পদ্মফুল পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
298

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩৮|

পদ্ম মাথা নুইয়ে ফেলল। আদিদ আবারও জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হলো পদ্ম, কিছু বলছেন না যে?’

পদ্ম তার ভারি পল্লব মেলে তাকাল। নরম গলায় বললো,

‘আপনি চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে ডাক্তারবাবু।’

আদিদ বিস্মিত কন্ঠে বললো,

‘কেন?’

পদ্ম আবার নত মস্তিষ্কে বললো,

‘জানি না।’

আদিদ চেয়ে রইল তার দিকে। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ নিরবতা কাটিয়ে সে বললো,

‘মায়া জিনিসটা মানুষকে বড্ড পোড়ায়, জানেন তো! আমিও পুড়ছি কারোর মায়ায়। তাই আপনাকে সাবধান করছি, এই মায়াকে প্রশ্রয় দিবেন না। কষ্ট বাড়বে।’

পদ্ম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো,

‘সুজানাকে আপুকে আপনি খুব ভালোবাসতেন তাই না?’

আদিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ভালোবাসতাম না, এখনো বাসি আর আজীবন বাসবো।’

পদ্ম আদিদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। আদিদ তার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ভেতরে যান। সবাই আপনাকে খুঁজবে নয়তো।’

পদ্ম দাঁড়িয়ে রইল। তার কেমন যেন লাগছে। সে অনুভব করতে পারছে, কিছু একটার জন্য কষ্ট হচ্ছে তার। বুকে তার তীব্র ব্যাথা অনুভব করছে। উফ, এই মন জিনিসটা এত খারাপ কেন কে জানে! অযথা যার তার মায়ায় পড়ে কষ্ট দিতে থাকে। মনটা বিষাদে ভরে যাচ্ছে। সে চোখ বুজে। ঢোক গিলে বলে,

‘আমার কষ্ট হচ্ছে ডাক্তারবাবু। আপনার জন্য কষ্ট হচ্ছে। জানিনা কেন, কিন্তু হচ্ছে কষ্ট। আপনি চলে গেলে এই কষ্ট আরো বেড়ে যাবে। আমি জানি আমি যেটা বলছি সেটা অন্যায়। আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন ডাক্তারবাবু। আমি তার জন্য চির কৃতজ্ঞ থাকবো। আপনি আমাকে কখনো ভুলে যাবেন না প্লীজ। আর পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন, আমি এসব বলতে চাইনি। কিন্তু না বলেও থাকতে পারছিলাম না। ভালো থাকবেন ডাক্তারবাবু। আর দয়া করে এখানে আর আসবেন না; কারণ আপনি আসলে আমার কষ্ট আবার বেড়ে যাবে। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি যাই, আপনি ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।’

পদ্ম কাঁদতে থাকতে। নাক মুখ ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে সে চলে আসতে লাগে। আদিদের বিস্ময় যেন কাটছে না। মেয়েটা এইভাবে কেন কাঁদছে, শুধুমাত্র সে চলে যাবে বলে? আশ্চর্য!

আদিদ ফিরে ডাকে তাকে। পদ্ম থমকে দাঁড়ায়। আদিদ হেঁটে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আমি চলে যাবো বলে আপনি কাঁদছেন?’

পদ্ম মাথা ঝাঁকিয়ে “না” বললো। আদিদ ফিচেল গলায় বললো,

‘মিথ্যে বলছেন কেন?’

পদ্ম নাক টেনে বলে,

‘এমনি।’

আদিদ ব্রু কুঁচকে ফেলে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে,

‘আমি আপনার কে হই, যে আমার জন্য আপনার এত মায়া? আমাদের পরিচয় কেবল কয়েক মাসের, এই কয় মাসেই আপনার আমার প্রতি এত মায়া জন্মে গেল? অদ্ভুত, এত মায়া নিয়ে বাঁচবেন কী করে আপনি?’

পদ্ম’র ভীষণ রাগ হলো। সে কড়া গলায় বললো,

‘আমি আপনার মতো পাষাণ না ডাক্তারবাবু। আপনার মধ্যে মায়া দয়া নাই থাকতে পারে কিন্তু আমার মধ্যে আছে, অনেক বেশি পরিমাণে আছে।’

‘মায়া যত বেশি, কষ্টও তত বেশি। অযথা যদি কষ্ট পেতে চান, তবে মনের মধ্যে এই একগাদা মায়া পুষে রাখুন। আর একদিন দেখবেন এই মায়া আপনাকে কীভাবে কুরে কুরে খায়।’

পদ্ম নাকের পাল্লা ফুলিয়ে শক্ত গলায় বললো,

‘ভালো, আমার কষ্ট আমি বুঝবো। আপনি যান।’

আদিদ জোরে শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘তা তো যাবোই। তবে যাওয়ার আগে একটা কথা বলতে চাই, আপনিও খুব ভালো একটা মেয়ে পদ্ম। জীবনে এত কষ্ট সহ্য করেও নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। জানেন, আপনি আমার কাছে আমার অনুপ্রেরণা। আপনাকে দেখেই আমি সাহস পেয়েছি, নতুন ভাবে বাঁচার। হয়তো ভালো নেই, তাও বেঁচে তো আছি। (একটু থেমে) পদ্ম, আমি হয়তো জানি আপনার মন কী চাইছে। কিন্তু, আমি বা আমার মন কোনোভাবেই প্রস্তুত না। কাউকে না পাওয়ার যন্ত্রণা যে কতটা নির্মম, সেটা আমিও বুঝি পদ্ম। আর বুঝি বলেই বলছি, নিজের মনকে প্রশ্রয় দিয়েন না তাতে আপনারই কষ্ট বাড়বে। আমি চলে যাচ্ছি, পদ্ম। তবে একেবারের জন্য না। আবার আসবো আমি। যদি কোনো দিন আমার মন বলে তার ঝিলে একটা পদ্মফুল দরকার তখন না হয় আসবো এই পদ্মফুলকে নিতে। আশা করি ততদিন পর্যন্ত সেই পদ্মফুলও সতেজ থাকবে। ভালো থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ।’

আদিদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। পদ্ম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতরটা ধপাস ধপাস করে লাফাচ্ছে। শরীরটা কেমন যেন অবশ অবশ লাগছে। সব তো ঠিক ছিল তবে আদিদের শেষের কথাগুলো তো তাকে বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছে। আদিদ কোন পদ্মফুলকে নিতে আসবে? আদিদ কি তার কথা বলছিল? সেকি আদিদের পদ্মফুল? পদ্ম’র মাথা ঘুরাচ্ছে। সেই মুহুর্তে তার রুমমেট একজন এসে খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠে। পদ্ম ভয় পেয়ে যায়। সেই মেয়েটি পদ্ম’র কাছে এসে তার হাত ধরে বলে,

‘এই মেয়ে, তুমি এখানে কী করো? আর ঐদিকে সবাই তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে শেষ। চলো, ভেতরে চলো।’

মেয়েটি তাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল। সবাই তাকে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। জানতে চাইল, এতক্ষণ কোথায় ছিল সে। পদ্ম’র কান অবধি সেই সব কথা পৌঁছাল না। তার কানে তো কেবল আদিদের কথাই বাজজে। সে কারোর কথার কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ল।

.
.

বসন্তের শেষ সময়। চারদিকে গরম পড়ছে। কখনো আবার বাতাস বইছে অনেক জোরে। দুপুরের কাঠ ফাটা রৌদ্দুর। দূরের মসজিদে তখন যোহরের আযান হচ্ছে। বাড়ি জুড়ে চলছিল তখন বিয়ের প্রস্ততি। আহামরি আয়োজন না হলেও বেশ পরিপাটি করে করা হচ্ছে সবকিছু। এই তপ্ত দুপুরেও আশ্রমের মেয়েগুলো ছুটো ছুটি করছে। অনেক কাজ তাদের। সকাল থেকেই তারা সবাই ব্যস্ত। ব্যস্ত তো হতেই হতো, বিয়ে বলে কথা! তাও তাদের এখানেই। পুরো আশ্রমের সমস্ত ছোট ছোট কটেজের মতো ঘরগুলো ফ্যাইরি লাইট দিয়ে সাজানো। ফুল দিয়ে সাজানো রুমের ভেতরগুলো। তার সাথে সেজে উঠেছে আশ্রমের সমস্ত প্রাঙ্গণগুলো। আশ্রমের পরিচালিকা দু’জন মেয়েদের উপর একটু পরপর কেবল ক্ষেপে যাচ্ছেন। তাদের ভাষ্য মতে মেয়েগুলো কোনো কাজ ঠিকভাবে করছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই চলে আসবে। এখনও পুরো রান্না হয়নি। কাজী সাহেবও চলে আসবেন নামাজ পড়ে। অথচ মেয়েগুলোর মধ্যে কোনো হুশ’ই নেই। উনারা হৈ চৈ করছেন, মেয়েদের তাড়া দিচ্ছেন। মেয়েরা বিরক্ত হলেও কিছু বলছে না। খালি আজ তাদের অভি ভাইয়ের বিয়ে বলে তারাও হাসি মুখে সবকিছু সহ্য করে নিচ্ছে।

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩৯|

কনে পক্ষের সবাই চলে এসেছে। অভি তার পুরো পরিবার সহিত আশ্রমে আরো আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। কনে কে নিয়ে মেয়েরা ভেতরের রুমে গেল। কাজী ও চলে এসেছে এবার বিয়ে পড়ানোর পালা।

কাজী সাহেব সহ আরো বেশ কয়েকজন বয়োজৈষ্ঠ লোক ভেতরের রুমে গেলেন। পদ্ম সহ বাকি সব মেয়েরা কনে কে চাদর দিয়ে আড়াল করলো। কাজী সাহেব কাবিননামা পড়ে শুনালেন তারপর মেয়েকে কবুল বলতে বললেন। পদ্ম’র সেই মুহুর্তে তার নিজের বিয়ের ঘটনাগুলো মনে পড়ছিল। সেই মুহূর্তে বুকের ভেতর টা তার কী পরিমাণ ছটফট করছিল সেটা কেবল সেই জানে। কী ভয়ানক সুন্দর ছিল সেই অনুভূতি। তবে তার পরিণতি ছিল ভীষণ কুৎসিত। পদ্ম আর সেসব নিয়ে ভাবল না। কনে কাঁদছে। পদ্ম তার হাতের উপর হাত রেখে বললো,

‘আপু, কবুল বলুন।’

মেয়েটা নাক টেনে বললো,

‘কবুল।’

পরপর তিনবার কবুল বলার পর সকলে একসঙ্গে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠল। তারপর সবাই ব্যস্ত হয়ে ছুটল বরের কাছে। সবাই চলে যাওয়ার পর পদ্ম একটা টিস্যু নিয়ে কনের চোখ মুখ মুছে দিল। তারপর সে তার পাশে বসলো। মুচকি হেসে বললো,

‘অবশেষে আমাদের অভি ভাইয়ের বউ হয়েই গেলেন। মাশাল্লাহ, দুজন কে একসাথে পুরো রাজযোটক লাগবে।’

মেয়েটি মিষ্টি করে হাসল। পদ্ম আবার বললো,

‘আপনার বুঝি কবুল বলার সময় খুব কষ্ট হচ্ছিল?’

মেয়েটি বললো,

‘হ্যাঁ, বিয়ে করলেই তো মা বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে সেইজন্যই খুব কষ্ট হচ্ছিল।’

পদ্ম আস্তে করে বললো,

‘ওহ।’

মেয়েটি কিছুক্ষণ পদ্ম’র দিকে চেয়ে থেকে বললো,

‘অভির কাছে আমি তোমার কথা অনেক শুনেছি। তুমি খুব সাহসী একটা মেয়ে। সারাজীবন এইভাবে এক বুক সাহস নিয়ে বেঁচে থাকো, দোয়া করি।’

পদ্ম তার কথার জবাবে প্রসন্ন হাসল।

.

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে সবাই মনোযোগ দিল ফটো সেশনে। সবাই বর কনে কে নিয়ে অনেক অনেক ছবি তুলছে। পদ্ম দূরে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখছিল। সেই সময় কেউ তার পেছনে এসে বললো,

‘আপনি ছবি তুলছেন না যে?’

পদ্ম চমকে পেছনে তাকাল। আলতো হাসল সে। বললো,

‘আপনি ছবি তুলবেন না?’

আদিদ বললো,

‘না, ইচ্ছে করছে না।’

‘সেকি, আপনার একমাত্র বন্ধুর বিয়ে বলে কথা আর আপনার তার সাথে ছবি তুলতে ইচ্ছে করছে না!’

‘না, করছে না। এতে এতো অবাক হওয়ার কী আছে?’

পদ্ম সেই কথার জবাব না দিয়ে আদিদের দিকে তাকাল। আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,

‘কী হলো?’

পদ্ম হেসে বললো,

‘আপনি সব সময় সাদা পাঞ্জাবী কেন পরেন? আপনার কি অন্য রঙের পাঞ্জাবী নেই?’

ব্যাপার টা আদিদের কাছে ভীষণ বিরক্তিকর মনে হলো। সে কী কালার পাঞ্জাবী পরবে সেটা তার ব্যাপার। এতো কিছু নিয়ে এই মেয়েকে কেন কথা বলতে হবে। আদিদ তার চোখে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,

‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই পরেছি।’

পদ্ম আর কিছু বলে না। আদিদ কিছুক্ষণ থেমে বলে,

‘আগামী মাসে আমার ফ্লাইট।’

পদ্ম নিরব থাকল। আদিদ তখন বললো,

‘অভি বলেছে এখানে থাকলে আপনি খুব ভালো থাকতে পারবেন। আর এখানের নারী সংস্থার সাহায্যে আপনি একদিন স্বাবলম্বী হতে পারবেন তখন আর আপনাকে বেঁচে থাকার জন্য অন্য কারোর উপর নির্ভর করতে হবে না। অভির সাথে আমার কথা হয়েছে, ও বলছে ও আপনার খেয়াল রাখবে। আর আমিও আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো। নিজেকে কখনোই একা ভাববেন না। আমরা সবাই আপনার পাশে সবাই আছি।’

পদ্ম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পদ্ম’র মৌনতা দেখে আদিদও আর কিছু বললো না। দূর থেকে অভি তাদের ডাকল। আদিদ তখন পদ্ম কে বললো,

‘চলুন, অভি ডাকছে।’

বলে সে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। পদ্ম আর সেদিকে গেল না। সে তার রুমে গিয়ে গা থেকে শাড়ি’টা খুলে ফেলল। তারপর একটা সুতি থ্রি পিস পরে আবার বাইরে বের হলো।

.

আদিদের জুরুরি একটা কল আসায় সে বাগানের এক কোণে গিয়ে কথা বলছিল। কথা শেষে চলে আসার সময় হঠাৎ সে কিছু একটা দেখে দাঁড়াল। বাগানের অপর পাশে রাণীকে দেখতে পেল সে, আর তার সাথে ছিল অভির শালা মানে নতুন কনে নিঝুমের ভাই। রাণী খুব হেসে হেসে ছেলেটার সাথে কথা বলছিল। ছেলেটার বয়সও বেশি না। হবে হয়তো উনিশ বিশের মতো। আদিদ বেশ আগ্রহ নিয়ে ব্যাপারটা দেখল। তখন তার মনে হলো এই জন্যই রাণী আজ আর তাকে বিরক্ত করেনি কারণ সে বিরক্ত করার নতুন মানুষ পেয়ে গিয়েছে। আদিদ হেসে হাঁটতে হাঁটতে বাগান থেকে বেরিয়ে আসে। সে বেরিয়ে আসতেই পদ্ম কে দেখে, হাতে বিশাল এক ঝুড়ি নিয়ে বাগানে ঢুকছে। তাকে বাগানে ঢুকতে দেখে আদিদ জিজ্ঞেস করলো,

‘কোথায় যাচ্ছেন?’

‘বাগানে, ফুল তুলবো।’

‘ভেতরে তো এত ফুল আছে। আর ফুল দিয়ে কী হবে?’

‘অভি ভাই বলেছে উনার বাসর ও নাকি এখানেই হবে। নিঝুম আপুও সেটাই চান। তাই উনাদের বাসর ঘর সাজানোর জন্য অনেক ফুল প্রয়োজন।’

আদিদ তখন উৎসুক কন্ঠে বললো,

‘চলুন তাহলে, আমিও আপনাকে সাহায্য করি।’

পদ্ম আদিদ কে বারণ করলেও আদিদ তার মতো কাজ করে যায়। অনেক ফুল নিয়ে তারা দু’তালার গেস্ট রুমে যায় সেটা সাজানোর জন্য। পদ্ম বললো, নিঝুম আপুর গোলাপ ফুল পছন্দ তাই অভি ভাইয়া বলেছেন গোলাপ ফুল দিয়েই পুরো রুম সাজানোর জন্য। কিন্তু আদিদ বললো, শুধু গোলাপ দিয়ে সাজালে ভালো দেখাবে না। তার সাথে কিছু অর্কিড নিলে হয়তো বেশি মানাবে। দুজনের কথা না মেলায় কিছুক্ষণ সেখানে বেশ তর্ক হলো। এক পর্যায়ে আদিদ বিরক্ত হয়ে বললো,

‘ঠিক আছে, আপনি সাজান আপনার মন মতো, আমি গেলাম।’

পদ্ম তাকে পাত্তা দিল না। আদিদ সত্যি সত্যিই চলে গেল।

সন্ধ্যার দিকে কনে পক্ষের সবাই আশ্রম থেকে চলে গেলেন। কেবল থেকে গেল কনের ভাই। পরিবারের মানুষগুলো চলে যাওয়ার সময় নিঝুম খুব কাঁদছিল। আর ওর কান্না দেখে আশ্রমের বাকি মেয়েরাও কাঁদছিল। আদিদ হতভম্ব হয়ে তখন মেয়েদের দেখছিল। সে বুঝতে পারে না, এক মেয়ের বিদায়ের বেলায় এত মেয়েকে কেন কাঁদতে হবে। যার বিদায় সে কাঁদবে, না এখানে সবাই দল বেঁধে কাঁদতে নেমেছে।

অভির মা বাবা বাদে তার বাকি আত্মীয়-স্বজন’রাও চলে যায়। তারা কালকে নতুন বউ নিয়ে একেবারে ফিরবে বলে আজ রাতটা সকলে এখানেই কাটায়।

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর আদিদ চলে যেতে চাইলেও অভি তাকে দেয় না। অভির জোরাজুরি তে এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে এখানে থাকতে হয়। আর তার জন্য সে প্রচুর বিরক্ত ও হয়ে উঠে। এখানে থাকার যে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই সেটা পদ্ম তার মুখ দেখেই বুঝতে পারে। কেবল মাত্র বন্ধুত্বের খাতিরে সে সবকিছু খুশি মেনে নিয়েছে।
.

সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। কিন্তু আদিদের চোখে ঘুম আসছে না। সে অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে হাসফাস করতে লাগল। তাও ঘুমের ছিটেফোটাও তার চোখে এসে ধরা দিল না। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সে বারান্দায় গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ খোঁজার চেষ্টা করলো। আকাশে আজ চাঁদ নেই। আদিদ তখন মনে মনে ভাবল, অভি আর নিঝুমের জন্য এই আকাশটা আজ বড্ড বেমানান। অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে সে আবার রুমে চলে যায়। তারপর বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে। চেষ্টা করতে থাকে, যদি অক্ষিকোণে একটু ঘুমের দেখা পাওয়া যায়।

______________________________________

গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়,

পদ্ম’র কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। শরীরের জামা’টার অনেককাংশ ঘামে ভিজে উঠেছে। মাথার উপর জলন্ত সূর্য টা যেন তাকে ভস্ম করে দিতে চাইছে। আদিদ গাড়ি টা স্টার্ট দিতেই পদ্ম আরো একবার কম্পিত স্বরে বলে উঠে,

‘না গেলে হয়না ডাক্তারবাবু?’

আদিদের কানে সেই সুর পৌঁছায় না। সে অভিকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। আশ্রমের সবাই তাদের বিদায় জানায়। তারপর তারা একে একে সবাই ভেতরে চলে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে কেবল পদ্ম। এই রোদে দাঁড়িয়ে থেকে তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে। কিন্তু সেই কষ্ট সে টের পাচ্ছে না। ডাক্তারবাবু চলে যাচ্ছে বলে এর থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। যদি তার ক্ষমতা থাকতো তবে সে তাকে আটকে রাখতো, যেতে দিত না। কিন্ত আফসোস! সেই ক্ষমতা তার নেই। পদ্ম নিষ্প্রাণ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন তার হাতটা এসে কেউ ধরে। পদ্ম আলতো চোখে তাকায় তার দিকে। রাণী তখন বিষন্ন কন্ঠে বলে,

‘তুমি কি ডাক্তার সাহেব কে ভালোবাসো?’

পদ্ম নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কেবল মাথা নাড়ায়। রাণী মেয়েটি তখন তার হাত ছেড়ে ভেতরে দৌঁড়ে যায়। আর পদ্ম দাঁড়িয়ে থাকে ঐভাবেই।

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪০|

দেখতে দেখতে চলে গেল পাঁচ’টা বসন্ত।

আরেকটা গ্রীষ্মের সকাল। চারদিকে ধু ধু রোদ্দুর। সেই রোদ্দুরেই গায়ে একটা সুতি শাড়ি জড়িয়ে এক রমণী ছুটল তার গন্তব্যে। যাওয়ার পথে টঙের কাছে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা ও গলাধঃকরণ করলো সে। এই গরমে কেউ চা খায়? সেই প্রশ্নের জবাব তার মাঝে নেই। কারণ, আজকাল চা ছাড়া তার চলেই না।

একটা রিক্সা কোনোভাবে ম্যানেজ করেই দ্রুত ছুটল সে। পনেরো মিনিটের রাস্তা জ্যামের কারণে আধ ঘন্টায় পার করতে হলো। প্রচন্ড গরমে ঘেমে গেয়ে একাকার সে। কোনো রকমে রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে ছুটল সামনের দিকে।

বাচ্চাগুলো তার জন্য অপেক্ষা করছে সেই কখন থেকে। সে এসেই জিভে কামড় দিল। কান ধরে বললো,

‘সরি রে আজও লেইট হয়ে গিয়েছে। আসলে হয়ে কী..’

‘থাক, আপনার আর এক্সকিউজ দিতে হবে না। যেদিন থেকে এখানে এসেছেন সেদিন থেকেই আপনার একের পর এক সমস্যা শুনেই যাচ্ছি। নেহাতই অভি বলেছে, তাই কিছু বলতে পারছি না। নয়তো আপনার মতো সময় জ্ঞানহীন মেয়েকে কখনোই আমি এখানে রাখতাম না।’

কথাটা বলেই লোকটা তার সামনে থেকে চলে যায়। পদ্ম হাসে। এ আর নতুন কী! এখানে আসার পর থেকেই এই লোকের রাগ সে সহ্য করছে। তার মাথায় আসে না, এত রাগ নিয়ে কী করে একটা মানুষ বেঁচে থাকে। কিছু থেকে কিছু হলেই, চেঁচিয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলেন।

বাচ্চাগুলো পদ্ম-কে নিশ্চুপ থাকতে দেখে মন খারাপ করে বলে,

‘তোমার কি মন খারাপ হইছে, আপা?’

পদ্ম তাদের দিকে তাকায়। হেসে বলে,

‘কই না তো। মন খারাপ হবে কেন?’

সেখান থেকে একটা বাচ্চা মেয়ে বলে উঠে,

‘স্যার সবসময় খালি তোমারে বকে। স্যার’টা একটুও ভালো না।’

পদ্ম বড়ো বড়ো চোখ করে বলে,

‘এইভাবে বলতে হয়না বাবু। স্যার তো আর আমাকে এমনি এমনি বকে না। দেখো না, আমি প্রতিদিন লেইট করি তাই তো স্যার আমার উপর রাগ করেন। আর আমার তাতে একটুও মন খারাপ হয় না, বুঝেছো সোনা? আচ্ছা, এখন এসব বাদ দিয়ে বলো আমরা কোথায় ছিলাম? আজ আমাদের কী পড়ার কথা ছিল?’

আরেকটা ছেলে বললো,

‘আপা, আজকে ক খ পড়াবেন বলছিলেন।’

‘ঠিক আছে, তাহলে শুরু করি।’

পদ্ম বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করলো। তার কথা আড়াল থেকে সেই লোকটি শুনছিল। লোকটি মাঝে মাঝে অবাক হয়, মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন? এত রাগ দেখানোর পরও তার মাঝে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা কাজ করে না। কতটা আদর দিয়ে বাচ্চাগুলোকে পড়ায় যেন নিজের সন্তান। মেয়েটাকে যত দেখছে ততই যেন সে তার আরো গভীরে চলে যাচ্ছে।
.

বাচ্চাগুলোকে ছুটি দিয়ে পদ্ম তার ব্যাগ গোছাচ্ছিল। তখনই পেছন থেকে নরম গলায় কেউ তাকে ডাকল। পদ্ম পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো,

‘স্যার, আপনি? কিছু বলবেন?’

লোকটি ইতস্তত কন্ঠে জবাব দিল,

‘আ’ম সরি, পদ্ম। আমি হয়তো সবসময় আপনার সাথে একটু বেশিই রাগ দেখিয়ে ফেলি। আসলে ছোট বেলা থেকেই আমি এমন। খুব টাইম মেইনটেইন করে চলি। আর কেউ যদি সময়মতো কিছু না করে তখন আমার খুব রাগ হয়। আর সেই রাগ সহ্য করতে না পেরে এইভাবে চেঁচিয়ে উঠি। আমি জানি এটা ঠিক না। কিন্তু আমি পারি না নিজেকে কন্ট্রোল করতে। আ’ম সরি পদ্ম, আ’ম এক্সট্রিমলি সরি।’

পদ্ম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যেন। ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,

‘আপনি এইভাবে কেন বলছেন, স্যার? দোষ’টা তো আমার। আমি একেবারেই ইররেগুলার। একদিনও টাইম মতো আসতে পারিনা। আসলে স্যার, রাত জেগে ব্লকের কাজ করি বলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে লেইট হয়ে যায় আর তাই এখানে আসতেও লেইট হয়ে যায়। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে আমাকে টাটা বাই বাই করে দিত। আপনি ভালো মানুষ বলে এখনো আমাকে সহ্য করে আছেন। ধন্যবাদ স্যার। আমার কাল থেকে আর লেইট হবে না, একেবারে সিউর।’

লোকটি হাসল। বললো,

‘আমি জানি কাল আপনার আবার লেইট হবে। আর আপনি কালও এসে এই একি কথাই বলবেন।’

পদ্মও হেসে ফেলল তার কথায়। তারপর লোকটি বললো,

‘আচ্ছা তাহলে, যান এবার। কাল আবার দেখা হচ্ছে, আল্লাহ হাফেজ।’

এই বলে সে সেখান থেকে চলে গেল। পদ্ম তার ব্যাগ গুছিয়ে নিজের পরের গন্তব্যের দিকে রওনা দিল।
.
.

গোসল সেরে বেরিয়ে দেখল চার’টা বাজে। পদ্ম দ্রুত তখন রান্নাঘরে গিয়ে খাবার বাড়তে লাগল। খেতে খেতেই মেয়েরা চলে আসবে। উফফ, আজকে মার্কেটে না গেলেই হতো, তাহলে আর এত লেইট হতো না তার। সে তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছিল। তখন তার সামনে একটা মেয়ে এসে বললো,

‘আহ আপু, আস্তে খাও না, গলায় লাগবে তো।’

পদ্ম ভরা মুখে বললো,

‘আস্তে খাওয়ার সময় নেই রাণী, মেয়েরা চলে আসবে।’

‘তো কী হয়েছে, ওরা না হয় একটু বসবে। তুমি আস্তে ধীরে খাও তো। নয়তো গলায় খাবার আটকে আবার আরেক বিপদ বাঁধবে।’

রাণীর কথায় পদ্ম আস্তে আস্তেই খেল। মেয়েরাও কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসে। পদ্ম আস্তে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে তাদের সামনে গিয়ে বসে। রাণীকে ডেকে তার রং আর কাঠের ব্লকগুলো আনতে বললো। সে সেগুলো নিয়ে এসে নিচে পদ্ম’র সাথে পাটিতে বসে পড়ল।

পদ্ম কিছু মেয়েকে ব্লক প্রিন্টের কাজ শেখায়। সে নিজে আশ্রমে এই জিনিসগুলো শিখেছিল। আজ সেগুলো দিয়েই নিজের ভরণপোষণ চালাচ্ছে। আর তার সাথে আছে রাণী। আশ্রমের সবাই যখন যার যার মতো স্বাবলম্বী হয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল রাণীই তখন একমাত্র পদ্ম’র হাত ধরে বলেছিল, “আপু, আমি তোমার সাথে থাকবো।” আর সেদিন থেকেই রাণী তার সাথেই আছে। রাণী কে নিয়ে সে ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায় থাকে। মেয়েটা ছিল বলেই তার জীবন আজ এতটা সহজ হয়ে উঠেছে। সে এতটা সাহস নিয়ে সব কাজ করে যাচ্ছে। এই হাতের কাজ আবার তার ছোট্ট পাঠশালা, এইসব কিছুর পেছনেই রাণীর অনেক অবদান আছে। পদ্ম মাঝে মাঝে ভাবে, মেয়েটা কেন তাকে এত ভালোবাসে? সে কোনো কারণ খুঁজে পায়না। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে থেকেও রাণীর ভালোবাসা কতটা নিখুঁত, কতটা সুন্দর, ভাবতেই পদ্ম’র ছোট্ট মনটা সুখে ভরে উঠে।

______________________________

অন্যদিনের মতোই আরেকটা সুন্দর, স্বাভাবিক সকাল। আবারও পদ্ম ছুটল তার পাঠশালার বাচ্চাদের পড়ানোর উদ্দেশ্যে। আজ আর সে লেইট হয়নি। লেইট হবে ভেবে টঙের মামার হাতে চা টাও ছেড়ে গিয়েছে সে। আফসোস হচ্ছিল খুব, কিন্তু সে নিরুপায়।

রিক্সা নিয়ে দ্রুত পৌঁছে গেল সে তার গন্তব্যে। গিয়ে দেখল সেখানে অভি আর নিঝুম। পদ্ম’র মনে যেন তখন এক পশলা খুশি এসে ভর করলো। নিঝুমের কোলে থাকা বাচ্চা মেয়েটি পদ্ম-কে দেখা মাত্রই আদু আদু বুলিতে বলতে লাগল,

‘পদঅঅঅ।’

সবাই তার আওয়াজে পেছন ফিরে তাকাল। পদ্ম-কে দেখে অভি আর নিঝুম ভীষণ খুশি হলো। পদ্ম এগিয়ে গেল তাদের কাছে। বাচ্চা মেয়েটাকে প্রথমে কোলে নিয়ে তারপর সে সবার সাথে সৌজন্য বিনিময় করলো। অনেকক্ষণ কথা বললো সবাই। আর কথার এক পর্যায়েই অভি হঠাৎ বলে উঠল,

‘আগামী সপ্তাহে তো আদিদ আসছে।’

কথাটা পদ্ম’র কানে যাওয়া মাত্রই থমকে গেল সে। বুকের ভেতরের পুরোনো ব্যাথাটা আবারও তীব্র হলো তার। সে হয়তো ভুলে যেতে চেয়েছিল, নিজেকে নিজের মতো করে বাঁচিয়ে রেখেছিল কিন্তু এখন আবার সে হয়তো দুর্বল হয়ে পড়বে। মনের মায়ার কাছে আবার হয়তো হেরে যেতে হবে তাকে। কিন্তু সেটা সে চায় না। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। আর কোনোভাবেই কোনো মায়ায় নিজেকে জড়ানো যাবে না। কারণ সে এতদিনে এইটুকু বুঝতে পেরেছে যে, মায়াহীন মানুষরাই এই পৃথিবীতে সব থেকে বেশি সুখী।

চলবে…