পুনর্জন্ম পর্ব-১৩

0
233

#পুনর্জন্ম🤍
#পর্ব_১৩
#আফিয়া_আফরিন

‘দেখো পরের জন্মে ঠিক তোমার হয়েই জন্মাবো। এইবার আমাদের ভাগ্যে এক হওয়া লেখা নেই। নিয়তি তো আমরা বদলাতে পারবো না।
তবে আমার একটা কথা তোমাকে রাখতে হবে। ফেললে চলবে না, রাখতে হবে মানে রাখতেই হবে।
বুকে পাথর চাপা দিয়ে বলছি তুমি মৃন্ময়ীকে বিয়ে করে নাও। উহু, একদম অবাক হবে না বলে দিলাম।
অন্য কারো সাথে তোমাকে সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না। মৃন্ময়ী তো আমার নিজের বোন, আমার সবচেয়ে ভরসার মানুষ।
আমাকে যদি তোমার পাওয়ার বিন্দু পরিমান ও সম্ভাবনা থাকতো তাহলে এই কথা কখনোই বলতাম না। আমি চাই মৃন্ময়ীর সাথেই তুমি সুখে থাকো। আমাদের এক হওয়া ভাগ্যে নাই, বুঝতে পারছো তো!
আজও তোমায় স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলাম, আমাকে আমার মত থাকতে দাও। বিরক্ত করো না। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, তুমি কষ্ট পাচ্ছো। আমার থেকে শত শত অভিমান নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছো। আমি ধরতে চেয়েও, ধরতে পারছি না। নাহ, তোমাকে আমার আর বোধহয় পাওয়া হবে না।
অলিক স্বপ্ন আমি নিজে ও বুনতে চাই না এবং তোমাকেও অলিক স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেবো না। তাই আমাদের আলাদা হতে হবে।
আমি কখনো নিজেকে খুব কাছ থেকে দেখি নাই। কখনোই না কিন্তু আজ দেখলাম এবং বুঝতে পারলাম, তোমাকে পাওয়ার যোগ্যতা আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে সরে যেতে হবে।
মেঘ ঘনিয়ে আসছে আমার চারিদিকে। সেই মেঘের মধ্যে তুমি হারিয়ে যাচ্ছো, যোজন যোজন দূরে। আমি কিছুই করতে পারছি না।
তোমাকে ছাড়া থাকতে আমারও কষ্ট হবে, তবুও থাকবো। তুমিও জীবনটা ঠিক করে নিও।
ধরো, মৃন্ময়ী ই তোমার ময়ূরী। পারবে না ওকে আপন করে নিতে? ভেবেই নাও না, ওর মধ্যে দিয়েই তোমার ময়ূরীর আরেকবার পুনর্জন্ম হলো। খুব কি বেশি ক্ষতি হবে তাতে?’

ময়ূরীর চিঠিটা পড়ে কিছুক্ষণ এই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো অনুপম। এটা কি করলো সে? কি নির্ম’ম পা’ষা’ণ প্রতিটি শব্দ! বাইরে প্রচন্ড বাতাস হচ্ছে। ধুলো উড়ছে সমানে। বৃষ্টি হবে নাকি? হোক। বৃষ্টির পর আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে যেমন আকাশ পরিস্কার হয়; আজ সেই বৃষ্টিতে অনুপমের ভেতরকার মেঘ কেটে গিয়েও যেন সতেজ হয়।
কিন্তু নিজেকে তার প্রচন্ড অসহায় মনে হচ্ছে। বুকের মধ্যে উথাল পাতাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে ময়ূরীকে যদি আরেকটাবার পাওয়া যেতো!
চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এটা কি রকম আদেশ দিল ময়ূরী? এই আদেশ তো পালন করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। একমাত্র ময়ূরী ই ছিল তার পুরো জীবনের একমাত্র স্বস্তিময় পৃষ্ঠা! অনুপম সারা জীবন সেই স্মৃতি নিয়েই বাঁচতে চায়।
আজ ভীষণ অসহায় লাগছে তার। মানুষের মতো অসহায় প্রাণী বোধহয় পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই!
.
.
.
মৃন্ময়ী যখন অনুপম কে চিঠিটা দিতে যাবে, তখন ওই একটা চিঠির পরেও আরো কয়েকটা চিঠি পেয়েছিলো। যার উপরে একেকজনের নাম লেখা ছিলো।
একটায় অনুপমের নাম, একটা মৃন্ময়ীর নাম, আরেকটা চিঠি ছিল মা-বাবার জন্য।

মৃন্ময়ী নিজেও নিজের চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে। ময়ূরী যে এরকম কিছু লিখে যাবে সেটা তার ভাবনাতেও ছিল না।
চিঠিটায় ছিলো,
‘প্রিয় মৃন্ময়ী,
কিছু কথা আজ বলবো তোকে। সরাসরি বলতে পারব না, অর্থাৎ কখনোই আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি জানি কখনো না কখনো এই চিঠিটা দুই হাতে পাবি। আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করা তো তোর শখ! আমার মৃ’ত্যুর পর হয়তো সেই সব কৌতুহলে পরিণত হবে।
যাইহোক আসল কথায় আসি।
তুই তো আমায় ভালোবাসিস, তাই না?
খুব বড় আর বেশ কঠিন একটা দায়িত্ব দেবো তোকে। অনুপম, হ্যাঁ অনুপম ই হলো তোর দায়িত্ব।
তুই জানিসই তো অনুপম কে কতটা ভালবাসতাম আমি। আমি না থাকলে ও একদম অগোছালো হয়ে যাবে। তাল ঠিক থাকবে না, কি থেকে কি করবে ও হয়তো নিজেও বুঝতে পারবে না। ওকে ওই জীবন থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারবি না? পারবি না ওকে, একদম আপন করে নিতে?
একটা সুখের সংসার গড়ে তোল। যেখানে শুধুমাত্র তুই আর অনুপম থাকবি। আর আমার দোয়া, ভালোবাসা থাকবে আজীবন তোদের মাথার উপর।
নতুন বসন্তের প্রথম দিকে ওকে আমি নিজের করে নিয়েছিলাম। তোকেও তাই করতে হবে। এটা আমার অনুরোধ না, আদেশ!
মান অভিমান, ঝগড়া হবে কিন্তু ভালোবাসার কমতি থাকবে না; অনুপম মানুষটা এমনই। তোকে কখনো কষ্ট পেতেই দিবেনা। ও তোর কাছে থাকলে আমি ভালো থাকবো। ভরসা পাবো। অন্য কারো সাথে ওকে আমি সহ্য করতে পারবো না রে। আমার হিংসে হবে খুব। অন্তত আমাকে ভালো রাখার জন্য হলেও অনুপমকে তুই বিয়ে করে নে!

খুব স্বার্থপর ভাবছিস আমায় তাই না? এটা ভাবছিস যে, নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখার জন্য নিজের বোনকে বিলিয়ে দিচ্ছে?
যা ইচ্ছে হয় ভাব, কিন্তু তোর বোনের এই অনুরোধটা রাখিস রে বোন!
পরিশেষে আমি একটু শান্তি পেতে চাই! আর কিছুই না!
ইতি
ময়ূরী!

চিঠিটা পড়ে মৃন্ময়ীর কান্না করা উচিত কিনা সে বুঝতে পারছে না। তবে প্রতিটি নিঃশ্বাস বিষা’ক্ত হয়ে উঠছে। জীবনের এমন একটা পরিস্থিতিতে সে দাঁড়িয়ে আছে যে, কেউ তার পাশে দাঁড়ানোর মতো নেই।
শিশিরের কথাটা জানতো না দেখেই ময়ূরী হয়তো এসব লিখে গেছে। এখন মৃন্ময়ীর আফসোস হচ্ছে, সে যদি আগে ময়ূরীকে শিশির আর তার সম্পর্কের কথাটা জানাতো।
.
.
ময়ূরী তার বাবা মায়ের জন্য একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলো। ঠিক চিঠিও নয়, একটা চিরকুট।
তাতে লেখা ছিল,
‘তোমাদের আমার আর কিছুই বলার নাই। শুধু বলবো, যদি সম্ভব হয় আমায় ক্ষমা করে দিও। তোমাদের কাছে ভীষণ অপরাধী আমি, লজ্জিত আমি।
শেষবারের মতো তোমাদের নিকট একটা অনুরোধ জানালাম, মৃন্ময়ী আর অনুপমের বিয়েটা দিয়ে দাও।’

এক দিক থেকে ময়ূরীর বাবা-মা স্বস্তি পেলেন। মৃন্ময়ীর কাছে গিয়ে মতামত চাইলে, সেই সরাসরি না বলে দেয়। কারণ শিশির ব্যতীত জীবনে দ্বিতীয় কারো কথা ভাবো তার পক্ষে অসম্ভব।

বিনীতা ওর কথায় রেগে গেলেন। বললেন, ‘কেন? বিয়ে কেন করবি না? তোর বোন শেষ বারের মতো তার ইচ্ছের কথা জানিয়ে গেছে, সেটা তুই রাখবি না?’

মৃন্ময়ী নির্বিকার ভাবে বলল, ‘আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘তুই একবার হ্যাঁ বলে দে। তাহলেই তো সম্ভব হয়ে যাচ্ছে। অনুপম কি ছেলে হিসেবে খারাপ, বল? আর শিশির তো এখন নেই। থাকলে কি তোকে বলতাম?’

‘ছাড়ো তোমার এসব কথা। ভালো লাগছে না।’

‘এত সহজে ছাড়ছি না। শোন আমি এখন অনুপম দের বাড়ি যাবো। ওর মায়ের সাথে কথা বলে বিয়েটা পাকা করব। আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি। এভাবে শোকে পাথর হয়ে কতদিন থাকবি? জীবন কখনো কারো জন্যই থেমে থাকে না। মনে রাখিস, জীবন কোন নষ্ট ঘড়ির কাটা না। জীবন বহমান। অন্তত শিশিরের শোক থেকে বের করার জন্য হলেও অনুপমের সাথে তোকে আমি দিয়ে দেব।’

মৃন্ময়ী অবিশ্বাস্যের কণ্ঠে বললো, ‘মা!’

‘হইছে আর কোন কথা নয়। আমি আসছি।’

মৃন্ময়ী হাজার বলেও মাকে আর থামাতে পারল না।

সেই রাতেই কাকতালীয়ভাবে মৃন্ময়ী স্বপ্নে দেখল, ময়ূরী তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
‘তুই যদি অনুপমকে বিয়ে করতে রাজি না হোস, তাহলে আমি কখনোই শান্তি পাবো না। বেঁচে থাকতেও শান্তি দিলি না, মরে গিয়েও কি শান্তি পাবো না?’

স্বপ্ন দেখে মৃন্ময়ী উঠে বসে পড়লো। চিন্তাভাবনার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে তার। ক্রমেই যেন মাথায় ফাকা হয়ে আসছে।

অনুপমকে যখন বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সেও সরাসরি না বলেই দিয়েছে। তবুও মা বাবা একপ্রকার জোর করেই তাকে রাজি করিয়েছে। মা-বাবার অনুরোধ, তাদের জেদের কাছে পরাজিত হয়ে অনুপম হ্যাঁ বলল।
.
.
.
.
দুপুরে খা খা রোদ। জন মানবহীন আশপাশ। মৃন্ময়ী জানালায় হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। পানি মুছিয়ে দেওয়ার কেউ নাই। বড্ড একা আর নিঃসঙ্গ লাগছে নিজেকে।
শিশির যদি এই ভর দুপুরের রোদ হয়ে একটু ছুয়ে দিতো তাকে, তাহলে বোধহয় শান্তি হতো।

সে আনমনেই বলে উঠলো, ‘কি করবো আমি? এত অসহায় কেন লাগছে আমার? বারবার মনে হচ্ছে মাঝ সমুদ্রের আটকে পড়ে গেছি। বাঁচানোর মতো আশেপাশে কাউকে পাচ্ছি না আমি। তবে কি দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাব?
একদিকে আমার মা-বাবার অনুরোধ, একদিকে বড় বোনের আদেশ, আর অন্যদিকে আমার শেষ হয়ে যাওয়া ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। কোন দিকে যাব আমি? এত দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে কেউ কেন আমায় কোন পথ দেখাতে পারছে না?
নিজেকে পৃথিবীর এক উচ্ছি’ষ্ট অংশ বলে মনে হচ্ছে আমার। এমনটা কেন মনে হচ্ছে? এত অসহায়তা নিয়ে বাঁচবো কি করে?
.
.
.
.
চলবে……

[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]