নীলাদ্রি পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
260

#নীলাদ্রি
#লেখনীতে_Nazia_Shifa
#পর্ব_০২(অন্তিম)
______________________
সীমান্ত আর মুনতাহার মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে মনোমালিন্য চলছিল। সীমান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রবাসে আর যাবেনা। টাকা পয়সা যা ইনকাম করেছে তা দিয়ে দেশেই ব্যবসা করতে পারবে নাহয় চাকরি বাকরি করবে। পড়ালেখাও মোটামুটি তার। প্রবাস জীবন কারো ভালো লাগার বিষয় তো না। যেহেতু দেশেই কিছু করার সুযোগ আছে সেহেতু ওখানে পড়ে থাকার মানে হয় না। কিন্তু মুনতাহা এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেনি। অযথাই সব বিষয় নিয়ে ঝামেলা করছিল। এক পর্যায়ে সীমান্ত রাজি হয় সে যাবে কিন্তু বিপত্তি বাঁধে আরেকটা। সীমান্ত কে একা যেতে দিবে না মুনতাহা। সে নিজেও যাবে সাথে আর না হয় শহরে তার নামে ফ্লাট কিনে দিতে হবে একটা। সীমান্ত হতবাক হয় মুনতাহার এই রূপ নতুন দেখে। বিয়ের আগে তো মুনতাহা ই বলতো তার জয়েন্ট ফ্যামিলি পছন্দ। সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকলে তার ভালো লাগে। তাহলে! শশুর শাশুড়ী কে নিয়েই থাকতে পারছে না! বিয়ের প্রায় এক বছর পর তার কেন সমস্যা হচ্ছে!
গত কয়দিন ধরেই ঝগড়াঝাটি লেগে আছে। সীমান্ত ইতিমধ্যেই ঢাকায় ছোট একটা চাকরি পেয়েছিল। সপ্তাহে একদিন আসে গ্রামে দুইদিন থেকে চলে যায় আবার। মুনতাহা গ্রামেই থাকে শশুর শাশুড়ীর সাথে। সীমান্ত একটা মাত্র ছেলে তার বাবা-মায়ের। সে পারে না বাবা-মা কে একা গ্রামে রেখে শহরে থাকতে। মুনতাহা তা বোঝে না, তর্ক করে, ঝগড়া করে। সীমান্ত সেই অশান্তি তে বাড়িতে আসাও ছেড়ে দেয়। মুনতাহা কল করে, ব্যস্ত দেখালেই সন্দেহ শুরু করে। অযথা সন্দেহ। অথচ মুনতাহাকে কল দিলে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যস্ত দেখায়। সীমান্ত কথা বলতে নিলে ব্যস্ততা দেখায়। সীমান্ত দিন কে দিন অতিষ্ঠ হচ্ছে। মুনতাহা তাকে ভালোবাসে, সন্দেহ করার প্রশ্ন ওঠে না। তাহলে? সীমান্তর কেবলই আফসোস হয়। নীলিমার সাথে সে যা করেছে তা যে অনুচিত ছিল সে বুঝ তার হয়েছে। সে ভালোবাসত না নীলিমাকে। তবুও প্রশ্রয় দিয়েছে, বলেছে ভালোবাসি। এর দায় তো তার ই। নিজের এই ইচ্ছেকৃত ভুলের শাস্তি ই কী তাকে দিচ্ছে মুনতাহা! সীমান্তর তাই মনে হয়। এদিকে নিজের ভুল বোঝার পরেও নীলিমার কাছে ক্ষমা চাওয়া তো দূর তার সামনে অব্দি দাড়াঁতে পারেনি। সীমান্ত শুধু ই আফসোস করে। এছাড়া করার কিছু আছে?


নীলিমার ভগ্ন হৃদয়ে নতুন করে জুড়ে বসেছিল শুভ্র নামক ছেলেটা৷ নীলিমা ভুলেই বসেছিল সীমান্তর জন্য তার প্রেমময় অনুভূতি গুলো। শুধু আফসোস হয় ভেবে, সে অপাত্রে ভালোবাসা ঢেলেছে। তবুও ভাগ্য করে সে শুভ্রকে পেয়েছে। শুভ্র আসবে আজকে তার বাবা-মাকে নিয়ে। এই এক বছরে নীলিমা নিজের জন্য আসা সম্মন্ধ গুলো সে নাকচঁ করেছে। বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে হওয়ায় বিয়ে নামক এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দেয়নি নীলিমার বাবা এনামুল হক। তিনি মেয়ের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন।

নীলিমা অনার্স শেষ করবে বলে বিয়েটা আটকে রেখেছিলো। শুভ্রও সেইজন্য অপেক্ষা করছিল এতদিন। নীলিমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত মাসের ১২ তারিখ। এই মাসের ২৮ তারিখ আজ। শুভ্র নিজের বাবা-মাকে আগেই জানিয়েছিল নীলিমার কথা। নীলিমাও জানিয়েছে যে তার পছন্দ আছে। মেয়ে নিজে নিজে ছেলে পছন্দ করেছে সেটা নিয়ে নীলিমার মা জাহনা বেগম একটু রাগও করেছিলেন বটে। কিন্তু এনামুল সাহেব ঢাকায় যেয়ে শুভ্রর পরিবার খোঁজ নিলেন। সীমান্তর বাবা হতেও সব খবরাখবর নিলেন। সব শুনে জাহনা বেগমের রাগ কমলো। শুভ্ররা আসবে বলে সকাল থেকে তোড়জোড় চলছে। সীমান্তদের আসতে বলা হয়েছে। সীমান্তর বাবা নীলিমাকে অনেক স্নেহ করেন। মেয়ের এত গুরুত্বপূর্ণ দিনে তিনি থাকবেন না তা হয়না। এনামুল সাহেব স্ব-পরিবারে তাদের আসতে বলেছেন। মুনতাহা ও হাসনা বেগম সকালেই এসে পড়েছেন। মুনতাহাকে দেখেই বোঝা যায় সে বিরক্ত। আপাদত নীলিমার রুমে এসির নিচে বসে বসে ফোন টিপছে। নীলিমা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে তা দেখে। হাসনা বেগম কাজ করতে করতে ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যকার ঝামেলার কথা বলছেন জাহনা বেগম কে। । নীলিমা তার কিছুটা শুনেছে। একটু খারাপও লাগছে তার। সীমান্ত তার সাথে যা-ই করুক না কেন মা-বাবা নিয়ে সে উদাসীন না। তাদের না জানিয়ে বিয়েটা করেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছিল শুধু। নীলিমা নিজ রুম ত্যাগ করে। ছাদে যায়, শুভ্রকে কল করে। এসময়টাতে অফিসে থাকে ছেলেটা, তবে ছুটি নিয়েছে আজ। একবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো পুরুষালি কন্ঠ ভেসেঁ আসে,

” গুড মর্নিং, সুইটহার্ট। ”

নীলিমা লজ্জা পায়, কিঞ্চিৎ হাসে। পর মুহূর্তেই ক্ষেপা কণ্ঠে বলে,

” এখনো ঘুমাচ্ছেন! অফিস না থাকলেই এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে হবে! ”

শুভ্র শব্দ করে হাসে, বলে,

” বিয়ে না হতেই শাসন করছো! আমি তো ভাবছিলাম তোমার যে পরিমাণ লজ্জা! তাতে আমার বিয়ের পরেও কয়েক মাস ব্যাচেলর থাকতে হবে। ”

নীলিমা লজ্জা পায়, এতটাই লজ্জা পায় যে বলার মতো কিছু না পেয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। তার কান্ডে শুভ্রর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম।


শুভ্ররা নীলিমাদের বাড়িতে পোঁছেছে দুপুরের একটু আগে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া তাদের বাড়িতেই হয়েছে। সীমান্ত বাদে উপস্থিত ছিল বাকিরা। শুভ্র মা-বাবা আর ছোট বোন মাহিমা এসেছে। ছেলে মেয়ে তো তাদের আগেরই পছন্দ করা। দুই পরিবারের মধ্যে কথা চলছে। শুভ্রর বাবা হাসান সাহেব ও মা উর্মিলা বেগম চাচ্ছেন আজকেই এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখতে। ওনারা সেই আয়োজন মতোই এসেছেন। বিয়ে যেহেতু এখানে ই দিবেন সেহেতু আপত্তি করেনা নীলিমার পরিবার ও। সীমান্ত কে আসতে বলা হয়। সে রওনা হয়েছিল আগেই কিন্তু ঢাকা শহরের জ্যাম! জ্যামে পড়ে সে আসতে আসতে বিকেল গড়িয়েছে। সীমান্ত বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নীলিমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। হাসনা বেগম কল করেছিলেন তাকে। বলেছেন নীলিমার যে আজকে এনগেজমেন্ট হবে। সীমান্তর কেন জানি মন খারাপ হয়েছে, বুক ভার ভার লাগছে। পরমুহূর্তে নিজের ভাবনাকে ধিক্কার দিয়েছে। সে যা করেছে তার জন্য মেয়েটা কম কষ্ট পায়নি। এত কিছুর পর হয়তো মেয়েটা নিজের সুখ পেতে যাচ্ছে আর সে এসব ভাবছে! আকাশ পাতাল ভাবনার মধ্যে ই সীমান্ত পোঁছায় নীলিমাদের বাড়িতে। সদর দরজা খোলাই ছিল, ড্রয়িং রুমে অবস্থান ছিল সবার। সীমান্ত ভেতরে ঢুকে সালাম দিতে যাবে সেসময়ই চোখে পড়ে শুভ্রকে। থমকে যায় সীমান্ত, শুভ্র এখানে কেন! বিস্ময় ভাব না কাটলেও সে সালাম বিনিময় করে, কুশলাদি করে৷ বাবার আদেশে সে যেয়ে বসে কর্ণারের সোফা টাতে। শুভ্রর সাথে চোখাচোখি হয়নি তার। কথা বলার সুযোগ ও হয়নি৷ সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী সবার উপস্থিতি তে সন্ধ্যার দিকে শুভ্র আর নীলিমার আংটি বদল হলো।

গ্রাম থেকে শহরের দূরত্ব টা অনেক বেশি হয়ে যায়। বিয়ের অনুষ্ঠান তাই তেমন করে এখন করা হবে না। দুই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সামনের সপ্তাহে হলুদ আর তারপর বিয়ে। বিয়ের দুইদিন পর শহরে কোনো কমিউনিটি সেন্টারে দুই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রিসিপশন। শুভ্ররা আগামী কাল ফিরে যাবে শহরে।

শুভ্র যে নীলিমার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসবে সেটা সীমান্ত বাদে সবাই জানতো। শুভ্র ই নিষেধ করেছিল যেন সীমান্ত কে না জানানো হয়।


সীমান্ত এসেছিল নীলিমার সাথে একটু কথা বলতে। যা হয়েছে তার জন্য ক্ষমা চাইতে। ক্ষমা করুক না করুক সেটা নীলিমার ব্যাপার। কিন্তু কথা বলার সাহস হয়নি সীমান্তর। বেরিয়ে এসেছে সেখান থেকে। সদর দরজা হতে বেরোতেই পেছন থেকে শুভ্র ডেকে ওঠে,

” সীমান্ত, চলে যাচ্ছিস? ”

সীমান্ত পা জোড়া থামায়, হাসি টেনে পেছনে ঘুরে বলে,

” হ্যাঁ চলে যাচ্ছি। কাজ আছে তো। ”

শুভ্র এগিয়ে এসে বলে,

” একসাথে ই যাই। দাড়াঁ। ”

সীমান্ত দাঁড়ায়, শুভ্ররা আসলে একসাথে ই ফিরে।


সীমান্ত ক্লান্ত শ্রান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই মুনতাহা রুমে আসে। জিজ্ঞেস করে,

” কাজ হয়েছে? ”

সীমান্ত গোপনে তপ্ত শ্বাস ফেলে, আবারও সেই বিষয়! সে ইচ্ছুক না এই বিষয়ে কথা বলতে। কিন্তু মুনতাহা মানতে নারাজ। সে পুনরায় রুঢ় কণ্ঠে বলে,

” একটা কাজ দিয়েছিলাম সেটাও করতে পারো না। হ্যাঁ। অন্যান্য স্বামীরা নিজের স্ত্রীদের জন্য কত কী করে আর তুমি! কী করেছো আমার জন্য? ছোট একটা জিনিস চাইছি তাও দিতে পারো না! ”

সীমান্ত রেগে যায়, ঈষৎ চেঁচিয়ে বলে,

” অন্যান্য স্বামীদের স্ত্রীরা এমন হয় না। নিজের সুখের কথা চিন্তা করে তারা কোনো পরিবার ভাঙ্গে না নিশ্চয়ই! ”

” হ্যাঁ পরিবার ভাঙ্গছি, আমার এই পরিবার লাগবেনা।আমার সুখ চাই, বিলাসীতা চাই। অর্ধেক জীবন শহরে কাটিয়েছি বাকি জীবন ও শহরে কাটাবো। থাকব না গ্রামে। ”

ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে সীমান্তর, মুনতাহাকে মুখের ওপর ই বলে দেয়,

” থাকা লাগবে না, এমন স্বার্থপর নারী আমার লাগবে না। তার চেয়ে বরং আমি আজন্ম একা থাকব। ”

বলেই সীমান্ত রাগে হনহন করে বেরিয়ে যায় কক্ষ হতে। মুনতাহার চকচক করা আঁখি জোড়া নজরে আসে না তার।


রাত তখন নয়টার মতো। গ্রামে রাত নয়টা মানে অনেক কিছু। তবুও কালের পরিক্রমায় উন্নতি হয়েছে অনেক কিছুরই। ঘুটঘুটে অন্ধকার নেই, মাঝেসাঝে ই দুই একটা আলো দেখা যায়। মানুষের ও চলাচল আছে। হাতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে শুভ্র নেমেছে রাস্তায়। ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে সে এগোচ্ছে। নীলিমাদের বাড়িতে যাবে সে।


পা টিপে টিপে কোনোরকমে ছাঁদে উঠে এসেছে নীলিমা। ছাঁদের দরজা খুলতেই দেখা গেল একদম তার বরাবর ই দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র। শুভ্রর পড়নে হালকা ছাই রঙা টি-শার্ট। চোখে লাগে নীলিমার। দরজা খোলা রেখেই সে শুভ্রর হাত টেনে ছাঁদের অন্য পাশে নিয়ে যায়। এদিকটা আড়াল, চোখে পড়বেনা কারো। নীলিমা সাবধানী কণ্ঠে বলে,

” এত রাতে কেন এসেছেন! কেউ দেখে ফেললে! ”

শুভ্র ও ফিসফিসিয়ে বলে,

” কিছু দেয়ার ছিল, তখন দিতে মনে ছিল না। ”

নিজের হাতের ব্যাগটা নীলিমার হাতে দেয় শুভ্র। নীলিমা ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলে,

” পরে দিলেও হতো৷ এত রিস্ক নিয়ে ছাদেঁ কে উঠতে বলেছিল! ”

” কাল চলে যাব ঢাকায়। একটু দেখতে ও এসেছিলাম তোমায়। ”

” দেখা হলে যান এবার। ”

” যার জন্য এত কষ্ট করে স্পাইডার ম্যান হয়ে ছাদঁ বেয়ে এখানে আসলাম সে ই তাড়িয়ে দেয়। ”

মুখ লটকে কথাটুকু বলে শুভ্র, তার মুখ দেখে নীলিমা হেসে ফেলে। একটু এগিয়ে যেয়ে শুভ্র কে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে। ফিসফিসিয়ে বলে,

” দেখার জন্য সারাজীবন বাকি, অল্প কয়দিন ই তো মাত্র! ”

শুভ্র হাসে, একহাত নীলিমার পিঠের ওপর রেখে সুমিষ্ট স্বরে শোধায়,

” এরপর যেদিন একান্তে পাবো সেদিন একদম আমার কল্পনা করা নীলাদ্রি রূপে চাই তোমায়। ”



শুভ্ররা তার পরদিন ফিরে যায় শহরে। রাতে হওয়া ঝগড়ার জের ধরে মুনতাহা বাড়ি ছাড়ে পরদিন বিকেলেই। সম্পূর্ণ দোষ দেয় সীমান্তর ওপর। হাসনা বেগম আটকে রাখতে পারেন না। সীমান্ত ও যেতে দেয় তাকে। ছেলের বউয়ের দোষ জানা স্বত্তেও সীমান্ত কে বলেন মুনতাহাকে ফিরিয়ে আনতে। এ ও বলেন যে সীমান্ত যেন রাজি হয়ে যায় মুনতাহা যা বলছে তাই করার জন্য। সীমান্ত হু হা কিছু ই করেনা।

সীমান্ত ফিরে যায় ঢাকায়, ব্যস্ত হয় নিজের কাজে। খবর ও নেয় না মুনতাহার। মায়ের কথায় তার ও মনে হয়েছিল ফিরিয়ে আনবে কী? কিন্তু যৌক্তিক কোনো উত্তর সে পায়নি। সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, শুধু মনে হয়েছে তার জীবনে শান্তি দরকার যা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। বিরক্ত হয়ে সে ভাবাই বাদ দিয়েছে। তিন চারদিন নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। এতটাই কাজে ডুবিয়ে রেখেছে যেন কাজের উর্ধ্বে কিছু ই নেই। এই তিন চারদিনে মুনতাহা বা তার পরিবার যোগাযোগ করেনি একবারের জন্য ও।

গ্রামে হাসনা বেগমকে এদিকে কিছু মানুষ ইতিমধ্যেই জিজ্ঞেস করছেন, বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ হুট করেই বাপের বাড়িতে গেল কেন? তাও বিয়ে সামনে রেখে! হাসনা বেগম ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে চুপ করিয়েছেন। তবুও তারা কী আদৌও চুপ থাকার পাত্রী!


মেহেদী রাঙা হাতে ফুল, লতাপাতার মধ্যে ই লুকানো শুভ্র নামটা। নীলিমা এক দৃষ্টি তে নিজের হাতে লেখা সেই নামটার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেরুন রঙা শাড়িতে একদম সাদামাটা সাজেই তৈরি হয়েছে নীলিমা। ভারি সাজ তার এমনিতেও অপছন্দ আর বিয়েটাও তেমন জাঁকজমক ভাবে হচ্ছে না। শুধু নিয়মের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুর জন্য ই হলুদ ছোঁয়ানো হয়েছে শুভ্র কে। নীলিমার ও তাই।

এর মধ্যে ই নীলিমার ছোট চাচাতো বোন এসে বললো,

” আপু বর পক্ষ এসে পড়েছে। ”

বর পক্ষ এসে পড়েছে শুনে নীলিমার বুক ভারি হয়ে আসে সাথে চাপা উত্তেজনা ও অস্থিরতায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। একদিকে শুভ্র কে পাওয়ার খুশি অন্য দিকে বাবা মার থেকে দূরে যাওয়ার চিন্তা। দুইয়ে মিলে নীলিমা পারলে তখনই কেঁদে দেয়। সে কীভাবে থাকবে বাবা-মা কে ছাড়া! জাহনা বেগম রুমে এসে মেয়ের মুখশ্রী পরখ করেই আন্দাজ করে নিলেন তার ভেতরকার অবস্থা। নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। দু-চারটা কথা বলে বুঝিয়ে নিয়ে গেলেন ড্রয়িংরুমে।

মেরুন রঙা পাঞ্জাবি, তার ওপরে অফ হোয়াইট রঙা কোটি পড়েছে শুভ্র। নীলিমাকে নিয়ে বসানো হয় শুভ্রর সামনে রাখা সোফা টাতে। দুইজনের মাঝে ই লাল রঙা একটা পর্দা টানা। নীলিমাকে বসাতেই কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। অতঃপর সবার উপস্থিতিতেই নীলিমা আর শুভ্রর চার হাত এক হয়। একদিকে দুইজন প্রণয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয় অন্য দিকে কারো প্রণয়ের বন্ধনের ইতি ও ঘটে। সীমান্তর বুকের ভেতর অসহ্য রকমের যন্ত্রণা হয় যখন নীলিমা কবুল বলেছিল। তার কেবলই মনে হচ্ছিল জীবনের অন্যতম বড় ভুলটা তার হয়ে গিয়েছিল। নীলিমাকে সে সত্যি অর্থে ভালোবাসে তা সময় থাকতে বুঝলে এই পরিণাম হত না নিশ্চয়ই।


বিদায় পর্ব শেষ করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে শুভ্ররা৷ গাড়িতে নীলিমা অনবরত কান্না করছে আর শুভ্র টিস্যু এগিয়ে দিচ্ছে। তার কান্না দেখে এক পর্যায়ে শুভ্র বলেই ফেলে,

” এত কান্না কাটি দেখে মনে হচ্ছে আমি কপালে বন্দু/ক ঠেকিঁয়ে বিয়ে করেছি তোমায় আর এখন তুলে নিয়ে যাচ্ছি। ”

নীলিমা চোখ মুছতে মুছতে ই বলে,

” এসব বুঝবেন না আপনি, জীবনের এত গুলো সময় পর বাবা মা কে ছেড়ে যাওয়া কতটুকু যন্ত্রণার। ”

শুভ্র আর কিছু না বলে মাথা এলিয়ে দেয় সিটে। কিছু সময় পরই বাম বাহুতে স্পর্শ পায়। মাথাটা ঈষৎ উঁচু করে দেখে তার কাঁধে মাথা রেখে বাম বাহু জড়িয়ে ধরেছে নীলিমা। শুভ্র স্মিত হেসে জড়িয়ে ধরে নীলিমাকে। নীলিমাকে নীলু হতে নীলাদ্রি ডাকার অনুমতি সে পেয়েছে অবশেষে। আজকের দিনটা স্মরণীয়, মনে গেঁথে রাখার মতো। আজকের দিনের ছোট ছোট মুহূর্ত গুলো ও চিরস্মরণীয় হয়ে রবে।


সীমান্ত কে অনবরত কল করে যাচ্ছেন হাসনা বেগম। এতক্ষণ কেটে দিলেও এবার না পেরে কল তুললো সীমান্ত। হাসনা বেগম ফোন কেটে দেয়ার জন্য বকা ও দিলেন এরপর ই জিজ্ঞেস করলেন,

” মুনতাহাকে আনতে যাবিনা?

সীমান্ত গম্ভীর গলায় বললো,

” যাবনা, আমার জীবনে শান্তির অভাব আম্মু। মুনতাহাকে যদি ফিরিয়ে আনি তাহলে জীবনে ও শান্তি পাবো না। যে নারী তার স্বামী থাকতে অন্য পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠতা রাখে তাকে ফিরিয়ে আনব না। তাকে চাইনা। ”

হাসনা বেগম প্রায় কেঁদে ই দেন, ছেলেকে বোঝান। কিন্তু সীমান্ত কিছু ই শোনে না, বোঝে না। এতটুকু ই বলে,

” সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিয়েছি মা আর এটাই শেষ সিদ্ধান্ত। ”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সীমান্ত, হাসনা বেগম অযথাই কিছুক্ষণ কানে ধরে রাখেন ফোন। আপনমনে বলেন,

” যে যেমন করবে কর্মফল তো তেমনই হবে বাবা। ভুগতে তো হবেই। ”


সীমান্ত তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে প্রবাহিত ছোট্ট নদীর ধারে ঘাসের ওপর বসে আছে। সন্ধ্যা নামেনি এখনো, ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সীমান্ত এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে প্রবাহিত নদীর স্রোতের দিক। তার মনে পড়ছে বিদায় মুহূর্তে নীলিমার বলা কথাগুলো,

” আপনার জন্য আমার অনুভূতি ছিল, সেগুলো কে ছোট করেছেন আপনি। ঠকিঁয়েছিলেন আমায়। কিন্তু আপনি না ঠকাঁলে আমি শুভ্র কে পেতাম না। আমার ভালোবাসাকে অপমান করা মানুষটার জন্য আমি সেই মানুষটাকে পেয়েছি যে আমাকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে। আমার ভালোবাসা কে সম্মান করে। এর জন্য কৃতজ্ঞ থাকব সীমান্ত ভাই। আপনি যদি আপনার ভুল বুঝতে পেরে থাকেন তো ভালো নাহয় ভেবে দেখার দরকার নেই । ভালো থাকবেন আপনার মানুষকে নিয়ে। ”

নীলিমার কথার পর সীমান্ত ও চুপ থাকেনি। সে সুযোগে বলে দিয়েছে সে অনুতপ্ত সাথে শান্তির অভাবী। যার জন্য নীলিমাকে ত্যাগ করেছে সে অন্য কেউতে আবদ্ধ, অন্য কেউ তে মুগ্ধ। নীলিমা যারপরনাই অবাক হয়েছে কিন্তু বলার মতো কিছু ই নেই।

ভাবনা ত্যাগ করে সীমান্ত পকেট হতে ফোন বের করে একটা ছবি ওপেন করে। ছবিটাতে স্পষ্ট ই বোঝা যায় মুনতাহা আর তার সাথের ছেলেটার মধ্যে ঘনিষ্টতা কতটুকু। সীমান্ত কল করে কাউকে। বুঝিয়ে বলার পর কড়া গলায় আদেশ করে,

” যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স পেপার তৈরি চাই আঙ্কেল। ”

ওপাশ হতে হয়ত সম্মতি আসে, কল কেটে দেয় সীমান্ত। ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে লম্বা শ্বাস নেয়। হয়তো শেষ থেকে ই শুরু হবে কিছু, নতুন করে, নতুন উদ্যমে।

#সমাপ্