নীলচে তারার আলো পর্ব-৪০+৪১

0
852

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৪০

হিয়া পড়ার টেবিলে বসে আছে। পড়ার টেবিলে বসেছে ঠিকই কিন্তু পড়তে ভাল্লাগছে না। কিছুক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে কখনো জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে কিংবা কখনো কলম মুখে নিয়ে পায়ের উপর পা রেখে দুলাচ্ছে। শুভ্র রুমের দরজার পাশে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। এ কেমন পড়ালেখার ধরন?

শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে দাড়িয়ে বইয়ের দিকে তাকালো। বইয়ের দিকে তাকিয়ে শুভ্র কুচকে ফেললো। তারপর হিয়ার দিকে তাকালো। মুখে কলম নিয়ে হিয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার মুখ থেকে কলমটা নিয়ে বললো,” এটা মুখে দিয়েছো কেনো?”

শুভ্রের এমন কাণ্ডে হিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আড় চোখে তাকালো শুভ্রের দিকে। শুভ্র হিয়ার সামনের বইটা হাতে নিয়ে বললো,” আমি রুম থেকে যাওয়ার আগেও তো তোমাকে এই পেজটা পড়তে দেখে গেলাম। এখনো পড়া হয় নি?”

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো কারণ সত্যি পড়া হয়নি। ধুর ভাল্লাগে না এই পড়ালেখা। আগে পড়তে খুব ভালো লাগলেও এখন লাগে না। বইটা হাতে নিলেই মনে হয় সবকিছু অচেনা অজানা। হিয়া ঠোঁট উল্টে বললো,” নাহ্ পড়তে ইচ্ছে করছে না।”

শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। পড়ালেখায় গাফিলতি সে একদমই পছন্দ করে না। বইটা হিয়ার সামনে রাখলো তারপর হিয়ার চেয়ার ধরে ঝুকে এসে বললো,” বুঝতে সমস্যা হচ্ছে কোথাও?”

” না আসলে আমার আজকে পড়তেই ইচ্ছে করছে না। কালকে থেকে আবার স্টার্ট করবো।,” বলে উঠে যাওয়ার আগেই শুভ্র হিয়াকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো,” আজ থেকেই পড়তে হবে।”

তারপর আরেকটা চেয়ার নিয়ে এসে হিয়ার পাশে বসলো শুভ্র। হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে আছে। কোনোভাবে কি সে ফেঁসে গেলো। পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুভ্র কি তার পাশে বসে থাকবে। শুভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” নাও, শুরু করো।’

হিয়া মুখ কালো করে বইয়ের দিকে তাকালো। আর কোনো উপায় নেই পড়া ছাড়া। হিয়া অনেক কষ্টে মন দিলো পড়ায়। নিজের চিন্তার চেয়েও বেশিক্ষণ পড়লো তারপর বই বন্ধ করে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,” হয়েছে আমি আর আজ পড়তে পারবো না। কালকে আবার বসবো।”

শুভ্র একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” এইভাবে ফাঁকিবাজি করলে তুমি টপ রেজাল্ট করতে পারবে না। তুমি যদি চেষ্টাই না করো তাহলে ভালো কিছু কি করি আসবে। তোমাদের কলেজ থেকে প্রতি বছর টপ স্টুডেন্টদের একটা লিস্ট তৈরি করা হয়। বাবা বলছিলো তোমার নাম ঐ লিস্টে নাকি নিশ্চয়ই থাকবে। বাট নাও আই হ্যাভ ডাউটস।” বাবার কথাটা শুভ্রের বানানো কথা। শুভ্র চায় হিয়া যেনো জীবনে ভালো কিছু করতে পারে। এগিয়ে যেতে পারে সব ক্ষেত্রে। হিয়া চেষ্টা করলে পারবে সেই যোগ্যতা তার আছে। এর আগের বোর্ড এক্সামের মার্কস শুভ্র বের করে দেখেছে। মিথ্যেটা সম্পূর্ন মিথ্যে না। বাবার কথাটাই সে ঘুরিয়ে বলেছে।

শুভ্রের কথাগুলো শুনে হিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকালো। তাকে যদি টপ রেজাল্ট করতে হয় তাহলে এই পড়ালেখায় তার কিছুই হবে না। হিয়া একটা ঢোক গিলে বললো,” বাবা সত্যি চায় আমি টপ রেজাল্ট করি।”

” কে কি চায় সেটা তো কোনো ম্যাটার না। কথা হচ্ছে তুমি কি চাও? কত দূর যেতে চাও।”,বলেই স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া মহা বিপদে পড়েছে। এইসব নিয়ে সে কখনো ভাবেই নেই। কিন্তু আসলেই তো সে কি হতে চায়। তার তো একটা স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু স্বপ্নটা যদিও অনেক আগে চাপা পড়ে গিয়েছিল। হিয়া ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বললো,” আমি আইনজীবী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার হাতে তো সময় অনেক অল্প আমি কিভাবে ভালো রেজাল্ট করবো? আমাকে দিয়ে হবে না।”

” সেটাই, তোমাকে দিয়ে হবে না। তুমি ছেড়ে দাও।”, কথাটা শুভ্র তাচ্ছিল্যের সুরে বলতেই হিয়ার গায়ে কাঁটার মতন ফুটলো সেটা। কিভাবে মুখের উপর বলছে পারবে না। হিয়া আড় চোখে তাকাতেই শুভ্র বললো,” তোমাকে তো দিন রাত জেগে কেউ পড়তে বলছে না। তুমি আকাশ দেখে ,পা নাড়িয়ে পড়লেই হবে। মানে অন্তত তুমি পাশটা তো করবে।”

হিয়ার রাগে গা জ্বলছে। তাকে খোঁটা মেরে কিভাবে বলেছে দেখো। হিয়া দাত কিরমির করে তাকালো শুভ্রের দিকে তারপর বললো,” আমি যদি টপ রেজাল্ট না করেছি তাহলে আমি আমার নাম বদলে ফেলবো বলে রাখলাম।”

” কি নাম রাখবে?”, কথার পিঠে প্রশ্ন করলো শুভ্র। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে কড়া চোখে তাকালো। শুভ্র নিজের হাসি লুকিয়ে বললো,” আগে থেকে ভেবে রাখা ভালো না? পরে কষ্ট কম হবে।”

হিয়া মুখ হা করে তাকালো। মানে উনি ধরেই নিয়েছেন যে সে পারবে না। কত খারাপ! হিয়া রাগে গজগজ করে বললো,” আপনি জান তো। গিয়ে ঘুমান। আমি পড়ছি আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।”বলেই বই নিয়ে বসলো। তাকে তো এইবার পারতেই হবে। হনুমানের মুখ বন্ধ করতে হবে যে।

শুভ্র উঠে গিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে রইলো। যাক তার উপর রাগ করে হলেও তো পড়ছে। শুভ্র সত্যি চায় হিয়া জীবনে এগিয়ে যাক। মানুষের মুখে হিয়ার প্রশংসা শুনবে সে। আর পাঁচটা মেয়ের মতন হিয়াও পিছিয়ে পড়ুক সে সেটা চায় না। হিয়া কিছুক্ষণ পর আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,” বসে আছেন কেনো?”

শুভ্র ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বললো,” আমার ইচ্ছা।” হিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলো। পড়তে তাকে হবে, বাবা চেয়েছেন। আর এমনিতেও সে আইনজীবী হবে এটা তার বাবারও স্বপ্ন ছিল। কিন্তু কিছু দুঃস্বপ্নের আড়ালে সেই স্বপ্নটাও হারিয়ে গিয়েছিল তার। আর এই হনুমানটার জন্যেও পারতে হবে। ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবে তা না দেখো খাটে বসে ঝিমুচ্ছে।

হিয়া পড়া শেষ করে বইটা বন্ধ করলো তারপর ঘড়ির দিকে তাকালো। বাপরে এতো রাত হয়ে গেছে পরক্ষনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে। হিয়া এগিয়ে আসলো শুভ্র আসলেই ঘুমিয়েছে কিনা সেটা দেখতে। লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছে। হিয়া শুভ্রকে বালিশ দিয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। তারপর ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে শুভ্রের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লো। কিন্তু হটাৎ হিয়ার মনে একটা ইচ্ছে জাগলো এগিয়ে এসে শুভ্রের বাহু জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।

⭐ রবীউল সাহেবের দুঃসম্পর্কের খালা হয় এই বৃদ্ধা। তিনি কি এক প্রয়োজনে এসেছেন, বয়স হলেও কথা কিন্তু সে স্পট করে কথা বলে।
বৃদ্ধা কিছুক্ষন পর পর খালি পান চিবুচ্ছে। পান রাখার একটা পাত্র তিনি সঙ্গেই রেখেছেন। পাত্র ভর্তি পান। হিয়ার এই বৃদ্ধাকে ভীষন ভয় লাগছে। যখন থেকে এসেছে খালি ভুল ধরেই যাচ্ছে। এমনকি তার শাশুড়ির ভুল পর্যন্ত ধরেছে। তিনি খাবার পরিবেশনের সময় গ্লাসে পানি দিতে ভুলে গেছে। এটা দেখে বৃদ্ধা বলেছেন,” বড় বউ, তোমার জলদি জলদি কাম করার সভাব গেলো না এতো বছরেও। গেলাসে পানি দিবার কথাও ভুইল্যা গেছো।”

সাহারা খাতুন রীতিমত অতিষ্ট হয়ে আছেন। রবীউল সাহেবের কোনো মহিলা আত্মীয়কে তিনি সহ্য করতে পারেন না। কারণটা হলো তার প্রতি তাদের এমন আচরণ। মুখে কিছু বলেন না ঠিকই কিন্তু চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।

হিয়ার অবস্থা তিনি নাজে হাল করে ফেলেছেন। হিয়া ঠোঁট কামারানো নিয়ে বলেছেন,” এমনে ঠোঁট কামড়াও কি জন্যে? এইডা তো ভালা লক্ষণ না।”
হিয়া মনে মনে আতঙ্ক নিয়ে আছে আপাদত কারণ বুড়ির পাশে বসে আছে হিয়া। তখন থেকে বুড়িটা আজে বাজে কথা বলে যাচ্ছে।

” নাতি পুতনির মুখ দেখাইবা কবে? বিয়ার এতদিনেও একটা সুখবর দিতে পারলা না? তোমাগো তো আবার ডিজিটাল যুগ প্ল্যানিং করা লাগে। আমাগো দিনে এইসব অসিলো না। আমার তো সাতটা মাইয়া একটা পোলা। বুঝছো?”, বুড়ির কথা শুনে হিয়ার মরে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। মোট আটটা সন্ত্তান এই বুড়ির। আস্তাগফিরুল্লাহ, আর তিনটা বাকি রেখেছিলো কেনো? পুরো টিম বানিয়ে ফেলতো। নিজের মুখে অনেক কষ্ট সে হাসি ধরে বসে আছে।

বুড়ি আরো বললো,” তোমরা তো এই কালের পোলামাইয়া। এতো বাচ্চা নিতে চাও না। তয় চাইরের নিচে যাইয়ো না।”, বুড়ির কথা শুনে হিয়ার মাথা ঘুরাচ্ছে। চারটা বাচ্চা! ভেবেই ঘাম ছুটছে। এদের ভয় ডর নাই কিছু। এমন ভাব যেনো বাচ্চাগুলো তো উনি পালবে। এদের জন্যেই দেশের জনসংখ্যার এই দশা।

হিয়া কিছু বলতে পারছে না মুখে হালকা হাসি রাখার চেষ্টা করছে এতেও বুড়ি বলে বসলো,” ওমা হাসো কি জন্যে? এইসব কথায় হাসতে হয় না। শরমের কথা।” হিয়ার ইচ্ছে করছে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে পড়ে আর কত কি শুনতে হবে তাকে?

মানে কি অবস্থা! হাসা যাবে না, নড়া চড়া করা যাবে না, জোরে কথা বলা যাবে না, সে কি রোবট যে পাথরের মতন বসে থাকবে। এমনিতেও উল্টা পাল্টা কথা বলে মাথার সিস্টেম নষ্ট করে দিচ্ছে। কথাগুলো যদি আস্তে বলতো তাও হতো। এতো জোরে বলছে রহিমা খালা দূর থেকে ঠোঁট চেপে হাসছে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার।

বুড়ি আবার বললো,” একটা সময় আছে। এই সময়ে বাচ্চা না লইলে পড়ে সমস্যা হইবো।”, কথাটা শুনে হিয়ার বুকের ভিতরটা ধুক করে উঠলো। কিন্তু হটাৎ শুভ্রের আওয়াজে হিয়া সামনে তাকালো। শুভ্র কঠিন গলায় বুড়িকে বললো,” আপনাকে আমাদের নিয়ে এতো ভাবতে হবে। আপাদত আপনি উল্টা পাল্টা কথা বলে হিয়াকে ভয় দেখনো বন্ধ করুন।”

বুড়ি সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো করে ফেললো। হিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র কি সবটা শুনেছে? শুভ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি পড়াশোনা রেখে এইখানে কি করছো? উপরে এসো।”

হিয়া চুপটি করে বসে আছে। কি করবে সে? উঠে গেলে আবার বুড়িটা কি বলে? হিয়া চুপ করে রইলো। শুভ্র ভারী গলায় বললো,” হিয়া,আমি আসতে বলেছি।”
হিয়ার কাছে আর কোনো উপায় নেই। শুভ্রের পিছু পিছু তাকে যেতেই হলো। সবাই তাকেই রাগ দেখায় খালি। রুমে গিয়ে আবার জনাবের মেজাজ সহ্য করতে হবে। যদিও সে এই ব্যাপারে কোনো কথাই শুনতে চায় না। হিয়া রুমে এসে সঙ্গে সঙ্গে পড়ার টেবিলে বসে পড়লো। একমাত্র পড়ালেখাই তাকে বাঁচাতে পারে। শুভ্র কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। এপ্রনটা খুলে রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেলো সে। হিয়া যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কি যে যন্ত্রণা! হিয়া বসে বসে কিছুক্ষণ বইটা ঘাটলো। মাথায় এই মুহুর্তে তার কিছুই ঢুকছে না, বুড়ির কথাগুলো শুধু মাথায় ঘুরছে।

হিয়া ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো শুভ্র শাওয়ার সেরে বেরিয়েছে, শুধু ট্রাওজার পড়ে। গা বেয়ে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মতন পানি পরছে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে সামনে এসে পড়েছে। হিয়া একটা ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। উফফ লোকটা এইভাবে বের হয়েছে কেনো? সবাই মিলে তাকে মেরে ফেলার ধান্দা।

[ #চলবে ]

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৪১

হিয়া ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো শুভ্র শাওয়ার সেরে বেরিয়েছে, শুধু ট্রাওজার পড়ে। গা বেয়ে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মতন পানি পরছে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে সামনে এসে পড়েছে। হিয়া একটা ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। উফফ লোকটা এইভাবে বের হয়েছে কেনো? সবাই মিলে তাকে মেরে ফেলার ধান্দা।

হিয়া শুভ্রের দিকে তাকাবে না আর, বইয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হটাৎ পানির বিন্দু টপ করে তার কাধে পড়তেই হিয়া কেপে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে তাকিয়ে দেখে শুভ্র চেয়ার ধরে হালকা ঝুকে এসে তার বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আর পানির এই বিন্দু শুভ্রের চুল বেয়ে হিয়ার কাধে এসে পরেছে।

শুভ্র বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়াকে এমন হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বললো,” কি দেখছো?” হিয়া সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করে ফেললো। তারপর জড়ানো কণ্ঠে বললো,” আপনি এইভাবে দাড়িয়ে থাকলে আমি পড়বো কি করে?”

শুভ্র সরে আসতে আসতে বলল,” ইয়াহ, ক্যারি অন।” শুভ্র সরে দাড়াতেই হিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আজকে তার কিছুই পড়া হয়নি। সারাদিন ওই বুড়ির পিছনে সময় চলে গেছে। মুখে তো এত এত বড় কথা বলেছে কিন্তু করতে না পারলে এই মুখ সে দেখাবে কি করে? হিয়া প্রতিদিনের তুলনায় আরো বেশি সময় নিয়ে আজকে পড়লো। হিয়া টেবিল ছেড়ে উঠে দেখে শুভ্র আজও তার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

হিয়া শুভ্রের পাশে এসে শুয়ে পড়লো। হিয়ার ঘুম আসছে না, চাইলে আরো কিছুক্ষন পড়া যেতো কিন্তু শুভ্র ঘুমিয়ে পড়ায় তার একা একা লাগছে। টেবিল ল্যাম্পের নীল আলোয় শুভ্রের মুখে এসে পড়েছে। হিয়ার খুব ইচ্ছে করছে শুভ্রকে জাগিয়ে তুলে বলে, চলুন রাতের এই শহরের নির্জন রাস্তায় হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় এক সাথে হাঁটবো।

কিন্তু আবার মায়াও লাগছে হিয়া এগিয়ে এসে একদম কাছ থেকে দেখতে লাগলো শুভ্রকে। তারপর একটু সাহস করে এসে শুভ্রের গালে একটা কিস করলো। সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র চোখ মেলে হিয়ার দিকে তাকালো। হটাৎ শুভ্রকে চোখ মেলতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হিয়া ভয়ে ছিটকে সরে গেলো পরক্ষনেই রক্তিম বর্ন ছেয়ে গেল তার পুরো মুখে।

শুভ্র ভ্রু কুচকে উঠে বসলো, কিছুক্ষণ আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। তারপর চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করছিল সে। হিয়াকে লজ্জায় জড়সড় হয়ে বসে থাকতে দেখে শুভ্র মনে মনে হাসছে। তারপর ধীরে ধীরে হিয়ার দিকে ঝুঁকে আসতে লাগলো। হিয়া শাড়ির আঁচল খামচে ধরে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। শুভ্র কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বললো,” তুমি কি ঐ বৃদ্ধার কথা বেশি সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছো।” হিয়া বিস্ময় নিয়ে চোখ খুললো। তারপর লজ্জায় এদিকে সেদিন তাকালো। শুভ্র এটা কি বললো তাকে? এইবার হিয়ার নিজেকেই মারতে ইচ্ছে করছে কেনো যে সে এই বদ লোকটার কাছে গিয়েছে? লোকটার মুখে যা আসছে সেটাই বলে যাচ্ছে।

হিয়াকে লজ্জা পেতে দেখে শুভ্র আরো বললো,” যদিও বিষয়টা সিরিয়াসলি নিয়ে লাভ নেই, এখন তোমার পড়ার সময়। আর এমনিতেও এই মুহুর্তে আমার পক্ষে দুটো বাচ্চাকে সামলানো সম্ভব না। সো লেট দা মাদার গ্রওন আপ দেন উই উইল টক এবাউট ইট।” বলেই শুভ্র চোখে হাসলো।

হিয়া রাগে চোখ বন্ধ করে করছে। মানে কি বলতে চায় উনি? সে তো একেবারে খুবই অবুঝ বাচ্চা তাই না? তাকে বোঝাচ্ছে। মান সম্মান আর কিছু বাকি রইলো না তারপরও হিয়া ক্ষীণ স্বরে বলল,” একদম আজে বাজে কথা বলবেন না।” তারপর আরো বিড়বিড় করে বললো,” আমি আপনাকে এই মুহূর্ত থেকে বয়কট করলাম। বেশি ভাব দেখায় এই হনুমানটা। নিজের বরকে কিস করেছি, তাতেও তাকে এতো কথা শুনতে হচ্ছে। ঠিক আছে এনার ধারের কাছেও আমি আর যাবো না।” বলেই হুট করে চাদর মুড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে একপাশে শুয়ে পড়লো।

শুভ্র হা হয়ে রইলো, হটাৎ করে কি হলো বিড়ালটার? কোনো প্রতিবাদ করলে না,বেশী লজ্জা পেয়েছে নাকি!

⭐ সকালে শুভ্রের ঘুম ভেঙেছে রোদের কারণে। সকালের রোদটা একদম তার চোখের উপর এসে পরেছে। শুভ্র চোখ মুখ কুঁচকে ঘুম থেকে উঠে বসলো। উঠে বসে বিরক্তি নিয়ে জানালার দিকে তাকালো। পর্দা সরিয়েছে কে? পরক্ষনেই হিয়ার কথা মাথায় আসলো তার। শুভ্র পাশ ফিরে তাকালো, হিয়া নেই। শুভ্রের কপালে একটা ভাজ পড়লো। এই মেয়েকে যা করতে নিষেধ করা হবে সে সেটাই করবে। শুভ্র এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। তারপর বালিশের পাশ থেকে নিজের চশমাটা পরে ফেললো।

শুভ্র নিজের ফোনটা হাতে নিয়েছিলো কয়টা বাজে সেটা দেখবার জন্যে কিন্তু তার আগে শুভ্রের চোখ পড়লো ড্রেসিং টেবিলের দিকে। শুভ্র এগিয়ে এসে আয়নার দিকে তাকালো, তাকাতেই চোয়াল শক্ত করে ফেললো সে। তার মুখে মার্কার দিয়ে গালের দুপাশে বিড়ালের মতোন তিনটা দাগ আর নাকের উপর একটা গোল আকা। শুভ্রর বিষ্ময়ের সীমা রইলো না। শুভ্র ফোনটা একপাশে রেখে বিরক্তি নিয়ে বলল,” হোয়াট ননন্সেন্স? আচ্ছা এই জন্যে তাহলে সকাল সকাল ঘর ছেড়ে পালিয়েছে!”

শুভ্র চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নীচে নেমে এলো। হিয়া রান্না ঘরেই ছিলো শুভ্রের উপস্থিতি বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হাসলো সে। আচ্ছা শিক্ষা দিয়েছে এই হনুমানটাকে। যদিও বিড়াল একেছিলো কারণ হনুমান কিভাবে আকে সে জানে না। জানলে ঠিকই হনুমান বানিয়ে আসতো।

হিয়ার একপাশে সাহারা খাতুন অন্যপাশে রহিমা খালা। হিয়ার মতে সে একটা সেফ জায়গায় আছে এতো চিন্তার কোনো কারণ নেই। এই লোকটা তার ধারের কাছেও আসতে পারবে না। শুভ্র এগিয়ে এসে তার মাকে কিছু একটা বলতেই সাহারা খাতুন চিন্তিত মুখে দোতলায় উঠে গেলো। হিয়া আড় চোখে তাকালো, কি বললো লোকটা?

শুভ্র আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলো তারপর রহিমা খালাকে বলল,” খালা আমার কাপড়গুলো আয়রন করা হয়নি। আমি ক্লিনিকের জন্যে বের হবো, একটু জলদি লাগবে।”

হিয়া কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। সব জামা তো আয়রন করাই আছে। আবার কিসের জামা আয়রন করবে রহিমা খালা। রহিমা খালা ব্যাস্ত হয়ে উপরে উঠে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে হিয়ার বুক ধুক করে উঠলো। সবটা শুভ্রের চালাকি বুঝতে পেরেই হিয়া আড় চোখে তাকালো। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে দাঁড়ালো। তারপর এক দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,” রূমে এসো। রাইট নাও ”

হিয়া শুভ্রের দিকে তাকালো পর্যন্ত পা টিপে টিপে এক কোনায় চলে গেলো। তারপর নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। হিয়া শুভ্রকে এড়িয়ে যাওয়ায় শুভ্রের রাগ আরো বাড়লো।

হিয়া চিনির বক্সটা নেওয়ার জন্যে পায়ের পাতায় ভর করে হাত উচু করলো। তারপর অনেক কষ্টে বক্সটা নামালো। তারপর চায়ে চিনি দিয়ে বক্সটা উপরে রাখতে যাবে শুভ্র হাত বেড়িয়ে বক্সের ঢাকনা খুলে নিতেই হিয়ার সারা গা চিনিতে ভরে গেছে। হিয়া শুভ্রের এমন ব্যাবহারে দাতে দাত চেপে রাগ সামলালো। শুভ্র বক্সের ঢাকনা একপাশে রেখে নিজের রুমে চলে গেল।

হিয়ার রাগে গা জ্বলছে। অসভ্য লোক একটা। সব সময় যা বলবে সেটাই করতে হবে তার।
রহিমা খালা কোনো জামা না পেয়ে ফিরে এলেন। এসে হিয়ার এই অবস্থা দেখে বললো,” ওমা ওমা, কি হইসে? ব্যাথা পাইলা নাকি?”

হিয়া গা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,” কিছু হয় নাই খালা।তুমি একটু থাকো আমি আসছি।” বলেই হিয়া কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। সারা গা চিটচিটে করছে। অসভ্য ডাক্তার একটা। হিয়া ভ্রু কুঁচকে রুমে এলো। শুভ্রের চোখে বিজয়ের হাসি। শেষমেষ লোকটার ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে রুমে আসতেই হলো। হিয়ার রাগে ফুলতে ফুলতে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। তোয়ালে নেওয়ার সময় হিয়া নিজের জামা নিতে ভুলে গেছে। শুভ্র বিষয়টা খেয়াল করে ঠোঁট চেপে হাসলো।

হিয়া অনেক্ষন সময় নিয়ে গোসল করলো। গোসল ছেড়ে বের হয়ে যেনো তাকে শুভ্রের মুখোমুখি না হতে হয়। হিয়া গোসল সেরে বুঝতে পারলো সে কাপড়ই আনে নি। কি ভয়াবহ অবস্থা! যদিও হিয়ার কেনো জানি মনে হচ্ছে এতোক্ষণে শুভ্রের যাওয়ার সময়ে হয়ে গেছে। হয়তো বেরিয়েও পড়েছে। হিয়া দরজা হালকা খুলে পুরো রুমটায় চোখ বুলিয়ে নিলো। নাহ্ নেই, উফফ বাঁচা গেছে। হিয়া তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হয়ে এলো। চুল বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। হিয়া রুমে এসেই দরজাটা বন্ধ করে ফেললো।

তারপর কাবাড খুলে ড্রেস বের করে পিছনে ঘুরতেই দেখলো শুভ্র নিচের স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়ার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সে তো দড়জা আটকে দিয়েছিলো তাহলে শুভ্র কি করে ভিতরে এলো। তাহলে কি শুভ্র বারান্দায় ছিলো?

হিয়া একটা ঢোক গিলে কাবাডের সাথে মিশে দাড়িয়ে রইলো। শুভ্র আস্তে আস্তে হিয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই হিয়ার বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো। শুভ্র হিয়ার কাছে এসে ঝুকে দাড়ালো। হিয়া তোয়ালে শক্ত করে ধরে মাথা নিচু করে রইলো। শুভ্র দূরত্ব কমিয়ে হিয়ার কাছে চলে আসতেই হিয়ার নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। শুভ্রের তপ্ত নিশ্বাসে তার শরীর শিউরে উঠছে। এমন নিরবতায় প্রচুর অসস্তি হচ্ছে হিয়ার।

হিয়া কিছু বলার আগেই শুভ্র একদম কাছে চলে এলো। দুজনের মাঝে ছিটে ফোঁটা দুরত্ব নেই। হিয়া একবার শুভ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে, চোখ সরিয়ে নিলো। শুভ্র যেনো এক ঘোরের মধ্যে আছে। শুভ্রের চোখে সেটা স্পষ্ট। শুভ্র হিয়ার মুখের কাছে মুখ আনতেই হিয়া চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। কিন্তু হটাৎ শুভ্রের ফোন বেজে উঠলো।

শুভ্র ভ্রু কুচকে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে ধরলো। হিয়া আস্তে করে একটা চোখ খুলে তাকালো শুভ্রের দিকে। শুভ্র ফোনের ওপাশে থাকা লোকটাকে বললো,” আই উইল বি লেট টুডেয়।”

শুভ্রের কথাটা কর্নগচর হতেই হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। লেট হবে মানে? কি করতে চাইছে এই লোকটা? শুভ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে কল কেটে ফোনটা পকেটে ভরে কাবাডের দুপাশে হাত রেখে ঝুকে এলো।

[ চলবে]