নেশাময় ভালোবাসার আসক্তি পর্ব-৩৫ এবং শেষ পর্ব

0
112

#নেশাময়_ভালোবাসার_আসক্তি
#পর্ব -৩৫ (শেষ পর্ব)
#নীলাম্বরী_সেন_রাধিকা

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদিও পোস্ট করেন লেখিকার নাম উল্লেখ করে পোস্ট করবেন)

আজ আসাফ আর তন্বীর বিয়ে। অনেক কষ্টের বিনিময়ে আসাফ তন্বীকে নিজের প্রেয়সী হিসেবে পাচ্ছে। এর জন্য কম কাঠঘর পুড়াতে হয়নি। তন্বী শুধু একটা কথাই বলেছে সে প্রেম বিষয়ক কোনো কিছুই করতে ইচ্ছুক নয়। যদি কোনো সম্পর্ক বানাতে চাই তাহলে তার পরিবার ও আসাফের পরিবারের সম্মতি নিয়ে নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানাতে হবে। এরপর না হয় প্রেম করা হবে। একবার একজন কে বিশ্বাস করে ঠকেছে। আর ঠকতে চাইনা সে। সেতো ডিসিশন নিয়ে নিয়েছিল যে কখনও কাও কে নিজের জীবনে অর্ধাঙ্গ হিসেবে জড়াবে না। কিন্তু আসাফ এর কয়েক মাসে তাকে এতটা স্পেশাল ভাবে নিজেকে উপলব্ধি করিয়েছে যে আবার তাকে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হয়েছে। কিন্তু সে অবাক হয়েছে তখন যখন আসাফ কে এসব বলার পর পরদিনই আসাফ তার পরিবার নিয়ে হাজির হয়েছে। সাথে আদ্রিয়ান মেঘাও ছিলো। তন্বীর মা বাবা আসাফ কে খুব পছন্দ করে। আর তার এক সপ্তাহ পরই তাদের বিয়ে ধার্য করা হয়। সেই বিশেষ দিনটি আজ।

তন্বী বউ সেজে স্টেজে বসে আছে। সাথে মেঘা, তন্বীর কাজিন, বান্ধবীরাও আছে। সবাই খুব মজা করে আড্ডা জমাচ্ছে আর একটু পর পর তন্বীকে লজ্জাজনক কথাও বলছে। তন্বীও সেই লাজুকবরণ কথা শুনে তার দৃষ্টি লাজুকতায় ছেয়ে যাচ্ছে। আজ মেঘা খুব সুন্দর করে সেজেছে। আসাফ কে সে তার আপন ভাই এর মত শ্রদ্ধা করে। আর তন্বী তো তার বেস্ট ফ্রেন্ড। তার আনন্দ যেনো দ্বিগুণ ভাবে উৎসাহিত হচ্ছে। কিন্তু তার আনন্দে ব্যাঘাত ঘটাতে একজন তো সব সময় থাকে। এই যে মেঘার সাথে দুইজন কেয়ার টেকার দিয়ে রেখেছে। কখন কি মেঘার লাগবে তা তদারপি করার জন্য। অবশ্য মেঘাও এতে বিরক্ত হয়নি। কারণ আদ্রিয়ান এর এরূপ কাজ করাটা যুক্তিযুক্ত। মেঘা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ডক্টর এখনই মেঘাকে কনসিভ করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করছে না। মেঘার শরীর এখন খুব দূর্বল। প্রেগেন্সি তে অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। এসব শুনে আদ্রিয়ান মেঘাকে বলেছিল বাচ্চাটা না নিলে ভালো হতো। তার যদি কিছু হয়ে যায় তখন আদ্রিয়ান কি করবে। দরকার হলে পরে আবার বেবি নিবে। কিন্তু মেঘা আদ্রিয়ান এর এরূপ কথা শুনে প্রচন্ড কষ্ট পাই। কারণ আদ্রিয়ান তাদের ভালোবাসার অংশ কে রাখতে চাইছে না। এই নিয়ে অনেক মনোমালিন্য হয় আদ্রিয়ান এর সাথে। প্রায় এক সপ্তাহ মেঘা আদ্রিয়ান এর সাথে কথা বলেনি। আদ্রিয়ান যখন দেখলো মেঘা জিদ ধরে বসে আছে তখন সেও মেঘার কাছে হার মানলো। কিন্তু শর্ত দিলো আদ্রিয়ান যেইসব নিয়ম অবলম্বন করতে বলবে সেইসব যাতে মেঘা মেনে চলে। মেঘাও এতে রাজি হয়ে যায়। এরপর থেকে শুরু হয় আদ্রিয়ান এর কেয়ারিং টর্চার। এই করোনা ওই করোনা এই টা খাও ওইটা খাবে না। উফ এতো কিছু মেনটেইন করতে হচ্ছে যে সে আর কি করবে। কিন্তু তবুও এসবের মধ্যে আদ্রিয়ান এর ভালোবাসা যেনো আরো বেড়েছে।

তন্বী আর আসাফ এর বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে। কিছুক্ষন পরই তারা আসাফ এর বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলো। মেঘারও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু শরীর টা হঠাৎ খারাপ হওয়ায় আদ্রিয়ান তাকে আর যেতে দেইনি। একদম বাড়িতে নিয়ে আসলো। মেঘার ড্রেস চেঞ্জ করে দিয়ে ফ্রেশ করিয়ে খাইয়ে দিল। মেঘা অবশ্য ঐখানে কিছু খেতে পারেনি। তাই আদ্রিয়ান নিজের হাতে কিছু হালকা কিছু খাবার তৈরি করে মেঘাকে খাওয়াতে লাগলো। আদ্রিয়ান কেও মেঘা খাইয়ে দিল। এরপর মেডিসিন খাইয়ে মেঘাকে বুকে নিয়ে আদ্রিয়ান শুয়ে পড়ল। মেঘার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দুইজনই ঘুমের দেশে পাড়ি দিল।

______________________________

অপারেশন থিয়েটারে সামনে লাল রঙের বাতি জ্বলছে। তার সাথে ক্ষণে ক্ষণে মেঘার চিৎকারের আওয়াজ আসছে। এখন রাত প্রায় তিনটে। হঠাৎ করেই মেঘার পেইন হতে শুরু করে। আদ্রিয়ান তখন ঘুমে ছিলো। মেঘার ফুফানো কান্নার আওয়াজ শুনে তাড়াতাড়ি উঠে দেখে মেঘা ব্যথায় চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে আছে। আদ্রিয়ান তখন দিক বেদিক ভুলে মেঘাকে সামলাতে লাগলো। আদ্রিয়ান তাড়াতাড়ি ফোন করে মেঘার ডক্টর কে পরিস্থিতির কথা বললে ডক্টর এমার্জেন্সি ওদের কে হসপিটাল আসতে বলল। আদ্রিয়ানো আর দেরি করলো না মেঘাকে কোলে নিয়ে হসপিটাল এর উদ্দেশ্য রওনা দিলো। সাথে দাদীমা কেও নিলো। পথিমধ্যে আদ্রিয়ান নিশু আর তন্বীকেও খবর দিলো। সবাই সাথে সাথে রওনা দিলো।

আদ্রিয়ান পায়চারি করছে। আর সৃষ্টি কর্তাকে সরণ করছে। কিছুক্ষন পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলো। আদ্রিয়ান বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে কান্না করে দিলো। নার্স বের হলো হাতে তোয়ালো পেছানো এক নবজাতক শিশুকে নিয়ে।

“স্যার আপনার পুত্র সন্তান হয়েছে।”

নার্স এর কথা শুনে আদ্রিয়ান কোলে থাকা সদ্য জন্মানো নবজাতক কে দেখার আগেই

“আমার ওয়াফ কেমন আছে?”

নার্স কিছু বলার আগেই ডক্টর রেয়ানা বের হলো হাসি মুখে

“আদ্রিয়ান মেঘা একদম সুস্থ আছে। শুধু একটু দুর্বল। আর হ্যা এখন থেকে শুধু মেঘার যত্ন নিলে হবে না। আমার এই ফুটফুটে গ্র্যান্ড চাল্ড এরো ঠিক ভাবে কেয়ার করতে হবে তানাহলে…

ডক্টর রেয়ানার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আদ্রিয়ান মেঘার সাথে দেখা করার কথা বললে জানালো যে কিছুক্ষন পরই কেবিনে শিফট করা হবে তখন দেখা করতে পারবে। এইদিকে বাচ্চাটা কে নিয়ে অলরেডী সবাই মাতামাতি করছে। আদ্রিয়ান বাচ্চাটা কে কোলে নিতে ভয় পাচ্ছে। কারণ খুব ছোটো বাচ্চাটা। যদি ব্যথা পাই। আদ্রিয়ান এর মনোভাব দেখে দাদীমা ঠিক করে নিয়ে আদ্রিয়ান এর কোলে দিলো। বাচ্চাটি কোলে নেওয়া মাত্রই ওয় ওয় আওয়াজ করতে লাগলো। আদ্রিয়ান দেখলো বাচ্চাটা ঠিক আদ্রিয়ান এর মতই গায়ের রং পেয়েছে। নাক আর চোখ মেঘার মত হয়েছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আদ্রিয়ান ফুঁফিয়ে কান্না করে দিলো। এরপর বাচ্চাটার কপালে উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া দিলো। এরপর কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু দোয়া পড়ে পুরো শরীরে ফু দিলো। আদ্রিয়ান এর কাণ্ড দেখে সবাই খুব অবাক সাথে তাদের চোখেও খুশির পানি।

“দাদীমা দেখো? আমার আর স্নিগ্ধ পরীর অংশ! কি ছোট্ট না? ওকে আমি আদর করবো কি করে? স্নিগ্ধ পরী ওকে নিবে কি করে? যদি ব্যথা পাই তাহলে?…..

এরূপ আরো অনেক কথা বলতে লাগলো। দাদিমাও একে একে আদ্রিয়ান এর পাগলামি দেখছে আর হাসছে। ছেলেটা বাবা হয়ে গেছে কিন্তু দেখো ছোটো বাচ্চাদের মত আচরণ করছে।

____________________________

পেটের নিচের দিকে চিন চিন ব্যথার আবাসে মেঘার ঘুম ভেংগে গেল। চোখ মুখ খুচকে চোখ খুলে দেখলো আদ্রিয়ান তার দিকে তাকিয়ে আছে। চুল গুলো এলোমেলো। শার্ট এর বোতাম দুইটা খুলা। চোখের অবস্থাও সূচনীয় নয়। কান্না করেছে খুব হয়তো। মেঘার হঠাৎ করেই চোখে পানি চলে আসলো আদ্রিয়ান এর এরূপ অবস্থা দেখে। আদ্রিয়ান মেঘার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিলো।

“উহুম জান আজ কান্নার দিন নয়। আজ আমাদের সুখের দিন। আজ তুমি আমাকে পরিপূর্ণ করেছো জান। বাবা হওয়ার সাধ দিয়েছো। তুমি যবে থেকে আমার জীবনে এসেছো তবে থেকে আমার সম্পর্ণ জীবন টা রঙিন প্রজাপতির মতো রং ছড়িয়ে যাচ্ছে। এতো এতো সুখ আমি কই রাখবো বলোতো সোনা?”

অশ্রু চোখেই আদ্রিয়ান হেঁসে হেঁসে কথা গুলো বললো। মেঘা আদ্রিয়ান হাত ধরে নিজের গালে ছুঁইয়ে

“আপনি নিজেই একজন রঙের রাজা। তাইতো আমার জীবনে এসে এতটা স্পেশাল ভাবে রং ছড়িয়েছেন যে নিজেকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। মনে হবে কি! আমি আপনাকে পেয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিষ অর্জন করেছি।”

আদ্রিয়ান মেঘার কথা শুনে মেঘাকে হালকা আলিঙ্গন করলো। এর মাঝেই দাদীমা বাচ্চাকে নিয়ে ঢুকলো। সাথে তন্বী, আসাফ, নিশি, রুশ। তন্বী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিশিরও ছেলে হয়েছে। নাম আয়ুশ। তার বয়স তিন মাস। নিশির হাসব্যান্ড এর কাছে তার ছেলে ঘুমাচ্ছে। দাদীমা মেঘার পাশে বাচ্চাটাকে মেঘার কোলে নিতে বলল। ফিডিং এর সময় হয়েছে। তাই আদ্রিয়ান মেঘাকে উঠতে সাহায্য করলো। মেঘা ভালো ভাবে বসলে দাদীমা বাচ্চা টাকে মেঘার কোলে দিলো। মেঘা বাচ্চাটার স্পর্শ পেয়ে কান্না করে দিলো। মা হওয়ার অনুভূতি বুঝি এতটা সুখের হয়। আজ সে পুত্র সন্তানের জননী। কাপা কাপা ঠোটে আদ্রিয়ান এর দিকে তাকিয়ে

“আদ্র আমাদের নীলাদ্র?”

মেঘার কথাই আদ্রিয়ান অশ্রু চোখে মাথা নাড়ালো। মেঘা হাসি মুখে তার ছেলেকে আদর করতে লাগলো। একে একে সবাই এসে মেঘা ও আদ্রিয়ান কে কংগ্রাচুলেট করলো। এরপর সবাই বের হয়ে গেলে নার্স এসে মেঘাকে ঠিক ভাবে শুইয়ে দিয়ে বাচ্চাকে ফিডিং করাতে লাগলো। মেঘার শরীর দূর্বল থাকায় ফিডিং করিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আদ্রিয়ান এসব দেখে তৃপ্তির একটি নিশ্বাস নিলো। আজ থেকে তার দায়িত্ব আরও বাড়ল। এখন থেকে সে ভালো স্বামী আর বেস্ট বাবা দুটোর দায়িত্ব পালন করবে। ভবিষ্যত এর চিন্তা করতে থাকলো সে কিভাবে কিভাবে সব কিছু ঘুছাবে। এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে সেও মেঘার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। কেবিনের বেড বড়ো থাকায় তেমন কোনো সমস্যা হলো না। আদ্রিয়ান মেঘার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়ল। মেঘার ঘুম একটু হালকা হলে চোখ খুলে দেখলো আদ্রিয়ান তাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। মেঘা একবার নিলাদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখলো বাচ্চাও দোলনায় ঘুমাচ্ছে। মেঘা নিলাদ্র কে এক হাত দিয়ে দোল দিতে লাগলো আর আরেক হাত দিয়ে আদ্রিয়ান হাত ধরে রাখলো। এরপর ওইভাবেই আবার ঘুমের দেশে পাড়ি দিল।

প্রত্যেক ভালোবাসা যদি এতো মিষ্টির হয় তাহলে সব ভালোবাসা #নেশাময়_ভালোবাসার মতোই আসক্ত হবে। প্রকৃতির স্নিগ্ধ ভালোবাসা গুলো এইভাবেই যাতে পরিপূর্ণ হয়। তাহলেই প্রকৃতি হবে আলোকিত, সুচ্চল।

#সমাপ্ত🥀