নেশাক্ত তোর শহর পর্ব-০৬

0
653

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৬

গ্ৰীষ্মের মাঝামাঝি সময়। মধ্যাহ্ন ছাড়িয়েছে। সূর্যের তীব্র রশ্মিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষ। ঘামে শরীরের জামাকাপড় এক প্রকার লেপ্টে আছে শরীরে। একটার পর একটা গাড়ির রাস্তা অতিক্রম করে চলেছে। কখনো জ্যামের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কখনো শুনশান নীরবতায় গাড়ি ছুটে চলেছে। ইমারজেন্সি থাকার কারণে সকালে না খেয়েই বেরিয়েছে তাহসান। ভাইকে দুপুরের খাবার পৌঁছে দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তৃষ্ণা। মিনিট দশেকের জায়গায় পাক্কা পঁচিশ মিনিট পর সিএনজি এসে থেমেছে হসপিটালের সামনে। সিএনজির ভেতর থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে ভাইয়ের হসপিটালে এসে পৌঁছেছে কি-না পরখ করে নিলো তৃষ্ণা। ঠোঁটের কোণে তখন এক তৃপ্তিকর হাসির রেখা দেখা গেল তার। ডোর খুলে বামপা বাড়িয়ে মাটি স্পর্শ করলো সে। মাথা এগিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে পার্স বের করে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিল। ড্রাইভার ক্যাশ বাক্সে টাকাটা রেখে দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো। টাকাটা নিলো না তৃষ্ণা। মৃদু হেসে ভেতরে থেকে টিফিন ক্যারিয়ার বের করে হসপিটালের ভেতরে ঢুকে গেল।

ভাইয়ের চেম্বারে বসে বাইরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে তৃষ্ণা। এখনো তাহসানের আসার খবর নেই। এসিস্ট্যান্ট পাঠিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেছে তাহসান। তাই শান্তমনে ভাইয়ের কেবিনে বসে আছে।

কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কারো প্রবেশের পদধ্বনি কানে এলো তৃষ্ণার। চমকে উঠলো না সে। ভালোভাবেই জানে ভাই এসেছে। তাহসান পড়নের এফ্রোন খুলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। তৃষ্ণা ভাইয়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে খাবার গুলো যত্ন সহকারে সাজিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো ভাইয়ের জন্য।

তাহসান বের হয়ে তোয়ালের সাহায্যে শরীরের পানি গুলো মুছে খাবার খেতে বসলো। খাওয়ার ফাঁকে ভাইয়ের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলল…

— “ভাইয়া তুমি খাওয়াতে এতো অনিয়ম করছ কেন”?

আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে পূর্ণরায় সম্পূর্ণ মনযোগ খাওয়া দিলো। কিন্তু খাবারটা শেষ করলো না। হাত ধুয়ে অস্বাভাবিক কন্ঠে বলল ..

— “জানিস তৃষ্ণা,, তুই আর তিশা আমার কাছে অধিক প্রিয়। কতোটা প্রিয় বোঝাতে পারবো না।
ঠিক তেমনি বোনগুলো সবসময় ভাইয়ের কাছে প্রিয় হয়।‌ আজ বোনের জন্য ভাইয়ের কান্না দেখে হতবাক হয়ে গেছি আমি। জানিস,
গত দুদিন আগে হসপিটালে দুইজন ভাই -বোন এডমিট হয়েছে। বোনকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিতে গিয়ে গাড়িটা হঠাৎ এক্সিডেন্ট হয়েছে। ভাইয়ের মাথায় সামান্য তম আঘাত লেগেছে আর বোনের পুরো শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে ব্লাড লস হয়েছে। ভাই সব জায়গায় পাগলের মতো খুঁজেও রক্তের যোগার করতে পারে নি। মেয়েটা বাঁচবে কিনা এখনো সিউর জানা নেই”।

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন তাহসান। তৃষ্ণা মাথা নিচু করে এক দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাই বোনের জন্য কষ্ট হচ্ছে তার। আচম্বিতে তার ভেতরে অদ্ভুত এক পরিবর্তন এলো। যে করেই হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে, অন্তত তার ভাইয়ের জন্য। প্রয়োজনে পুরো ভার্সিটি খুঁজে রক্তের যোগার করবে সে। চক করে প্রশ্ন ছুঁড়ল।

— “ভাইয়া, মেয়েটার ব্লাড গ্ৰুপ কি”?

–” A-“।

শরীরটা চেয়ারে হেলিয়ে দিয়ে বড় সড় শ্বাস টানলো সে। নিজেকে সামলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল…

— “ভাইয়া আমি রক্ত দিতে চাই। আমি কাউকে ডোনেট করছি না। এটা তার ভালোবাসা প্রতি শ্রদ্ধা”।

তিনি জানতেন, তার বোনের রক্তের গ্রুপের সাথে মেয়েটির রক্তের গ্ৰুপের মিল রয়েছে। কিন্তু সরাসরি বোনকে প্রেসার দিতে চাই নি, তাই উল্টোভাবে বলে বোনকে ইমপ্রেস করেছে।

বোনের দিকে তাকালেন তাহসান। বোনের চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। চোখের অশ্রু গুলো টলটল করছে। নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। তার বোনকে আজ মহীয়সী নারী থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না। আজ গর্ব হচ্ছে তৃষ্ণার জন্য। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি দিয়ে বললেন..

— ব”ড় হ বোনু। অনেক বড় হ। দেশের এবং দশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত কর।
চল তাহলে”।

সাথে সাথে দুজনেই বেরিয়ে গেল।

বর্তমানে__

নিষুপ্তি উগ্ৰে বেডের পাশে হাত রাখতেই ফাঁকা অনুভব করলো আয়াত। দ্রুত চোখ খুলে পাশে তাকালে তৃষ্ণার ঘুমন্ত মুখটা তার নজরে এলো না। মনের মাঝে চরম ভয় কাজ করলো তার। তাহলে কি তৃষ্ণা চলে গেছে। বেডের উপর ভর করে উঠে বসলো সে। বেলকেনির দরজা খোলা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল। তৃষ্ণাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। শব্দহীন পায়ে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে পাশে বসে পড়লো। বাইরে তখন রোদের সোনালী আলোর খেলা চলছে। আজকে তৃষ্ণার ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু। কালকে রাতে তাহসান বই খাতা দিয়ে গেছে। দুগালে হাত রেখে স্লো কন্ঠে বলল…

— “তৃষ্ণা। এই তৃষ্ণা। দেখো সকাল হয়ে গেছে। ভার্সিটিতে যাবে না”।

নিভু নিভু চোখ খুলে তাকালো তৃষ্ণা। পূর্বের ন্যায় চোখ বেষ্টিত করে ধরা গলায় বলল..

— “প্লীজ আয়াত ঘুমাতে দাও। প্রচুর ঘুম পেয়েছে। কালকে থেকে সত্যি কলেজে যাবো দেখো”।

ফোঁস করে দম ছাড়লো আয়াত। সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে গেছে এখনো বলছে কালকে ভার্সিটিতে যাবে। দোলনার হাতল থেকে মাথা তুলে কাঠ কাঠ গলায় বলল…

— “কবে যাবে সেটা আমার জানার দরকার নেই। আজকে যাবে কি-না সোজা উত্তর দিবে”।

বেশ সুবিধা হলো তৃষ্ণার। আয়াতের হাত ছাড়িয়ে ঘুম ঘুম চোখে সংক্ষেপে উওর দিলো… ” না”
প্রচন্ড পরিমানে রেগে গেল আয়াত। ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়ালো। ভেতরে যেতে যেতে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে গেল..

— “আমি বুঝে গেছি, তুমি কি চাইছ। আজ বলছ, কাল যাবে আর কাল বলবে পরশু যাবে। এমন করলে তোমার আর যাওয়া হবে না। তারচেয়ে বরং আমি তোমার বই খাতাগুলো পুড়িয়ে ফেলি”।

মস্তিষ্ক সচল হতেই চোখ বড় বড় করে তাকালো তৃষ্ণা। নিজের পাশে আয়াতকে না দেখে একছুটে দৌড়ে রুমে চলে গেল। আয়াতের কোনো বিশ্বাস নেই। সে-সব করতে পারে।
আয়াত বই ছোঁয়ার আগেই কেড়ে নিল তৃষ্ণা। বইগুলো বুকে আগলে কপাল কুঁচকে জবাব দিলো..

— “আপনি তো দেখি, মহা-ধুরন্ধর লোক। আমি একবারও বলেছি, আজকে যাবো না। আপনি ঘুমের ঘোরে কি শুনেছেন , তারজন্য বইগুলোকে”।

— “হয়তো। তুমি এখানে তৈরি হয় নাও। আমি নিচ থেকে আসছি”।(যেতে যেতে আয়াত)

আয়াতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সময় নিয়ে ভেংচি কাটলো তৃষ্ণা। অতি দ্রুত বইগুলো বেডের উপর রেখে ওয়াশরুমে ছুটল। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে আবার খুলে বেরিয়ে এলো। আয়াতের জ্বালায় জামা কাপড় নিয়ে যাওয়া হয়নি। কাবার্ড থেকে শুভ্র রঙের চুড়িদার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। আয়াত যদি এসে আগের মতোই দেখে তাহলে এবার নির্ঘাত বইগুলো ছাই হতে সময় লাগবে না।
.
অনেকদিন পরে আবার ভার্সিটিতে যাবে। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠবে।কখন ফিরবে জানে না, তাই সকাল সকাল শাওয়ার সেড়ে নিল তৃষ্ণা। কোনোরকম মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে রুমের এক কোণ থেকে অন্য কোণে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে। কখনো এটা তো কখনো ওটা। বুঝে উঠার আগেই পা স্লীপ করে ধপাস করে নিচে পড়ে গেল। আপনাআপনি মুখ থেকে বের হয়ে গেল,, “আহহ”! সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নিল। উঠতে গিয়ে ব্যাথায় আবার পড়ে গেল। পায়ে ব্যাথা লাগে নি। কোমরে প্রচুর ব্যাথা পেরেছে। হাত পা ছড়িয়ে ফ্লোরে শুয়ে এক্সারসাইজ শুরু করে দিল। যাতে ব্যাথাটা কন্টালে আসে।
এক্সারসাইজ শেষ হওয়ার আগেই আয়াত রুমে প্রবেশ করলো। তৃষ্ণাকে এক্সারসাইজ করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এক হাঁটু গেড়ে নিচে উঁকি দিয়ে বলল..

— “একটু আগে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পেলাম। বাই এনি চান্স, তুমি পড়ে যাওনি তো”।

তৃক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তৃষ্ণা। একেই তো কোমরে অসম্ভব ব্যাথা অন্যদিকে আয়াতের গাঁ জ্বালানো কথা বার্তা। কর্কট কন্ঠ বললো..

— “চোখে দেখেন না, কালা না-কি? দেখছেন এক্সারসাইজ করছি। আবার জিজ্ঞেস করছেন। জীবনে কখনো এক্সারসাইজ করেছেন ?
হাউ ফানি! এক্সারসাইজ আর আপনি। যদি এক্সারসাইজ নামটাও শুনতেন তাহলে আপনার শরীর গন্ডারের মতো থাকতো না”।

বলেই উচ্চ শব্দে হেঁসে উঠলো তৃষ্ণা। তৃষ্ণার হাসির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল..

— “আমি জানি, আমার শরীর গন্ডারের মতো। আসলে নিচ থেকে একটা হাতি পড়ার শব্দ পেয়েছিলাম। তাই দেখতে এলাম, আমার ঘরে কতোবড় হাতি (🐘) বাসা বেঁধেছে।”

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো তৃষ্ণা। স্লীম হওয়াতে সবাই তাকে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা বলে আর আয়াত বলছে হাতি। হাতির বাচ্চা বললেও মানানসই ছিলো।

— হেই মিস্টার আমাকে আপনার হাতি মনে হচ্ছে।(রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তৃষ্ণা)

(চলবে)