নীড় পর্ব-১৩+১৪

0
314

নীড়
রেশমী রফিক
১৩।।
তুবা এই মুহূর্তে স্বর্ণর অফিসে রুমের সোফায় বসা। ভেতরে এসি চলছে। তবু সে দরদর করে ঘামছে। আবার ঠান্ডায় একটু-আধটু কাঁপছেও। চোখে হতবিহ্বল ভাব। কোনো কথা বলছে না। কারও দিকে তাকাচ্ছেও না। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে মানসিক বিকারগ্রস্ত। অবশ্য আজকের ঘটনার পর তার থেকে মানসিক সুস্থতা আশা করা যায় না একদমই। পরনের কাপড় ছেঁড়া। চুল এলোমেলো। স্বর্ণ তাকে নিজের ওড়না দিয়েছিল শরীর ঢাকতে। কাপড়টা সে হাতে নিলেও ভালোভাবে শরীর ঢাকতে পারছে না। হাত এত বেশি কাঁপছে, ওড়না গায়ে জড়াতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্বর্ণ এক গ্লাস ঠান্ডা পানীয় দিয়েছিল ওকে। ওটা হাতে নিতে গিয়ে ফেলে দিয়েছে মেঝেয়।
শারার বসে আছে চেয়ারে। তার হাতে বরফের পোটলা। মাথা ফেটেছে। অল্পস্বল্প রক্ত বের হচ্ছে। এই মুহূর্তে ওকে হাসপাতালে নেবার উপায় নেই। কারণ রেস্টুরেন্ট চারদিক থেকে ঘেরাও করা হয়েছে। আপাতত স্বর্ণর নির্দেশে রেস্টুরেন্টের এক কর্মচারী ফ্রিজ থেকে কতগুলো বরফের টুকরো নিয়ে একটা সুতি কাপড়ে জড়িয়ে শারারকে দিয়েছে। ওটা সে মাথায় ধরে রেখেছে। এছাড়াও হাতে-পিঠে প্রচুর আঁচড়ের দাগ। দেখে মনে হচ্ছে রীতিমতো টর্ণেডো বয়ে গেছে ওর উপর।
স্বর্ণ ওদের সামনে, নিজের চেয়ারে বসা। মোবাইলে বিভিন্নজনের সাথে কথা বলছে সে। উপরমহলে যাদের সাথে জানাশোনা আছে, সবাইকে কল করে এখানের পরিস্থিতি জানাচ্ছে। এই মুহূর্তে ওর বাবা দেশে নেই। ব্যবসায়িক একটা কাজে সিঙ্গাপুরে গেছেন। স্বর্ণ চাইলে এখনই জানাতে পারে তাকে। তিনি শুধু একটা কল করবেন বাংলাদেশে। তারপর আলাদিনের দৈত্যের মতো সমস্ত ঝঞ্ঝাট দূর হয়ে যাবে। কিন্তু স্বর্ণ তাকে কোনোরকম বাড়তি ঝামেলায় ফেলতে চায় না। তাছাড়া স্থানীয়দের সাথে ওর শত্রুতা আজ নতুন নয়। রেস্টুরেন্ট চালু করার পর থেকেই এখানকার অনেকের চক্ষুশুল হয়ে গেছে সে। এই পর্যন্ত যতবার সমস্যায় পড়েছে, বাবার সাহায্য নিয়েছে। কিন্তু এখন নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চাইছে। বাবার উপর নির্ভর করে আর কতদিন? রেস্টুরেন্টের ব্যবসা যেহেতু শুরু করেছে, আর এটাকে ঘিরে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের নানা পরিকল্পনা আছে। তাই অন্যসব ঝুটঝামেলার মতো এই ব্যাপারটাও নিজে সামলানোর চেষ্টা করা ভালো। ক্ষমতাধর বাবার একমাত্র কন্যা হিসেবে তার নিজেরও ক্ষমতার জোর কম নয়। সমস্যা হচ্ছে, এতকাল সে এই ক্ষমতার আশপাশে ছিল না। সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করেছে। আর দশটা মেয়ের মতো সংগ্রাম করেই জীবনের উচ্চ শিখরে পা রাখতে চেয়েছে। অবাক করা ব্যাপার হলো, এই সংগ্রামে নামার পরই সে অনুভব করেছে, জীবনে ভালোভাবে চলতে-ফিরতে গেলে এই ক্ষমতা ভীষণ দরকার। তবু এতকাল অবধি ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। বারবার হামলার শিকার হয়েও সাধারণ মানুষের মতোই মামলা করেছে। উকিল নিয়োগ থেকে শুরু করে সব ধরনের দৌড়ঝাঁপ করেছে। তাতে অবশ্য ওর বাবার কিছুটা প্রভাব ছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, ক্ষমতার উপর আর কিছু নেই। অন্তত এই বাংলাদেশে ক্ষমতাই সবকিছুর উর্ধ্বে। যার ক্ষমতা, অর্থ আর প্রভাব প্রতিপত্তি আছে, সে-ই কেবল সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারবে।
অনেকটা সময় পর শারার মুখ তুলল। স্বর্ণকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– কিছু হলো?
স্বর্ণ মোবাইলটা টেবিলের উপর রেখে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
– এখনো না। তবে হয়ে যাবে।
– আর কতক্ষণ?
– নিশ্চিত বলতে পারছি না, শারার। ঘটনা খুবই সিরিয়াস।
– কীসের সিরিয়াস? আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে এখানে? তুবা আমার গার্লফ্রেন্ড না। নাইবা আমরা এখানে প্রেম করতে আসছি। ও আমার কাজিনের শ্যালিকা। কাজিনের বিয়েতে পরিচয় হয়েছিল। এরপর অল্পসল্প যোগাযোগ ছিল। আজ দুপুরে ওর সাথে আমার দেখা করার কথা ছিল কর্ণফুলীতে। একসাথে লাঞ্চ করব। আর যে ব্যাপারে দেখা করব, সেই ব্যাপারে কথা বলব। ওখানে প্রচুর ভীড় আর ফুডকোর্টের এসিও ঠিকমতো কাজ করছে না হয়তো, আল্লাহ জানেন। আমি ভাবলাম, তোমার রেস্টুরেন্টে চলে আসি। লাঞ্চ করা হবে। তুবার সাথে কথাও বলা হবে। তোমার সাথেও দেখা হলো। এই তো। আর তুবা খেতে পছন্দ করে। সেদিন তোমার রেস্টুরেন্টে খেয়ে খুব ভালো লেগেছিল। এজন্য ওকে নিয়ে আসলাম। ভাবলাম, ও পছন্দ করবে। অথচ কী থেকে কী হলো। আমি মাত্রই গাড়িটা পার্ক করেছি। তুবা ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওকে ডাকব, ঠিক তখনই সব হামলে পড়েছে। মানে ঘটনা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল, আমি কিছুই বুঝলাম না।
ইচ্ছেকৃতভাবে তুবাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে লক্ষ করার কথাটা চেপে গেল শারার। এসব কথা বলার মানে হয় না কোনো। স্বর্ণ ওকে পালটা ভুল বুঝতে পারে। হয়তো ভাববে, ওর চারিত্রিক দোষ আছে। তুবাকে এই কুমতলবেই নিয়ে এসেছিল। আবার তুবাও আছে সামনে। ঘটনার আকস্মিকতায় চোখ মেলে তাকানোর ওই মুহূর্তটা ওর মাথা থেকে গায়েব হয়ে গেছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। এখন সেই প্রসঙ্গ চলে এলে তার ধর্তব্যেও থেকে যাবে। এমনকি স্বর্ণকে এও বলল না কী কারণে তুবার সাথে দেখা হচ্ছিল কিছুদিন যাবত। সব কথা সবাইকে বলা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে একেকজন একেকরকম বুঝতে পারে।
স্বর্ণ ক্লান্ত সুরে বলল,
– তোমার বুঝার কথাও না। কারণ ওদের শত্রুতা তোমাদের সাথে নয়, আমার সাথে।
– কীসের শত্রুতা? কী বলছ?
– আমি একটা ‘মেয়ে মানুষ’ হয়ে ব্যাটাছেলের মতো রেস্টুরেন্ট বিজনেস খুলে বসছি এখানে। প্লাস আমি নিজে এই রেস্টুরেন্টে কাজ করি। এখানের শেফ, মানে যারা এই রেস্টুরেন্টে খেতে আসে, তারা আমার হাতের রান্না খায়। একটা ‘মেয়েমানুষ’ হয়ে আমি কী করে এগুলো করতে পারি? মেয়ে থাকবে চার দেয়ালের ভেতর। রান্নাবান্না করবে বাড়ির ভেতর বসে। তার হাতের রান্না কেবল তার স্বামী আর পরিবার-পরিজনরাই খাবে। সেখানে আমি রেস্টুরেন্টে বসে রান্না করছি আর দুনিয়ার মানুষজনকে খাওয়াচ্ছি। হলো কিছু?
শারার হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্বর্ণর কথার মাথামুন্ডু বুঝার চেষ্টা করছে। স্বর্ণ আবার বলল,
– এদের রাগ আসলে আমার উপর। আমি একলা মেয়ে মানুষ, কোনো পুরুষের হেল্প ছাড়া রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছি। আমার সাথে যারা কাজ করছে, বেশিরভাগই ছেলে। মেয়েও আছে। তবে কম। মাত্র দুইজন। ওরা পার্টটাইম কাজ করে। বিকেলের দিকে এসে টেবিল সেটআপ করে দেয় আর কাস্টমারদের টেবিলে খাবার পৌঁছে দেয়। বাকি কাজগুলো আমি ছেলেদের দিয়ে করাই। মানে একটা মেয়ের আন্ডারে এই রেস্টুরেন্ট সাকসেসফুলি চলছে। অনেকগুলো ছেলে কাজ করছে। সোসাইটির ইজ্জত যাচ্ছে আর কী। তারা আমার পেছনে লাগার জন্য বহুদিন ধরে ইস্যু খুঁজছিল। আজ মে বি প্ল্যান করেই তোমাদের উপর অ্যাটাক করেছে। তবে প্রি-প্ল্যানড না বোধহয়। কারণ ওদের সাথে অস্ত্র বলতে সেরকম কিছু তো ছিল না।
শারারের চোখ বিস্ফোরিত হলো। প্রায় চিৎকার করে বলল,
– অস্ত্র মানে? ওদের কি অস্ত্র নিয়ে অ্যাটাক করার কথা ছিল? ও মাই গড!
ইশারায় ওকে শান্ত হতে বলল স্বর্ণ। এসি রুমের কথাবার্তা বাইরে যাবার কথা না। তবু কেউ কান পাতলে অবশ্যই শুনতে পাবে। শারারের কথোপকথন তো দূরে থাক, এই মুহূর্তে ওর কণ্ঠও বাইরে যাওয়া যাবে না। লোকজন প্রচুর ক্ষেপে আছে। উত্তেজিত কণ্ঠ শুনলে আবার চড়াও হতে পারে। নিচু সুরে বলল,
– আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, ওরা তোমাকে আগে দেখেছিল এখানে। ফ্রেন্ডসদের সাথে আসছিলে। আজ সেকেন্ড টাইম দেখে হুট করে প্ল্যান করেছে অ্যাটাকের।
– আমি ঠিক বুঝলাম না। হোয়াই মি? আমি কী ক্ষতি করেছি ওদের? আর যেখানে আমার সাথে একটা মেয়ে আছে।
– এটাই পয়েন্ট। তোমার সাথে তুবাকে দেখেছে বলেই চট করে অ্যাটাকের প্ল্যান চলে এসেছে। তোমাকে আর তুবাকে জড়িয়ে কেচ্ছাকাহিনি রটাবে আর আমাকেও এর মধ্যে জড়াবে। এটাই এদের উদ্দেশ্য।
শারার হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল স্বর্ণর দিকে। আচ্ছারকম বিপদে পড়া গেল তো! আগে জানলে ভুল করেও এখানে আসত না। তুবাকে নিয়ে তো নয়ই, একাও না। স্বর্ণ ওকে আশ্বাস দিল,
– রিল্যাক্স! এভ্রিথিং উইল বি ফাইন। আমি হ্যান্ডেল করছি তো ব্যাপারটা।
শারারের পকেটে মোবাইল বাজতে শুরু করেছে। লাঞ্চের সময় এক বন্ধুর সাথে দেখা করার কথা বলে বের হয়েছিল অফিস থেকে। এরপর অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। ঘড়িতে এখন সোয়া তিনটা বাজে। তিনটার দিকে অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হবার কথা। ওর বাবা আজ সকালে অফিসে না এলেও লাঞ্চের পর আসার কথা। উনি নিজেও মিটিংয়ে থাকবেন। এখন নিশ্চয়ই ওকে খুঁজছেন।
ফোনটা ধরা উচিত হবে না কি না, শারার বুঝতে পারছে না কিছু। একবার মনে হচ্ছে, বাবাকে এসব জানানো মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। আবার মনে হচ্ছে, অবস্থা যেরকম বেগতিক, এক কান দুই কান করে বাবার কানে চলে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। চারপাশ থেকে তিলকে তাল বানানো গল্প বাবা শোনার চাইতে সে নিজে যদি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে, ভালো হবে। বাবা নিজেও এই পরিস্থিতি থেকে ওকে উদ্ধার করতে পারবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তার আগে স্বর্ণ যদি ব্যাপারটা যে করে হোক মিটিয়ে ফেলতে পারে, এটাই সবথেকে ভালো।
একনাগাড়ে কল হচ্ছে। রিসিভ করা উচিত। নয়তো বাবা টেনশন করবে। চারদিকে খোঁজ লাগাতেও পারে। সাতপাঁচ ভেবে শারার ঘরের একপাশে সরে এলো। কল রিসিভ করে নিচু সুরে বলল,
– হ্যালো আব্বু। আমি একটু আটকা পড়ে গেছি। এক ফ্রেন্ডের সাথে আছি। তুমি একটু মিটিংটা চালিয়ে নাও প্লিজ।
ওপাশ থেকে কড়া কণ্ঠ শোনা গেল,
– কোথায় আটকা পড়েছ? কী এমন জরুরী কাজ যে মিটিং ফেলেই যেতে হলো?
– আব্বু, আমি একটু পরেই চলে আসব। এসেই সবটা বলছি। ঠিক আছে? আমার ফ্রেন্ড এত করে বলল। আমি আসলে…
– এই ফ্রেন্ডরাই তোমার সর্বনাশের মেইন কারণ। স্টাডি শেষ করে বহু ফাতরামি করেছ ফ্রেন্ডসার্কেল নিয়ে। অনেক ধরেবেঁধে অফিসে রেগুলার করেছি তোমাকে। তাও অফিসের ফাঁকে ফাঁকে ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে চলে গেছ। একবার ভাবলে না, অফিসটা তোমার বাপের হলেও এখানে তুমি জাস্ট একজন স্টাফ। বাকিরা যেমন নয়টা-পাঁচটা অফিস করে, তোমাকেও করতে হবে।
– আব্বু, প্লিজ। তুমি রাগ করো না। আমি চলে আসব তো। ডেইলি-ডেইলি তো যাই না অফিসের বাইরে।
– ডেইলি না গেলেও দুদিন পর পরই অফিসের বাইরে তোমার কাজ পড়ে যায়, সেই খবর আমার কাছে অলরেডি আছে, বুঝেছ? এর আগেও তুমি কয়েকবার লাঞ্চ টাইমে অফিস থেকে বের হয়ে আর ব্যাক করোনি।
– আজকের পর আর কখনো এমন হবে না। আই প্রমিজ।
– ওরকম প্রমিজ তো আগেও করেছ। দেখেছি তো!
শারার চুপ রইল। ওপাশ থেকে তুমুল বকাবকি চলছে। ঠিক বকা নয়, বাবা রেগে গেলেই বিশাল লেকচার দেবে জীবন সম্পর্কে, ক্যারিয়ার সম্পর্কে। ওসব বাণী শুনতে শুনতে কান পেকে গেছে। তবু কিছু কিছু সময়ে চুপচাপ শুনতে হয়। সবটা ভালোই চলছিল। ছেলেকে হু-হু করতে দেখে শারারের বাবার কণ্ঠ অনেকটাই নরম হয়ে এসেছে। অফিস শেষ হবার আগেই যেন চলে আসে, এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে ফোনটা রাখতে যাবেন, ঠিক এমন সময়ে পাশ থেকে তুবা কাঁদো কাঁদো সুরে বলল,
– ভাইয়া, প্লিজ জলদি কিছু একটা করেন। আমার ফ্রেন্ড আমার জন্য ওয়েট করতেছিল। একসাথে কোচিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ও যদি আমাকে খুঁজে না পেয়ে বাসায় কল করে, একদম সর্বনাশ হয়ে যাবে। আর বাসায় জানলে আম্মা কী যে করবে, আমি জানি না। মেরে ফেলবে একদম। আমার মোবাইল ব্যাগ সবকিছু তো মনে হয় ওরা নিয়ে গেছে…
শারার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তুবার এই সময়েই কথা বলতে হলো? সবকিছু শুনে ফেলল বাবা। এখন উপায়?
যা ভেবেছিল, তাই। ওপাশ থেকে কৌতুহলী কণ্ঠ শোনা গেল,
– শারার, তোমার সাথের মেয়েটা কে? কী বলল ও? কোথায় তুমি? হোয়াটস গোয়িং অন?
(চলবে)

নীড়
রেশমী রফিক
১৪।।
শফিকুল চৌধুরী একজন সফল ব্যবসায়ী। দেশের প্রধান শিল্পপতিদের কাতারে তার নাম না থাকলেও ব্যবসায় ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ঢাকাইয়া পরিবারের ছেলে তিনি। তাও বংশের একমাত্র পুত্রসন্তান। তার বংশে কথিত চল আছে, ব্রিটিশ আমলে কোনো এক প্রজন্মের এক পুরুষ ছিলেন অত্যাচারী জমিদার। তার যন্ত্রণায় প্রজাদের জীবন অতিষ্ঠ ছিল। পাইক-পেয়াদারা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত কখন কাকে ধরে আনবে তুচ্ছ কোনো অপরাধে, আর জমিদারও বিনা বিচারে শাস্তি দিতে পৈশাচিক আনন্দ পেতেন। কিন্তু কথায় আছে, সব কর্মফলই একদিন শেষ হতে ধন্য। একদিন এক বাড়ন্ত কিশোরকে ধরে আনা হলো জমিদারের দরবারে। অপরাধ, খেলতে-খেলতে জমিদারের সীমানায় ঢুকে পড়েছে সে। শুধু তা-ই না, বাগানের ফুলগাছ থেকে কতগুলো ফুলও তুলেছে। মালিরা তাকে বাধা দিলে পাথর ছুটে একজনকে রক্তাক্ত করেছে। শুনে জমিদার খুব রেগে গেলেন। কত্ত বড় সাহস তার বাগানের ফুল ছিঁড়ে! আবার তারই কর্মচারীকে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়েছে! তিনি গর্দান নেবার নির্দেশ দিলেন। খবর পেয়ে ছেলেটির মা ছুটে এলো। জমিদারের পায়ে পড়ে খুব কাকুতি-মিনতি করল। তার ছেলেটা আসলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। কিছু না বুঝেই অন্যায় করে ফেলেছে। কিন্তু জমিদারের কথার নড়চড় কখনো হয়নি। তিনি একবার যা বলেন, তা আর কখনো পালটায় না। সেবারও তাই হলো। মায়ের কান্না-আহাজারি আর অনুনয়-অনুরোধ ছেলেটিকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারল না। সে ছিল মায়ের একমাত্র ছেলে। সাতটি কন্যাসন্তানের পর এই ছেলেকে আল্লাহ তার কোলে দিয়েছেন। প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেবার অপরাধে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। পরিবার-পরিজনরা সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তবু সে ছেলেকে কোলছাড়া করেনি। যতই কষ্ট হোক, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেছে। নিজের দিকে খেয়াল না করে সবসময় ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। অথচ তারই চোখের সামনে তার ছেলের মাথা কেটে ফেলা হলো। সন্ধ্যা পেরোয় তখন, কিন্তু মা ছেলের রক্তাক্ত মাথা আগলে রেখে ওভাবেই বসে রইল বিরানভূমিতে।
জমিদার খবর পেয়ে নির্দেশ দিলেন মহিলাকে যেন রাজ্যছাড়া করা হয়। অতঃপর, ছেলের মাথা বুকের আঁচলের সাথে বেঁধে আর শরীর একটি বস্তায় ভরে মা রওনা হলো অন্য রাজ্যের উদ্দেশ্যে। সন্তানকে এই রাজ্যে কবর দিতেও অনীহা তার। কতটা পথ ওভাবে চলেছিল, জানা নেই। মৃত শরীরে পচন ধরতে শুরু করেছে। বিকট দুর্গন্ধে আশপাশে টেকা দায়। পথিমধ্যে এক ঋষিমুনির আশ্রম। ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় গন্ধের উৎস আর কাহিনি শুনে তাকে থামানো হলো। এরপর নিয়ে যাওয়া হলো মুনির দরবারে। মুনি সবটা শুনে মহিলাকে বর দিলেন, ওই মুহূর্তে সে যা উচ্চারণ করবে মুখ দিয়ে, ওটাই সত্যি হয়ে যাবে। সন্তানহারা মা বললেন,
– আমার ছেলের হত্যাকারী নির্বংশ হোক। ওই বংশে এখন অবধি যত ছেলে বেঁচে আছে, সবাই মরে যাক।
মুনির বর কাজে দিল। রাজ্য থেকে বহুদূরে এক আশ্রমে বসে মহিলা কথাগুলো বললেও তা সত্যে পরিণত হলো। জমিদার তখন দরবারের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তখনই হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেলেন। জমিদারের ভাইরা যে যেখানে ছিল, আচানক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল। এমনকি জমিদারের ছেলেরাও। কেবল ছোট ছেলে বেঁচে রইল। জমিদারের পঞ্চম স্ত্রীর সন্তান সে। বয়স মাত্র সাত বছর। মায়ের মতোই ধার্মিক আর শান্ত স্বভাবের। ওই সময়ে মায়ের সাথেই নামাজ আদায় করছিল সে। হয়তো আল্লাহর নির্দেশে মৃত্যু তার ছায়া মাড়ায়নি। কিন্তু সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার জীবন নিয়ে টানাটানি চলল অনেকদিন। জমিদারের ধার্মিক স্ত্রী জায়নামাজে বসে রইলেন। আল্লাহর দরবারে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন। আল্লাহর অশেষ কৃপায় ছেলে একদিন সুস্থ হলো ঠিকই, কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারল না।
সেই থেকে জমিদার বংশের উপর অভিশাপ স্থায়ী হয়ে গেল। ছেলে সন্তান জন্ম নেবার পর পরই মারা যায় কোনো না কোনো কারণে। শত চেষ্টা করেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। অবাক হলে সত্যি, প্রতিবারই কোনো না কোনো ধার্মিক মায়ের দোয়ায় একটি ছেলে বেঁচে যায়। সেই ছেলের বদৌলতে জমিদার বংশ এই পর্যন্ত টিকে আছে। শফিকুল চৌধুরী সেইসব ভাগ্যবান পুরুষদের মধ্যে একজন। তার ছেলে শারারও একই ভাগ্যে ফেরে বেঁচে যাওয়া সন্তান।
বর্তমান কালে পুরনো অভিশাপ কেউ বিশ্বাস করে না। শফিকুল চৌধুরীও করেন না। কিন্তু তার মা মরে যাবার আগে বিষয়টা ছেলেকে জানিয়ে গেছেন। এবং নির্দেশ দিয়েছেন যেন বংশ পরম্পরায় এই অভিশাপের খবর পৌঁছে দেয়া হয়। এরই জের ধরে বংশে যে পুত্রবধু আসে, তাকে অতি অবশ্যই ধার্মিক হতে হয়।
শারারের মা শুরুতে ধার্মিক ছিলেন না। তবে রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়ায় নামাজ-রোজার প্রতি মনোযোগী হওয়া তাকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়েছিল। প্রথম দুটি সন্তান মারা যাওয়ার পর যখন ডাক্তার বললেন, তিনি আর মা হতে পারবেন না। গর্ভধারণ জনিত কিছু জটিলতার কারণে তার জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। তখন তিনি জাগতিক সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বাড়ির ভেতর মহিলাদের জন্য একটি নামাজঘর তৈরি করা হয়েছিল। সেখানেই রাতদিন পড়ে থাকতেন। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন তিনি। সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করতেন। এদিকে শফিকুল চৌধুরী নিজেও ধার্মিক মননের। তার মা তাকে গড়ে তুলতে সবার আগে ধর্ম শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনিও ব্যবসায় পরিচালনার ফাঁকে যখনই সময় মিলত, মসজিদে গিয়ে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত তুলতেন। এরই মধ্যে হঠাৎ কীভাবে যেন এক পরনারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেলেন। হয়তো তার ঈমান ঠিক ছিল না। শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে বিপথে চলতে শুরু করেছিলেন। হয়তো স্ত্রীর উদাসীনতা তাকে বাইরের জগতে ঠেলে দিয়েছিল। বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে মদে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখনই এক নারীর সাথে পরিচয়, তারপর প্রেম। ফলে দ্বিতীয় সংসার শুরু হলো অতি সঙ্গোপনে। সেই স্ত্রীর সন্তানই হচ্ছে শারার। ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে ওর মা। সেই মৃত্যু একজন স্বামী বা একজন সন্তানের কাছে কোনোভাবেই কাম্য না হলেও শফিকুল চৌধুরী এক প্রকার হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। কারণ, প্রতি ক্ষণে তার মনের মধ্যে খচমচ করত। প্রথম স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ে যাবার ভয় তাড়িয়ে বেড়াত। ক্ষণিকের মোহে পড়ে বিয়ে করলেও ক’দিন বাদে তার উপলব্ধি হয়েছিল, ব্যাপারটা খুব খারাপ হলো। প্রথম স্ত্রীর কানে এই খবর গেলে দুনিয়ার সর্বনাশ হয়ে যাবে। তারপর তক্কে-তক্কে ছিলেন কতদিনে বিয়েটাকে গোপন রাখা যায়। ভাগ্য ভালো ছিল এখানেই, দুনিয়ার কোনো ব্যাপারেই প্রথম স্ত্রীর আগ্রহ থাকত না। সারাক্ষণ আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।
শারারকে এরপর নিজ বাড়িতে নিয়ে এসেছেন শফিকুল চৌধুরী। প্রথম স্ত্রীর কোলে তুলে দিয়েছেন তাকে। তবে ভুল করেও বলেননি, ছেলে তারই ঔরসজাত। শুধু বলেছেন, ছেলেটার বাবা-মা কেউ নেই। পালক ছেলে বিধায় প্রথম স্ত্রীর মনোযোগ একটু হলেও সংসারে ফিরল। অন্তত এই ছেলের মৃত্যু নিজ চোখ দেখতে হবে না তার। তাই সাগ্রহে ছেলেকে লালন-পালন করতে ব্যস্ত হলেন তিনি। শফিকুল চৌধুরীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। শারারের জন্মের সময় একদমই যে ঝামেলা হয়নি, তা নয়। যমে-মানুষে টানাটানি হয়েছিল। ডাক্তার স্পষ্ট বলেছিল, সন্তান অথবা মা যে কোনো বাঁচানো যাবে। শফিকুল চৌধুরী সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন।
তারপর শারারের উপর বহু ফাঁড়া এসেছে। কিন্তু তার পালক মায়ের কারণে সবটাতেই উৎরে গেছে সে। ছোটবেলা থেকেই সারাক্ষণ দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দেয়া হতো তাকে। কখনোবা পীর বাবার দরবারে নিয়ে যাওয়া হতো। বড় হবার পর অবশ্য ফাঁড়া কেটেছে অনেকখানি। এখন আর অত সমস্যা হয় না। কিন্তু ছেলের মতিগতি সন্দিহান। জন্ম-ফাঁড়া কেটে গেলেও তার মধ্যে বিপথে যাবার প্রবণতা বেশি। একমাত্র ছেলে হিসেবে তাকে যতই বৈষয়িক দিকে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করেন না কেন, শারারের আনন্দ কেবল টাকা উড়ানোয়। বন্ধুবান্ধবদের সাথে ফুর্তি করতে তার জুড়ি নেই। ছেলেরা তো বটেই, মেয়েরাও শামিল হয় সেই ফুর্তিতে। শফিকুল চৌধুরী সর্বক্ষণ ছেলের পেছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রাখতেন, যার প্রধাণ কাজ ছিল ছেলেকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনা। যেসব মেয়েরা শারারের আশপাশে ঘুরঘুর করে, তাদেরকে কোনো না কোনো উপায়ে হটিয়ে দেয়া। এতকাল ছেলে পড়াশুনা করেছে। তাই অতটা লাগাম টেনে ধরতে পারেননি। এখন নিজ অফিসে ঢুকিয়েছেন। তাই এখন আর গুপ্তচর লাগিয়ে রাখার দরকার মনে হয়নি। সপ্তাহে পাঁচদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শারার অফিসেই থাকে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বাসায় থাকার নির্দেশ জারি করা হয়েছে তার উপর। অর্থাৎ জুম্মা নামাজ পড়তে যেতে হবে বাবার সাথে। তারপর আবার বাসায় ফিরে দুপুরের খাওয়া হবে একসাথে। সপ্তাহের এই দুটো দিন বাবা-মা আর ছেলে মিলে একসাথে খাওয়া-দাওয়া করবে, এটাই নিয়ম। সেকারণে শারার খুব একটা সময় পায় না বন্ধুদের সাথে দেখা করার। তবে শুক্র-শনিবার বিকেলে সে বাইরে যায়। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বা কোনো অনুষ্ঠানে। তখন ফিরতে রাত করে। তবু তিনি অতটা গা করেন না। ছেলে বড় হয়েছে। নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছে। এখন গুপ্তচরগিরি না করলেও চলবে। অতি শাসনে ছেলের বিগড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই অতটুকু ছাড় তিনি দিয়েছেন।
ইদানীংকালে এও লক্ষ করেছেন, শারার লাঞ্চের সময় কোনো না কোনো বাহানায় বাইরে যায়। এরপর আর অফিসে ফেরে না। এই ছাড়ের জন্যই অতটা পাত্তা দেননি। কিন্তু আজ ফোনের ওপাশে মেয়েলি কন্ঠের কথাগুলো শুনে তার মনে হলো, বড় ধরনের কোনো ঘাপলা আছে। তবে কি ছেলে আবার বিপথে চলতে শুরু করেছে? তাকে লুকিয়ে খারাপ ধরনের কোনো কাজে কি লিপ্ত হয়েছে? মেয়েলি কন্ঠের কারণে টেনশন আরও বেশি হচ্ছে। কে এই মেয়ে? শারারের সাথে তার কী সম্পর্ক?
শারার তখনই ফোনের লাইন কেটে দিয়েছে খট করে। এরপর আর কলব্যাক করেননি তিনি। তবে চুপচাপ বসেও নেই। মোবাইল কোম্পানীতে খোঁজ লাগিয়ে শারারের লোকেশন জেনে নিয়েছেন। বিশ্বরোডের কোনো এক জায়গায় দেখাচ্ছে লোকেশন। ঠিকানা যেটা জানা গেছে, ওটা একটা রেস্টুরেন্ট। নাম স্বর্ণপাতার থালা। শারার কি তবে কোনো মেয়ের সাথে লাঞ্চ করতে ওখানে গেছে? কোনো ঝামেলা হয়েছে নিশ্চয়ই। ওই মেয়েটাই হয়তো শারারকে ইচ্ছেকৃতভাবে ডেকে নিয়েছে যাতে আচ্ছামতো প্যাঁচ লাগানো যায়।
আপাতত ঠিকানা অনুসারে রওনা হয়েছেন ওদিকে। রেস্টুরেন্টে পৌঁছুবার পর বুঝা যাবে ঘটনা আসলে কী। কিন্তু টেনশন কমাতে পারছেন না একটুও। গাড়ি ছুটছে কিন্তু মনে হচ্ছে সময় থেমে আছে। কিংবা মরীচিকার উদ্দেশ্যে চলছেন তিনি। নাহ, এই ছেলেকে নিয়ে আর পারা গেল না। যতই শাসনে বা কড়া নজরে রাখেন, বংশের রক্ত আছে তার গায়ে। এই ছেলে তো সোজা পথে চলার নয়!
(চলবে)