#নীলাদ্রি
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_Nazia_Shifa
” চৌধুরীর বাড়ির খবর জানিস! ”
হড়বড়ানো কণ্ঠে করা উক্তি, নীলিমা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
” না কী হয়েছে? ”
” সীমান্ত ভাই যে বিয়ে করে বৌ নিয়ে এসেছে..! ”
নীলিমা থমকে যায়, ঝটকা যেন সামলাতে পারে না, থ হয়ে যায়। তার এহেন অভিব্যক্তিতে তন্নি ঘাবড়ানো কণ্ঠে বলে,
” কিরে, তোর কী হলো? ”
সম্বিত ফিরে পায় নীলিমা, হকচকানো কণ্ঠে বলে,
” কি..কিছুনা, আমি যাই একটু তাড়া আছে রে। ”
নীলিমা একপ্রকার দৌড়েঁ বেরিয়ে আসে তন্নীদের বাড়ি হতে। পাছে তন্নী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে।
চৌধুরী বাড়ির মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা। বুকের ভিতর তার হাহাকারের স্তূপ জমেছে। ভেতরটা ভেঙেচুরে গুড়িয়ে যাচ্ছে। অবাধ্য মন বারবার বলছে,
” এটা স্বপ্ন হোক, তন্নীর দেয়া খবরটা মিথ্যে হোক। ”
কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সীমান্তর মা নীলিমাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ডাকলেন। নীলিমা এগিয়ে গেলো গুটিঁগুটিঁ পায়ে। কুশলাদি করে হাসনা বেগমই বললেন,
” সীমান্ত টা যে কী করলো! ও এ বাড়ির একমাত্র ছেলে আর এভাবে বিয়ে করলো! তোর চাচা তো রেগেমেগে শেষ। একটু শান্ত হয়েছে এখন। গ্রামে তার মান আছে, লোকে নানান কথা বলবে। এখন বলেছে বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান করবে। তোদের বাড়িতে মনে হয় আজই যাবে দাওয়াত করতে। অনেক কাজ নীলু, আয় তো হাত লাগা কাজে। ”
নীলিমা জোরপূর্বক হেসে পিছু নেয় হাসনা বেগমের।
।
।
মুনতাহা..সীমান্তের সদ্য বিয়ে করা বৌ। দেখতে ভারি মিষ্টি। খাড়া নাক, ডাগর ডাগর চোখ, গায়ের রঙ ও ফর্সা। এই রূপেই বুঝি আটকেছে সীমান্ত! রূপ তো তারও ছিল, সেই রূপে ও তো আটকেছিল সীমান্ত। মোহ কেটে গেছে বুঝি! এইজন্য তার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করে এনেছে! সুদর্শন ছেলেদের সুবিধা বোধহয় এতেই। মেয়ের অভাব হয়না। নীলিমা একরাশ অভিযোগ, অভিমান আর তাচ্ছিল্য নিয়ে ছাদেঁ এলো। ছাদেঁর রেলিং ঘেষেঁ দাঁড়িয়ে ছিল সীমান্ত। একসময় যাকে প্রিয় মানুষ মানতো, ভালোবাসতো।
“ভালোবাসতো!” এখন কি ভালোবাসে না?
নারী মনে ধোকার মত জঘন্য আঘাত লাগলে নাকি সে কঠোর হয়ে যায়, অনুভূতি কী কাজ করা বন্ধ হয়ে যায় মানুষটার প্রতি? উত্তর পায় না। সে এগিয়ে যায়, তীর্যক হেসে বলে,
” মুনতাহা কিন্তু দেখতে সুন্দর। ”
সীমান্ত পিছনে ঘুরে, তার মুখের অভিব্যক্তি শূন্য।
নীলিমা আবার বলে,
“এভাবে বিয়ে করলেন কেন, ধুমধাম করেই করতেন! ”
মুখ খোলে সীমান্ত, নিচু কণ্ঠে বলে,
“আমি বিয়ে করতে চাইনি এভাবে। মুনতাহার মা-বাবা চাপ দিচ্ছিলেন না হয় ওকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিতেন। ”
” ভালো করেছেন তো। ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে গেলে যে কষ্ট হয় সেটা সহ্য করতে পারতেন না। ”
” আ’ম সরি নীলিমা। ”
” এমনটা না করলেও পারতেন সীমান্ত ভাই, আমি তো বলিনি আমাকে ভালোবাসতে! ভালোবাসার নাটক করলেন কেন! কেন ধোকাঁ দিলেন? ”
এতক্ষণের আটঁকে রাখা কান্নাদের বাঁধ ভাঙে যেন। সীমান্ত এগিয়ে এসে ধরতে যায় নীলিমাকে। ছিটঁকে দূরে সরে যায় নীলিমা। সীমান্ত-র দিকে আঙুল তাকঁ করে বলে,
” ছুঁবেন না আমায়। যাকে আগলে রাখতে আমায় ঠকিয়েছেন তাকে দেখে রাখবেন। ”
নীলিমা গটগট পায়ে নেমে যায় ছাদঁ থেকে। পিছু ফিরে তাকায় ও না। সীমান্ত যারপরনাই অবাক হয়, এত সহজে মেনে নিল নীলিমা!
এরপরের সময়গুলোতে সীমান্ত সামনে পড়লেও তাদের চোখাচোখি হয়নি, বাক্য বিনিময় হয়নি। সীমান্ত দিব্যি বৌ নিয়ে ঘুরেছে। নীলিমার চোখে পড়েছে সবই কিন্তু অভিব্যক্তি তার শূন্য ছিল।
।
।
” নীলাদ্রী ”
ফের একই সম্বোধনে নীলিমা বিরক্ত হয়ে পেছনে তাকায়। সীমান্তর বৌ ভাত অনুষ্ঠানের জন্য নীলিমারা তাদের বাসায় এসেছে স্ব পরিবারে। আসার পর হতেই সীমান্তর বন্ধু, শুভ্র নামক ছেলেটা পিছু নিয়েছে তার। তার ওপর এই অদ্ভুত সম্বোধন! উফফ! নীলিমা এবার ভেবেই নেয় কড়া কিছু শুনিয়ে দেয়ার কথা। পেছনে ঘুরে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই সামনে থেকে কেউ সুমিষ্ঠ স্বরে বলে ওঠে,
” নীলাদ্রী রাগলে আরও সুন্দর লাগে তোমায়। ”
” নীলাদ্রি ডাকেন কেন! ”
” নীলাদ্রি মানে নীল পর্বত, তোমার নামের মধ্যে একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে। আমার কাছে শান্তির রঙ নীল, তাই ডাকি। নীলাদ্রি নামটাও সুন্দর। ”
নীলিমা চুপ হয়ে যায়, কড়া কিছু বলার বদলে ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
” কী চান আমার থেকে? ”
” তোমার থেকে কিছু চাই না বরং তোমাকেই চাই। ”
” কেন চান! ”
” আমি সব জানি। ”
নীলিমা চমকে তাকায়,
” কী জানেন! ”
” নীলু..”
নীলিমা শক্ত কণ্ঠে বলে,
” সেজন্য সুযোগ নিতে চাইছেন, ভাঙা হৃদয় চাইলেই ঢুকে যেতে পারব, জায়গা নিতে পারব। এজন্য! ”
” ধোঁকা খেলে কারো কারো মন পূর্বের থেকেও শক্ত হয়ে যায় তখন অত সহজেই তার মনে জায়গা করা যায় না। তবে একবার জায়গা করে নিলে তার কঠিন ভালোবাসার হকদার হওয়া যায়। ”
” এত তাড়াতাড়ি ভালোবাসা হয়? ”
” বছরের সম্পর্ক ও তো শেষ হয়ে গেল! দুইদিন ৮ ঘন্টা ১৩ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড ধরে তোমার আশেপাশে ঘুরঘুর করছি। ভালোবাসা হতেই পারে। শোনো মেয়ে নীলিমা কে নীলু হতে নীলাদ্রী ডাকার অনুমতি চাই। সবসময়ের জন্য। দিবে অনুমতি? ”
নীলিমা নিরুত্তর রয়, কী বলবে ভেবে পায় না। তার অবস্থা শুভ্র ও বুঝতে পারে। একটু এগিয়ে এসে ক্ষীণ স্বরে বলে,
” আজকে ফিরে যাব ঢাকায়, যদি চাও তো তোমার একবার বলাতেই ফিরে আসব আবার। না হয় সব বাদ, শুভ্র নামে কেউ নেই, কাউকে চেনো না তুমি। ”
।
।
শুভ্র ঢাকা ফিরে গেছে আজ দুই সপ্তাহ, নীলিমা আটকায়নি তাকে, না বলেছে আবার ফিরতে। আর না পেরেছে এটা মানতে যে শুভ্র নামে কাউকে চেনে না সে। সে দোটানায় আছে। অবাধ্য মন, অস্থিরতা, মনের মধ্যে মন খারাপের স্তূপ সব মিলিয়ে ভারি বিড়ম্বনায় পড়েছে সে। ইদানীং মন তার অবাধ্য হয়ে গেছে, যাকে নিয়ে ভাবতে চায়নি তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্যঁ করেছে। বিরক্ত হয়ে নীলিমা ফোন হাতে নিল। অনলাইন হতেই নোটিফিকেশন আসলো মেসেঞ্জারে। মেসেজ রিকোয়েস্ট চেক করতেই যেন আকাশ থেকে পড়লো। একটা মেয়ের আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। মোটামুটি রচনা আকৃতিতে লেখা একটা মেসেজ। যার মূল কথা দাঁড়ায় এই যে শুভ্রর এক্সিডেন্ট হয়েছে। গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। দুইদিন যাবৎ হাসপাতালে ই ভর্তি। পুরো মেসেজ পড়ে নীলিমা এতটুকু বুঝতে পারে এই মেয়ে যেই হোক তার সম্পর্কে মোটামুটি ভালো ই জানে। শুভ্রর এক্সিডেন্টের কথা শুনে আতঙ্কে তার হাত পায়ে কাঁপন ধরে গেছে। কাঁপা কাঁপা হাতেই সে শুভ্রর নাম্বারে কল করলো। বুক ধুকপুক করছে তার। একবার, দুইবার, তিনবারের সময়ই ফোন রিসিভ করা হলো। সাথে সাথেই ওপাশ হতে কেউ বলে উঠলো,
” হেই সুইটহার্ট, কল করতে দেরি করে ফেললে যে! ”
নীলিমা হতভম্ব হয়, কণ্ঠ তার চেনা, শুভ্র ই তো! কিন্তু তার কণ্ঠ শুনে বোঝা যায় না সে অসুস্থ। নীলিমার থম মে/রে থাকার কারণ শুভ্রর জানা ই। সে উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
” কী ভেবেছিলে এক্সিডেন্ট হয়েছে, হসপিটালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছি। এমন কিছু! ”
নীলিমা বিস্ময় নিয়ে বলে,
” তাহলে এমন কিছু না? ”
” না তবে আমি অসুস্থ। ”
” কী হয়েছে? ”
” প্রেমরোগ হয়েছে আর আমি খবর পেয়েছি তুমিও সেই রোগে আক্রান্ত। ”
নীলিমা জিভ কামড়ে ধরে, প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
” মিথ্যা বললেন কেন! ”
” ভয় পেয়েছিলে বুঝি! ”
” মেয়েটা কে? ”
” কলিগ। ”
” প্রেমিকা হলে খুশি হতাম। ”
” প্রেমিকা চাই না আমার। নীলাদ্রী কে হালাল রূপে চাই। স্ত্রী হিসেবে চাই তোমায়, এই অসুখ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় তুমি। ”
” কিন্তু আমি চাই না আপনি এই অসুখ থেকে আরোগ্য
লাভ করুন। আমার সাথে সাথে আপনিও এই অসুখে আকণ্ঠ ডুবে থাকুন। ”
” কেউ কী কিছু মেনে নিল! ”
নীলিমা ঠোঁট এলিয়ে হাসে, শুভ্র সেই হাসি দেখতে না পারলেও বুঝতে পারে।
” হাসলে সুন্দর লাগে তোমায়। অনুমতি দাও এসে নিয়ে যাই একেবারে। ”
নীলিমা হাসি থামায়, কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার পর লাজুক কণ্ঠে বলে,
” অনুমতি দিলাম, নিয়ে যান, আগলে রাখবেন কিন্তু! ”
” যথা আজ্ঞা মহারানী। ”
কানে ফোন নিয়ে দুজন ই নীরব থাকে। নীলিমা লজ্জায় কথা বলতে পারে না আর শুভ্র তার নীলাদ্রি কে নীরব থেকে অনুভব করতে কথা বলে না।
চলবে।