নীল বুনোলতা পর্ব-০২

0
209

#নীল_বুনোলতা ( ২)
লেখনীতে #রেহানা_পুতুল
ঊষালগ্নেই ঘুম ভেঙ্গে গেল লতার। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল মাত্র। আলস্যতার রেশ কাটতে ঘরের পিছনের আঙিনায় গিয়ে পা রাখল। তার প্রিয় ঋতু বর্ষাকালের ভেজা পরিবেশ প্রকৃতিজুড়ে। গাছের সবুজ সজীবতায় লতার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। কিছু নাম না জানা স্বেতশুভ্র ফুল দৃশ্যমান হতেই লতা পা টিপে টিপে সামনের দিকটায় এগিয়ে গেল। অনিন্দ্য সৌন্দর্যে মাখামাখি এই ফুল। লতা কিছু তাজা ফুল ছিঁড়ে নিল মুঠি ভরে।

লতার দৃষ্টিজুড়ে আটকে আসা চারপাশ দেখল অপলক নয়নে। মায়াময় শ্যামল প্রকৃতিতে ঘেরা সজীবদের বিশাল একা বাড়ি। বাড়ির চারপাশটা ছবির মত সুন্দর। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা অপরুপময় কোন চিত্রকর্ম। লতা মনে মনে ঠিক করল,একদিন শাশুড়ী মায়ের থেকে অনুমতিক্রমে পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখবে। সঙ্গী হিসেবে রাখবে চুমকিকে।

অদূরে লতায়পাতায় ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ একটি পরিত্যাক্ত বাগান দেখতে পেল লতা। সেদিটায় যাওয়ার সরু একটি পথ ও নজরে পড়ল তার। সে মাত্রই পা বাড়াল সেদিকে যাওয়ার জন্য আগ্রহান্বিত হয়ে । হঠাৎ কোন মেয়েলী কন্ঠস্বরের ডাক শুনে পা পিছিয়ে নিল লতা। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতেই চুমকির দেখা মিলল। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

ভাবিজান এইখানে কি করেন?

কিছুইনা। ফুলগুলো দেখেই আসলাম। তুমি কেন আসছ এদিকে চুমকি? আসো একটু গল্প করি তোমার সাথে।

চুমকি সন্তপর্ণে লতার নিকটে গিয়ে দাঁড়াল।

চোখেমুখে ভাবের রেশ এনে বলল,
আমি গরীব মানুষ। কামের মানুষ। কামের শরীর৷ সারা বাড়িতেই আমার কাম। বহুত কাম । আমি পুকুর থেইকা কলসী ভরতে আসছি। কিন্তু ভাবিজান আপনাকেতো এই সাতসকালে আমি আর দেখিনাই। তাহলে এদিকটায় আপনি আর আসেননাই?

আসিনাই। তাই দেখনাই। তারমানে তুমি রোজ এইসময় পুকুর থেকে রান্নার পানি নাও?

হুম নেইতো। এই পুকুরের পানি ম্যালা পরিষ্কার থাকে। অন্য পুকুরে কচুরিপানা আর শ্যাওলা থাকে। আচ্ছা গেলাম। আর কথা কওন যাইবোনা।

ও হ্যাঁ। তোমার তো আবার কাজের তাড়া রয়েছে। আচ্ছা তুমি অবসর হলে আমাকে জানিও চুমকি। তোমাকে নিয়ে পুরো বাড়ির সবকিছু ঘুরেফিরে দেখব।

চুমকি এগিয়ে নেওয়া পা দুটোকে ফের পিছনে নিয়ে আসে।
তা মনে হয় সম্ভব না ভাবিজান। আমিতো চইলা যামু কয়দিন পরেই।
কেন চলে যাবে চুমকি? অবাক চোখে জানতে চাইলো লতা।
ভাবিজানগো। এদের এত সুন্দর বাড়িটারে আমার কাছে আজব বাড়ি মনে হয় । খালি এই বাড়িটাই আজব নয়। এদের ঘরের মানুষগুলাও আজব কিছিমের। এদের ঘরে জ্বিন, ভূত আসা যাওয়া করে। আল্লার দোহাই লাগে আপনি আবার কাউরে এসব কইয়েন না। আপনিও একটু সতর্ক থাইকেন।ভীত চোখে বলল চুমকি।

ওমা! কি বলছ এসব? আমিতো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতেছিনা।

বুঝবেন সময় হলেই। বলেই ষোড়শী চুমকি চঞ্চল পায়ে পুকুর ঘাটের দিকে চলে গেল কলসী কাঁখে করে।

লতার চনমনে মনটা বিপুল খারাপ হয়ে গেল। সাথে সাথে তার ভিতরে অল্পস্বল্প অজানা আশংকা বিরাজ করল। শেষমেষ কিনা চুমকির থেকেও তার সতর্ক বাণী শুনতে হলো। সে চিন্তা করতে লাগল নিগূঢ়ভাবে। চুমকির বলা কথাটার সত্যতা পেল সে। আজব বাড়ি। আজব ঘর। সত্যিইতো। শুরুর দিকে না ধরতে পারলেও সপ্তাহ ধরেই লতা খেয়াল করছে একটা বিষয়। সজীবদের বাসার কেউ কারো সাথে খুউব বেশী কথা বলেনা। কিন্তু রহস্যটা কি। সবার যেন আলাদা আলাদা একটা নিজস্ব জগৎ রয়েছে। সেই জগৎ নিয়েই তারা ব্যস্ত। একজনের আরেকজনের সাথে একটা অদৃশ্য দেয়াল দাঁড় করানো। এ কোন রহস্যের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে লতা মাকড়সার জালের মতন। আর সত্যিই কি জ্বীনে ভূত আসা যাওয়া করে? হবে হয়তো।

লতা পুকুর ঘাটে নেমে হাত মুখ ধুয়ে নিল বারকয়েক পানির ঝাপটা মেরে। নিজের রুমে এলো। সজীব এখনো ঘুমিয়ে আছে। লতা নিঃশব্দে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রিম মেখে চুলগুলো আঁচড়ে নিলো। পরক্ষণেই বেরিয়ে গেল। সজীব চোখ মেলে লতার চলে যাওয়া দেখল নিরব চাহনীতে।

লতা রান্নাঘরে গেল। দেখল শাশুড়ী ও চুমকি পিঠা কাজ করছে।
লতা সুজানার দিকে চেয়ে আছে আপ্লুত নয়নে। কল্পনা করছে,

কি মিষ্টি একজন মা পেলাম আমি। বাড়িতে থাকলে প্রায়ই রোজ সৎ মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। আর এখানে এই কয়দিনে উনি আমার চালচলনের কোন ত্রুটি ধরেন নি। উনি দেখতেও কি আদুরে জোছনার মতো। আবার ঠিক যেন বর্ষার ভেজা মাটি। সমস্ত দুঃখ যাতনা শুষে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যা সব নারী পারেনা।

মা আমি কোন কাজ করব এখন?

তরল কন্ঠে জানতে চাইলো লতা।

সুজানা ঘাড় ফিরিয়ে স্নিগ্ধ আঁখিতে চাইল লতার দিকে।

ওহ বৌমা তুমি এসেছ? এত জলদি উঠে গেলে কেন? বিশ্রাম নাও।
আমাদের চুমকিই মাশাল্লাহ একহাতে সব সামলে নিতে পারে। নারে চুমকি?

হ ভাবিজান। খালাম্মা ঠিক কইছে। আপনে এইখানে বসেন। তাইলে আমি কাইলকার ভেজা কাপড়গুলা উঠানে বাইর কইরা দিই। রোদ আইসা যাইব। কি প্যাঁচপ্যাঁচ বৃষ্টি শুরু হইছে এই দুইদিন ধইরা।

নিজে নিজে বকতে বকতে চুমকি বের হয়ে গেল।

লতা কাঠের জলচৌকিটা টেনে নিয়ে বসল শাড়ির আঁচল কোলের উপর গুঁজে নিয়ে।

ও মনে হয় বেশি কথা বলে মা?

বেশী মানে। এক কথায় বাচাল। ও এমন ভাবে সাজিয়েগুছিয়ে কথা বলতে পারে। যেকেউ শুনলে ধরে নিবে সব সত্যি। তিলকে তাল করা চুমকির তুড়ি মাত্র। এজন্যই ভাবছি ওকে বিদায় করে দিব। অবশ্য সেও যেতে চাচ্ছে।

লতা প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল,

তালের রস আবার কখন নিলেন মা? তাল কিনে এনেছেন?

রস চুমকি রাতেই নিয়ে ফ্রিজে রেখেছে। এখন নারকেল আর দুধ দিয়ে জ্বাল করে ক্ষীর পাকাচ্ছি। আর কিনে আনতে হয়নাকি এতবত গাছগাছালীতে ভরা আলিশান বাড়ি থাকতে।

ওহ আচ্ছা। আমিতো আর পুরো বাড়ি দেখিনি মা। তাই জানিনা।

মাত্রই বধু হয়ে এলে। আমার মত পুরনো হও। সবি দেখবে। সবই জানবে।
দুর্বোধ্যর হাসি দিয়ে বলল সুজানা।

আচ্ছা মা।

তালের রস খাও তুমি?

হুম খাই। আমার দাদী, যেদিন তাল রান্না হতো সেদিন মুচমুচে করে অনেকগুলো চাল ভেজে নিত। সেই চালভাজা দিয়ে আমাদেরকে তালের ক্ষীর খেতে দিত। দারুণ লাগে খেতে। আবার কলাপাতায় করে তালের পিঠাও বানাতো। সেটাও অস্থির স্বাদ হয়।

মা আপনি এত ভালো কেন?

নিজের সম্পর্কে মুখের উপর ঠাস করে এই সরল প্রসংশাখানি আশা করেননি সুজানা। তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন,
আমাকে কেন ভালো মনে হলো তোমার?

বারে! আমি কতদিন বেলা করে উঠলাম ঘুম থেকে। কই আপনিতো আমাকে কিছুই বলেন নি মা। সবাই বলে শশুর বাড়িতে নাকি কাজের মেয়ের আগেও ঘরের বউর উঠতে হয়। কাজ না থাকলেও উঠতে হয়। নয়তো অলক্ষীপানা এসব।

সুজানা সারামুখজুড়ে মধুর হাসি দিলেন। ধীর গলায় বললেন,

জগতে সব মানুষ একরকম নয় হাতের পাঁচ আঙ্গুলের মতন। তোমার এই বয়েস একদিন আমার ও ছিল। বিয়ের পর নতুন অবস্থায় প্রায়ই বিছানা ছাড়তে মন চায়না। দুনিয়ায় যত আলসেমি আছে সব ঝেঁকে বসে শরীরে ও মনের মধ্যে। কারণ রাতে স্বামীর সাথে নানা দুষ্টমি হাসি তামাসা করতে করতেই সময় গড়িয়ে যায়। ঘুম ধরেই ভোর রাতের দিকে। তবুও অনেক কষ্ট করে উঠতে হয় নতুন বউকে। আমি তোমাকে এ কষ্টটা দিতে চাইনা বৌমা। আট দশটা শাশুড়ীর মত আমি প্রতিশোধ পরায়ন নই। যে আমিও ভোরে উঠেছি। বকা শুনেছি। এখন আমার ছেলের বউ কেন আমাকে সেই সেবা দিতে পারবেনা। এসব যুক্তি আমি মানিনা।

লতা মন্ত্রমুগ্ধের মত বিবশ হয়ে শুনল সুজানার কথা।

কিন্তু তার মনের ভিতর খচখচানিটা বেড়েই চলছে ক্রমশ। তার মানে চুমকির বলা কথাগুলো বানানো? কার কথা যে কাকে বলবে লতা কিছুই বুঝে উঠছেনা।

মা আপনার বাল্য বিয়ে তাইনা?

সুজানা ঘাবড়ে যাওয়া চোখে চাইলে লতার দিকে।
আমি বুঝেছি কেন এটা বলছ? সজীব আর আমার বয়স মেলাতে পারছনা এইতো?

ঠিক ধরেছেন মা।

এটা সজীবকেই জিজ্ঞেস কর গিয়ে।

লতা আর কিছুই বলতে পারলনা অচেনা মেয়েলী কন্ঠস্বর শুনে।

খালামনি কেমন আছ? হেই সুইটি কেমন আছ?

আরেহ ইতিকা তুই এত সকালে?

কই এত সকাল। ভোর হয়েছে পাঁচটায়। এখন বাজে নয়টা। ক্লাসে যাব। মা তোমাদের জন্য আতাফল দিল। তাই আসা। বলেই ফলের ব্যাগটা রেখেই ইতিকা ঘরের ভিতর চলে গেল।

আপনার ভাগনি মা?

হুম। বড় আপার ছোট মেয়ে। মাঝে মাঝে এসে আমার কাছে বেড়ায়।

একটু পরে লতাও উঠে এলো নিজের রুমে সজীবকে জাগানোর জন্য। কিন্তু রুমের দরজায় পা রাখতেই লতা অবিস্বাস্য চোখে চেয়ে রইল বিছানার দিকে।

ক্রমশ….(২)