেয়।
হিয়া শার্টটা পড়ে আরো বিপদে পড়েছে মনে হচ্ছে। কাধ থেকে পড়ে যাচ্ছে বার বার। গলাটা এতো বড়। এইভাবে বের হবে? কথাটা ভাবতেই শুভ্র আবার নক করলো। হিয়ার কাছে আর কোনো উপায় নেই, এইভাবেই বের হতে হবে।
শুভ্র দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তাকাতেই দেখলো হিয়া ভেজা শাড়িটা হাতে নিয়ে গুটিসুটি মেরে বের হয়েছে। হিয়া বের হয়ে শুভ্রকে এমন খালি গায়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। হিয়া বড় বড় পা ফেলে বারান্দায় চলে এলো। শাড়িটা শুকাতে দিতে হবে। শাড়িটা শুকিয়ে গেলেই সে বেচেঁ যায়। বারান্দার রেলিং গুলো অনেক উচু তাই নীচ থেকে তেমন কিছু দেখা যায় না এইটা একটা সস্থির বিষয় তাকে এমন অর্ধেক শার্ট আর অর্ধেক পেটিকোটে কেউ দেখবে না।
কিন্তু বিরক্তির ব্যাপার হচ্ছে দড়িটা একটু বেশিই উচুতে বলতে গেলে তার নাগালের বাহিরে। শতবার লাফিয়েও কাজ হয়নি। শুভ্র এমন ধুপ ধাপ লাফানোর শব্দ শুনে এগিয়ে আসলো। তারপর বুকের কাছে হাত ভাজ করে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হিয়া কি সত্যি ভাবছে এইভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে সে দড়ির নাগাল পাবে?
হিয়া রীতিমত হাপিয়ে গেছে, এতো উচুঁতে দড়ি টাঙিয়েছে কে? ঐটা নির্ঘাৎ মইয়ের সমান লোক ছিল। হিয়ার বিরক্তি আরো বাড়লো যখন দেখলো শুভ্র একপাশে দাড়িয়ে মজা নিচ্ছে। হিয়া ভ্রু কুঁচকে বলেই ফেললো,” এইভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছেন? একটু হেল্প করতে পারছেন না?”
শুভ্র কোনো জবাব দিলো না। হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে আবার দড়িটা ধরার জন্যে চেস্টা করতে লাগলো। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার কোমড় ধরে উপরে তুলতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। হিয়াকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ্র বললো,” কি হলো তাকিয়ে আছো কেনো?”
” আপনি আমাকে নামান। আমি এইভাবে কাপড় দিতে পারবো না। নামান আমাকে আমি পড়ে যাবো।”,বলেই নামতে চেষ্টা করলো। শুভ্র আরো শক্ত করে ধরতেই শিউরে উঠলো হিয়া। হিয়া চোখ মুখ খিচে অপ্রস্তুত হয়ে বললো,” নামান আমাকে, লোকে দেখবে তো।”
” সেটা আমি বুঝবো। তোমাকে যেটা করতে বলেছি করো।”,কঠিন গলায় বললো শুভ্র। শুভ্রের কণ্ঠ শুনেই মনে হচ্ছে শুভ্র তাকে নামবে না। হিয়া চটজলদি শাড়িটা মেলে দিয়ে বললো,” হয়েছে, হয়েছে এবার নামান আমাকে।”
শুভ্র হিয়াকে আস্তে করে নামিয়ে নিজের সামনে দাড়করাতে হিয়া খেয়াল করলো তার কাঁধের দিকে শার্টটা সরে গিয়েছে। হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে গলার কাছে শার্ট শক্ত চেপে ধরলো। তারপর শুভ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র ঠোঁট চেপে হাসছে। শুভ্র হিয়ার কোমড় ধরে আরেকটু কাছে আনতেই। হিয়ার বুকের ভিতরটায় ধুক ধুক শুরু হয়েছে। শুভ্র হিয়ার মুখের সামনে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,” আই থিঙ্ক আজকের দিনটা বড্ড বেশামাল, সব কিছু তো আমারই ফেবারে। ইভেন তোমার পড়ে থাকা আমার এই শার্টটাও।”
[ #চলবে ]