নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-১৪

0
7118

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_১৪||
;
;
;

—“জয়, তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। অনেক বড় অঘটন ঘটে গেছে। ”

জয় বেচারা এমনি অফিস সামলাতে সামলাতে জান যায় যায় অবস্থা। নিজের টাইয়ের নাট ঢিলা করে বললো,
—“আমার এই দুনিয়ায় আসাটাই সবচেয়ে বড় অঘটন ছিল। কী হয়েছে সেটা একটু ক্লিয়ার করে বলো তো, ভাবী।”

—“মুনের পায়ের ভেতর অনেক ধারালো একটা লোহার টুকরা ঢুকে গেছে। আমি ওকে হসপিটালে এনেছি, ড্রেসিং করিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় নিয়ে যাবো।”

জয় উত্তেজিত হয়ে বললো,
—“হোয়াট?? এই মেয়ের কি একটু বুদ্ধি-সুদ্ধি নেই? নিজের খেয়াল তো অন্তত রাখতে পারে!”
বলেই ফোন কেটে দিলো। আর বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেল।

কিছুক্ষণ আগে,,,
—“এবছর অনার্স ফাইনাল এক্সামে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে “ফাহমিদা আহমেদ মুন “।”

নিজের নাম শুনতেই আমার চোখে পানি চলে এলো। আমার এতো বছরের কষ্টের ফল এটা, আজ আমি সফল হয়েছি।

পাশ থেকে রাদিফ খোঁচা মেরে বললো,
—“কী, কইসিলাম না? মিলসে এবার? আমার কথায় তো পাত্তাই দেস না। ফাইনালি হেই আমার কথাই সত্যি হয়। কথায় আছে না, ‘গরীবের কথা বাসি হইলেও ফলে’।”

আমি ওর কথা শুনে হেসে দিলাম। চোখের পানি মুছে স্টেজে যেতেই সব টিচাররা কনগ্রেচুলেট করলেন। আমাদের ডিপার্টমেন্টের হেড ম্যাম বললেন,
—“ওয়েলডান, ফাহমিদা। আমি জানতাম তুমিই ফার্স্ট হবে। এবার এমবিএ কমপ্লিট করে আমাদের স্টুডেন্ট থেকে কলিগ হয়ে যাও।”
বলেই আমায় গোল্ড মেডেলটা পড়িয়ে দিলেন।

প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়েছে হিম। কিন্তু ও আসেনি। ভার্সিটির কেউ কিছু জানে না ওর ব্যাপারে। আমরাও আর মাথা ঘামাচ্ছি না। কিছু কিছু অন্যায় মানুষ সহ্য করলেও উপরওয়ালা সহ্যের করেন না। হয়তো এটাই তার প্রমাণ। সব মেয়ের কাছেই যার যার সতীত্ব যে কতটা মূল্যবান তা শুধু একটা মেয়েই বলতে পারে। আর সেই সতীত্বের ওপর কেউ হাত দেওয়ার চেষ্টা করলে তা যে কতটা যন্ত্রণার হয়, সেটা কেউ বুঝে না। যারা হাত দেয়, তারা বুঝে না যে, তারাও কোনো মেয়ের জন্যই পৃথিবীর আলো দেখছে। প্রকৃতপক্ষে এদের বাঁচার কোনো অধিকার নেই। সেদিন আমার ফ্রেন্ডসরা ঠিক সময় পৌঁছে না গেলে আমার যে কী অবস্থা হতো ভাবলেই গাঁ শিউরে ওঠে। হয়তো ওর গায়েব হওয়ার পেছনে রহস্য আছে, তবে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।

সবাই আমায় অভিনন্দন জানাচ্ছে। আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানালাম।

মাঠ দিয়ে আমি, আমার ফ্রেন্ডস আর অদ্রি ভাবি হাঁটছি। আমি বাবাকে কল দিতে যাবো এমন সময় পায়ে মনে হলো কিছু একটা ঢুকে গেছে। আমি ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে আহহ বলে উঠি, আর চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ছে। সবাই আমার পায়ের দিকে তাকাতেই দেখে রক্ত দিয়ে পা আর আশেপাশের সবুজ ঘাস লাল হয়ে গেছে। অদ্রি ভাবীর রক্তে ফোবিয়া আছে, ওনি চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে বললো,
—“ওকে হসপিটালে নেয়ার ব্যবস্থা করো। নয়তো আরো রক্ত যাবে আর ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

অর্ণব আমায় কোলে নিয়ে পাশের ক্লিনিকের দিকে ছুট লাগায়, আর তার পিছনে পিছনে সবাই।

বর্তমান,,,
আমার ডান হাত রুহি আর রাদিফ বাম হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো। পায়ের তলার ঠিক মাঝ বরাবর কেটে গেছে, শুধু কাটেইনি, অনেক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কয়েকটা সেলাই পড়েছে। বাইরে বের হতেই সবগুলো একসাথে আমার ওপর হামলে পড়লো।

ভাবী অসম্ভব রেগে বললো,
—“এতো কেয়ারলেস কেন রে তুই? চোখ দুটো কোথায় থাকে আপনার? ”

অনিতা, আর রুহির বকা তো তাও হজম করতে পারলাম কিন্তু রাদিফ আর অর্ণব খাস বাংলায় যা ছাড়লো, তা শুনে বেচারা লোহার টুকরোর জন্য অনেক আফসোস হতে লাগলো। যদি ওর কান থাকতো বা অন্যকোনো উপায়ে শুনতে পেত, তাহলে একবুক কষ্ট নিয়ে বলতো,
—“ধরনী দ্বিধা হও, আমি তোমার ভেতর মুখ লুকাবো।”

বাসায় কলিং বেল বাজাতেই মা এসে মেইনডোর খুলে দেখলো অদ্রি ভাবী আমায় আঁকড়ে ধরে আর আমি তার ওপর ও আমার একপায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার এই অবস্থা দেখে তো মায়ের চক্ষু চড়কগাছ! ভাবী রেগে বোম হয়ে আছে, যখন-তখন ব্লাস্ট হতে পারে। আর এদিকে আমি মুখে ক্লোজআপ হাসি টেনে দাঁড়িয়ে আছি।

—“তোর পায়ে কী হয়েছে রে, মা? ব্যান্ডেজ কেন?”

আমি আমতা আমতা করে বললাম,
—“আগে ঢুকতে তো দাও। একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা পুরো ব্যথা হয়ে গেছে। ”

মা আর ভাবী ধরে নিয়ে আমায় সোফায় বসালো। হাঁটতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে, গোড়ালি মনে হয় আর গোড়ালি নেই। আল্লাহ জানে, কয়দিনে আমার পা সেরে উঠবে আর এ কদিন আমি কেমনে কী করবো?

অদ্রি ভাবী মাকে সব বলার পর, মা আমার পাশে এসে গালে হাত দিয়ে বসে বললো,
—“এই প্রথম দেখলাম কোনো মানুষ রেজাল্টের দিন পা কেটে গলায় গোল্ড মেডেল ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরে। এটা দেখাটাই বাকি ছিল জীবনে!!”

আমি কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললাম,
—“তোমরা সবাই মিলে এখন আমায় হিউমিলিয়েট করবে? আমার রেজাল্টের কোনো দাম নেই, তাই না? ”

অদ্রি বললো,
—“কে বলেছে দাম নেই? আর হিউমিলিয়েশনের কী দেখলি? কষ্ট কী এখন আমাদের হচ্ছে নাকি তোর?”

আমি অবাক হয়ে বললাম,
—“এটা তো আমার মায়ের ডায়ালগ? তুমি কীভাবে জানলে?”

অদ্রি বিরক্ত হয়ে বললো,
—“এসব জানতে হয় না, বুঝেছিস? আমি জয়কে জা,,,,,”

ভাবীকে বলতে না দিয়েই আমি রীতিমতো চিৎকার দিয়ে বললাম,
—“এই খবরদার, তুমি ওনাকে কিছু বলবে না। একবার হাত কেটে গিয়েছিল বলে ওনি আমায় কী থ্রেট দিয়েছিল জানো?”

আয়েশা আর অদ্রি জিজ্জাসু দৃষ্টিতে তাকালো।

আমি বললাম,
—“আমাকে নাকি এক থাপ্পড় দিয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবে। এবার এটা জানলে তো মনে হয় আমাকে দুনিয়া থেকেই বাইরে ফেলে দিবে।”

পেছন থেকে কেউ একজন বললো,
—“দুনিয়া থেকে ফেলে দিবে না, তার থেকেও বেশি কিছু করবে।”

আমিও তার কথায় সায় দিয়ে আপনমনে বলতে লাগলাম,
—“হুম, একদম ঠিক। ব্যাটা সেই লেভেলের রাগী আর বদমেজাজি। এমনিতে কতো ভালো মানুষ! আর রেগে গেলে মনটা চায় এক ঢিলে উগান্ডা পাঠিয়ে দেই। খারুস কোথাকার! তা,তা,তাই ননন,না?”
কথার মাঝে আমার হুশ এলো আমি কার কথার উনি দিচ্ছি। ভয়ে ভয়ে ঘাড় ঘোরালাম আর মনে মনে দোয়া করতে লাগলাম আমার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি যেন না হয়। কিন্তু কথায় আছে না, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়।’ আমার বেলাও কথাটা ফলে গেল। শুধু ফললোই না, খুব বাজে শুরু ফলে গেল।

তাকিয়ে দেখলাম, জয় রেগে পুরো লাল টমেটো হয়ে গেছে। আমি সেটা দেখে একের পর এক শুকনো ঢোক গিলছি, কিন্তু ভয়ে গলা বারবার শুকিয়ে যাচ্ছে।

জয় আমার দিকে এগিয়ে এসে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
—“কী কী যেন বলছিলে? আমায় উগান্ডা পাঠিয়ে দিবে? আমি খারুস?”

আমি মুখে নকল হাসি টেনে তোতলিয়ে বললাম,
—“না না, আমি তো সেটা আপনাকে বলি নি। আপনি তো অনেক দয়ালু। আপনাকে দেখলে আমার হাজী মুহম্মদ মহসিনের কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয়, আপনি তাদের আল্ট্রা ম্যাক্স প্রো ভার্সন।”

জয় চোখ দিয়ে অগ্নিবর্ষন করতে করতে বললো,
—“কী বললে?”

পেছন থেকে জায়েদ ভাইয়া এসে বললেন,
—“ওই, মেয়েটা এমনি অসুস্থ। ওর সাথে তুই এমন ভাবে কথা বলছিলে কেন রে? বেয়াড়া কোথাকার?”

ভাইয়ার পাশ থেকে বাবা বলে উঠলেন,
—“জয়, আমার ছোট মেয়েটাকে বকাঝকা করার কোনো অধিকার তোমাকে দেইনি। মেয়েটা এতো ভালো রেজাল্ট করেছে, তারওপর পা কেটে কত ব্লিডিং হয়েছে ওপর শরীর থেকে। তাও তুমি এমন করছো!”

জয় অবাক হয়ে বললো,
—“আমার বউ, আর আমারই অধিকার নেই? ”

জয়ের মুখে এমন কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ওনার মুখে নিজেকে বউ বলে সম্বোধন শুনবো, এটা আমার চিন্তা জগৎ থেকে অনেক দূরে ছিলো।

অদ্রি আর জায়েদ ও অনেক অবাক হয়েছে। তারাও এমনটা আশা করেনি।

জয়ের হুঁশ ফিরতেই সে বুঝতে পারছে কী বলে ফেললো। তাই আমতা আমতা করে বললো,
—“না মানে, আমি বলছিলাম যে, আমি কোনো বেয়াড়া-টেয়াড়া না। আমার নামের ভাইয়াকে এই ট্যাগটা ঝুলাতে না করো।”

জায়েদ 😏 রিয়েকশন দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

আমি ভাবীর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম,
—“আমার পা কেটেছে, আর এটা তুমি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছো?”

—“তো জানাবো না? এটা কী কোনো সাধারণ ব্যাপার নাকি?”

জয় বিরক্ত হয়ে বললো,
—“তুমি এতো প্রশ্ন করো কেন বলো তো? গলায় মেডেল ঝুলিয়ে ল্যাংড়া হয়ে বাড়ি ফিরেছো! এখন চলো রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও।”

আমি উঠে দাড়াতে যাবো তখনি মিস্টার হিরোর মতো এসে আমায় থামিয়ে বললেন,
—“আমি দাড়াতে বলেছি তোমায়? ”
বলেই আমায় কোলে তুলে নিল। সবাই তেমন অবাক না হলেও আমি অনেক অবাক হয়েছি। বলতে গেলে আজ আমি শুধু অবাকই হচ্ছি।

রুমে এসে জয় সোফা ক্রস করতেই আমি বললাম,
—“এই যে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সোফা তো ওখানে! আর আপনি সামনে যাচ্ছেন কেন?”

জয় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“আর একটা কথা বললে তোমায় জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেব।”

—“কিন্তু জানালায় তো গ্রিল দেওয়া। ”

জয় আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালো। আর আমি মুখে হাত দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম। আমায় বেডে বসিয়ে বললো,
—“এখন বেডেই থাকো, বেশি কথা বললে এক থাপ্পড় দিয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো!”

আমি ওনার কথা মেনে নিলাম।
_______________

নিবিড় : জয় ধীরে ধীরে তোমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বুঝতে পারছো না তুমি?

তনিমা : আমি এখন কী করবো? ওকে ফোন দিলেই তো বলে যে, অফিসে এখন অনেক ব্যস্ত।

নিবিড়: সামনের মাসে যেন টাকাগুলো হাতিয়ে নিতে পারো সেই ব্যবস্থা করো।

হঠাৎ আহিল তাদের সামনে এসে চেয়ার টেনে বসে বললো,
—“আমি আপনাদের সাহায্য করবো, যদি আপনারা চান।”

-চলবে………