পরাণ দিয়ে ছুঁই ২ পর্ব-৪+৫

0
212

#পরাণ_দিয়ে_ছুঁই (২য় পরিচ্ছেদ)
#পর্বঃ৪
#Jhorna_Islam

(অতীত)

ঐদিন যখন নূরের মা নূরকে একটা শাড়ি দিয়ে কোনো কিছু না বলে তৈরি হতে বলে চলে যায়। আর নূরের ফুপাতো বোন নূরকে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দেয় তখনও বুঝতে পারছিলো না তার সাথো হচ্ছে কি।এক্সামের টেনশনে এসব বিষয় গুলো মাথার ভিতর যাচ্ছিলো না। নূরের বাবা রুমে এসে যখন তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলো আম্মা বাবার প্রতি বিশ্বাস আছে না? বাবারা যা করে ভেবেচিন্তে করে।আমি তোমাকে জলে ভাসিয়ে দিবো না। বাবার উপর একটু ভরসা রেখো।

বাবার কথায় নূর বেশ অবাক হয়।সচরাচর বাবা এমন করে কথা বলে না। মনে নানান ধরনের কু চিন্তা আসতে থাকে। এরমধ্যে নূরের মা আর দুইজন মহিলা যখন নূরকে ড্রইংরুমে নিয়ে বসিয়ে দেয় নূর তখন সাত পাঁচ ভাবতে থাকে। এরমধ্যে নূরকে কাজী যখন কবুল বলতে বলে,,নূরের মাথায় যেনো আসমান ভেঙে পরে। বাবার দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে। বাবার করুন চোখের চাহনি দেখে না জেনে না দেখে মুখ দিয়ে সেই সবচেয়ে পবিত্র সবচেয়ে কঠিন জীবন বদলে দেওয়া কবুল শব্দটি উচ্চারণ করে।

বিয়ের পর যখন কিছু সময়ের জন্য বরের পাশে নিয়ে বসায় নূর তখনও মাথা নিচু করে বসে আছে। শুধু বসে নেই হাত এমন ভাবে কচলাচ্ছে মনে হচ্ছে চামড়া উঠিয়ে ফেলবে।সকল রাগ ক্ষোভ হাতের সাথে মিটাচ্ছে। কোনোদিকে তাকানোর বা কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না। নীরব থাকা মানুষ গুলোর প্রতি তাদের কাছের মানুষরাই সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টকর বোঝা গুলো চাপিয়ে দেয়।

নিজের বাবার উপর সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস ও ভরসা ছিলো আর সে কিনা এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত একা নিয়ে জীবনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিলো। একবার বলার বা জানানোর ও প্রয়োজন মনে করলো না।এতোই বোঝা হয়ে গেছে নূর।না খাওয়াতে পড়াতে পারলে বলে দিলেই হতো এমন করে শাস্তি দেওয়ার কি আছে। মনে মনে আরো নানা ধরনের কথা ভাবছিল আর হাতের উপর সব রাগ ঢালছিলো নূর।

এটা হাত কাপড় ইস্ত্রী করা মেশিন না।নাকি চামড়া থুবড়ে গেছে দেখে এভাবে ডলে ডলে ঠিক করার চেষ্টা চলছে।শেষ মেষ কিনা ভুলভাল বুঝিয়ে একটা বুড়ির সাথে আমাকে বেঁধে দিলো।

কারো গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠে এসব উল্টা পাল্টা বাক্য শুনে চোখ তুলে তাকায়। সেই তাকানোতে কয়শো ভোল্টের ঝটকা খেয়েছে নূর নিজেও জানে না। হাত পা অটোমেটিক কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ।মনে হচ্ছে এখন এক সমুদ্র পানি এনে নূরের গলায় ঢেলে দিলেও তার তৃষ্ণা বুঝি মিটবে না।

নূর লোকটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এটাই ভাবার চেষ্টা করছে ইনি এখানে কি করছে? আর ইনি আমাদের বাড়ি চিনলো কি করে। পরে মনে পরলো লোকটা ঐদিন তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে। লোকটা কি নূরের বাবার কাছে বিচার দিতে আসছে বাসের ঐ ঘটনার জন্য? এসব নানা ধরনের আজগুবি সব চিন্তা ভাবনা করে চলেছে নূর।তার যে একটু আগে বিয়ে হয়ে গেছে এক মুহূর্তের জন্য সেটা মাথা থেকে বের হয়ে গেছে।

কিরে সৌন্দর্য নতুন বউকে দেখি একদিনেই পাগল করে দিলি।দেখ দেখ তোর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। আমরা মুরুব্বিরা যে আছি সেই কথা মেয়ে টা ভুলেই গেছে। আহা সৌন্দর্যের সৌন্দর্যে দিওয়ানা হয়ে গেছে আমাদের নূর।

তালহার এরূপ বাক্যে কটমট করে তাকায় সৌন্দর্য। চোখ পাকিয়ে গলা নিচু করে বলে চুপ যা শা*লা।এটা তোর মশকরা করার জায়গা না।বের হয়ে নেই তারপর দেখে নিচ্ছি তোকে।

এমন করে ভয় দেখাস কেন ভাই? বিয়ের দিন ও তোর এরকম রূপ দেখাচ্ছিস? তোর বউ তো ভয় পেয়ে আর শ্বশুর বাড়ি ই যেতে চাইবে না।মেয়েটা এমনিতেই যেই ভী’তু।

সৌন্দর্য তালহার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,, আমার বউ কেমন সেটা তোকে বলতে হবে না। আমি নিজে বুঝে নিবো সাহসী নাকি ভীতু।

বাহ্ ভাই বাহ্ এখনই এতো? ভুলে যাস না সে তোর বউ হওয়ার আগে আমার ছাত্রী।

তোর ছাত্রী আমার বিয়ের পাত্রী। বলেই সৌন্দর্য কলার ঠিক করে পাঞ্জাবির।

ওদের দুই বন্ধুর কথা কানেই যায় নি নূরের সে টা’সকি খেয়ে বসে আছে এসব কি করে হলো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এসব কিছু তো নূর কল্পনাতে ও ভাবে নি। তাও কিনা সৌন্দর্য স্যারের সাথে? যার সাথে একটার পর একটা দূর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। কতো লজ্জায় পরতে হয়েছে নূর কে। তারচেয়ে বড় কথা এই লোকটার তো মেয়ে আছে বিবাহিত। নিজের বউ বাচ্চা থাকা সত্তেও কিনা নূর কে বিয়ে করেছে।বাবা কি করে পারলো একটা বিবাহিত লোকের সাথে তার বিয়ে দিতে? মনে মনে নূর ঠিক করে নেয় বাবার সাথে আর কোনোদিন কথাই বলবে না।

নূরের নানান ভাবনার মাঝেই নূরের বোন এসে নূর কে ড্রয়িং রুম থেকে নিয়ে যায়।

সৌন্দর্যরা ও খাওয়া দাওয়া করে চলে যায় নূরের সাথে আর আলাদা করে কথা হয় না।এমনকি বিয়ে নিয়ে কোনো আলাপ আলোচনা ও হয়নি। এমনিতে নূরের বাবা কথা বলতে আসলে চুপ হয়ে যেতো। ভালো মতো খাওয়া দাওয়া ও করে নি। এমন করেই দুই দিন চলে যায় এরমধ্যে আর সৌন্দর্য ফোন ও দেয় নি। নূর অনেক চেষ্টা চালাচ্ছে বিষয় টা ভুলে যেতে। কিন্তু কে জানতো যেটা থেকে নূর পালানোর চেষ্টা করবে সেটাই তার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাবে।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

(বর্তমান)

ফাতিহা পিছন সিট থেকে এসে নূরের কোলে বসেছে।

সৌন্দর্য গাড়ি চালাতে চালাতে নূরের দিকে একবার ফাতিহার দিকে একবার দেখছে।নূর বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলেও ফাতিহা এক দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। কে জানে কি দেখছে মেয়েটা নাকি কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে।

নূর মনে মনে ভাবছে এই বাচ্চা মেয়েটা কি করে নিজের মা কে ভুলে আরেকজন কে এতো সহজে মাম্মা মেনে নিলো।অবশ্য ওর কোনো দোষ নেই ওর মাথায় যা ঢুকানো হয়েছে তাই তো বলবে।

মাম তুমি আমার কোলে এসে পড়ো।বেচারির দেখো মুখটা শুকিয়ে একটু খানি হয়ে গেছে। কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছে এখনই বুঝি কেঁদে দেবে।সৌন্দর্য নূরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।

ফাতিহা সৌন্দর্যের কথায় নূরের দিকে তাকিয়ে বলে,, মাম্মা আমি তোমার কোলে উঠায় তুমি কষ্ট পাচ্ছো? আমি কি বেশি মোটা? এই কথা টা বলতে বলতে ফাতিহার চোখ দুটো পানিতে টইটুম্বুর হয়ে উঠে।

নূরের কেন জানি ফাতিহার এমন চাহনী দেখে খুব মায়া হলো । ফাতিহা কে নিজের সাথে জড়িয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলে একদম না। আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। আমার আরো ভালো লাগছে।

সৌন্দর্য মনে মনে বলে,,এখানে তাকে এনেছি একজনের মন ভালো করার জন্য। সে এসে নিজেই গঙ্গা, যমুনা ভাসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সবগুলো ইমোশনাল ফুল।

ফাতিহা আর নূর সৌন্দর্য কে পাত্তা না দিয়ে নানান ধরনের গল্প করা শুরু করে দেয়। অবশ্য বেশি বকবক ফাতিহা ই করছে নূর শুধু তার উত্তর দিচ্ছে। এরমধ্যে নূর কিছু একটা বলতে গিয়ে ফাতিহা কে ডাক দেয়,,,,তিহা শুনো।

নূরের তিহা ডাকে সৌন্দর্য আর ফাতিহার মাথায় যেনো বা/জ পরে। সৌন্দর্য হুট করে গাড়ি ব্রেক করে। হুট করে হওয়ায় নূর সামলাতে না পেরে ফাতিহা কে নিয়ে হেলে পরে। কপালে আঘাত পাওয়ার কথা থাকলেও সৌন্দর্য হাত বাড়িয়ে নূরের কপালের সামনে রাখায় ব্যাথা পাওয়া থেকে বেঁচে যায়।

নূর সৌন্দর্যের দিকে তাকায়। সৌন্দর্য নূরের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার গাড়ি চালাতে থাকে আর বলে,,,নেক্সট টাইম ফাতিহা মাম কে তিহা বলবে না। আই নো ভালোবেসে বলেছো বাট কিছু কিছু জিনিস একজনের কাছে ভালোবাসার হলেও আরেকজনের কাছে কষ্টের কারণ। আই থিংক বুঝতে পেরেছো।

নূর চুপ করে শুধু তাকিয়ে ছিলো বুঝলো না তিহা ডাকের সাথে কষ্টের কি সম্পর্ক। নূর আর বেশি ঘাটায় ও নি আর না প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করে।

এরমধ্যে একটা দোকানের সামনে সৌন্দর্য গাড়ি থামিয়ে রাখে। গাড়ি থেকে নামার সময় ফাতিহা জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছো?

এখনই আসছি মাম বলে সৌন্দর্য বড় বড় হাঁটা দিয়ে চলে যায়। কিছু সময়ের মাঝে ফিরেও আসে। হাতে অনেকগুলো প্যাকেট। গাড়ির ভিতরে ঢুকে সবগুলো প্যাকেট নূরের হাতে ধরিয়ে দেয়। নূর কিছু গাড়ির পিছনে রাখে আর কিছু ফাতিহার জন্য নেয়। যেই প্যাকেট টা নেয় এরমধ্যে হরলিক্স ও দেখতে পায়। ফাতিহা দেখে খুশি হয়ে যায় কারণ তার অনেক পছন্দ। নূরের হাত থেকে নিজেই নিয়ে নেয়। প্যাকেটে দুটো হরলিক্স ছিলো একটা ফাতিহা নিলো তাই নূর আরেকটা গাড়ির পিছনে রাখে পরে খাবে ফাতিহা এটা ভেবে। কিন্তু নূরের আর হরলিক্স রাখা হয়না সৌন্দর্যের কথায় আহাম্মক হয়ে যায়।

ওটা রাখছো কেনো? ওটা তোমার জন্য। স্মৃতি শক্তি যা দূর্বল ফাতিহার সাথে সাথে তুমিও খাও। ওটা তোমার।

নূর হরলিক্সের কৌটা নিয়ে চোখ বড়সড় করে তাকিয়ে আছে কারণ ওটা বাচ্চাদের হরলিক্স। লোকটা কিনা সত্যি সত্যি তারজন্য হরলিক্স কিনেছে? তাও আবার বাচ্চাদের গুলো।

চলবে,,,,?

#পরাণ_দিয়ে_ছুঁই (২য় পরিচ্ছেদ)
#পর্বঃ৫
#Jhorna_Islam

নূর হরলিক্সের কৌটা টা গাড়ির সামনে রেখে চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে বসে আছে। ভিতরে ভিতরে রাগে ফুঁসছে। সৌন্দর্য একের পর এক অপমান করে যাচ্ছে। একটা মানুষ কে এতো অপমান করা কি ঠিক? লোকটা একজন শিক্ষক হয়ে জানেন না একজন মানুষকে প্রতি নিয়ত এমনভাবে অপমান করলে মানুষটার মনে কিরকম প্রভাব পরবে।

ফাতিহার কোনো দিকে কোনো খেয়াল নাই,সে একমনে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে আঙুল ও চা’টছে যেটার আওয়াজ হচ্ছে। নূরের বিষয় টা খুব ভালো লাগছে। কি সুন্দর করে মেয়ে টা খাচ্ছে।

কিন্তু লোকটার এটাও সহ্য হলো না। নূরের কোনো কিছুই মনে হয় সহ্য হয় না লোকটার। নূর এই লোকটার সাথে সারাজীবন কি করে কাটাবে ভেবে পায় না। এসব কিছু নিয়ে ভাবতে গেলেই নূরের কান্না পায়।

সৌন্দর্য কপাল কোচকে ফাতিহা কে বলে,,,আহ্ মাম কি হচ্ছে কি? এভাবে কেউ শব্দ করে খাবার খায়? খাবার খাবে নিঃশব্দে। আর তুমি কি করছো? কি রকম বা’জে সাউন্ড। আর এটা ব্যাড ম্যানার মাম।সাউন্ড পলিউশন হয়।

ফাতিহা সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে।তারপর মাথা নেড়ে খেতে থাকে।

নূর সৌন্দর্যের কথায় বো’কা বনে যায়। খাওয়ার আওয়াজে ও নাকি সাউন্ড পলিউশন হয়। এটাও শোনার বাকি ছিলো। তাই বলে কি লোকে তাদের শান্তি মতো খেতে ও পারবে না নাকি।আজব লোক।

আমাকে কি আজ বেশি সুন্দর লাগছে নাকি? এতো ছোট ছোট চোখ কে এমন বড় বড় করে দেখার কি আছে। ন’জর ট’জর লেগে গেলে তো সমস্যা। কে জানে আবার আমার ফ্রেশ মুখে ব্রন,টন আবার বের হলে।

নূর সৌন্দর্যের এরূপ কথায় চোখ সরিয়ে নেয়। মনে মনে ভেংচি কাটে। এএএ আসছে আমার রূপবতী পুরুষ মানুষ। উনাকে নজর লাগাতে আমার ঠে’কা পরছে।

আ-আমি মোটেও আপনার দিকে চোখ দেই নাই। আমতা আমতা করে বলে নূর।

তাহলে তুমি কি টে’রা নাকি মেয়ে? যে একদিকে তাকাও কিন্তু দৃষ্টি থাকে অন্য দিকে? এই তোমার আর কি কি দোষ আছে সব ক্লিয়ার করে বলোতো আমাকে।লিস্ট করে রাখি।সৌন্দর্যের এরূপ কথায় নূর বলে,,

— এসব আপনি কি বলছেন? আমি মোটেও টে’রা না।এই এই যে দেখেন আমার চোখ। বলেই নূর নিজের চোখের কাছে আঙুল নিয়ে চোখ দেখায় সৌন্দর্য কে। আর বলে,, আর শুনুন আমার চোখ মোটেও ছোট ছোট না।আমার ফেইসের সাথে আমার চোখ মানান সই। আপনি এসব বলে আমাকে একদম অপমান করতে পারেন না।

সৌন্দর্য একটা নদীর পাড়ে এনে গাড়ি থামায়। নূরের কান্ড দেখে সৌন্দর্য শব্দ করে হেসে উঠে।

সৌন্দর্যের হাসির শব্দে নূরের হুঁশ ফিরে।কি করেছে এতক্ষন ভাবলেই লজ্জা লাগছে।কি ভেবেছে লোকটা। নূর তারাতাড়ি নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়।

সৌন্দর্য ততক্ষণে গাড়ির ডোর খুলে বাইরে বের হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে বলে মাম তোমরা ও বেরিয়ে আসো।

ফাতিহা নূরের কোল থেকে নেমে তারাতাড়ি বেরিয়ে আসে। নূর ও আস্তে ধীরে গাড়ি থেকে বের হয়। চার পাশে অনেক গাছ গাছালি।কি সুন্দর বাতাস।বাতাসে নূরের ওড়না দুলছে। ফাতিহা গাড়ি থেকে নেমে নূরের জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলো । নূর বের হতেই নূরের হাতের আঙুল ধরে গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে থাকে।

জানো মাম্মা এটা না মি.ওয়াহিদের খুব পছন্দের জায়গা। বলেই নূরকে ফাতিহা এটা ওটা দেখাচ্ছে।

— আচ্ছা তাই নাকি? নূর জিজ্ঞেস করে।

— হুম আমরা প্রায়ই আসি।তবে বিশেষ কারণে।

— বিশেষ কারণ?

— হ্যা যখন আমার অথবা মি. ওয়াহিদের মন খুব খারাপ থাকে তখনই আমরা এখানে আসি। আর আমাদের মন ভালো হয়ে যায় বলেই ফাতিহা লাফিয়ে উঠে।

ফাতিহার কথায় নূরের মনে কেন যেনো প্রশ্ন জাগলো। কিছু না ভেবে নূর ফাতিহা কে নিজের মনের প্রশ্ন টা জিজ্ঞেস করেই ফেলে।

আচ্ছা ফাতিহা আজ কার মন খারাপ? তোমার?

ফাতিহা নূরের দিকে তাকিয়ে বলে না তো।

— তাহলে,,,, তাহলে কি উনার? নূর সৌন্দর্যের দিকে আঙুল তাক করে জিজ্ঞেস করে।

— আরে না। তুমি খুব বোকা।নিজের মন খারাপ আর নিজেই জানো না? আজ তো তোমার মন খারাপ তাই আমরা এখানে এসেছি।ফাতিহা কথাটা বলেই দৌড়ে গিয়ে সৌন্দর্যের কোলে উঠে কারণ সে আইসক্রিম দেখেছে।

নূর ঐখানেই দাঁড়িয়ে বাপ বেটির দিকে তাকিয়ে রয়। আর ভাবতে থাকে তার মন খারাপ বলে এখানে তাদের পছন্দের জায়গায় নিয়ে এসেছে। না চাইতেও নূরের মন টা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায় ফাতিহার কথা শুনে।

*******-**

ইসরাত গাড়ির পিছনের সিটে বসে একের পর এক গান গেয়ে চলেছে আস্তে নয় জোরে জোরে। গাড়ির ড্রাইভারের এখন গাড়ি চালানো রেখে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কান দিয়ে মনে হচ্ছে রক্ত বের হবে।কানে তুলু দিয়ে ও কোনো লাভ হচ্ছে না।মনে হচ্ছে কানে গুঁজে রাখা তুলো ভেদ করে মস্তিষ্কের ভিতর গিয়ে এই বেসুরা কন্ঠ স্বর গিয়ে বারি খাচ্ছে। একটা মানুষ এতো বাজে গান করে ড্রাইভার এই মেয়েটা কে না দেখলে বুঝতো না। ড্রাইভার মনে মনে ভাবছে আজকের পর থেকে আর কোনো দিন গানই শুনবে না।যেই গান ড্রাইভারের এতো প্রিয় অবসর সময় পেলেই গান শুনে সেটা আজ থেকে ব’য়:কট। কিছু বলতেও পারছে না মেয়েটা কে।স্যারের পরিচিত কেউ হবে কিছু বললে যদি আবার বিচার দেয় তাহলে সমস্যা। চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে শেষে।

এরকম বা*জে গানের কন্ঠ স্বর হতে পারে কারো ড্রাইভার এই মেয়েকে না দেখলে জানতেই পারতো না। গাড়ি চালানো রেখে এখন উল্টো দৌড় দিয়ে পালাতে মন চাচ্ছে লোকটার। মনে মনে একটাই জিনিস চাচ্ছে কখন রাস্তা ফুড়াবে আর এই মেয়ে কে নামিয়ে দিয়ে নিজের কান দুটো রক্ষা করবে।

ইসরাতের গানে যে একজন বেহুঁশ হওয়ার পথে সেদিকে তার কোনো হুঁশ নেই। সে তার মনের আনন্দে গান গাইছে। আজ ইসরাতের এক্সাম খুব ভালো হয়েছে। এইদিকে বান্ধবীর ও কিছু একটা গতি হয়ে যাবে আজ। স্যার নিশ্চই তাদের সম্পর্ক টা সহজ করার জন্য আজ নিয়ে গেছে নূর কে। আহা পরাণের বান্ধবীটা ও মিংগেল হয়ে গেলো আর ঐ ব*জ্জাত তালা টা ইসরাতের এতো এতো ভালোবাসার এক কানাকড়ি ও বুঝলো না। বুঝবে বুঝবে যেদিন অন্য কেউ এসে এনট্রি নিবে তখন বুঝবে।এসব কথা ভাবতে ভাবতে ইসরাত গান গায়,,,,

❝প্রেমে পরিয়া গেলাম ফাঁসিয়া,
করতে হবে এবার বিয়া।
সোনার ই চান পিতলা ঘুঘু,
যাবে কোথায় পালাইয়া!❞

ইসরাত গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। এরমধ্যে কিছু একটা দেখতে পেয়ে জোরে চিল্লিয়ে উঠে। ড্রাইভার কে তারাতাড়ি গাড়ি থামাতে বলে। ইসরাতের চিল্লানীতে ড্রাইভার তাল হারিয়ে জোরে ব্রেক করে।

ড্রাইভার কিছু বলার আগেই ইসরাত গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। ড্রাইভার কে কিছু বলতেও দেয় নি। এই নিয়ে ড্রাইভার ও মাথা ঘামায় নি নেমে গেছে ভালো হয়েছে। কান দুটো একটু রক্ষা পেয়েছে। নয়তো এই মেয়ের বাড়ি পর্যন্ত যেতে যেতে হয়তো আর কানেই শুনতে পেতো না।

ড্রাইভারের খুশিতে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে ইসরাত দৌড়ে এসে বলে দিয়ে যায় গাড়ি নিয়ে যেনো এখানেই থাকে।একটু পর ইসরাত আসতেছে। যেমন দৌড়ে ইসরাত এসেছে আবার তেমন ভাবে দৌড়েই চলে যায়। ড্রাইভার ইসরাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কানে হাত দিয়ে বসে থাকে।

ইসরাত গাড়ি থেকে তালহা কে দেখতে পায়। শুধু তালহা কে না সাথে একটা মেয়ে ও আছে। দুইজন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে।

একজন দাঁত কেলিয়ে হাসছে আর সেই হাসিতে মুগ্ধ হওয়ার কথা থাকলেও আরেকজনের কলিজায় গিয়ে বিঁধছে।

তালহা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মেয়েটার সাথে কি নিয়ে যেনো কথা বলছে।ইসরাত কাছাকাছি এসে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে কিন্তু ভালো মতো কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। কি সব যেনো বলছে,, আছে, আমি দিবো,চিন্তা আরো কি কি।

ইসরাত এদের হাসি মাখা কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কিছু না ভেবেই ইসরাত তালহা আর মেয়েটার সামনে গিয়ে হাজির হয়।

হুট করে কেউ সামনে আসায় তালহা আর মেয়েটা ভরকে যায়। তালহা তো ইসরাতের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।

ইসরাত কোমড়ে হাত দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকায়।

তালহা ঢুক গিলে মনে মনে ভাবে হয়ে গেলো।যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধা হয়। আর সময় পেলো না আসার।কি তা/ন্ডব চালাবে কে জানে।

তালহা কে অবাক করে দিয়ে ইসরাত নিচে বসে পরে। আহাজারি করতে করতে বলে আমার সংসার শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেলো গোওও। বিয়ের আগে সতীন বের হইছে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ইসরাত।

তালহা প্রথমে বোঝার চেষ্টা করে কি হচ্ছে কি এখানে। পরে মাথা কাজ করতেই তারাতাড়ি ইসরাত কে উঠতে বলে।

ইসরাত কি হচ্ছে কি এসব? পা’গল হয়ে গেছো তুমি? কি করছো এসব রাস্তার মধ্যে? লোককে হাসাচ্ছো। উঠো বলছি। উঠো।

আমার সব শেষ করে দিয়ে এখন উঠতে বলছেন? আমি উঠবোনা বলেই বিলাপ করতে থাকে।

তালহা এবার একটু রা’গেই বলে তুমি কি উঠবে?

আমি উঠবো না।ভাগ্যিস সৌন্দর্য স্যার আমাকে এই দিক দিয়ে পাঠিয়েছে নয়তো আমিতো কিছুই জানতে পারতাম না।

তালহা কথাতে,রাগে কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।ইসরাত একই ভাবে বসে আছে। কোনো উপায় না পেয়ে তালহা সৌন্দর্য কে ফোন দিয়ে বলে,,ভাই আমাকে বাঁচা নয়তো গ’ণধো’লাই খেতে হবে। সব খুলে বলে তালহা সৌন্দর্য কে।

সৌন্দর্য দশ মিনিটের মাঝে জোরে গাড়ি চালিয়ে উপস্থিত হয়। গাড়ি থেকে নেমে দেখে ইসরাত গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। একটা কথা ও বলছে না। সৌন্দর্যের সাথে সাথে নূর ও নেমে আসে।

সৌন্দর্য এসব দৃশ্য দেখে বিরবির করে বলে,, একটা ব;ল;দ। আরেক টা তারছিরা।

#চলবে,,,,?