নেশাক্ত তোর শহর পর্ব-০৭

0
607

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৭

ব্র্যাক সিটে বসে আছে আয়াত তৃষ্ণা। আয়াত বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কিছু একটা মনে হতেই ধীরে ধীরে সেটে গেল তৃষ্ণার দিকে। দৃষ্টি পূর্বের মতোই বাইরে আছে। শুধু নিজের সিট থেকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যাতে তৃষ্ণা কিংবা সামনে বসে থাকা আরোহী আর ড্রাইভার কিছু বুঝতে না পারে।
তৃষ্ণার শরীরে কারো স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো পাশে। আয়াতকে নিজের খুব কাছে দেখে ঘাবড়ে গেল সে। নিশ্চুপ হয়ে আরেকটু জানালার দিকে সেটে গেল। আয়াতের দিকে আর না ঘুরে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে পূর্বের ন্যায় তৃষ্ণার শরীর ঘেঁষে বসলো। সিটে রাখা তৃষ্ণার হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। শিউরে উঠলো তৃষ্ণা। বুকের ভেতরের ধুক পুকানী ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তিন ফুট দ্রুতে থাকা যে কেউ আওয়াজ শুনতে সক্ষম হবে। আয়াত সেই শব্দের তোয়াক্কা করলো না। বরংচ নিজের মাথাটা তৃষ্ণার কাঁধে রেখে কোমর জড়িয়ে ধরলো।

স্তব্ধ হয়ে গেল তৃষ্ণা। কোমরের ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠছে। তখন পাত্তা না দেওয়াতে এখন প্রচুর ব্যাথা করছে। সবটা বোধগম্য হতেই নিঃশব্দে হাত ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। বিরক্তি নিয়ে পাশে তাকালো। আর জায়গা বাকি নেই। হাত ঝাড়া মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো..

— “আয় আমার কোলে এসে বস। সরি, আমার কোলে কেন বসবেন? একটা কাজ করুন হাতির কোলে গন্ডার বসুক। জীবনে কখনো তো দেখেন নি, এবার দেখে নিন”।

তৃষ্ণার বিরক্তিকর কন্ঠে সামনে বসে থাকা আরোহী ভ্রু কুঁচকে তাকালো পেছনে। সাথে সাথে তৃষ্ণার থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল আয়াত। হাই তোলার ভঙ্গি করে মাথা চুলকে বলল..

— “দেখতে পারছিস পার্সোনাল সময় কাটাচ্ছি আর তুই তার বেঘড়া না দেওয়া পর্যন্ত থামবি না”।

সিটের উপর শরীরের সমস্ত ভড় দিয়ে আয়াতের দিকে একটু এগিয়ে বলল..

— “এটা তোর বেডরুম নয় ব্রো। তাই পার্সোনাল সময়টা কন্সিনটেশন করিস না”।

লজ্জা পেল তৃষ্ণা। দুহাতে মুখ গুঁজে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল। ভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়ার আগ পর্যন্ত গাড়ির ভেতরে তেমন আর কোনো কথা হলো না।
.
আনমনে ক্যাম্পাসের ভেতরে দিয়ে হেঁটে চলেছে তৃষ্ণা। উদ্দেশ্য সোজা ক্লাসরুমে যাওয়া আর ক্লাস শেষে বাড়ি পৌছানো। অন্যমনস্ক হয়ে হাটার ফলস্রুতি স্বরুপ অপরিচিত লোকের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। কিছুদিন থেকে হুটহাট পড়ে যাওয়া একটা অভ্যসে দাঁড়িয়েছে তৃষ্ণার। কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকালো।” কে রে” সম্পূর্ণ করতে পারলো না। চোখের অগোছালো পলকগুলো থেমে গেল। হারিয়ে যাওয়া ক্ষতগুলো তাজা হতে লাগল। তার সামনে রিজভী আর তিশা দাঁড়িয়ে আছে। গভীর ভাবে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল তৃষ্ণা।দুজনকে পাশাপাশি কতোটা সুন্দর লাগছে। আচ্ছা যদি তিশার জায়গায় তৃষ্ণা থাকলো। তাহলে কি এতোটা সুন্দর লাগত। কথাগুলো ভেবেই জিভ কিটলো তৃষ্ণা। কিসব ভাবছে সে। এখন তৃষ্ণার উপর একমাত্র আয়াতের অধিকার। তার ভাবনা জুড়ে শুধু আয়াত থাকবে, রিজভী নামের কেউ না। ধরা গলায় মলিন হেসে বলল..

— “কেমন আছিস আপু। আমাদের ছোট পুচকু কেমন আছে রে। আর রিজভী.. মাই মিন ভাইয়া। আমার বোন এতো শুকিয়ে গেছে কেন? একটু কেয়ার টেয়ার তো করতে হবে‌।
আর তুই এই অবস্থায় বাইরে বেরিয়েছিস কেন? যা বাড়িতে যা আর হ্যা পুচকুর যত্ন নে,

মিনিট পাঁচেক পেরুবার আগেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল তৃষ্ণা। নিজেকে শক্ত রাখতে পারছে না। তবুও দূর্বল প্রমান করতে চায় না। অন্তত নিজের জন্য। ক্যাম্পাসের মাঝে বসে পড়লো সে। বেশ কিছুক্ষণ সময় ভেবে আয়াতকে ফোন করলো।প্রথমবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো না। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ হলো।
আয়াতকে কিছু বলতে না দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তৃষ্ণা। ভড়কে গেল আয়াত। একটু আগেও মেয়েটাকে স্বাভাবিক দেখেছিল। সামান্য সময়ের ব্যবধানে কি এমন হলো। বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজেকে সংযত করে আশ্বাসের কন্ঠে বলল..

— “পিয়াসু, এই পিয়াসু। কি হয়েছে তোমার পিয়াসু পাখি। আমাকে বলো”।

কান্না থামিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল..

— “আয়াত ..! তুমি কোথায়? প্লীজ আমার কাছে এসো”।

— “চিন্তা করো না। আমি এখুনি আসছি। তুমি লাইন কেটে না”।

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল আয়াত। আজকে ইম্পর্ট্যান্ট ছিল। মিটিং ক্যান্সেল করে দিলো।

অবশেষে এসে পৌঁছালো ভার্সিটির সামনে। ড্রাইভার আসে পাশে না থাকায় নিজেই ফুল স্পিডে ড্রাইভ করে চলে এসেছে। যেন ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা করলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। প্রতিটা সময় ফোনে হ্যালো হ্যালো করে শান্তনা দিয়েছে। গাড়ি থামতেই ভার্সিটির ভেতরে ছুটল। তৃষ্ণার ক্লাস জিজ্ঞাসা করার আগেই চোখ গেল ক্যাম্পাসের ভিড় করা মানুষের মাঝে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখল, তৃষ্ণা হাঁটু ভাঁজ করে নাক টেনে কাঁদছে। লাইন কেটে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। চোখ বন্ধ করে শান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে তৃষ্ণার গা ঘেঁষে বসে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হচ্ছিল তৃষ্ণাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।

মুখ তুলে গালে হাত রেখে বলল..

— “এই পিয়াসু কাঁদছ কেন? চোখ তুলে দেখ, আমি এসেছি। তোমার কোনো ভয় নেই। কি হয়েছে বলো আমাকে”।

চোখের সামনে আয়াতকে দেখে সময় অবিলম্ব না করে ঝাপিয়ে পড়ল চিবুকে। চাঁপা কান্না থামিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। পিঠে হাত রাখলো আয়াত। জিজ্ঞাসু সুরে বলল..

— “কি হয়েছে পিয়াসু বলো আমাকে”?

চোখ তুলে আয়াতের দিকে তাকালো তৃষ্ণা। যে-চোখে তার জন্য লুকিয়ে আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। তাকে শান্ত করার অদম্য ইচ্ছা। সেই ছেলেটাকে কিভাবে বলবে অন্য একটা ছেলের দেওয়া ধোঁকার জন্য এভাবে কাঁদছে। আচ্ছা আদোও কি সে এমন স্বার্থহীন ভালোবাসার যোগ্য। মাথা নিচু করে করুন সুরে বলল..

— “আসলে আমার ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না। তাই এমন করেছি..

চোখ গরম করে তাকালো আয়াত। ইতিমধ্যে ভার্সিটি জুড়ে আয়াত তৃষ্ণার কথা ছড়িয়ে পড়েছে। দুহাতে বাহু ঝাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল…

— “তোমার ধারণা আছে, আমি কতোটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ক্যান্সেল করে এসেছি। তাও তোমার এইসব ন্যাকামীর জন্য।
আর আপনাদের কোনো ক্লাস নেই, এখানে দাড়িয়ে ফালতু ন্যাকামো দেখছেন। আ’ম আয়াত রিদুয়ান। তৃষ্ণার হাসবেন্ড। এখন যান এখান থেকে”।

ধীরে ধীরে ভিড় জমানো ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে শুরু করলো। সাথে সাথে ভেতরে ভয় জমতে শুরু করল তৃষ্ণার। কিন্তু আয়াত কোনো বাক্য উচ্চারণ করলো না। উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। খসে পড়া ব্যাগটা পূর্ণরায় কাঁধে ঝুলিয়ে আয়াতের পিছু পিছু ছুটল তৃষ্ণা। আয়াত যে তার উপর রাগ করেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সত্যি কথাগুলো শুনলে হয়তো কষ্ট পেত, তারচেয়ে রেগে আছে এতেই ডের ভালো।
.
দু’জনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো রিজভী -তিশা। বোনের কথা শুনে থামাতে এসেছিলো তিশা। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে বোনকে ধরার আগেই পাশ কাটিয়ে অন্য একটি ছেলে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে গেল। প্রথমে ছেলেটির বিহেব বুঝতে ব্যর্থ হলেও পরে যখন হাসবেন্ড শুনেছে তখন চমকে উঠেছে। তার জানামতে তৃষ্ণা রিজভীকে ভালোবাসে। সামান্য কিছুদিনের তফাৎ এ কিভাবে এটা সম্ভব। মুঠোফোন থেকে তাহসানের নাম্বারে ফোন করল।

_____________________
— “এইযে শুনছেন? এভাবে মুখ ফুলিয়ে আছেন কেন? বলছি তো আ’ম সরি। প্লীজ এভাবে রাগ করে থাকবেন না। এই দেখুন আমি কান ধরছি”।(কানে ধরে তৃষ্ণা)

লুকিং গ্লাসে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আয়াত। এই নিয়ে ১৩ বার সরি বলছে কিন্তু আয়াত ফিরেও তাকায় নি। মেয়েটার মধ্যে সত্যিই এক অদ্ভুত জাদু আছে। যতই চেষ্টা করছে কথা না বলতে ততই দূর্বল হয়ে পড়ছে।
ফোনটা বের করে কানে ধরা অবস্থায় একটা পিক তুলে নিলো। আকস্মিক ঘটা এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিল না তৃষ্ণা। কান ছেড়ে আয়াতের ফোন নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
হঠাৎ ব্রেক করতে সামনে ঝুঁকে গেল তৃষ্ণা। সামনে তাকিয়ে আয়াতের দিকে তাকালো। আয়াত গাড়ির চাবি নিয়ে, সিট বেল্ট খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল..

— “আজ সারাদিন পার্কে ঘুড়বো আর বাদাম খাবো। যদি কেউ যেতে চায়। তাহলে যেতে পারে। আমার কোনোরুপ সমস্যা নেই”।

(চলবে)