#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_১১
#লেখনীতে_শুভ্রতা
প্রায় ১৮ বছর আগের কথা!
আমার ডেলিভারির ডেট তখনও একমাস পর। আয়শা ভাবি, অভ্র আর আমি গিয়েছিলাম গ্রামে ভাবির দাদাবাড়িতে ওনার অসুস্থ দাদিকে দেখতে। সেখান থেকে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আমরা বাড়ি ফেরার রওনা হলে গাড়ি পাওয়ার আগে রাস্তাতেই আমার পেইন শুরু হয়। ডেলিভারি পেইন এ আমার তখন ছটফট করছি কাঁটা মুরগির মতো। ভাবি দিশেহারা হয়ে পড়েন। ভেবে পান না কি করবেন। অনেক খুঁজে একটা ভ্যান পাওয়া যায় কিন্তু ভাড়া চেয়ে বসে অনেক। তখন অত কিছু ভাবার সময় ছিলো না তাই ভাবি ওই অবস্থাতেই ছোট্ট অভ্রকে কোলে নিয়ে আমাকে ভ্যানে করে নিয়ে যান কাছের একটা হাসপাতালে।
ডাক্তার ডেকে বেডে দেওয়া হয় আমাকে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়ায় তেমন সমস্যা হয় না। জন্ম নেয় আমার মেয়ে। আমার মেয়ে বলার কারণ আমার স্বামীর মেয়ে পছন্দ ছিলো না। এমনকি তিনি আমাকে একথাও বলে দিয়েছিলেন যে যদি আমি কন্যা সন্তানের জন্ম দিই তবে তিনি আমাকে তালাক দেবেন। আমি তখন চরম দোটানায়। এক দিকে মা হওয়ার সুখ তো অন্য দিকে সংসার হারানোর ভয়। বুঝতে পারছিলাম না কিছুই। ভাবি তখন ভাইদের সাথে বাইরে কথা বলছেন। তখনও কেউ জানেন না আমার সন্তান মেয়ে না ছেলে! হঠাৎ চোখ যায় পাশের বেডে। এক মহিলা অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছেন তার পাশে একটা ছেলে। সম্ভবত আজই জন্ম নিয়েছে।
সেখানকার যে নার্স আমাদের দুজনের দেখাশোনা করছিলো তাকে অনেক কষ্টে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করাই। আর তারপর… তারপর ছেলেটা হয়ে যায় আমার আর মেয়েটা হয়ে যায় সেই অচেতন মহিলার। সেই নার্স আর আমি ছাড়া দুনিয়ার কোনো মানুষ জানতে পারে না এই ঘটনা। সারা দুনিয়া জানে নয়না আকশার পিয়াল চৌধুরী নামে এক পুত্রের জন্ম দিয়েছেন।
এই ঘটনার পর থেকে প্রায়ই আমার বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে পড়তো। মন কাঁদতো তার জন্য কিন্তু কিছু করার ছিলো না। আমাকে আমার সংসার বাঁচাতে হতো যেকোনো মূল্যে। সেই মূল্য হিসেবেই নিজের মেয়েকে অন্যের কোলে ছেড়ে এসেছিলাম। এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না বা হয়তো ছিলো কিন্তু আমি পাইনি। এরপর আমি স্বামী সন্তান নিয়ে আমেরিকাতে পাড়ি জমাই। ভালোই চলছিল আমার মেয়ের বিনিময়ে টিকিয়ে রাখা সংসার।
১৩-১৪ বছর আগে হয়তো!
রওনক ভাইয়া ব্যাবসার কাজে ওই গ্রামেই গিয়েছিলেন। ব্যাবসার কাজ শেষ করে নৌকা করে নদী পাড়ি দিয়ে অন্য একটা গ্রামে যাচ্ছিলেন কিছু দরকারে। মাঝ নদীতে নৌকা ঝড়ের কবলে পতিত হয়। চারপাশে আঁধার ঘনিয়ে আসছিলো। তখন হঠাৎ মাঝি কিছু একটা দেখে চিৎকার করে ওঠে। ভাইয়া চেয়ে দেখেন কলা গাছ ধরে ভেসে থাকতে চাইছে একটা তিন থেকে চার বছর বয়সি বাচ্চা মেয়ে। অবাক হন ভাইয়া। এই মাঝ নদীতে মেয়েটা এলো কীভাবে? তারপর মেয়েটাকে সেখান থেকে নিজের সাথে নিয়ে আসেন বাড়িতে। বড় ভাবি মারা গিয়েছিলেন তার ছয় বছর আগে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে। মা বাচ্চা দুজনের কেউই বাঁচেনি। তারপর ভাইয়া ছোট ভাইয়ার পরিবার নিয়েই ছিলেন। ভাইয়ার জীবনে আলো হয়ে আসে বাচ্চা মেয়েটা। মেয়েটার গলায় একটা লকেট সহ চেইন ছিলো। যার ওপর লেখা ছিলো নীলাঞ্জনা। হয়তো মেয়েটার নাম। তখন থেকে সেই মেয়েটা বেড়ে উঠতে থাকে আকশার বাড়ির ছোট মেয়ে হিসেবে।
নীলাঞ্জনা মেয়েটার কথা ভাইয়ার কাছ থেকে ফোনে শুনলেও তাকে কখনো দেখা হয়নি আমার। দেখলে হয়তো আরো আগেই বুঝতে পারতাম এই নীলাঞ্জনাই আমার সেই বিনিময় করা মেয়ে যে কিনা দেখতে হয়েছে আমারই মৃত ননদের মতো।
এটুকু বলে থামেন নয়না আকশার। চেয়ে দেখেন নিজের স্বামী পলাশ চৌধুরী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন তার মুখপানে। হয়তো ভেবে চলেছেন এসব কি বলছেন তার স্ত্রী? ওই মেয়েটা তার নিজের মেয়ে? চৌধুরী বাড়ির মেয়ে? তাহলে এতদিন আদর যত্নে যে পিয়ালকে বড় করলো সে তার কেউ না? এগুলো সত্যি? পলাশ চৌধুরীর খুব করে চান এগুলো যেন স্বপ্ন হয়। সে ঘুম ভেঙেই দেখবে আশেপাশের সব আগের মতো। পিয়াল তারই সন্তান। তার মৃত বোনের মতো দেখতে কোনো মেয়ে নেই। কিন্তু আফসোস! তা হয় না। এ যে কঠিন এক বাস্তব। তার অযৌক্তিকতার কাছে হেরে গিয়ে নয়না তারই সন্তানকে বিনিময় করেছে বহু বছর আগে। আর এই কঠিন সত্যটাই এখন পলাশ চৌধুরীর দরজায় এসে কড়া নেড়েছে। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়েন তিনি। স্ত্রী নয়না ধরতে আসলে তাকে ইশারায় বারণ করেন।
নয়না আকশার স্বামীকে তার মতো একা ছেড়ে দেন। যখন তিনি বেলকনি থেকে রুমে আসেন তখন দেখতে পান দরজা থেকে একটা ছাঁয়া সরে গেলো। কিন্তু বাইরে গিয়ে কাউকে দেখতে পান না। প্রচন্ড ক্লান্ত থাকায় শুয়ে পড়েন তিনি। পলাশ চৌধুরী ঠিক বাস্তবতাকে মেনে নিজেকে সামলাতে পারবেন। হয়তো সময় লাগবে কিন্তু পারবেন তিনি। এটা নয়নার নিজের স্বামীর প্রতি বিশ্বাস।
নিজের বোনকে অতিরিক্ত ভালোবাসতেন পলাশ চৌধুরী। তার একমাত্র বোন পড়শী। কলেজে উঠতে না উঠতেই পলাশের কানে আসে তার বোনের প্রণয়ের কথা। মেনে নিতে পারেন না তিনি আদরের বোনের এমন অধঃপতন। বাবা না থাকায় পরিবারের সবকিছু সে নিজেই সামলাতো। দেরি না করে কলিগের সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেলেন বোনের। বোন পড়শী ভাইয়ের এমন শাসন মানতে না পেরে করে বসে আত্মহত্যার মতো ভুল। সেই থেকেই মেয়ে অপছন্দ ছিলো পলাশ চৌধুরীর। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন সবাই এক না এবং ভুল তারও কিছু ছিলো। তবে তা বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে এখন। তার সন্তান শুধু মাত্র তার এই ভ্রান্তির জন্য অন্যের পরিচয়ে বেড়ে উঠেছে। সে নিজেও পরের সন্তানকে নিজের ভেবে এসেছে এতদিন যাবৎ। ডুকরে কেঁদে ওঠেন পলাশ চৌধুরী।
রওনক আকশারের সামনে বসে আছে মহু। দৃষ্টি তার বাবাই এর মুখ পানে। খাওয়া শেষে বাবাই তাকে নিজের রুমে ডেকেছিলেন। মহু আসতে একটু দেরিই করেছে বটে কিন্তু এভাবে চুপচাপ বসে থাকতেও বিরক্ত লাগছে। অনেক ভেবে মুখ খুললো সে।
“বাবাই তুমি ডেকেছিলে।”
মহুর কণ্ঠ পেয়ে চোখ তুলে তাকান রওনক সাহেব। কিছুক্ষণ ভেবে বলেন
“তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো মামনি।”
আশ্চর্য হয় মহু। বাবাই কবে থেকে তার সাথে কথা বলার আগে এত ভাবতে শুরু করেছে। কই আগে তো এমন দেখেনি কখনো। তবে আজ কি এমন বলবে বাবাই? কৌতূহল দমাতে পারে না মহু।
“হ্যাঁ বাবাই বলো না। এত সংকোচ করছো কেনো?”
কিছু একটা ভাবেন রওনক সাহেব। অতঃপর বলেন
“আমি চাই তুমিও তোমার অভ্রদার মতো ইন্টেলিজেন্ট এজেন্সিতে জয়েন করো।”
এটা তো মহুর নিজেরও স্বপ্ন। এতে এভাবে সংকোচ নিয়ে বলার কি আছে? নাকি আরো কিছু বলতে চাইছে বাবাই?
“তুমি কি শুধু এটাই বলতে ডেকেছো বাবাই?”
মহুর প্রশ্নে যেন কিছুটা ঘাবড়ে যান রওনক আকশার। অতঃপর নিজেকে ধাতস্ত করে এমন কিছু বলেন যাতে মহু পুরোপুরি হতোভম্ব হয়ে যায়।
অবাক হয়ে বলে মহু
“বাট বাবাই আমি সবে মাত্র ভার্সিটি ভর্তি হয়েছি।”
আরো কিছু বলবে তার আগেই থামিয়ে দেন রওনক সাহেব।
“আমি কিছু শুনতে চাই না নীলাঞ্জনা। আমি যা বলছি তাই করবে তুমি। চাকরির সাথে এটা নিয়েও ভাববে। এবং উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ হওয়া চাই। কোনো কিছু নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি শুধু নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করো।”
কিছু বলতে গিয়েও বলে না মহু। ছোট থেকে বাবাই তাকে বড় করেছে। কখনো কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। এখন সেই বাবাই এর কথা কীভাবে ফেলবে মহু? বাবাই অবশ্যই তার ভালোই চাইবে।
“ঠিক আছে বাবাই। তুমি যা বলবে তাই হবে। আমি প্রস্তুত তুমি ব্যবস্থা করো।”
মেয়ের কথায় তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে তার অধরে। অতঃপর হঠাৎ মনে পড়ে এই মেয়েটা তো তার নিজের নয়। যখন নীলাঞ্জনা জানতে পারবে রওনক সাহেব তার নিজের বাবা না এমনকি আকশার বাড়ির কেউই তার আপন না তখন কি অবস্থা হবে মেয়েটার? সামলাতে পারবে তো নিজেকে? সে তো মেয়েটাকে ভেঙে পড়া অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারবে না। বড্ড ভালোবাসে যে। নিজের সন্তানের চেয়ে বেশিই ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন তিনি নীলাঞ্জনাকে। সেই মেয়ের কষ্ট কীভাবে দেখবেন? অনেক ভেবে রওনক সাহেব সিদ্ধান্ত নেন নীলাঞ্জনা যে এ বাড়ির কেউ না তা আজীবন গোপন রাখবেন। জানাবেন না নীলাঞ্জনাকে। সে যেমন মহুয়া হয়ে বেঁচে আছে তেমনই থাকুক। তবু তো ভালো থাকবে। নাই বা থাকলো নিজের আসল বাবা মায়ের পরিচয়। সে তো আর জানছে না।
শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরের একটা জায়গা। এখান থেকে কিছুটা এগোলেই বিলের জমি শুরু হয়েছে। রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে রেখে একটা গাছের নিচে একে অপরের পিঠের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে দুই বন্ধু। দুজনের অন্তরেই বয়ে চলেছে দমকা হওয়া। নভ নাহয় পিয়াল আর নয়ন এর চেহারার সমীকরণ মেলাতে ব্যাস্ত কিন্তু অভ্র? তার কি হলো?
পিয়ালের কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে এসেছিলো নভর। এমন সময়ে বিকট শব্দে বেজে ওঠে মোবাইল নামক যন্ত্রটি। হাতে নিয়ে দেখে অভ্র। এত রাতে অভ্রর কল পেয়ে অবাক হয়ে পিক করে নভ। তাকে কিছু না বলতে দিয়েই অভ্র বলে সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। নভ যেন পাঁচ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হয়। এই রাতে মেসের বাইরে আসাটা সহজ ছিলো না কিন্তু তাও সম্ভব করেছে অভ্র আকশার। নব বুঝতে পারছে না এত রাতে অভ্র তাকে কেন এখানে নিয়ে এলো। আর এত চুপচাপই বা আছে কেন ছেলেটা? সে তো সবসময় হাসিখুশি থাকে! তাহলে হলো টা কি? ভেবে পায় না নভ।
চলবে…?
#নীলাঞ্জনা
#বোনাস_পর্ব (ফ্রম প্রাণ😁)
#লেখনীতে_শুভ্রতা
আকশার বাড়িতে লেগে আছে মানুষের ভিড়। সব জায়গা থেকে আত্মীয় স্বজন এসে বসে আছে বাড়িতে। উপলক্ষ বাড়ির দুই মেয়ের একসাথে বিয়ে। রওনক আকশার ও রেহমান আকশার এর মেয়ে রেহানা আকশার ও মহুয়া আকশার নীলাঞ্জনার বিয়ে ঠিক হয়েছে একই দিনে। ছোট মেয়ের বিয়ে আরো পরে হওয়ার কথা থাকলেও রওনক আকশার তা হতে দেননি। নিজের প্রিয় পাত্রর হাতে যত দ্রুত সম্ভব তুলে দিতে চাইছেন মেয়েকে। অজুহাত স্বরূপ বলেন তিনি বছর খানেকের জন্য দেশের বাইরে যাবেন। তখন যাতে মেয়ের তার ভাইয়ের পরিবার বা বাইরের কারো জন্য কোনো সমস্যা না হয় তাই এই বিয়ে। বাড়ির লোকজন এ কথায় মন খারাপ করলেও রওনক সাহেব তার সিদ্ধান্তে অটল। মহুরও কোনো সমস্যা নেই। তাই বিয়েটা হচ্ছেই।
মহু ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে দেখছে তাঁদের বাড়িতে লোকজনের সমাগম। এত লোক সব তার আর রেহানার বিয়ে উপলক্ষে। মহুর কেবল অবাক লাগে এই ভেবে যে সে এখনো তার হবু স্বামীকে দেখেনি এমনকি নামটাও জানে না। যদিও বাবাই বলেছিলো ছবি দেখতে, সে নিজেই দেখেনি। দেখে কি হবে? সেই বাবাই এর ইচ্ছে অনুযায়ীই তো সব হবে। তার দেখা না দেখা সমান। অজানা একটা মানুষের সাথে ঘর বাধঁতে চলেছে সে। অথচ বাড়ির সবাই সেই অজানা মানুষের সাথে তার বিয়েই তোড়জোড় নিয়ে ব্যাস্ত। অদ্ভুত! সমস্যা কি তার তো আর কোনো মনের মানুষ নেই! আচ্ছা আসলেই কি কেউ নেই? তবে যে লকেটে থাকা ছবির ছেলেটার চাহুনি তাকে খুব করে টানে। বাবাই বলেছিলো ঐটা অভ্রদা কিন্তু ওই চোখ জোড়া তো অভ্রদার চোখের মতো নয়। সেখানে তো নতুন কিছু খুঁজে পায় মহু। তবে সে দেখেছে ওই চোখ। অল্প সময়ের মাঝেই কিন্তু সঠিক মনে করতে পারে না। হবে হয়তো সবই তার মনের ভুল। ঐটা অভ্রদারই ছবি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহু।
রেহানা আর মহুকে অভ্রর সাথে বিয়ের শপিং এর জন্য যেতে বলেন রওনক সাহেব। সপ্তাহ খানেক বাকি বিয়ের অথচ এই মেয়ে দুটোর কোনো হুশই নেই! বেশ জোর করেই পাঠান। সাথে যায় পিয়ালও। শপিং মলে গিয়ে রেহানা নিজের মতো শপিং করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেও মহুর ধ্যান থাকে তার হাতে থাকা ফোনে। কেউই হয়তো ভাবতে পারে না যে একটা মেয়ে নিজের বিয়ের শপিং করতে এসে কিছু না দেখে গেমস খেলছে। অথচ ঠিক এই কাজটাই করে চলেছে মিস আকশার। হঠাৎ কেউ একজন এসে একটা শাড়ি জড়িয়ে দেয় তার গায়ে। চেয়ে দেখে অভ্রদা মিষ্টি হেসে তাকিয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে একবার অভ্র তো একবার শাড়ির দিকে তাকায় মহু। নীল রঙা বেনারসিটায় বেশ মানিয়েছে তাকে। ধন্যবাদ দেয় অভ্রকে। অভ্রও সৌজন্যের হাসি দেয়। অতঃপর বাদবাকি শপিং শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে চার ভাইবোন।
বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে ড্রয়িং রুমে রেহমান, রওনক, আয়শা সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে। আপনাআপনি কপালে ভাজ পড়ে যায় তাঁদের। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে রওনক সাহেব কিছু বলতেই যাবেন এমন সময় দেখেন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে তার বোন নয়না। আর পেছনে পেছনে হেটে আসতে আসতে কিছু বোঝানোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে পলাশ সাহেব।
“নয়না বোঝার চেষ্টা করো। নীলাঞ্জনার বিয়ের তোড়জোড় চলছে বাড়িতে। এই মুহূর্তে তুমি এই কথাটা বলতে পারো না।”
স্বামীর কথায় খানিকটা রেগে যান নয়না আকশার।
“তোমার জন্য একবার আমি আমার মেয়েকে হারিয়েছি। এখন আমি চাই না অন্যের পরিচয়ে সে স্বামীর বাড়ি যাক। আজ আমি সত্যিটা বলবোই।”
আবারও বাধা দিতে চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন পলাশ চৌধুরী। সেদিন সবকিছুর পরে তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেও নয়না আকশার পারেননি নিজেকে সামলাতে। উসখুস করছেন নীলাঞ্জনার আসল পরিচয় সবার সামনে বলার জন্য। কিন্তু হঠাৎ রওনক সাহেব নীলাঞ্জনার বিয়ে ঠিক করে ফেললে স্ত্রীকে বাধা দেন পলাশ সাহেব। এরকম আনন্দের মধ্যে এসব না বলাই ভালো। আর যেখানে রওনক সাহেব ছোট থেকে মানুষ করেছেন নীলাঞ্জনাকে সেখানে রওনক সাহেবের সামনে তাঁদের বাবা মা হয়ে দাঁড়ানো নিতান্তই ঠুনকো ব্যাপার বলে মনে করেন তিনি। কেবল জন্ম দিলেই যে বাবা মা হওয়া যায় না একথা তো সত্য। এগুলো বলেই এতদিন স্ত্রীকে দমন করেছিলেন পলাশ সাহেব কিন্তু আজ আর শেষ রক্ষা হলো না। নয়না তার বারণ না শুনেই সব বলতে প্রস্তুত।
নিচে নেমে এসে স্বামীকে অগ্রাহ্য করে ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে যান নয়না। অতঃপর বলেন
“ভাইয়া আমি তোমাদের কিছু বলতে চাই।”
এবার শেষ চেষ্টা চালান পলাশ সাহেব।
“আজ না বললেই নয় নয়না?”
স্বামীর কথা কানে নেন না তিনি। রওনক সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেলেন। কৌতূহল জাগে বাকিদেরও। রওনক সাহেব গম্ভীর ভাবেই বলেন
“এত হেয়ালি না করে কি বলবি সোজাসুজি বলে দে। বাড়ির দুই মেয়ের বিয়ে, অনেক কাজ আছে সবার।”
“আসলে ভাইয়া নীলাঞ্জনা বা মহুয়া আমার আর পলাশের মেয়ে।”
এ কথা শুনে অভ্র আর পলাশ সাহেব বাদে সকলে একসাথে বলে ওঠে
“মানে?”
অতঃপর একে একে সব খুলে বলেন নয়না। ধপ করে সোফায় বসে পড়েন রওনক সাহেব। মহুর চোখ ছলছল করে ওঠে। এসব কি শুনছে সে? বাবাই তার আসল বাবাই না? ফুপ্পির হাসবেন্ড তার বাবা? তাহলে সে এখানে কীভাবে? নাকি সব মিথ্যে? রওনক সাহেবের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে। করুণ কণ্ঠে সুধায়
“ফুপ্পি এগুলো মিথ্যে বলছে তাই না বাবাই? আমার বাবাই তো তুমি বলো। এনারা কেনো আমার বাবা মা হবেন বাবাই বলো। আমি তো তোমার মেয়ে। মহুয়া আকশার। তোমার প্রিন্সেস নীলাঞ্জনা। বলো বাবাই। কি হলো বাবাই কিছু বলো তুমি।”
কাঁদতে কাঁদতে বলা মহুর কথা গুলো শুনে সকলের চোখ ভিজে ওঠে। নয়না আকশার তাকে তুলতে গেলে সে বাধা দেয়। আয়শা বেগম এগিয়ে এসে সালমান মহুকে। সবার নজর এখন রওনক সাহেবের দিকে। মহু তো এই আশায় আছে যে তার বাবাই বলবে এসব মিথ্যে। সে শুধু ওনার মেয়ে, নিজের মেয়ে। কিন্তু তা আর হয় না। রওনক আকশার নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খোলেন।
“দেখো নয়না তুমি যে নিজের মেয়েকে এভাবে অন্যের কাছে ছেড়ে তাঁদের ছেলেকে নিয়ে গেছো সেটা কেউই জানতো না। এরপর ভাগ্যক্রমে নীলাঞ্জনা আমার কাছে আমার মেয়ে হয়ে এসেছে। এখন হুট্ করে তোমার দরদ জেগে উঠলো, তুমি এসে তাকে চাইলে আর আমি দিয়ে দিলাম। এরকম ভেবে থাকলে ভুলে যাও তা। নীলাঞ্জনা আমার মেয়ে হিসেবে বড় হয়েছে, আমার মেয়েই থাকবে। কিছু দিন পর নভর সাথে তার বিয়ে। এখানে আমি আর কিছু শুনতে চাই না। যে যার কাজে চলে যাও এখন।”
কথা গুলো বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যান রওনক সাহেব। এদিকে নভ নামটা শুনে দুজন চমকে ওঠে। অভ্র আর নীলাঞ্জনা দুজনেই মনে মনে নামটা আওড়াতে থাকে। কেউ অবাক হয়ে তো কেউ অমীমাংসিত ভাবনার মীমাংসা পেয়ে। তারপর দুজনেই চলে যায় যার যার ঘরে।
এতক্ষণে নয়না আকশারের মনে পড়ে পিয়ালের কথা। তাকে আশেপাশে দেখা কেনো যাচ্ছে না? চিন্তিত হয়ে পড়েন নয়না। নিজের ছেলে না হলেও ছোট থেকে তাকে নিজের ছেলের মতোই তো মানুষ করেছেন। ওনার কথায় কষ্ট পেয়ে চলে গেলো না তো ছেলেটা? গেলোই বা কোথায়? স্বামীকে বলতে গিয়েও সাহস পাননা। পলাশ তো বারণ করেছিল বাড়াবাড়ি করতে। তিনিই শোনেননি। এখন কোথায় খুঁজবেন পিয়ালকে? মস্ত বড় ভুল হয়ে গেলো।
নভ চলে এসেছে তার গ্রামের বাড়ি। এখান থেকেই বরযাত্রী যাবে। নভর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না যে তার নীলময়ীর সাথে বিয়ে হচ্ছে। প্রচন্ড রকম অবাক সে। আবার তার বাড়ির লোকও অবাক নীল বেঁচে আছে সে কথা শুনে। আয়রা বেগম আর আনোয়ারা বেগম তো অস্থির হয়ে আছেন কখন নীলকে দেখবেন। তাঁদের সেই ছোট্ট নীল যে কিনা আধো আধো বুলিতে সবার সাথে কথা বলতো তার বিয়ে! ভাবা যায়?
চলবে…?