নীড়ভাঙ্গা ভালবাসা পর্ব-০২

0
388

#পর্বঃ ২
#নীড়ভাঙ্গা_ভালবাসা
#লেখকঃমুহাম্মদ_রাফি

তার বের হয়ে যাওয়া আমার কাছে নতুন কিছু না। নিশ্চিত আব্বু এমন কিছু বলেছে তার মাথা গরম হয়ে গেছে তাই মাথা ঠান্ডা করতে বাইরে হাটতে গেছে। আমরা মিরপুরের যে এলাকায় থাকি এখানে হাটার খুব সুন্দর জায়গা আছে। এত সুন্দর আবাসিক এলাকা বাংলদেশে খুব কম দেখা যায়। কি সুন্দর নিরিবিলি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ও স্নিগ্ধ। খুলনায় আমার শ্বশুরবাড়ি এলাকাটাও খুব সুন্দর।

আমি নাস্তা বানানোর জন্য উঠতেই দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনলাম। উঠতে উঠতেই দেখি বাড়িওয়ালি ভাবি ডাইনিংয়ে দাড়িয়ে আছে৷ আমাকে দেখে হেসে বললো, পাখি আজ তোমার নাস্তা বানাতে হবে না। আমি পাস্তা করতেছি দিয়ে যাবো, তোমার দরজা খোলা দেখে ভাবলাম বলে যাই। বলেই সে চলে গেলে আমি দরজা লাগিয়ে দিলাম।

এই বাসাটা অনেক সুন্দর। মাত্র তিনতলা বাসাটা, ফ্যামেলি মাত্র দুইঘর। বাকি সব ইউনিট একটা মহিলা মাদ্রাসার কাছে ভাড়া দেওয়া। তাই ভাবি ভালো কিছু করলেই আমাদের দিয়ে যায়, আমরাও তাই করি।

নাস্তা বানানোর ঝামেলা না থাকাতে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসলাম। সামনের মাসেই বিসিএস পরীক্ষা, এবার পাস না করলে ভবিষ্যত খুব খারাপ। তার একটাই কথা তার বউকে ক্যাডার হতে হবে যাতে তার পরিবার আমাকে আর কটুকথা বলতে না পারে৷

বেশকিছু সময় ধরে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি পড়ার পর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনলাম। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই সে ভিতরে ঢুকলো। আমি আবার পড়তে বসলাম। সেও হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় আমার কোলে শুয়ে শুয়ে পড়তে লাগলো। ভাবি নাস্তা দিয়ে গেলে সে নাস্তা করে বললো,
– চলো চা খেয়ে আসি।

আমি শাড়ি পাল্টাতে গেলে সে বললো শুধু মাথায় ওড়না দাও আর কিছু লাগবে না। পার্কিংয়ে আসতেই আমি বললাম, হেটে যাবো। রাব্বানি হোটেল বাসা থেকে প্রায় ১ কিলো। আমার তার হাত ধরে এটুকু পথ হাটতেই ভালো লাগে। আমার সব চেয়ে প্রিয় চা বানায় এই হোটেলে। খুলনা, ঢাকার সব নামকরা রেস্টুরেন্টে খেয়েও এই হোটেলের মতো স্বাদ আমি আর কোথাও পাইনা৷
সন্ধ্যার পর রেস্টুরেন্টটায় অনেক ভীড় থাকে বলে আমি বাইরে দাড়ালাম আর সে চা আনতে গেলো। চা আনার পর দুইজন দাড়িয়ে চা খেতে থাকলাম। তার হাফ চা শেষ হতে আমি একটু অন্যদিকে তাকাতেই সে কিছু চা আমার কাপে ঢেলে চুপচাপ এমন ভান করে খেতে থাকলো যেন কিছুই হয়নি। আমার যে খাবারটা খুব প্রিয় সেটা সে তার পাত থেকে সবসময় আমাকে কিছুটা হলেও তুলে দেয়। শুধু আজ না, সম্পর্কটা গভীর হওয়া থেকে প্রতিমুহূর্তেই সে এটা করে। আচ্ছা দুনিয়ায় টাকা থাকাটাই কি সব? এই যে ভালবাসা তার জন্য কি বাবার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পুরো জনমটা তার সাথে ওই একতলার ছোট্ট বাসাটায় কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়?

রাতের খাবার সেরে আবার পড়তে বসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– আব্বু ওতবার ফোন দিলো যে?
– আম্মু বাসায় যেতে বলতেছে, নানা খুব অসুস্থ। চলো কাল খুলনা যাই ভোরে।
– আচ্ছা, বলে আমি বইখাতা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম অন্য দিকে ফিরে।
– সোনাপাখি…সোনাপাখি…
আমি রেগে গেলেই সে এমন আদর করে ডাকে। কিন্তু আজ আমার রাগ কমার বদলে হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা আমি কি সারাজীবন এমন অপশনাল থেকে যাব তার কাছে? এই যে নানা অসুস্হ বলে সে বাসায় যাবে তারপরের সব কাহিনি আমার মুখস্হ। এমনকি তারও মুখস্হ, তবুও আম্মু কিছু বললে লক্ষীছেলের মত সে তার কথায় উঠবস করবে। বাড়িতে যেয়ে আমাকে ফোন দেওয়ারও সময় পাবেনা৷ বাথরুমে গেলেও আম্মু দরজার বাইরে বসে তাকে পাহারা দেবে। যখন তখন একটা সুন্দরী মেয়ে বাসায় এনে তাকে দেখাবে। ৪ বছর আগে যেদিন প্রথম সে আমার কথা বাড়িতে জানিয়েছিলো সেদিন থেকে আজ অব্দি এই কাহিনি চলছে। আল্লাহ কবে যে মুখ তুলে চাইবে!
হুট করে কোমর জড়িয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে আদর করতে করতে করতে সে বললো,
– রাগ করোনা সোনাপাখি। আমি এইবার বাসায় ফিয়ে আম্মুকে বিয়ের কথাটা জানাবো। ভাবছিলাম একটা স্টাবল জব ম্যানেজ করে তোমার বাসা, আমার বাসায় জানাব তাহলে আর তোমাকে এত কষ্ট করতে হবে না। কিন্তু কয়মাস পরই তো বেবি আসবে তখন তারা এমনিতেই জানবে বলে সে ধীরে দীরে তলপেটে হাত বুলাতে লাগলো।
– বেবি আর আামার চিন্তা যদি তোমার থাকতো তাহলে আজ বিকেলে বাসা থেকে বের হয়ে তাদের নতুন ঠিক করা পাত্রীর সাথে কথা বলতে না।
– তুমি আবার আমার ফোন চেক করেছো?
– হাত সরাও তোমার। তোমার ফোন কেন তোমার সব চেক করার রাইট যদি আমার না থাকে তাহলে তুমি বাসায় ফিরে তাদের মতে বিয়ে করো।আর, ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, চায়ের বিল দেওয়ার সময় ফোন আমার কাছে যখন দিয়েছিলে তখন ওই মেয়ে তোমার হোয়াটস অ্যাপে টেক্সট করেছিলো। তখন জানলাম তোমার এই কাহিনি।
– বিশ্বাস করো সোনাপাখি, আব্বু-আম্মুর জোরাজুরিতেই আমি ওই মেয়ের কল ধরেছিলাম। আমি তাকে বলেছি এখন আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা।
– তা পরশু নিশ্চয়ই দেখা করতে যাবে? কোন রেস্টুরেন্ট ফিক্সড করলে? সিটি লাইটে নিয়ে যেও, ওখানে বসে বসে আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছ। নতুন মানুষের সাথেও ওখান থেকেই শুরু করো।
– রয়েলে যেতে বলছে।
– ভালো। ওই মেয়ে যদি বিল দেয় তাহলে আমার জন্য রয়েলের ফালুদা নিয়ে আসবা। বর দেখায় আমি আর আমার বেবিও একটু খাওয়া দাওয়া করি!
– তোমার মাথার ঠিক আছে? কান্নাকাটি না করে তুমি কিসব উদ্ভট কথা বলছো?
– ৪ বছর ধরে তো একই কাহিনি। বউ রেখে তুমি পাত্রী খুঁজো। কাদতে কাদতে আমার ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি শুকিয়ে গেছে। আর পানি আসবে না৷ অন্তত যে ছেলে বউ, অনাগত বাচ্চার কথা ভুলে বাপমার কথায় সুরসুর করে পাত্রী দেখতে রাজি হয় তার জন্য আমি আর একফোটাও চোখের পানি ফেলবো না।

– ভুলে গেছো! বাসায় রোজ ঝগড়া, আম্মুর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল, রোজ রোজ নতুন নতুন মেয়ে বাসায় এনে আমার সাথে পরিচিতো করানো থেকে বাঁচতে তুমিই আমায় বলেছিলে তাদেরকে আর তোমার কথা না বলতে? কাকে বলছি! যে সব ভুলে শুধু অভিমান করতে পারে! এখন ঘুমাও, ভোর ভোর রওনা হব তাহলে জ্যাম পড়বে না।

কিছুনা বলে আমি শুয়ে পড়লাম। ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে তাকে উঠিয়ে আমিও আস্তে আস্তে উঠে পড়লাম। আজকাল সকাল উঠতে গেলেই খারাপ লাগা শুরু হয়। সারাদিন কিছু বুঝিনা, শুধু সকালটাই ভীষণ জ্বালায়। নামাজ পড়া সেরে আমি ভাত চাপালাম রাইসকুকারে। আর রুটির খামি দিয়ে পড়তে বসলাম।
সে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
– রাগ পড়ছে?
– না।
– কেন?
-কেন পড়বে?
-ভালবাসি তাই।
– সেই জন্যেই তো সব ছেড়েছুড়ে বাপ মা কে মিথ্যা বলে, এখানে পড়ে আছি। নইলে একবার কি ভেবে দেখছো! যে তুমি ছেলে হয়ে সারাদুনিয়ার মেয়ে দেখে বেড়াও বিয়ের জন্যে সেখানে আমার বয়সি একটা মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের চাপটা বোঝো? আমি সং সেজে কখনো গেছি পাত্রের সামনে?
– আমি সং সেজে যাইনা। সিম্পল শার্ট-প্যান্ট পরে যাই।
– গুড, কালও যেও। আমার কোনো বাধা নেই।
– এত রাগ করে না, বউ। আমি এবার সবাইকে বলবো।
– বললে ভালো না বললে মনে রেখো এবার আর আমাকে তুমি ফিরে পাবেনা। সাথে আমার বাচ্চাকেও হারাবে। তোমাকে ছাড়াই আমি চলে যাবো দূরে কোথাও। অনেক সহ্য করেছি আর না।
– ওকে ওকে।
বলেই সে আমাকে আদর করতে শুরু করলে, আমি বাধা দিতে গেলেই বললো, আর কতদিন পর তোমাকে কাছে পাবো ঠিকনেই। প্লিজ না করোনা। আমি কখনোই তাকে না করিনা, সেজন্যই কি সে আমাকে টেকেন ফর গ্রান্টেন্ড ধরে নিয়েছে! এবারও না করলাম না, হারিয়ে গেলাম তার মাঝে।

মাওয়া ঘাট পৌছাতে পৌছাঁতে আমাদের ১১ টা বাজলো। বাড়িতে আমি কিছুই জানায়নি। বাবা রোজ সকালে একবার ফোন দেয়, আজ কেন দেয়নি জানিনা৷ আচ্ছা আমি কি পারবো ওকে ছাড়া জীবন সাজাতে। ভালবাসা কি, ঘর বাধার স্বপ্ন কি, সবই তো সে শিখিয়েছে। সম্ভব তাকে ছাড়া বাঁচা???

চলবে…