পদ্মফুল পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
444

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪১|

অভি আর নিঝুম চলে যাওয়ার পর পদ্ম বাচ্চাদের কাছে যায়। সে মন থেকে সবকিছু ভুলে যেতে চাইলেও সেটা পারছে না। পদ্ম বেখেয়ালী ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। বাচ্চাগুলোও বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। তারা তখন সমস্বরে ডেকে উঠে,

‘আপা!’

পদ্ম’র হুঁশ ফিরে। সে প্রত্যেক দিনের মতোই ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলে,

‘কেমন আছো, বাচ্চারা।’

সবাই বললো,

‘ভালো আছি।’

পদ্ম’র বুক চিরে কেন যেন তখন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে হলো সে কেন ভালো থাকতে পারছে না। তারপর পদ একটা চক নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডে কিছু একটা লিখল। আর বললো,

‘বলতো এখানে কী লেখা?’

বাচ্চাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে চেয়ে রইল। যদিও তাদের বয়স একটু বেশি তবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে তারা একেবারেই নতুন। সবে মাত্র অ আ শেখা শেষ করেছে। পদ্ম’র তাই ধারণা তারা লেখাটা বুঝতে পারবে না। কিন্ত তার ধারণাকে বদলে দিয়ে সেখান থেকে একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

‘এটা ভালোবাসা।’

পদ্ম অবাক হয়ে বললো,

‘বুঝলে কী করে?’

ছেলেটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,

‘আমার বড়ো ভাইয়ের মুখে একবার শুনছিলাম, এই শব্দ টা ভালোবাসা।’

পদ্ম হেসে বললো,

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। এখানে “ভালোবাসা” লেখা। আচ্ছা তোমরা কাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসো?’

একেক জন একেক জবাব দিল। কেউ বললো মা, কেউ বললো বাবা। যার মা বাবা কেউই নেই সে বললো, ভাই। আবার দু এক জন বললো তারা যে বাড়িতে মাঝে মধ্যে কাজ করতে যায় সেই বাড়ির মালিক। সবার জবাব দেওয়া শেষ হলে সেখান থেকে কয়েকজন বলে উঠে,

‘আপা, আপনি কারে সবথেকে বেশি ভালোবাসেন?’

পদ্ম চোখ বুজে মিষ্টি করে হেসে বলে,

‘তোমাদের, তোমাদের আমি অনেক বেশি ভালোবাসি। আর ভালোবাসি আমার মা বাবাকে। আমার একটা ছোট্ট বোন আছে, “রাণী” ওকেও খুব ভালোবাসি। আর..’

বাচ্চাগুলো খুব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে “আর” এরপর আর কার নাম বলবে সেটা শোনার জন্য। কিন্ত পদ্ম আর কিছু বলে না। সে বোর্ড পরিষ্কার করে তাদের পড়ানো শুরু করে দেয়।

পড়ানো শেষ করার পর, পদ্ম কে স্যারের রুমে ডাকা হলো। দরজায় নক করে সে বললো,

‘আসবো স্যার।’

অনিক হেসে বললো,

‘হ্যাঁ, আসুন।’

পদ্ম ভেতরে গেল। অনিক তাকে বসতে বললো। পদ্ম তার কথা মতো বসলো। তারপর অনিক একটা খাম পদ্ম’র দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘আপনার ফি।’

পদ্ম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে খামটা হাতে নিল। অনিক তখন বললো,

‘আপনার কি কিছু হয়েছে? সকাল থেকেই দেখছি মন খারাপ করে আছেন?’

পদ্ম এবার হাসার চেষ্টা করলো। বললো,

‘না না, কিছু হয়নি। আমি একদম ঠিক আছি।’

অনিক কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তাকে দেখে মনে হলো সে কিছু ভাবছে। অনেকটা সময় যাওয়ার পর অনিক বললো,

‘পদ্ম, আমি আপনাকে আমার এই সংস্থার সম্পাদক বানাতে চাই যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।’

পদ্ম বিস্মিত হলো। অবাক কন্ঠে বললো,

‘কেন স্যার?’

অনিক হালকা হেসে জবাবে বললো,

‘কারণ আমার আপনাকে এই পজিশনের জন্য পারফেক্ট মনে হয়েছে, তাই।’

পদ্ম কিছুটা সময় নিয়ে বললো,

‘স্যার, আমার এই বাচ্চাগুলোকে পড়াতেই ভালো লাগে। ওরা আমার পরিবার। ওরা আমার ভালো থাকার একটা মাধ্যম। আমাকে প্লীজ ওদের শিক্ষক হিসেবেই থাকতে দিন।’

পদ্ম’র অনুরোধের কাছে অনিক কে হার মানতে হলো। সে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,

‘ঠিক আছে। আপনি রাজি না হলে, আমি আপনাকে জোর করবো না।’

পদ্ম তখন হেসে অনিক কে সালাম দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।

রাস্তার এক পাশ দিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে হেঁটে চলছে সে। হাঁটার মাঝখানেই পদ্ম থামল। সামনে চায়ের একটা স্টল দেখে মনে প্রশান্তি এলো তার। দু’কাপ চা খেলো সে। চায়ের দোকানের মামা খানিকটা অবাক হলো তাতে। পদ্ম’র চোখে মুখে ফুটে উঠা বিষন্ন আর হতাশা যেন সকলেরই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। চায়ের দাম দিয়ে পদ্ম আবার হাঁটতে লাগল। প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর সে তার বাড়িতে এসে পৌঁছাল। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখল রাণী মেঝেতে বসে কিছু একটা করছে। পদ্ম তার সামনে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলো সে কী করছে। সে দেখল, রাণী এক গাদা সুতি কাপড় নিয়ে বসেছে। এগুলো মূলত পদ্ম’র অর্ডারের কাজ ছিল। কালকের মধ্যে সবগুলো কমপ্লিট করতে হবে। পদ্ম’র জন্য খুব চাপ হয়ে যাবে দেখে, রাণী এগুলো নিয়ে আগেই বসে পড়েছে। পদ্ম মনে মনে ভীষণ শান্তি পেল। রাণী যেন তার আত্মার সাথে জুড়ে গিয়েছে। সে রাণীর পাশে বসে। রাণী খুব মনোযোগ দিয়ে তার কাজগুলো করছে। পদ্ম মাঝে মধ্যে তাকে এটা ওটা দেখিয়ে দিচ্ছে। কথার প্রসঙ্গেই পদ্ম হঠাৎ বললো,

‘জানিস তো, তোর ডাক্তার সাহেব আসছেন।’

রাণীর হাত সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। তুলিটা হাত থেকে পড়ে যেতেই কিছুটা রং জামায় ছড়িয়ে গেল। পদ্ম ব্যস্ত হয়ে সেটা মুছতে লাগল। রাণীর বিস্ময় এখনো কাটছে না। সে ঢোক গিলে বললো,

‘এবার আসলে উনাকে সব বলবে তো?’

পদ্ম বিষন্ন চোখে তাকিয়ে বললো,

‘কী বলবো?’

‘তুমি যে উনাকে ভালোবাসো, সেটা?’

পদ্ম সেই কথার জবাব দিল না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,

‘দেখ রং’টা ছড়িয়ে ফেলেছিস। এইদিক টা ঠিক কর।’

রাণী বিরক্ত হলো। বললো,

‘আমার কথার জবাব দাও আগে।’

পদ্ম কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,

‘সব কথার জবাব হয় না। আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি, তুই এটা ঠিক কর।’

রাণী থ মেরে বসে থাকে। পদ্ম তাকে উপেক্ষা করে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে যায়।
.
.

অভির নাম্বারে তখন থেকে কল আসছে। ফোন’টা তার মেয়ের কাছে থাকায় সে সেটা নিতেও পারছে না। এইদিকে অনিক তাকে অনেকগুলো কল দিয়ে ফেলেছে। আর সে অনেক চেষ্টা করেও ফোনটা তার মেয়ের কাছ থেকে নিতে পারছে না। সে শেষে আর না পেরে নিঝুম কে ডাকে। ঐটুকু মেয়ে মা’কে প্রচন্ড ভয় পায়। নিঝুম এসে দাঁড়াতেই সে ভদ্র মেয়ের মতো ফোনটা রেখে তার অন্য খেলনা দিয়ে খেলতে আরম্ভ করে। তা দেখে অভি হেসে ফেলে। আর নিঝুম তখন ভাব নিয়ে বলে,

‘দেখেছো, মাদার’স পাওয়ার।’

অভি হেসে অনিক কে আবার কল দেয়। রিসিভ হলে কিছুক্ষণ তারা আনুষঙ্গিক কথা বার্তা বলে। কথার এক পর্যায়ে অনিক বললো,

‘অভি, আমার তোকে কিছু বলার আছে?’

অভি বললো,

‘কী বলবি, বল।’

অনিকের অস্বস্তি হচ্ছিল। সে কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,

‘আম-আমি আসলে…আসলে আমি পদ্মকে ভালোবাসি অভি। আর ওকে আমি বিয়ে করতে চাই।’

অভি নির্বাক হয়ে পড়ল। তার এই মুহূর্তে কী বলা উচিত সেটাই সে বুঝতে পারছে না। অভির কাছ থেকে কোনোরূপ রেসপন্স না পেয়ে অনিক আবার বললো,

‘কী হয়েছে অভি, তুই কিছু বলছিস না কেন?’

অভি জোরে নিশ্বাস ফেলল। গম্ভীর সুরে বললো,

‘কিন্তু, পদ্ম তো তোকে বিয়ে করতে রাজি হবে না।’

‘কেন হবে না? ও কি অন্য কাউকে পছন্দ করে?’

‘না, তবে ও বিয়ে করতে চায় না। আর তুই কীভাবে পদ্ম কে…আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘তুই তো বলেছিস পদ্ম এতিম। ওর দায়িত্ব তুই নিয়েছিস। সেই ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে তোকে জানানোর দরকার তাই জানিয়েছি। এখন আমি পদ্ম’র সাথেই সরাসরি কথা বলবো। রাখছি তাহলে।’

অনিক কল কেটে দিল। অভি নিঝুম কে সব বললে সে বললো,

‘সমস্যা কোথায়? অনিক ভাইয়া তো অনেক ভালো ছেলে। উনি যদি পদ্ম কে ভালোবাসেন তাতে সমস্যা টা কোথায়। পদ্ম তো আর সারাজীবন একা থাকতে পারবে না। ওর তো কাউকে প্রয়োজন, তাই না? আর আমার মনে হয় ওর জন্য অনিক ভাইয়া’ই ঠিক আছে।’

অভি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘কী জানি, কে ঠিক কে বেঠিক। এখন পদ্ম’র জীবনের সিদ্ধান্ত পদ্ম নিজেই নিবে।’

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪২|

ব্যস্ত আরেকটি সকাল। আজ পদ্ম’র পাঠশালা নেই। শনিবার পাঠশালা বন্ধ থাকে। তাই আজকের দিনটা অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই ব্যস্ত কাটে তার। সকাল সকাল সে একগাদা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। এগুলো ডেলিভারি দিতে হবে। রাণীকেও তার সাথে নিয়েছে। সবগুলো ডেলিভারি দিয়ে তারা যখন লাস্ট একটা বাড়িতে গেল তখনই বাঁধল বিপদ। সেই বাড়ির গেইটের সামনের কুকুর তাদের দেখে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো। আর তা দেখে রাণীর পুরো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। পদ্ম রাণীর হাত ধরে বললো,

‘ভয় পাচ্ছিস কেন? চল, আস্তে করে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে যাবো।’

কে শুনে কার কথা। রাণী ভয়ে ভয়ে বললো,

‘পাগল হয়েছো তুমি! দেখছো না কুকুরটা কী করছে, কাছে গেলেই কামড় দিবে।’

‘আরে বাবা, এগুলো পোষা কুকুর কামড় দিবে না।’

কিন্তু রাণী তো আর বুঝবে না। সে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। পদ্ম তার হাত ধরে অনেক টানাটানি করলো, এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললো,

‘ঠিক আছে তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক, আমি একাই যাচ্ছি।’

রাণী ঝাপটে পদ্ম’র হাত ধরে ফেলল। উত্তেজিত কন্ঠে বললো,

‘আরে না, তুমি চলে গেলে কুকুর টা আমাকে খেয়ে ফেলবে তো।’

পদ্ম পড়ছে মহা ফ্যাসাদে। সে চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

‘তাহলে করবো টা কী? তোর সাথে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব?’

রাণী অসহায় ভাবে তাকাল। বললো,

‘এই কুকুর টা সরে না কেন? এই বাড়ির মালিক কই? এসে এটাকে নিয়ে যেতে পারছে না।’

পদ্ম’র রাগ হচ্ছে। সে রাণীর হাত ছাড়িয়ে বললো,

‘তুই দাঁড়া, আমি দেখছি।’

পদ্ম গেইটের কিছুটা কাছে যেতেই কুকুর টা আরো বেশি গর্জে উঠল। রাণী তা দেখে চিৎকার দিয়ে বললো,

‘আপু, আর যেও না তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’

পদ্ম দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাণীর দিকে চাইল। রাণী ঢোক গিলে বললো,

‘তুমি বুঝো না কেন আপু, কুকুর টা তোমাকে খেয়ে ফেললে আমার কী হবে?’

পদ্ম নাকের পাল্লা ফুলিয়ে রাগে রাণীকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে কেউ একজন উপস্থিত হয়।

‘দুঃখিত, আমার কুকুর হয়তো আপনাদের বিরক্ত করছিল। আসলে ও…’

ছেলেটির কথার মাঝখানেই রাণী বজ্র কন্ঠে বলে উঠল,

‘এমন বেয়াদ্দপ কেন কুকুর টা? আপনি বোধ হয় ভালো ভাবে ট্রেনিং দিতে পারেনি। আমার কাছে দিয়েন, একদিনে সোজা করে দিব।’

পদ্ম খেয়াল করলো ছেলেটা রাণীর কথা শুনে ভীষণ অস্বস্তি তে পড়ে গিয়েছে। তাই সে রাণীর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে তাকে থামতে বলে। ছেলেটা তখন ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘আমি সত্যিই দুঃখিত।’

‘না ভাইয়া, আপনার কুকুর যা করেছে একদম ঠিক করেছে। আমরা অপরিচিত মানুষ, তাই সে আমাদের দেখে এমন করেছে। আর এটা সে তার প্রভু প্রীতি থেকেই করেছে, আমরা তাতে কিছু মনে করেনি।’

পদ্ম’র কথা শুনে যেন ছেলেটা কিছুটা আশ্বস্ত হলো। সে প্রসন্ন হেসে বললো,

‘আপনাদের পরিচয় টা কি জানতে পারি?’

‘আসলে আমরা একটা পার্সেল নিয়ে এসেছিলাম। এই যে এড্রেস, এখান থেকেই অর্ডার টা করা হয়েছিল।’

ছেলে টা এড্রেস টা দেখে বললো,

‘ওহ, আমার আম্মু অর্ডার টা করেছে। দিন, পার্সেল টা আমাকে দিন।’

পদ্ম রাণীকে বললো পার্সেল টা ছেলেটা কে দেওয়ার জন্য। রাণী দু কদম এগিয়ে পার্সেল টা ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিল। ছেলেটা সেটা হাতে নিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাল। তারপর পদ্ম আর রাণী সেখান থেকে চলে এলো।

ফেরার পথে রাণী ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরলো। পদ্ম তাকে নিয়ে গেল ফুচকা খেতে। পদ্ম’র ফুচকা পছন্দ না। এই নিয়ে রাণী তাকে অনেক কথা শোনায়। কারণ তার ভাষ্যমতে যে মেয়ে ফুচকা খায় না সে মেয়ে তো মেয়েই না। কিন্তু তাতে পদ্ম’র কিছু যায় আসে না। ছোটবেলায় একবার ফুচকা খেয়ে সে যে পরিমাণ বমি করেছিল তারপর থেকে তার ফুচকা খাওয়ার একেবারের জন্য স্বাদ চলে গিয়েছে।

রাণীকে নিয়ে পদ্ম অনেকদিন পর মায়া আশ্রমে এল। কত স্মৃতি, কত আনন্দ, কত মুহূর্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই আশ্রমের প্রাঙ্গণে। এখানেই আসতেই যেন পুরনো সেই মুহুর্তগুলো আবারও তাজা হয়ে উঠল। রাণী আর পদ্ম ভেতরে গেল। তারা দেখল সেখানে অনেক নতুন মেয়ে এসেছে। মেয়েগুলো বিস্মিত চোখে তাদের দেখছে। রাণী হেসে হেসে মেয়েগুলোকে বললো,

‘আমরাও এই আশ্রমের মেয়ে। একসময় তোমাদের মতো আমরাও এখানে ছিলাম।’

তারপর দু’জন গেল মহিলা পরিচালিকা দু’জনের রুমে। আর তাদের দেখেই পরিচালিকা দু’জন এসে জড়িয়ে ধরলেন। খুশিতে চোখ ভিজে উঠল যেন। রাণী তো কেঁদেই ফেলল। সে এই দু’জন কে খুব জ্বালিয়েছে। আর বকাও খেয়েছে খুব। কিন্তু তাদের কাছ থেকে পাওয়া সেই অফুরন্ত ভালোবাসা সে কখনোই ভুলতে পারবে না।

পদ্ম আর রাণী আশ্রমে অনেক সময় কাটাল। দুপুরের খাওয়া দাওয়া টা সেখানেই করলো। বিকেলের দিকে বেরিয়ে এল তারা। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল দু’জন। পথিমধ্যে পদ্ম’র একটা কল এল। সে ফোন টা হাতে নিয়ে দেখল, অনিক কল করছে। পদ্ম কল টা রিসিভ করে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে অনিক বললো,

‘আপনি এখন কোথায় আছেন, পদ্ম?’

‘আমি একটু বাইরে আছি স্যার, কেন?’

অনিক ধীর গলায় বললো,

‘আমার সাথে এখন একটু দেখা করতে পারবেন?’

হঠাৎ দেখার করার কথা শুনে পদ্ম কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল। সে চিন্তিত কন্ঠে বললো,

‘কিছু কি হয়েছে, স্যার? হঠাৎ এই সময় দেখা করার কথা বলছেন?’

‘আপনার সাথে আমার একটু জরুরি কথা ছিল। আপনি যদি ফ্রি থাকেন তাহলে আমি একটা এড্রেস দিচ্ছি সেখানে চলে আসুন।’

পদ্ম’র চিন্তা এবার দুশ্চিন্তার রূপ নিল। ফোন টা কাটতেই সে দেখল অনিক তাকে ঠিকানা টেক্সট করে পাঠিয়েছে। পদ্ম’র চোখ মুখ দেখে রাণী জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছে আপু, কোনো সমস্যা?’

পদ্ম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

‘অনিক স্যার আমাকে ডেকেছেন। কী জরুরি কথা নাকি বলবেন। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে উনি আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিবেন। আমি কাল যে উনার অফার রিজেক্ট করেছি, তাই হয়তো উনি আমার উপর রেগে আছেন। নির্ঘাত আমার চাকরি টা এবার যাবে।’

পদ্ম অস্থির হয়ে উঠল। রাণী তার হাতে হাত রেখে বললো,

‘এত অস্থির হচ্ছো কেন? অন্য কিছুর জন্যও তো ডাকতে পারেন। আগে থেকেই এত হাইপার হইও না। আগে গিয়ে দেখোই না, উনি কী বলে।’

রাণীকে নিয়েই পদ্ম অনিকের পাঠানো ঠিকানা তে গেল। রিক্সা থেকে নেমে রাণী বললো,

‘জায়গা টা কিন্তু বেশ সুন্দর। আমার কী মনে হয় বলতো আপু, এই সুন্দর জায়গায় দাঁড়িয়ে তোমার স্যার তোমাকে কখনো অসুন্দর কথা বলতেই পারবেন না। দেখবে, নিশ্চয়ই উনি সুন্দর কিছু বলার জন্যই তোমাকে ডেকেছেন।’

রাণীর কথায় পাত্তা না দিয়ে পদ্ম অনিক কে কল করলো।

‘চলে এসেছেন?’

‘জ্বি স্যার, আমরা গেইটের সামনে।’

‘আমরা মানে? আপনার সাথে কি অন্য কেউ আছেন?’

‘আসলে স্যার আমার বোনও এসেছে।’

‘ওহ আচ্ছা। আপনারা সেখানেই দাঁড়ান, আমি আসছি।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই অনিক সেখানে চলে এলো। তাকে দেখেই রাণী পদ্ম’র কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘ওয়াও! তোমার স্যার কী হ্যান্ডসাম আপু।’

পদ্ম তার হাতে চিমটি কেটে চুপ করতে বললো। অনিক হেসে রাণীর সাথে পরিচয় হলো। তারপর তারা গিয়ে একটা টেবিলে বসলো। মূলত এটা একটা ক্যাফে যেটা একটা সুন্দর লেকের পাশে অবস্থিত। সন্ধ্যার সময় বলে বেশ বাতাস এই দিকটাই। পদ্ম’র টেনশন কোনোভাবেই কমছিল না। তাই সে আর থাকতে না পেরে অনিক কে জিজ্ঞেস করে,

‘স্যার, আপনি কী বলার জন্য এত জরুরি তলবে আমাকে ডেকেছেন?’

অনিক মৃদু হেসে বললো,

‘এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আগে খাবারের অর্ডার তো দিন তারপর সব বলছি।’

অনিক একটা ওয়েটার কে ডাকল। তারপর রাণী আর পদ্ম কে বললো অর্ডার দেওয়ার জন্য। তারা কেবল দু কাপ কফি অর্ডার দিল। অনিক তাদের আরো কিছু অর্ডার দিতে বললেও তারা দিল না। তাই তাদের সাথে সে ও একটা কফিই অর্ডার দিল।

ওয়েটার চলে যাওয়ার পর অনিক রাণীর সাথে কিছুক্ষণ খোশগল্প করলো। রাণী তো তাতে বেজাই খুশি। ওদিকে পদ্ম টেনশনে ম*রছে। কফিও চলে এলো। কফির কাপে চুমুক দিয়ে অনিক জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। অতঃপর বললো,

‘এবার তাহলে বলি, আপনাকে এখানে ডাকার কারণ।’

পদ্ম নড়েচড়ে বসলো। কফির মগটা টেবিলের উপর রেখে ভয়ে ভয়ে বললো,

‘জ্বি, বলুন।’

কোনোপ্রকার দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়া, একেবারে সোজা সাপ্টা ভাষাই অনিক বলে উঠল,

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি পদ্ম। উইল ইউ মেরি মি?’

আকস্মিক ভাবে কথাটা কর্ণকুহুরে পৌঁছাতেই পদ্ম যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। রাণীও আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। কিন্তু অনিক বেশ স্বাভাবিক। সে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পদ্ম’র মুখের দিকে। পদ্ম নিরব, নিস্তব্ধ। সে ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর মলিন কন্ঠে বললো,

‘আমাকে ক্ষমা করবেন, স্যার। রাণী চল।’

রাণীকে নিয়ে পদ্ম সেখান থেকে চলে গেল। বিস্ময় নিয়ে সে যাওয়া দেখল অনিক। আটকালো না। সে বসে বসে কফি টা শেষ করলো। তারপর বিল দিয়ে সেখান থেকে চলে এলো।

চলবে…
#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৩|

পাঁচ বছর পর দেশের মাটিতে আবার পা রাখল আদিদ। সেই চেনা মাটির ঘ্রাণ, বাতাসে মিষ্টি ফুলের সুবাস আর ভেজা পাতার উটকো গন্ধ, এই সবকিছুই যেন আবার তার শরীরে শিহরণ জাগাচ্ছে। এই তো সেদিন সে এখান থেকে বিদায় হয়েছিল। আজ আবার ফিরে এসেছে সেই প্রিয় জায়গায়..

আদিদ কে রিসিভ করতে অভি আর নিঝুম এসেছে। দুপুর তিন’টায় আদিদের এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার কথা। কিন্তু মালপত্র সব গুছিয়ে বের হতে হতে তার বাজল পাঁচ’টা। আদিদ এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই অভি কে দেখল। অভি এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আদিদও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অনেকক্ষণ দুই বন্ধু ওভাবেই ছিল। তারপর আদিদ অভি কে ছেড়ে নিঝুমের সাথে কথা বললো। তার কোল থেকে নিশা কে নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ আদর করলো সে। তারপর সেখান থেকে সবাই একটা রেস্টোরন্টে গেল দুপুরের খাওয়া দাওয়া করতে।
অভি আর আদিদ অনেক গল্প করছে। এতদিনের জমানো অনেক কথা আজ মন খুলে দু’জন দু’জনকে বলতে পারছে। তাদের কথার মাঝেই আদিদ অভি কে পদ্ম’র কথা জিজ্ঞেস করলো। অভি তাকে আশ্বস্ত করে বললো,

‘পদ্ম ভালো আছে। ওর নিজের একটা ছোট্ট বিজনেস আছে আর তাছাড়া আমার একটা কাজিনের পাঠশালাতে ও শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত।’

আদিদ ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘এখন কোথায় থাকে ও?’

‘আলাদা একটা বাসায় থাকে। ওর সাথে রাণী ও থাকে।’

আদিদ তখন অবাক কন্ঠে বলে,

‘রাণী? তোর আশ্রমের ঐ বাচ্চা মেয়েটা?’

‘হ্যাঁ।’

আদিদ হেসে বলে,

‘মেয়েটা নিশ্চয়ই এখন খুব বড়ো হয়ে গেছে। এখনও কি আগের মতো চঞ্চল আছে নাকি বদলেছে কিছুটা?’

অভিও হেসে বললো,

‘আগের মতো নেই, পদ্ম’র টাইটে এখন কিছুটা মানুষ হয়েছে। আগে তো একটা বাদর ছিল।’

তারপর তারা আরো অনেক কথা বললো। সাথে খাওয়া দাওয়াও করলো। সন্ধ্যার দিকে সকলে সেখান থেকে রওনা দিল। অভি আদিদ কে অনেকবার জোরাজুরি করছিল আজকের রাত টা অন্তত তার বাড়িতে থাকার জন্য। কিন্তু আদিদ রাজি হলো না। সে অভি কে বিদায় জানিয়ে তার হসপিটালে চলে এল। হসপিটালের সবাই আগে থেকেই জানতো যে আদিদ আসছে। তাই সবাই ফুলের তোড়া নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিল আদিদের জন্য। আদিদ সেখানে গেলে সবাই তাকে সাদরে গ্রহণ করলো। অনেকগুলো দিন পর প্রিয় একটা জায়গায় আবার এসেছে সে। হসপিটালের ঘ্রাণ টা নাকে যেতেই তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো জেগে উঠল। পুরোনো স্মৃতিগুলো আবার তাজা হয়ে উঠল। এই হসপিটাল জুড়েই রয়েছে তার আর সুজানার সুন্দর মুহুর্তগুলো। এই হসপিটালেই পদ্ম’র সাথে তার প্রথম পরিচয়। আর এই হসপিটালেই সে করুন সত্যির মুখোমুখি হয়েছিল। সবকিছু হয়েছিল এই হসপিটালেই। সব মনে পড়ছে তার। এতদিন নিজেকে খুব ব্যস্ত রাখায় এসব স্মৃতি খুব একটা মস্তিষ্কে বিচরণ করতে পারেনি কিন্তু আজ এগুলো মাথার ভেতর কিলবিল করছে।

সবার সাথে দেখা করে আদিদ তার কেবিনে যায়। আগের মতোই আছে সবকিছু। তবে কিছু মুখ বদলেছে। কিছু চেনা মানুষ হারিয়ে গেছে। সময়ের স্রোতে হয়তো ভেসে গিয়েছে এসব কিছু। তবু তার কেবিন টা রয়ে গেছে আগের মতো। ঐ তো তার বইগুলো। আদিদ সেগুলো ছুঁয়ে দিল। তারপর সে তার চেয়ারটাতে গিয়ে বসল। মাথার ভেতর যেন কিছু ভনভন করছে। মনে পড়ছে অনেক মুহুর্ত। যা ভুলতে চেয়েও কখনো ভুলা হয়ে উঠেনি।

সেদিন রাতে আদিদ আর তার কেবিন থেকে বের হয়নি। পরদিন সকালে হসপিটালের সকল স্টাফদের সাথে দেখা করে সে বেরিয়েছে তার একটা জরুরি কাজে। সে অভি কেও কল করে আসতে বলে। তারপর দু’জনেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় কোনো এক উদ্দেশ্যে। আর সেই গাড়ি গিয়ে থামে, থানায়। আদিদ আর অভি গাড়ি থেমে নামে। অভি আগে না বুঝলেও এখন বুঝেছে আদিদ আসলে কী করতে চাইছে।

আদিদ বেড়াল পায়ে থানার ভেতরে গেল। ওসির রুমের কাছে গিয়ে থামল সে। ন্যামপ্লেট টা দেখে কপাল কুঁচকাল। পেছন থেকে অভি বললো,

‘নতুন ওসি এসেছেন। আগের জনের ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে।’

আদিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে গেল। ওসি তাদের চিনলেন না। দু’জনেই তাদের পরিচয় দিল। ওসি এবার তাদের বসতে বললেন। আদিদ ছোট্ট একটা ঢোক গিলে বললো,

‘আসলে ওসি সাহেব, আমরা দু’জন মানুষের সাথে দেখা করতে এসেছি।’

আদিদের কথাটা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। অভি সেটা বুঝতে পেরে নিজ থেকে বললো,

‘পাঁচ বছর আগে এখানে আকবর হোসেন আর রুবি হোসেন নামে দু’জন ব্যক্তিকে আনা হয়েছিল। উনাদের বিশ বছরের জেলের রায় হয়েছিল। উনারা কি এখন এখানে আছেন? আমরা উনাদের সাথেই দেখা করতে এসেছি।’

ওসি সাহেব একটু চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

‘পাঁচ বছর আগের গেইসের ফাইল তো এখন আমার কাছে নেই। আচ্ছা, আপনারা একটু বসুন আমি দেখে আপনাদের জানাচ্ছি।’

তারপর অফিসার পুরোনো কিছু ফাইল নিয়ে বসলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অফিসার সেই ২০২২ সালের ফাইলটা পেলেন। সেটা চেক করে তিনি বললেন,

‘উনাদের তো আরো এক বছর আগেই জামিন হয়েছে। বার্ধক্যজনিত কারণে দু’জনেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই হাইকোর্টের বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে উনাদের জামিন দেওয়া হয়। বাই দ্যা ওয়ে আপনারা উনাদের কী হোন?’

অভি আর আদিদ একজন অন্যজনের মুখের দিকে তাকাল। আদিদ জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে আস্তে করে বললো,

‘আমি উনাদের ছেলে।’

‘ওহ, আপনার মা বাবা এখানে নেই। তাই উনাদের ব্যাপারে আর কোনো ইনফরমেশনও আমাদের কাছে নেই।’

আদিদ থানা থেকে বেরিয়ে হতাশ কন্ঠে অভিকে বলে,

‘মানুষ দু’টো কোথায় গিয়েছে বলতো? আচ্ছা, উনাদের কি আমার কথা মনে আছে? নাকি ভুলে গিয়েছেন? আমার না উনাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার যাবো ঐ বাড়িতে? তুই কী বলিস অভি।’

অভি আদিদের কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘চল যাই।’

তারপর দু’জন আবারো বেরিয়ে পড়ল। এবার তারা গেল আদিদের বাড়িতে। আদিদ সেখানে গিয়ে বিস্মিত হলো। সে যেভাবে বাইরের গেইটে তালা দিয়ে এসেছিল এখনো সেখানে সেইভাবেই তালা টা ঝুলছে। তারমানে আদিদের মা বাবা এখানে আসেননি। আদিদ যেন চিন্তায় পড়ে যায়। দেশে আসার আগ থেকেই মা বাবার কথা তার খুব মনে পড়ছিল। নিজের মনের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মা বাবার সাথে এবার দেখা করবে সে। কিন্তু আজ উনাদের না পেয়ে ভীষণ অস্থির লাগছে মনটা। মা বাবা হাজার অন্যায় করলেও বোধ হয় কোনো সন্তান তাঁদের ঘৃনা করতে পারে না। আদিদ ও হয়তো তাই পারেনি।

আদিদের অস্থিরতা দেখে অভি বললো,

‘এত অস্থির হোস না। আংকেল আন্টি হয়তো তোদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। সেখানে একবার গিয়ে খোঁজ করে আয়। আমার মন বলছে উনারা সেখানেই থাকবেন।’

অভির কথা মতো আদিদ তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার দুপুর হয়ে গেল। এতদিন পর গ্রামে আসায় পথ চিনতে একটু কষ্ট হচ্ছিল তার। আশেপাশের মানুষদের বলে বলে পথ চিনতে হয়েছিল তাকে। আর এইভাবেই পথ চিনতে চিনতেই সে তার বাড়ি এসে পৌঁছাল। গাড়িটা এক পাশে পার্ক করে সে ধীর পায়ে বাড়ির ভেতরে গেল। চারপাশ টা কেমন নিরব যেন। আদিদ এবার ডাকল,

‘বাড়িতে কেউ আছেন?’

কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তাই আবারো সে বললো,

‘কেউ আছেন বাড়িতে?’

তখনই একজন মহিলা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তারা পরনে একটা তাঁতের মলিন শাড়ি। চুলগুলো উস্কোখুস্কো আর বিষন্ন চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি কে দেখে বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠল তার।

মহিলা’টাও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর হঠাৎ করেই তিনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললেন,

‘আদিদ, বাবা তুই এসেছিস?’

তিনি এসে আদিদকে জাপটে জড়িয়ে ধরলেন। আদিদ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। মায়ের এই অবস্থা দেখে এখনো তার বুক কাঁপছে। সবসময় যিনি নিজেকে চকচকে করে রাখতেন আজ তার একি করুন দশা। আদিদও আর থাকতে না পেরে মা’কে জড়িয়ে ধরে। বুকটা ফেটে গেলেও আজ আর কাঁদে না সে। অনেকক্ষণ মা’কে ওভাবে জড়িয়ে ধরে থেকে সে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘কেমন আছো…মা?’

রুবি হোসেন জবাব দিলেন না। তিনি কেঁদেই চলছেন। আদিদ আবার অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে,

‘বাবা কোথায়?’

আদিদের এই প্রশ্নে রুবি হোসেনের কান্না যেন আরো বেড়ে গেল। আদিদ মা’কে শান্ত হতে বলছে কিন্তু তিনি থামছেন’ই না। আদিদের কিছু একটার ভয় হলো। তার মা কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে বললেন,

‘তোমার বাবা মা,রা গেছেন, আদিদ।’

চলবে…