নীড়ভাঙ্গা ভালবাসা পর্ব-০১

0
588

#সূচনা_পর্ব
#নীড়ভাঙ্গা_ভালবাসা
#লেখকঃমোহাম্মদ_রাফি

মিরপুরের নীচতলার ছোট্ট ১ রুমের ফ্লাটের জানালা দিয়ে গেটের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া আপাতত হাতে কোন কাজ নেই।

ঘড়িতে ২ টা বেজে গেছে অথচ আজ এখনও তার আশার কোনো খোঁজ নেই। ফোন না দিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে যখন সে গেটের সামনে আসে তখন সেই প্রথম প্রথম দেখা হওয়ার অনুভূতি পাই। নিজেকে আবার সেই অষ্টাদশী যুবতী মনে হয়। কি করে যে একটা গোমড়ামুখো, রঘচটা লোকের প্রমে পড়েছিলাম তা আজও আমার কাছে এক রহস্য।

তখন আমার ১৮ বছর বয়স। সবে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি ক্লাস শুরু হয়নি৷হঠাৎ একদিন বাবা একদিন আমার হাতে তার ফোন দিয়ে বললো তোমার ব্যাচের এক ছেলে ফোন দিয়েছে। ক্লাস যেহেতু শুরু হয়নি আমি কাউকেই চিনিনা তাই অবাক হয়ে ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই তোমার পুরুষালি আওয়াজে তুমি বললে, আমি নীড়। অফিস থেকে ব্যাচের সবার নাম্বার ম্যানেজ করে পরিচিত হওয়ার জন্য কল দিলাম। সেই শুরু কথা বলা। ধীরে ধীরে দেখা হলো, বন্ধু হলাম, ভালবাসলাম। ৪ বছর আগে বিয়েটাও করলাম, এখন ছয়মাস হলো সংসার শুরু করেছি। তবুও ৮ বছরের এই বন্ধনটার জন্য কত কাঠখড়ই না পোড়াতে হলো!

ভাবতে ভাবতে আরও আধ ঘন্টা পেরিয়ে গেলে পরিচিত বাইকের হর্ণ শুনতে পেয়ে মাথায় কাপড় টেনে গেট খুলতে বেরোলাম। গেট খুলে দাড়াতেই তাকে দেখতেই স্বভাবত আমার চোখে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আর আমাকে দেখে তার রাশভারি মুখটা আরও ভার হলো৷ বুঝলাম হাসি থামাতে বলছে।

আমি গেট লাগিয়ে পার্কিং পেরিয়ে ঘরে ঢুকলে সেও বাজারের ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকলো। আমি ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে রেখে তার পিছে পিছে রুমে গিয়ে গামছা আর ট্রাউজারটা বের করে দিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে গেলাম।
সব খাবার আনতে আনতে সেও গোসল সেরে ফিরলো। তার প্লেটটা টুলের উপর রেখে আমি বাটিতে করে সব তরকারি সাজিয়ে রাখলাম। সে খেতে বসে বললো, তুমি খেয়েছো?

না এখনও খাইনি, তুমি শুরু করো। আমি আসছি বলে আমার প্লেট নিয়ে আসলাম রান্নাঘর থেকে৷

স্বামীকে সব মেয়েই ভালমন্দ খাওয়াতে ভালবাসে কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ আমার সোনার চামচ মুখে দিয়ে মানুষ হওয়া স্বামীর পাতে ৩/৪ পদের বেশি তরকারি তুলে দিতে পারিনা। মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদি তার খাওয়ার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে। কিন্তু উপায় নেই, স্বামীর খুব সামান্য টাকা ইনকাম দিয়ে মাস চালাতে গেলে এর বেশি কিছু তার পাতে তুলে দেওয়া সম্ভব না।

আজ মেন্যুতে ধনেপাতা ফুলকপি দিয়ে মসুরের ডাল, পাঙ্গাস ভুনা, রুইমাছ দিয়ে পেঁপে আর ফুলকপি ভাজি৷ বরাবরই স্বামী আমার খুব ভোজনরসিক।৮ বছরের সম্পর্কের মাঝে তার খাওয়ার প্রতি ভালবাসাটা ছিলো দেখার মতো। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো ক্যান্টিনে খেতো না কারণ ওতো কম পদে তার খাওয়া হতো না। সবসময় সে বাসায় যেয়ে খেয়ে ক্লাসে ব্যাক করতো। মাঝে মাঝে বাটিতে করে চুরি করে আমার জন্য এটা ওটা নিয়েও আসতো। শাশুড়ী আমার ১০ পদের নীচে কখনো রান্না করেনা৷ সেখানে আমি স্ত্রী হিসেবে তাকে কিছুই খাওয়াতে পারিনা।

রান্না জিনিসটা আমি ভালোই করি৷ সেটাও তাকে ভালবেসেই শেখা। সে খেতে এতো ভালবাসতো আর আমি সামান্য ভাতও নামাতে পারতাম না।কারণ জন্মানোর পর কখনো দরকার পরেনি আমার রান্নাঘরে যাওয়ার। নিজহাতে রান্না করে খাওয়ানোর তৃপ্তি থেকে তাই আমি বঞ্চিত ছিলাম।

কিন্তু একদিন তার এক বন্ধুর জন্মদিনে বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের নিজের হাতে বানানো কেক খেয়ে এসে তার মুখে প্রশংসা শুনতে শুনতে আমি ডিসিশন নিলাম যে করেই হোক রান্না আমাকে শিখতেই হবে। যে অন্য মানুষের বানানে কেক খেয়ে পাগল হয়ে যেতো সেই আজ আমার বানানো কেক ছাড়া নামিদামি বেকারির কেকও মুখে দিতে পারেনা। যদিও আমার রান্নার প্রশংসার বেলায় তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না। চুপচাপ একনিমিষে সব সাবাড় করা দেখে বুঝে নিতে হয় সব। সে তার বন্ধুদের নাকি বলতো আমার বউকে শুধু রাগিয়ে দিলেই হয়, যে কাজে হাত দেবে সেই কাজেই পার্ফেক্ট।

রান্নাটা ভালো পরি বলেই আজ সামান্য আয়োজনেও তার তৃপ্তি করে খাওয়া দেখতেও শান্তি। আমি পাখি আর আমার সামনে বসে যে খাচ্ছে সে আমার একমাত্র স্বামী নীড়। ২ জনের ছোট্ট সংসার আমাদের। শ্বশুর শাশুড়ী থাকেন খুলনা। আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা কিছুই জানেনা। সে এক ভয়াবহ ইতিহাস। অন্যএকদিন এই গল্প হবে। আজ মনোযোগ আমার স্বামীর খাওয়ার দিকে দেওয়া যাক।

রান্না কেমন হয়েছে?
ভালো।
নিজে থেকে কি কিছু বলতে ইচ্ছা করে না তোমার?
না।
আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ ভাত নাড়তে থাকলাম।
তার খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখন জিজ্ঞেস করলো, খাচ্ছোনা কেনো? আজ আমি খাইয়ে দিতে পারবো না। অনেক কষ্ট হয়ে গেছে। টিপ নিয়ে সেই মতিঝিল গেছিলাম। অনেক ধকল গেছে আজ। তুমি খেয়ে একটু শুয়ে তারপর পড়তে বসবা। সারাদিন সংসার করলে হবে না। বলেই সে হাত ধুয়ে সটান করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

আমি খাওয়ায় ফাঁকি দিতে যাবো তখনই সে চোখ বোজা অবস্থায় বলে উঠলো প্লেটের ভাত শেষ না করে উঠলে আজ আমার সাথে সে একটা কথাও বলবে না। অনুপায় হয়ে আস্তে আস্তে খাওয়া শেষ করে সব পরিষ্কার করে গুছিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়লাম। তার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে বুঝলাম এত নিষ্পাপ একটা মানুষের জন্য একজনম না শুধু, জনম জনম আমি আমার সব সুখ আহ্লাদ ত্যাগ করে তার হাত ধরে দুখের সাগর হাসিমুখে পাড়ি দিতে পারি।

বিকালে ঘুম ভাঙ্গলো তার ফোনের শব্দে। স্ক্রিনের দিক তাকিয়ে দেখি আব্বু বার বার কল দিচ্ছে। এই সময়ে আব্বু সাধারণত কল দেয় না। তাই একটু অবাক হলাম। যখন দেখি আব্বু ৮বারের মত কল দিয়েছে অগ্যতা তাকে জাগিয়ে আমি ফোনটা তার কানে ধরলাম। আব্বুর কথা শুনে সে কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে বসে থেকে আমাকে কিছু না জানিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো…

চলবে।