পদ্মফুল পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
265

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২৬|

চলন্ত গাড়ি’টা ব্রেক কষলো। ড্রাইভার আড়চোখে তার পাশের লোকটার দিকে চেয়ে বললো,

‘এহন কী করমু, স্যার?’

লোকটি ভারি গলায় বললো,

‘জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে?’

‘না, রি*স্ক হইয়া যাইব। রাস্তা ভীষণ খারাপ আর তার উপর অন্ধকার। গাড়ি উল্টাই যাইতে পারে।’

‘তাহলে স্পিড দে। একটানে এই জায়গা পাড় হবি। সামনে কেউ আসলে ডিরেক্ট উড়িয়ে ফেলবি। বুঝতে পেরেছিস?’

ড্রাইভার লোকটা ভয়ে ভয়ে বললো,

‘কিন্ত, ওরা তো পুলিশ। আমি পারমু না স্যার।’

আরাফাত দাঁত খিঁচে বললো,

‘তুই বোধ হয় ভুলে গেছিস যে, তোর মেয়েও আমাদের কাছে আছে। মেয়ের ভালো চেয়ে থাকলে, যা বলেছি তাই কর।’

লোকটা কাঁদতে লাগল। বললো,

‘আমাগো মাফ কইরা দেন না। আর আমার মাইয়ারে কষ্ট দিয়েন না।’

আরাফাত ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বললো,

‘আগে আমার কথা শোন। সোজা যেতে থাক। গাড়ি যদি থামিয়েছিস তবে আজ খবর আছে তোর।’

ভয়ে ভয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঢোক গিলল সে। এক্সিলেটরে চাপ দিয়ে ফুল স্পিডে চালাতে থাকল। কিছুটা সামনেই পুলিশের গাড়ি। সামনে থেকে ট্রাক আসতে দেখে সতর্ক হয় তারা। আগে থেকেই বেরিকেট দিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তায় বেরিকেট দেখে ড্রাইভার লোকটি আরো বেশি ঘাবড়ে যায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘স্যার, বেরিকেট দিয়া দিছে, এহন কী করমু?’

‘শা*লা, বেরিকেট ভাঙ্গ।’

‘সম্ভব না স্যার। এক্সিডেন্ট হইবো।’

‘যা খুশি হোক, গাড়ি থামাতে পারবি না। স্পিড দে আরো…’

লোকটি আরো স্পিড দিল। গাড়ির স্পিড দেখে পুলিশ’রা আরো সতর্ক হয়ে দাঁড়াল। অফিসার বললো,

‘গাড়ির স্পিড বেড়েছে মনে হয়। এভ্রিওয়ান, বি কেয়ারফুল।’

গাড়িটা কাছাকাছি আসতেই সেখানের পুলিশ’রা সিগনাল দিতে লাগল, গাড়ি থামানোর জন্য। কিন্ত গাড়ি কি আর থামবে? থামার বদলে উল্টো আরো স্পিড বাড়িয়ে গাড়ি সামনের দিকে এগুতে লাগল। অফিসার তাড়া দিয়ে বললো,

‘গাড়ি থামবে না মনে হচ্ছে, ঐদিকটাও বেরিকেট দিন। আর আপনারা সবাই, প্রস্তুত থাকুন। গাড়ি না থামলে ডিরেক্ট শু*ট করবেন।’

‘ওকে স্যার।’

গাড়িটা থামল না। বেরিকেটে জোরে আঘাত করতেই একটা ছিটকে সেগুলো দূরে গিয়ে পরে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সবাই একসঙ্গে ফায়ারিং শুরু করলো। গাড়ির স্পিড তাতেও কমেনি। সবটুকু দিয়ে ছুটে যায় সামনের দিকে। আর কিছু করার নেই দেখে উপস্থিত পুলিশ’রা এক নাগাড়ে শুট করতে থাকে। আর তখনই হয়তো একটা বুলেট গিয়ে গাড়ির চাকায় লাগে যার ফলে গাড়ি ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। এতকিছুর পরও আরাফাত চেঁচিয়ে বলছে,

‘গাড়ি থামাবি না। চালিয়ে যা।’

ড্রাইভার ভীত সন্ত্রস্ত কন্ঠে বললো,

‘স্যার, গাড়ি এহন না থামাইলে এক্সিডেন্ট করবো। পেছনের চাকার হাওয়া বাইর হইয়া গেছে। আমিও আর ব্যালেন্স পাইতেছি না।’

আরাফাত রাগে নিজের চুল ঘামছে ধরে।

‘শা*লা, তোর জন্য আমার এতদিনের পরিশ্রম সব জলে যাবে। থামা গাড়ি।’

গাড়িটা থামল ঠিকই। তবে রাস্তা থেকে অর্ধেক নেমে গেল জঙ্গলে। আরাফাত আর ডানে বামে না দেখে গাড়ি থেকে নেমেই দিল জঙ্গলের দিকে দৌঁড়। একে তো রাত। তার উপর জঙ্গলের ভেতর পুরো অন্ধকার। সে কোন দিকে যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। তাও ছুটে যাচ্ছে নাক মুখ বুঁজে।

.

গাড়ি থামতে দেখে পুলিশ’রা ছুটে এলো। গাড়ি থেকে বেরিয়ে যে কেউ জঙ্গলের দিকে ছুটে গিয়েছে সেটা আর অন্ধকারের ভেতর কারোর চোখে পড়লো না। গাড়ির দরজা খুলেই মধ্যবয়স্ক লোকটা-কে একটা চ*ড় মেরে গাড়ি থেকে নামাল তারা। অফিসার ক্ষেপে গিয়ে বললো,

‘বেরিকেট দেখেও গাড়ি থামাসনি কেন? কী নিয়ে যাচ্ছিলি গাড়ি দিয়ে? পেছনের শাটার খোল।’

লোকটি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বলতে লাগল,

‘আমি কিছু করি নাই স্যার। এইসব করছে ঐ লোকটা। মাত্র এই জঙ্গলের দিকে গেছে। আমার কোনো দোষ নাই। ওরা আমার মাইয়ারে আটকাই রাইখা আমারে দিয়া এসব করাইছে। আর গাড়ির পেছনে আরো অনেক মাইয়া আছে। ওরা নারী পা*চা*রকারী, স্যার।’

অফিসার তার দু’জন লোককে জঙ্গলের দিকে যেতে বললো। যে করেই হোক ঐ লোকটাকে খুঁজে বের করতে হবে। ওকে বের করতে পারলেই এই চক্রের আসল মাথাকেও পাওয়া যাবে।

.

গাড়ির পেছনের শাটার খুলে দেখল সেখানে দশ থেকে বারো’টা মেয়ে। সবারই হাত, পা, মুখ সব বাঁধা। তারা তাড়াতাড়ি করে উপরে উঠে ওদের সবাই হাত, পা, মুখ খুলে দিল। চোখের সামনে পুলিশ দেখে সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল। কেউ কেউ কেঁদে উঠল। অফিসার দেখল সবার মাঝে একজন নিচে পড়ে আছে। কোনোরকম নড়া চড়াও করছে না। অফিসার গিয়ে তার বাঁধন সব খুলে দিল। নাকের কাছে দুই আঙ্গুল রেখে দেখল শ্বাস প্রশ্বাস চলছে কিনা। না, বেঁচে আছে। জ্ঞান নেই হয়তো। অফিসার কনস্টেবল ডেকে পানি আনতে বললো। পানি আনার পর তিনি হাতে খানিকটা পানি নিয়ে মেয়েটাকে পানির ঝাপটা দিতে লাগলো। গাড়ি এত নড়া চড়া করায় মাথার এক পাশে আ*ঘাত লেগেছে তার। চামড়া’টা হালকা ছি*লে গিয়েছে। অফিসার কোনোরকমে তাকে ধরে বসালো। সাথের মহিলা কনস্টেবল কে বললো,

‘উনাকে ধরে গাড়িতে নিয়ে বসান। আর বাকি সবাইকেও নিয়ে যান।’

সবাই একে একে গাড়িতে গিয়ে বসলো।

আশপাশ থেকে অনেক গমগম শব্দ কর্ণকুহুরে ঢুকছে। কে যেন বলছে, “মেয়েগুলোকে আগে হসপিটালে নিতে হবে। তারপর ওদের পরিবারের লোকদেরও খবর দিতে হবে।” আবার কেউ একজন বলছে, “স্যার, এই মেয়েটার জ্ঞান তো এখনও ফেরেনি, কী করবো?”

শরীরে এত বেশি যন্ত্র*ণা করছে যে মনে হচ্ছে হয়তো সে মা*রা পরছে। চোখ মেলে যে তাকাবে সে শক্তিও পাচ্ছে না। সে বুঝতে পারছে তার আশেপাশে কিছু হচ্ছে। তাকে নিয়েই কিছু হচ্ছে। সে চেষ্টা চালাচ্ছে। তাকাতে হবে। দেখতে হবে, তার পাশে কে আছে। এক চোখে হালকা তাকাল। অপর চোখটা এখনও বন্ধ। এক চোখে দেখে কি কিছু বোঝা যায়? এবার দু চোখ কষ্ট করে খুলল সে। প্রথমে ঝাপসা দেখলেও কিছুটা সময় পর সবকিছু পরিষ্কার হলো। চারদিক অন্ধকার। টিমটিমে লাইটের আলোয় অনেকগুলো মুখ। যে মুখগুলোতে ছেয়ে আছে আতংক আর ভয়। আরো দেখল কিছু পোশাকধারী মানুষ। যাদেরকে দেখে এবার তার মনে হলো সে বেঁচে আছে। সে অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগল,

‘পা-পানি খাবো।’

মহিলা কনস্টেবল’টি তাকে ধরে পানি খাইয়ে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

‘এখন সুস্থ লাগছে কিছুটা?’

পদ্ম বললো,

‘আ-আমি ক-কোথায়?’

‘ভয় পাবেন না। আপনি এখন এখানে নিরাপদেই আছেন। আমরা আপনাদের সবাইকে উদ্ধার করতে পেরেছি।’

তারপর সে অফিসারকে ডেকে বললো,

‘স্যার, উনার জ্ঞান ফিরেছে।’

অফিসার সামনে এসে বললো,

‘আপনি ঠিক আছেন?’

মেয়েটি জড়ানো গলায় বললো,

‘জ্বি।’

অফিসার হঠাৎ কী মনে করে জিজ্ঞেস করলো,

‘নাম কী আপনার?’

‘প-পদ্ম।’

অফিসার চমকে বললো,

‘আপনিই পদ্ম? ..এবার তো তাহলে আসল অপ*রাধী ধরা পড়বেই।’

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২৭|

পদ্ম সহ সবাইকে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি করা হলো। তারপর অফিসার অভিকে কল দিয়ে সবকিছু জানাল। কিন্তু থানায় অভি এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বললো না। আদিদকেও না। সে একটু আড়ালে গিয়ে অফিসারকে আবার কল করে বললো,

‘অফিসার, আপনি দেরি করবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি পদ্ম’র জবানবন্দী নিন। এখন ও মুখ খুললেই এই কেইসের সমস্ত ধোঁয়াশা দূর হবে। আর আমি এইদিকে কাউকে কিছু জানাইনি। আগে আপনি ওর জবানবন্দী নিন, তারপর আমি ব্যাপারটা সবাই কে জানাবো।’

‘ঠিক আছে, ডক্টরের চেক আপ শেষ হোক। তারপর দেখছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ওদের সবার জবানবন্দী নিব।’

থানা থেকে সুজানার মা বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এই মানুষ দুটো পুরোটা সময় নিস্তব্ধ ছিলেন। উনাদের আশে পাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেখা যায়নি উনাদের। রুমের এক কোণে বসে পুরোটা সময় শুধু তপ্ত শ্বাস ছেড়ে গেছেন।

সুজানার মা বাবা চলে যেতেই আকবর সাহেব গর্জে উঠলেন। সবাইকে যেতে দেওয়া হচ্ছে শুধু তাদেরই কেন বসিয়ে রেখেছে। এইভাবে আর কতক্ষণ? আরেকটু পর তো ভোর হবে। উনি চেঁচামেচি করে পুরো থানা গরম করে তুলছেন। উনার চেঁচামেচি শুনে রুবি হোসেন গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আদিদ বিরক্ত হচ্ছে খুব। সে চোখ মুখ কুঁচকে চেয়ারে থ মেরে বসে আছে। রুবি হোসেন এসে বললেন,

‘আমাদের কি আজকে বাড়ি যেতে দিবে না? আর কতক্ষণ?’

আদিদ বিরক্ত গলায় বললো,

‘জানি না মা।’

রুবি হোসেন রেগে বললেন,

‘কী জানো না। কই তোমার ঐ বন্ধু কোথায়? যত ঝামেলা তো ওর জন্যই লেগেছে। অবশ্য তুমিও তার সাথে সমান দায়ী। কী দরকার ছিল, ঐ রুম থেকে এত কিছু বের করার? এখন ভালো লাগছে এই ভাবে থানায় বসে থাকতে?’

আদিদ অবাক গলায় বললো,

‘মা, কী বলছো এসব? ঐ রুমে একটা মানুষের ক*ঙ্কা*ল ছিল। আর তুমি বলছো, কী দরকার ছিল এসব বের করার? তুমি কি বুঝতে পারছো মা, তুমি কী বলছো? আমি ঐ রুমে না গেলে তো ঐ ক*ঙ্কা*ল টা আজীবন সেখানেই পরে থাকতো। একটা মানুষের ক*ঙ্কা*ল আমাদের বাড়িতে পরে থাকতো আর আমরা সেটা কখনো জানতেই পারতাম না। কী আশ্চর্যজনক ব্যাপার! আর এত কিছুর পরও তুমি বলছো, আমার আর অভির দোষ? আমাদের উচিত হয়নি এসব ঐ রুম থেকে বের করা, তাই তো? কেন মা, কেন তোমার এমনটা মনে হচ্ছে? আচ্ছা মা, আমাকে সত্যি করে বলতো, ঐ ক*ঙ্কা*ল টা কী করে ঐ রুমে এলো? ঐটা কার ক*ঙ্কা*ল মা?’

রুবি হোসেন নাক মুখ ফুলিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

‘আমি কী করে জানবো? এখন ঐ অভির মতো তুমিও আমাদের সন্দেহ করছো?’

‘সন্দেহ করতে তো তোমরাই বাধ্য করছো। আচ্ছা, এটা বাদ দাও। পদ্ম’র কথা বলো, উনার সাথে কী হয়েছে? তুমি কার সাথে উনার বিয়ে দিয়েছো? তুমি কি তাকে চেনো?’

‘আরে বাবা, এই বিয়ে তো তোমার বাবার এক কলিগ এনেছিলেন। আমাদের বলেছিলেন, একটা ভালো ছেলে আছে যে কিনা বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে। তার খুব সাধারণ একটা মেয়ে লাগবে। বাড়ি গাড়ি কিছুই চায়না, শুধু মেয়ে ভালো হলেই চলবে। তো তখন তোমার বাবা উনাদের পদ্ম’র কথা বললেন। তারপর ছেলের মা আমার সাথে কথা হলো। আর তারপর তো আমি পদ্ম’র সাথেও ছেলের কথা বলিয়ে দিই। ওর ও তো ছেলে খুব পছন্দ হয়েছিল। নিজের ইচ্ছায় ও এই বিয়েটা করেছে। আমরা কেউ ওকে জোর করেছি নাকি? তাহলে এখন ওর দায়ভার আমরা কেন নিব?’

‘অবশ্যই নিতে হবে। কারণ, বিয়েটা আপনারাই দিয়েছেন। কোনো কিছু না ভেবে, দেখে না ভেবে হুট করেই উনাকে আপনারা বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এখন যদি উনার কিছু হয় তবে তার খেসারত আপনাদেরই দিতে হবে।’

অভির কথা শুনে রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে যেন। আকবর সাহেব অভির উপর কিছুক্ষণ খুব চেঁচালেন। এক পর্যায়ে হুমকিও দিলেন। বললেন, উনি চাইলে দুই মিনিটেই অভির চাকরি খেয়ে দিতে পারেন। শুধুমাত্র সে আদিদের বন্ধু বলে উনি তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। নয়তো, কখনোই ছাড়তেন না।

উনার কথা শুনে অভি ভীষণ মজা পেল। যেন এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছু হতে পারেনা। রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে অভি বললো,

‘একটা কথা জানেন তো, সত্যকে কোনোদিন ধামা চাপা দিয়ে রাখা যায় না। একদিন না একদিন সত্য ঠিকই বেরিয়ে আসবে। আর তখনের সেই তিক্ত সত্যটাকে হজম করতে কিন্ত খুব কষ্ট হবে। তাই সময় থাকতে, সত্যকে সহজ ভাবে প্রকাশ করে ফেলুন। তাতে আপনাদেরই লাভ।’

আকবর সাহেব দাঁত চিবিয়ে বললেন,

‘বলেছি তো, আমরা কিছু জানি না।’

অভি হেসে বললো,

‘আমি জানি। অনেক কিছু জানি। সময় আসলে অবশ্যই আমি আপনাদের সবকিছু জানাবো। অপেক্ষায় থাকুন।’

আদিদ আর এসব সহ্য করতে পারলো না। সে উঠে বাইরে চলে গেল। আদিদ চলে যাওয়ার অভি আবার বললো,

‘আপনাদের ছেলে আপনাদের খুব ভালোবাসে। এত কিছুর পরও কিন্তু সে আপনাদের উপর থেকে ভরসা হারায়নি? এখন ভাবুন তো, যখন ও সবটা সত্যি জানবে, তখন ওর কেমন লাগবে? মেনে নিতে পারবে? উঁহু, কখনোই পারবে না।’

কথাটা বলে অভিও বেরিয়ে গেল।
.

ভোর হতে চলছে। পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গিয়েছে। আরেকটা নতুন দিনের সূচনা। পূর্ব দিকে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে। এই সময় রাস্তায় কেউ নেই বললেই চলে। দু এক জন যারা আছেন তারা ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন।

রাস্তার এক পাশে ফুটপাতের উপর আদিদ বসে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এখনও কেন আকাশ টা রোদে ঝলমল করছে না। কেন সূর্যটা তার তীক্ষ্ণ রোদে সবকিছু ঝলসে দিচ্ছে না। এই অন্ধকার যে আর ভালো লাগছে না। কবে সবকিছু আলোকিত হবে? কবে এই আঁধার কাটবে? কবে তার জীবনে শান্তি আসবে…কবে?

আদিদের ফোনটা বাজছে। কিন্তু সে ঠিক করলো সে কল রিসিভ করবে না। আর এইসব সহ্য হচ্ছে না। যখনই নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে তখনই তাকে আবার এলোমেলো করার জন্য এসব ঘটনা ঘটে। সুজানা চলে গিয়েছে, হারিয়ে গিয়েছে, মেনে নিয়েছিল তো সে। একটা আশায় নিজেকে তো বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু, সেই আশাটা কেও এইভাবে ভেঙ্গে দিতে হলো? খুব কি দরকার ছিল এসবের? কেন…কেন ঐ ক*ঙ্কা*ল টা সে খুঁজে পেল? কেন?

আদিদ সাইড থেকে ছোট একটা পাথর নিয়ে রাগে সেটা সামনের রাস্তার উপর ছুঁড়ে মারে। তারপর উঠে দাঁড়ায় সে। অভির কলটা রিসিভ করে বজ্র কন্ঠে বলে উঠে,

‘কী সমস্যা, এত কল দিচ্ছিস কেন?’

‘কোথায় তুই?’

‘আছি কোথাও। কী হয়েছে সেটা বল?’

‘তোর হসপিটালে আয়। আমরা সেখানেই আছি। আর পদ্ম-কে ও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তুই আয় তাড়াতাড়ি।’

আদিদ কল কেটে দিয়ে মনে মনে ভাবল, “ইশ, যদি কেউ এইভাবেই কল দিয়ে বলতো, সুজানাকেও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে..”
.
.

হসপিটালে গিয়ে আদিদ অবাক হলো। দু তালার বড়ো কেবিন’টার ভেতর অনেকগুলো মেয়ে। আর সেই রুমের ডান দিকের বেড’টাতে পদ্ম শুয়ে আছে। তার স্যালাইন চলছে। এতগুলো মেয়েকে দেখে আদিদের অদ্ভুত লাগে। অভি এসে বলে,

‘এদের সবাই কে পুলিশ উদ্ধার করেছেন।’

আদিদ ব্রু কুঁচকে বলে,

‘উদ্ধার করেছে মানে?’

‘মানে ওদের কেউ পা*চা*র করতে চেয়েছিল। ট্রাক দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়’ই ওদের পুলিশ আটকে ফেলে। সেই পাচারকারী কে অবশ্য এখনও পায়নি। তবে…’

‘তবে কী?’

অভি তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

‘তবে পদ্ম তার জবানবন্দী তে বলেছে এই সব কিছুর জন্য তোর মা বাবা দায়ী।’

‘কী!’

আদিদ চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস ফেলে। তারপর চাপা স্বরে বলে,

‘মা বাবা কোথায়?’

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২৮|

‘মা, এসব কি সত্যি?’

রুবি হোসেন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন,

‘না।’

‘তাহলে সত্যি’টা কী আপনিই বলুন মিসেস রুবি হোসেন।’

অফিসারের দিকে তাকিয়ে রুবি হোসেন জবাব দিলেন,

‘আমি কী বলবো? বলেছি তো, ঐ মেয়েটা মিথ্যে বলছে। আমি বা আমার স্বামী এসব ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না।’

আদিদ শক্ত গলায় বললো,

‘পদ্ম’র মিথ্যে বলে কী লাভ মা?’

রুবি হোসেন বললেন,

‘লাভ’ই তো। ও মিথ্যে বললে আমরা ফেঁ*সে যাবো। তখন পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যাবে। আর ও তখন আবার আমাদের বাসায় গিয়ে রাণীর মতো থাকতে পারবে। এসবই তো চায় ও। লোভী মেয়ে একটা!’

রুবি হোসেনের কথা শুনে অফিসার তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,

‘মেয়েটার সাথে এত কিছু হয়ে গিয়েছে। আর একটু হলে হয়তো, মেয়েটাকে আমরা আর কোনো ভাবেই উদ্ধার করতে পারতাম না। আর ওকে একবার নিয়ে গেলে ওর সাথে কী হতো নিশ্চয়ই সেই ব্যাপারে আপনার ধারণা আছে? ওকে বিক্রি করে দেওয়া হতো। আর এই সবকিছু মেয়েটা এখন বুঝতে পারছে। আর তাই সে এখনও সেই ট্রমা থেকে বেরুতে পারছে না। আর এত কিছুর মাঝেও আপনার মনে হচ্ছে মেয়েটা তার লোভে বশীভূত হয়ে আপনাদের নামে মিথ্যে বলছে? আমার তো তা মনে হয় না। দেখুন, প্রথম থেকে একের পর এক যা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তা কিন্তু বারবরই আপনাদের প্রতিই সন্দেহের সৃষ্টি করছে। আচ্ছা, একবার ভেবে দেখুন তো, ঐ ক*ঙ্কা*ল টা যদি সত্যি সত্যিই সুজানার হয়, তখন কী হবে? তখন কি ধরে নিব, আপনারাই সুজানাকে মে*রেছেন? আর মা*রার পর এখানে লুকিয়ে রেখেছেন। কী, এই সন্দেহটা তো তখন হবেই, তাই না? সুজানা, আপনাদের বাড়িতেই মা*রা গিয়েছে। ও লাস্ট আপনাদের বাড়িতেই গিয়েছিল। তারপর আর সেখান থেকে বের হয়নি। আমরা কিন্তু আপনাদের বাড়ির সি সি ক্যামেরা চেক করেছিলাম। কাউকে আমরা বেরুতে দেখেনি। তারমানে ও ঐ বাড়িতেই ছিল। আর আজ ঐ বাড়ি থেকেই এই ক*ঙ্কা*ল টা পাওয়া গিয়েছে। আর আমরা ডেফিনেটলি সিউর যে ঐ টা সুজানারই ক*ঙ্কা*ল। কারণ এছাড়াও সেখান থেকে সুজানার জামা, আর তার লেখা একটা ছবিও পাওয়া গিয়েছে। যেটাতে লেখা ছিল, ওকে কেউ খুব কষ্ট দিচ্ছে। আর ও হয়তো তার কথা আদিদ-কে বলতেও চাইছিল কিন্তু পারেনি। পারেনি এই জন্য যে ঐ মানুষটা হয়তো আদিদের খুব কাছের কেউ। আদিদ শুনলে খুব কষ্ট পাবে তাই সুজানা ওকে কিছু বলেনি বা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। এই এত সবকিছু ঘটনা কী ইঙ্গিত করছে মিসেস এবং মিস্টার হোসেন? আপনারাই বলুন, কী মনে হচ্ছে কে সেই মানুষ যার কথা সুজানা আদিদ-কে বলতে চাইছিল? কে সে…আচ্ছা আকবর সাহেব, আপনি নন তো?’

‘কী যা তা বলছেন? আমি কেন হতে যাবো? আমি সুজানাকে আমার নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতাম। আমি কেন সুজানাকে মা*রতে যাবো?’

অফিসার বাঁকা হেসে বললেন,

‘মেয়ের মতো ভালো তো আপনি পদ্ম-কেও বাসতেন, তাই না আকবর সাহেব। এত ভালোবাসতেন যে সময় পেলেই ওকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেন, ওর কাছে যেতে চাইতেন, তাছাড়া ইশারা ইঙ্গিতে অনেক কিছু বোঝাতেও চাইতেন, তাই না?’

আকবর সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। কপালের ঘাম মুছে বললেন,

‘এসব কী বলছেন, অফিসার? আমি এসব কিছুই করিনি।’

অফিসার দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

‘পদ্ম আমাকে সব বলেছে মি. , তাই এসব নাটক এখন বন্ধ করুন। আর ভালো ভালোই সবকিছু স্বীকার করুন। নয়তো, অন্য ব্যবস্থা করতে আমি বাধ্য হবো।’

আদিদ ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। মাথার ভেতরটা ভো ভো করছে তার। আর কিছু শুনতে পারছে না। শুনতে শুনতে মস্তিষ্কের নিউরনগুলো এবার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মেনে নিতে পারছে না। মেনে নিবেই বা কীভাবে? মা বাবাকে কখনো অবিশ্বাস করা যায়? যাদেরকে সে এতদিন ফেরেশতা ভেবে এসেছে তারা তার সাথে এত বড়ো অন্যায় কীভাবে করতে পারলো? কীভাবে? আদিদ ছটফট করতে থাকে। সে বুঝতে পারছে তার প্রেশার কমে যাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে খুব। চোখে ঝাপসা দেখছে। অভিকে ডেকে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললো,

‘অ-অভি, আমাক-কে একটু বেডে নিয়ে যা না। আমার শ্বাস ফেলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আর এসব নিতে পারছি না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল।’

ছেলের এই অবস্থা দেখে রুবি হোসেন তার কাছে যেতে চাইলে আদিদ চেঁচিয়ে উঠে,

‘খবরদার…খবরদার আমার কাছে আসবে না। ত-তোমাকে আমার ঘৃণা হচ্ছে। তোমরা কেউ আমার কাছে আসবে না। অভি আমাকে নিয়ে চল। আমার বুকে খুব ব্যথা করছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

অভি আদিদ-কে তার কেবিনে নিয়ে গিয়ে বেডে শুইয়ে দিল। আদিদ ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। অভি বিচলিত কন্ঠে বললো,

‘তুই এত দুর্বল কেন বলতো? আমি তো জানতাম, ডক্টর’রা খুব স্ট্রং হয়। তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের সামলে নিতে পারে। কিন্তু তুই হয়েছিস পুরো উল্টো। একটু কিছু হলেই ভেঙ্গে পড়িস। এমন হলে কী করে হবে বলতো? মেনে নিতে হবে তো সবকিছু। যত ভেঙ্গে পড়বি ততই তোর কষ্ট পারবে। নিজেকে শক্ত কর, ভেবে নে এটাই ভাগ্য।’

আদিদ অভির দিকে তাকাল। চোখগুলো লাল হয়ে আছে তার। হয়তো সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। জড়ানো গলায় আদিদ বললো,

‘উনারা আমার মা বাবা, আমি কীভাবে মেনে নিব অভি? পারছি না তো। আমি নিজের চেয়ে বেশি উনাদের বিশ্বাস করি। আর তুই বলছিস আমি সবকিছু সহজ ভাবে মেনে নিব? এটা কি সম্ভব? আমি তো পারছি না। যতবারই ভাবছি আমার নিজের মা বাবা এই জঘন্য কাজগুলো করেছে ততবারই আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা অভি, এসব কিছু মিথ্যে হতে পারে না? আমার মা বাবা নির্দোষ হতে পারে না? আমার যে উনাদের অপ*রাধী ভাবতে ইচ্ছে করছে না। উনারা যে আমার মা বাবা। আমি পারছি না অভি, সত্যিই পারছি না। কষ্ট হচ্ছে খুব। সুজানাকে হারিয়ে যতটা না কষ্ট হয়েছে আজকে তার থেকে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। আহ, এখানটাই কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তারদের কেন কষ্ট হয় বলতো? ওরা তো মানুষ না, ওরা তো রোবট। তাহলে ওদের কেন এত কষ্ট হয়?’

আদিদ চোখ বুজে বলেই যাচ্ছে। কী বলছে নিজেও হয়তো বুঝতে পারছে না। অভি জানতো সত্যটা আদিদ সহজ ভাবে নিতে পারবে না। যতই হোক মা বাবা তো মা বাবাই হয়…

.
.

‘আপনাদের এখন আমার সাথে থানায় যেতে হবে। সেখানে গিয়ে সুন্দর ভাবে সব সত্যি কথা আমাদের বলে দিবেন। কোথায় কোথায় আপনার এই ব্যবসার ঘাঁটি গেরেছেন, কে কে আপনাদের সাহায্য করেছে, এভ্রিথিং। যত বেশি কথা লুকাবেন, তত বেশিই আপনাদের বিপদ বাড়বে। তাই সহজ ভাবে সবকিছু বলে দিবেন তাহলে আপনাদের শাস্তিটাও সহজ হয়ে যাবে।’

‘শুধুমাত্র একটা মেয়ের কথার ভিত্তিতে আপনারা আমাদের জেলে নিতে পারেন না। আপনাদের কাছে উপযুক্ত কোনো প্রমাণ আছে? নেই। আগে উপযুক্ত প্রমাণ যোগার করুন, তারপর আমাদের জেলে নেওয়ার কথা ভাববেন।’

অফিসার হাসলেন। তারপর তিনি তার পকেট থেকে ফোন বের করে উনাদের একটা ভিডিও দেখালেন। ভিডিও দেখে দুজনেরই গলা শুকিয়ে উঠল। এগুলো কখন হলো?

‘আপনারা এত বোকা! থানায় বসে কেউ এসব আলোচনা করে? রুবি হোসেন যেই রেস্ট রুমে ছিলেন সেটাতে একটা হিডেন ক্যামেরাও ছিল। আর সেই ক্যামেরাতে আপনাদের সমস্ত কথোপকথন ধরা পড়েছে। এখন বলুন, আরো কি প্রমাণ লাগবে আপনাদের?’

রুবি হোসেন দাঁতে দাঁত পিষছেন। শেষ পর্যন্ত এভাবে তাকে হারতে হলো। না, এত সহজে সে হার মানবে না। প্রথমে সুজানা তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে তিনি তাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এখন আবার এই পদ্ম। এই মেয়ের জন্য আজ তাকে জেলে যেতে হচ্ছে। এই মেয়েকে তো তিনি এত সহজে ছেড়ে দিবেন না।

‘ঠিক আছে, সবকিছু মেনে নিলাম। কিন্তু, আমাকে একবার শেষ বারের মতো পদ্ম’র সাথে কথা বলতে দিন। আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইবো। ওর সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি। তাই জেলে যাওয়ার আগে আমি ওর কাছে একবার ক্ষমা চেয়ে যেতে চাই। নয়তো আমি শান্তিতে থাকতে পারবো। প্লীজ অফিসার, আমাকে পদ্ম’র কাছে নিয়ে চলুন।’

রুবি হোসেনের জোরাজুরিতে অফিসার শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। তিনি আকবর সাহেব আর রুবি হোসেনকে নিয়ে পদ্ম’র কেবিনে দিকে গেলেন। তবে কেবিনে যাওয়ার আগে রুবি হোসেন অফিসারের চোখের আড়ালে স্ট্রে থেকে একটা ছু*রি নিজের কোমরে গুঁজে নিলেন। মনে মনে বললেন,

“আমি ভালো না থাকতে পারলে অন্য কাউকেও ভালো থাকতে দিবো না।”

চলবে…