#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা।
#পর্ব_৩৮
সকালের মিষ্টি রোদ চোখে এসে পড়তেই হিয়ার ঘুম ভাঙলো। আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই পেটের উপর কারোর বলিষ্ঠ হাতের বাধন অনুভব করলো সে। হিয়া নড়া চড়া করতেই কেউ যেনো তাকে আরো কাছে এনে হাতের বাধন শক্ত করলো। হিয়া আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরাতেই শুভ্রের ঘুমন্ত মুখটা চোখে পড়লো তার। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। লোকটা ঘুমের মাঝে তাকে এইভাবে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে কেনো? সে কি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে? হিয়া কিছুক্ষণ আগ্রহ নিয়ে শুভ্রের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু শুভ্রের ঘুম ভাঙ্গার আগেই তাকে সরে যেতে হবে। হিয়া হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে শুভ্রের মাথার কাছ থেকে তার শার্ট টা নিলো। কোনো উপায় নেই তাকে এইটাই পড়তে হবে।
হিয়া খুব সাবধানে শুভ্রের বাঁধন থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর গোসল সেরে শুভ্রের কাবাড থেকে মেরুন রঙের একটা শার্ট নিয়ে পরে ফেললো। কি এক যন্ত্রণা! তাকে কি শুভ্রের জামা কাপড় পড়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে? শুভ্রের এই লম্বা লম্বা ট্রাউজার গুলোও তো তার হবে না। তাও বেছে বেছে সে একটা ট্রাউজার নিলো। তাকে যে কি পরিমান হাস্যকর লাগছে সেটা সে আয়নায় সামনে দাড়িয়ে বুঝতে পেরেছে। হিয়া নিচের ঠোঁট উল্টে শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্র গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে সে। হিয়া ঠোঁট উল্টে ফিসফিসিয়ে বললো,” অসভ্য ডাক্তার।” বলেই ঠোঁট চেপে হাসলো।
হিয়া দরজা খুলে বের হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ইউভিকে খুঁজলো। হিয়া সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখলো ইউভি সোফায় বসে লেজ নাড়াচ্ছে। হিয়াকে দেখেই সে দৌড়ে এলো। হিয়া ইউভিকে কোলে তুলে আদর করতে লাগলো। সারারাত বেচারী একা একা ছিলো। হিয়া ইউভিকে কিচেনে নিয়ে গেলো। তারপর ইউভির খাবার বের করে বাটিতে নিয়ে ইউভিকে খেতে দিলো।
হিয়াকে এইবার নাস্তা বানাতে হবে কিন্তু তার আগে ডাক্তার সাহেবের ডিটক্স বানাতে হবে। হিয়া একটা বাটিতে শশা, লেবু, পুদিনা পাতা ইত্যাদি পাতলা স্লাইস করে কেটে পানি দিয়ে ভিজিয়ে ঢেকে একপাশে রেখে দিলো। তারপর নাস্তা বানিয়ে যেই কিচেন থেকে বেরিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে কলিংবেল বেজে উঠলো। কে এসেছে এই সকালে? এই হাস্যকর রূপে এবার তাকে দরজা খুলতে হবে? হিয়া দরজা হালকা খুলে শুধু মুখটা বের করতেই দেখলো একজন পার্সেল হাতে দাড়িয়ে আছে।
লোকটা পার্সেল এগিয়ে দিতেই হিয়া হাত বাড়িয়ে নিয়ে সাইন করে সঙ্গে সঙ্গে দরজা আটকে দিলো। এই সাত সকালে আবার কিসের পার্সেল। কি ভারী বক্সরে বাবা! হিয়া বক্সটা হাতে নিয়ে অনেক কষ্টে উপড়ে নিজের রুমে এলো। রুমে ঢুকে বক্সটা একপাশে রাখতেই দেখলো শুভ্র উঠে বসে আছে। চোখে মুখে ঘুম আর বিরক্তির ছাপ। হিয়া এগিয়ে এসে বলল,” একি আপনি কখন উঠেছেন?”
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে হাত ইশারায় হিয়াকে নিজের পাশে বসতে বললো। হিয়া বেশ চিন্তিত হয়ে পাশে এসে বসলো। ঘুম থেকে উঠেই এমন মেজাজ খারাপ কেনো শুভ্রের?
শুভ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে হিয়ার পা থেকে মাথা সম্পুর্ন দেখে বললো,” কখন উঠেছো তুমি?” হিয়া কানের পিছনে চুল গুঁজে বললো,” অনেক্ষন আগে। কিন্তু কেনো?”
শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” এরপর থেকে আর কখনো আমার আগে ঘুম থেকে উঠবে না।”, হিয়া ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে যাবে শুভ্র হিয়াকে থামিয়ে বললো,” ঘুম ভেঙে গেলো। আমাকে ডেকে তুলবে কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠবে না।” বলে হিয়ার দিকে তাকালো। তারপর বললো,” কি বললাম বুঝতে পেরেছো?” হিয়া না সূচক মাথা নাড়ল। মানে কি এইসবের? বিছানা ছেড়ে উঠবে না তাহলে কি করবে? শুভ্রের অগোছালো কথার মানে সে কিছুই বুঝলো না।
শুভ্র সিরিয়াস হয়ে বললো,” সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর চোখ মেলতেই যেনো আমি তোমাকে দেখতে পাই। বুঝেছো?”
হিয়ার মুখের হাসি প্রশস্ত হলো। শুভ্র কি অদ্ভূত তাই না?এই সুন্দর কথাটা একটু মিষ্টি করে বলা যেতো না বুঝি? সেই গম্ভীর মুখেই বলতে হবে তাকে। হিয়া ঠোঁট কামড়ে হাসি থামিয়ে বললো,” ঠিক আছে। সে পরে দেখা যাবে।” শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” অ্যাম সিরিয়াস।”
হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো তারপর বললো,” সকাল সকাল এমন রেগে রেগে কথা বলছেন কেনো আমার সাথে?”
” আমার রাগের কারণটা তো তুমি নিজেই।”, আড় চোখে তাকিয়ে বললো। হিয়া ঠোঁট উল্টে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। শুভ্র বিছানা ছেড়ে উঠে যেতেই হিয়া শুভ্রের হাত টেনে ধরলো শুভ্র পিছনে তাকাতেই দেখলো হিয়া ছোট বাচ্চার মতন চেছারা করে তাকিয়ে আছে। শুভ্র ঝুঁকে এসে হিয়ার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া ঠোঁট চেপে হাসলো। শুভ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” যাও চেঞ্জ করে নাও।”
” মানে? চেঞ্জ করে কি পড়বো?”, বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো হিয়া। শুভ্র হিয়ার টেবিলে এনে রাখা বক্সটার দিকে ঈশারা করে বললো,” ওখানে আছে।”
হিয়া চমকে উঠে বললো,” সত্যি! এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছে? আমি তো ভেবেছিলাম সারাজীবন হয়তো আমাকে এই লম্বা শার্ট আর লম্বা প্যান্ট পরে কাটাতে হবে।” হিয়া এগিয়ে গিয়ে বক্সটা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে গেলো। শুভ্র হালকা হেসে ফ্রেশ হতে গেলো।
হিয়া ড্রেস গুলো দেখে একটা সস্থির নিশ্বাস ফেললো। যাক এই শার্ট পরে থাকা, থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে। হিয়া একটা নীল রঙের কুর্তি আর সেলোয়ার পড়ে নিলো। তারপর আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখলো। আহ্ কি শান্তি লাগছে নিজেকে দেখে।
শুভ্র ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়ে দেখলো হিয়া একগাল হাসি দিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে আছে। হাসির কারণ কি তার দেওয়া এই ড্রেসগুলো। হিয়া হেসে উঠে বললো,” সুন্দর লাগছে না?”
শুভ্র ঠোঁট উল্টে না সূচক মাথা নেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। হিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। শুভ্র না বললো, তাহলে কি ভালো লাগেনি। কি খারাপ মুখের উপর না বলে দিলো। হিয়া ভ্রু কুঁচকে শুভ্রের দিকে এগিয়ে এলো তারপর বললো,” খুব বাজে লাগছে।” শুভ্র আবারো না সূচক মাথা নাড়লো।
হিয়া একটু চিন্তামুক্ত হয়ে বললো,” ও আচ্ছা। তাহলে মোটামুটি লাগছে?”
শুভ্র তৃতীয় বারের মতন না বলতেই হিয়া ক্ষেপে উঠে বললো,” হয়েছে হয়েছে,আমাকে তো আপনার ভালো লাগবেই না।”
শুভ্র হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের এগিয়ে এসে হিয়ার দুপাশে হাত রাখলো। কিন্তু হিয়া মুখ কালো করে তাকিয়ে রইলো। শুভ্র একটু কাছে এসে ঝুঁকে আসতেই হিয়া একটা ঢোক গিললো। তারপর শুভ্র আস্তে আস্তে খুব কাছে চলে আসতেই হিয়া শুভ্রের হাতের নিচ দিয়ে ঝুকে বেড়িয়ে এলো।
শুভ্র সোজা দাড়িয়ে দুই হাত ভাজ করে বললো,” চলে গেলে কেনো? শুনে যেতে আমার তোমাকে ঠিক কিভাবে ভালো লাগে।”বলেই বাকা হাসি দিলো।
হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে রইলো। শুভ্রের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বললো,” থাক, হয়েছে। আপনাকে আর বলতে হবে না।” শুভ্র হিয়ার কাছে এগিয়ে আসতেই
হটাৎ হিয়ার কেনো জানি মনে হলো রহিমা খালার আওয়াজ শুনেছে সে। তাহলে কি সবাই ফিরে এসেছে? হিয়া চট জলদি রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সত্যিই তাই। বাবা মা সবাই ফিরে এসেছে। কিন্তু নীচে এসেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো হিয়ার। সঙ্গে রিমি নামক আপদটাও এসেছে।
রিমি এগিয়ে এসে হিয়াকে বললো,” বাহ্, তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে।”
হিয়া হাসার চেষ্টা করলো তারপর বললো,” তোমাকে দেখে ভালো লাগছে।” মনে মনে তো তার একদমই ভালো লাগছে না।
” আসলে আমি এতদিন এই বাড়িটাকে অনেক মিস করেছি। তাই ভাবলাম ইউএসে ফিরে যাওয়ার আগে সবার সাথে কিছুদিন থেকে যাই।”
হিয়া নিতান্ত অনিচ্ছায় হাসলো তারপর বললো,” অনেক ভালো করেছ। তোমাকে দেখে আমিও অনেক খুশি হয়েছি।” হিয়া কেনো যে একই কথা বার বার বলছে সে নিজেও জানে না।
শুভ্র নীচে নেমে এসে ওদের পাশে দাড়ালো। শুভ্রকে দেখে রিমি বললো,” কেমন আছো?” বলে এগিয়ে জড়িয়ে ধরতে যাবে হাত বাড়িয়ে দিতেই হিয়া এসে রিমিকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললো,” অনেক ভালো আছে।”
হিয়া হাসি দিয়ে পুরো বিষয়টাকে ঢাকা দিতেই অনবরত হেসে যাচ্ছে। রিমি হিয়ার কাণ্ডে প্রথমে অবাক হলেও পরে হেসে উঠে নিজেও হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। হিয়ার এমন কাণ্ডে শুভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে তো মারাত্মক হিংসুটে।
[ #চলবে ]
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩৯
আজ কতদিন পর যে হিয়া কলেজে এসেছে সে নিজেও ভুলে গেছে। সামনে বোর্ড এক্সাম। এমনিতেই বাড়িতে রিমি পেত্নীর জন্যে চিন্তায় বাচে না এখন আবার পরিক্ষার ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে সে। হাতে মাত্র অল্প কিছু মাস বাকি। দিবার একি অবস্থা। সারা বছর তাইরে নাইরে করলে যা হয়। দিবা ক্লাস শেষে বের হতে হতে বললো,” ধুর আর পড়ালেখা ভাল্লাগে
না। আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেই তো পারে।”
হিয়া ভ্রূ কুচকে তাকালো তারপর বললো,” বিয়ে করলে বুঝি পড়তে হবে না।”
” নাহ্ সেটা না। বিয়ে দিয়ে দিলে বরের সাথে রোমান্স করে জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে পারতাম। তখন পড়ালেখায় বেশি মনোযোগ আসতো।”, দিবার কথা শুনে হিয়া হেসে ফেললো। দিবা আড় চোখে হিয়ার দিকে তাকালো। কিন্তু সামনে তাকাতেই শুভ্রকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দিবা ফিসফিসিয়ে বললো,” বাহ্। কি প্রেম! দিন দিন দেখছি প্রেম খালি বাড়ছে।”
হটাৎ দিবার এমন মন্তব্য শুনে হিয়া সামনে তাকাতেই শুভ্রকে দেখলো। হিয়া মনে মনে খুশি হলেও মুখে তা প্রকাশ করলো না। দিবাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,” কিসের প্রেম? বেশী বলছিস।”
” হ্যা, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।”,বলেই ফিক করে হেসে উঠলো। হিয়া আস্তে করে দিবাকে চিমটি কেটে থামালো। তারপর দিবাকে বায় বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর শুভ্রের সামনে দাড়িয়ে কোমরে দুই হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” আপনি এসেছেন কেনো? ড্রাইভার কাকু কোথায়?”
শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। বাহ্ তাকে রেখে ড্রাইভার কাকুর কথা জিজ্ঞেস করছে। শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আজ সকাল থেকে হিয়ার এমন ব্যাবহারের কারণটা সে জানে। তাই শুভ্র কথা বাড়ালো না। গাড়ির দরজা খুলে হিয়াকে বসতে বললো। হিয়া মুখ বাঁকিয়ে গাড়িতে বসলো। বলার তো কিছু নেই তাই লোকটা এখন চুপ।
হিয়া গাড়িতে বসতেই শুভ্র তপ্ত একটা নিশ্বাস ফেললো। যাক অন্তত তার কথা তো শুনেছে। শুভ্র গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। মাঝে মাঝে হিয়ার দিকেও তাকালো কিন্তু হিয়ার চোখ মুখ স্বাভাবিক। মনে মনে কি না কি জটলা পাকিয়ে বসে আছে এই মেয়ে। শুভ্র দৃষ্টি সামনে রেখে গাড়ি চালাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
আজ সকালে হিয়া কলেজে আসবে রেডি হয়ে নিচে নেমেছে। তখনই দেখলো রিমি শুভ্রের কানে কানে কি জানি বলছে তারপর শুভ্রের হাত ধরে কি জানি মিনতি করছে। দেখেই মাথায় রক্ত উঠে গেছে তার। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে হনহনিয়ে বেড়িয়ে এলো। শুভ্রের দিকে তাকালো পর্যন্ত না। তারপর ড্রাইভার কাকুর গাড়িতে করে কলেজে চলে এলো। সেই কারণেই সে শুভ্রের সাথে কথা বলছে না।
গাড়ি জ্যামে থামলো। শুভ্র কি বলবে বুঝতে পারছে না। রিমি কানে কানে রায়হানের কথা জানতে চেয়েছিল। শুভ্র সে ব্যাপারে কিছু জানে না বলেছিলো। কিন্তু রিমির জোরাজুরিতে আর হাত ধরে অনেক রিকোয়েস্ট করেছে তাই শুভ্র রায়হানের গ্রিসে চলে যাওয়ার কথাটা বলে আর সেই ফটোগ্রাফারের নামটাও জানিয়ে দেয়।
শুভ্র আর রিমির সম্পর্ক টা ভাইবোন ঠিকই কিন্তু তার চেয়েও বেশি বন্ধুত্বসুলভ। এইটা হিয়াকে কে বোঝাবে? যেহেতু রিমি আমেরিকায় বেশির ভাগেই সময়ে ছিলো তাই সে তাদের কালচারে অভ্যস্ত। শুভ্র এক দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো চুপচাপ আছে কেনো সে? কিছু একটা তো এই মেয়ের মাথায় চলছে।
শুভ্রের গাড়ির পাশে হটাৎ একটা স্কুটার এসে থামলো। স্কুটারে একটা ছেলে। ছেলেটার মাথায় জেল দিয়েছে নাকি তেল, বুঝা যাচ্ছে না। এক সাইডে সিথি করা চুলগুলো। কাধেরর একপাশে ব্যাগ ছুলছে। চোখে ধরার মতন চকচকে নীল রঙের শার্টের সাথে কালো প্যান্ট। স্কুটারে বসে ছেলেটা মাথা নাড়তে নাড়তে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। হিয়া অনেক্ষন হলো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা শুভ্র খেয়াল করছে। এই হাদারামের দিকে তাকিয়ে থাকার কি আছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না।
চকচকে শার্ট পরা ছেলেটা কয়েকবার সেটা খেয়াল করলো। প্রথম কয়েকবার তার ঠিক বিশ্বাস হয়নি, গাড়ীতে বসে থাকা মেয়েটা যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কয়েকবার সন্দেহ হয়েছে কিন্তু হিয়া একটু হেসে তাকাতেই ছেলেটার চোখ রসগোল্লার মতন হয়ে গেলো। হিয়া ইচ্ছে করেই বেশ সুন্দর করে হাসলো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। শুভ্র সবটা খেয়াল করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। হিয়া কি করতে চাইছে। তাকে জ্বালাতে এইসব করছে?
হিয়া নিজে থেকেই ওই ছেলেটাকে হাত নাড়িয়ে ডাকতেই ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে হেসে তাকালো। শুভ্র চোয়াল শক্ত করে ফেললো আর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির কাচটা তুলে দিলো। তারপর কড়া চোখে হিয়ার দিকে তাকালো। এখন যদিও হিয়ার প্রচুর হাসি পাচ্ছে তাও সে না হাসার চেষ্টা করছে। হিয়া নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি থামাচ্ছে। শুভ্র রেগে গিয়ে বললো,” কি করছো এইসব?”
হিয়া আড় চোখে তাকালো। বোঝাই যাচ্ছে শুভ্র রেগে গেছে। হিয়া থমথমে গলায় বললো,” কি করেছি? আমি তো কাউকে গিয়ে জড়িয়ে ধরিনি কিংবা হাত ধরে টানাটানি করি নি।”
” হিয়া, আই ক্যান্ট বিলিভ তুমি সকালের সামান্য বিষয়টার জন্যে ওই ইডিয়েটের দিকে তাকিয়ে হাসছো।”, বলতে বলতে কঠিন দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটা এখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হিয়ার দিকে।
হিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,” সামান্য বিষয়? যখন জড়িয়ে ধরা, হাত ধরে টানাটানি করা সামান্য বিষয় হয় তাহলে কারোর দিকে তাকিয়ে হাসলাম সেটা তো আরো নগণ্য বিষয়। আপনি এতো রিয়েক্ট করছেন কেনো? আমিও শান্ত আছি আপনিও শান্ত থাকুন।”
মনে মনে হিয়ার শান্তি লাগছে। এইবার শুভ্র বুঝবে ঠিক কেমন লাগে।
শুভ্র ট্রাফিক সিগন্যালের দিকে তাকালো। গ্রীন লাইট হতে সময় বাকি। হিয়া আড় চোখে তাকালো, শুভ্র নিজের সিটবেল্ট খুলছে। কিন্তু কেনো? ছেলেটাকে মারবে নাতো। শুভ্র হাত দিয়ে কপালের সামনের চুলগুলো পিছনে সরিয়ে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে। এইদিকে ওই স্কুটারের ছেলেটা গাড়ির জানালায় নক করতেই হিয়া ভয় পেয়ে তাকালো। ছেলেটাকে দেখে খুব বেশিই সহজ সরল মনে হচ্ছে। শুভ্র যে কি করবে কে জানে। শুভ্র বির বির করে বললো,” আই সোয়ার আই উইল কিল দিস স্টুপিড।”, বলেই জানালাটা হালকা খুলে কড়া চোখে তাকাতেই ছেলেটা একটা ঢোক গিললো। তারপর হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ” আমি রাকিব। আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগলো। আপনার বাড়ি কি ময়মনসিংহে?”
হিয়া অবাক হয়ে তাকালো। কি অদ্ভূত এই ছেলে তাকে চিনে কি করে? হিয়া হা সূচক মাথা নাড়তেই ছেলেটা হেসে উঠলো। শুভ্র জানালা এতো অল্প খুলেছে হিয়া একটু উচু হয়ে মুখটা বের করে বললো,” আপনি আমাকে চিনেন?”
ছেলেটা হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” মনে আছে? তোমার মামার বাসায় অনেকবার গিয়েছিলাম নানা কারণে।”, বাকিটা বলার আগেই শুভ্র গাড়ির কাচ তুলে দিলো। অনেক কষ্ট নিজের রাগ সামলে রেখেছে সে। এই হাদারামকে এই জায়গায় এসেই নিজের স্কুটার থামাতে হলো। শুভ্র তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। হিয়া শুভ্রের হটাৎ এমন কাচ তুলে দেওয়ায় ভীষন বিরক্তি বোধ করলো। আজব ছেলেটা কি ভাবলো তাকে? হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” আপনি কাচটা এইভাবে তুলে দিলেন কেনো?”
শুভ্র কঠিন দৃষ্টি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না সে। গ্রীন লাইট জ্বলতেই সিটবেল্ট পড়ে নিলো। তারপর সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে আপাদত গাড়ি চালাতে নিজেকে ব্যাস্ত রাখলো সে। হিয়া ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগ টাগ করলো নাকি আবার। হিয়ার একটু চিন্তা হলো। এই মশাই তো আবার রাগ করলে রাগ ভাঙ্গানো মুশকিল।
বাড়িতে ফিরে শুভ্র সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। হিয়া ভেবে পায় না শুভ্রের কিসের জন্যে এতো রাগ হলো। রাগটা হওয়ার কথা তার কিন্তু এই মশাই রাগ করে বসে আছে। এইদিকে রিমি নাকি চলে যাচ্ছে। হিয়া জানতো মেয়েটা আমেরিকা ফিরবে কিন্তু তাহলে গ্রিসে যাচ্ছে কেনো হটাৎ? যাক, এই দেশ ছেড়ে গেলেই সে বাঁচে। হিয়া ব্যাগ নিয়েই নিচে দাড়িয়ে রইলো রিমিকে বিদায় দিতে। শুভ্রকে রিমি আগেই বলে রেখেছে। তাই সবাইকে বলে এইবার তার একা একা গ্রিসে পাড়ি দেওয়ার পালা। সেই মানুষটাকে তো খুঁজে বের করতে হবে। সবার আড়ালে কেনো নিজেকে গুটিয়ে রেখেছ জানতে হবে তো।
হিয়া পা টিপে টিপে ঘরে এলো। শুভ্র শার্টের প্রথম দুটো বোতাম খুলে এসি ছেড়ে বসে আছে। শুভ্রকে কেনো জানি অন্যরকম ভালো লাগছে। হিয়া ব্যাগটা একপাশে রেখে আস্তে আস্তে শুভ্রের পাশে এসে বসলো। শুভ্র আড় চোখে একবার তাকিয়ে আবার চোখে বন্ধ করে ঘাড় পিছনে ফেললো। হিয়া মাথাটা উচু করে শুভ্রের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলো। হিয়া কিছু বলতে গিয়েও বললো না।
কি বলবে এখন? থাক পরে বলবে। হিয়া উঠে চলে যেতেই শুভ্র চোখ খুলে হিয়ার হাত ধরে ফেললো। তারপর সোজা হয়ে বসলো। হিয়া অবাক হয়ে তাকালো। শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শুভ্র হাতটা টেনে নিজের কাধের উপর রেখে হিয়ার কোমড় জড়িয়ে নিজের একদম কাছে নিয়ে এলো। হিয়া একটা ঢোক গিলে শুভ্র শীতল দৃষ্টির দিকে তাকালো। শুভ্র হিয়ার মাথার সাথে নিজের মাথা মিলিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” লেটস স্টপ দিস ফাইট। অ্যাম ডান উইথ অল দিস।”
হিয়া চোখ তুলে বললো,” আমি কি ঝগড়া করেছি? আপনিই তো গাড়িতে রাগ দেখালেন।”
শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” ওই স্টুপিডটা কে ছিলো?”
হিয়া একটু ভেবে বললো,” আমি জানি না। একজন প্রায় মামার কাছে আসতো। উনি হয়তো সে।” পরক্ষনেই হেসে উঠে বললো,” এইবার টের পেয়েছেন কেমন লাগে?” শুভ্র শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর বললো,” আমি ইচ্ছে করে তোমাকে হার্ট করিনি। আই হ্যাভ বিন অ্যালওয়েস ট্রিট হার লাইক মাই সিস্টার। কিন্তু ওতো আমেরিকায় ছিলো, ওখানকার কালচারই এমন।”
হিয়া শুভ্রের গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললো,” সে যেই হোক না কেনো? আমি আপনাকে কারোর সাথে শেয়ার করতে পারবো না। আমি এমনই হিংসুটে আর এমনই থাকবে। এই হিংসুটে বউকেই আপনার সহ্য করতে হবে।”
শুভ্র নিঃশব্দে হাসলো তারপর হিয়াকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে,হিয়াকে জড়িয়ে রাখলো। হিয়া উঠে যেতে চাইলো কিন্তু শুভ্র হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে বললো,” এভাবেই থাকো।”, বলেই হিয়ার চুলের ভাজে মুখ গুজে দিলো। হিয়া ঠোঁট উল্টে বললো,” আমি চেঞ্জ করবো তো।” শুভ্র কোনো কথা বললো না,নিঃশব্দে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো হিয়াকে।
[ #চলবে ]