পুনর্জন্ম পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
408

#পুনর্জন্ম🤍
#অন্তিম_পর্ব
#আফিয়া_আফরিন

কৃষ্ণচূড়া ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো উঠোন টা। দূর থেকে দেখে মনে হবে কেউ লালের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। কৃষ্ণচূড়া ফুলটা ময়ূরীর খুব পছন্দের ছিলো। মানুষের সাধারণত পছন্দ থাকে গোলাপ, কাঠগোলাপ এবং অন্যান্য ফুল। ময়ূরীর সবচেয়ে পছন্দের ফুলের তালিকার শীর্ষেই ছিল কৃষ্ণচূড়া।
মৃন্ময়ী উঠোনে এলোমেলো ভাবে পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে ভালই লাগছে।
নিজের দিকে তাকালো একবার। তার পড়নেও লাল বেনারসি।
এরই মধ্যে কেটে গেছে ছয় মাস। অনুপম আর মৃন্ময়ীর আজ বিয়ে।
বহু অনুরোধ, অনুনয় বিনয় করে তাদের রাজি করানো হয়েছে।
মৃন্ময়ী পরবর্তীতে মা-বাবার দিকে তাকিয়ে, বোনের আদেশ রক্ষার্থে বিয়েতে রাজি হয়েছে।
বিয়ে শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে অরুনিমা পাশে এসে বসলো।

মৃন্ময়ীর দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো, ‘ইশশ, তোকে আজ কত সুন্দর লাগছে রে!

অরুনিমার কথা শুনে মৃন্ময়ী কিছু বললো না। শুধুমাত্র ওষ্ঠোদ্বয় কোণে মৃদু হাসি ফোটালো।

অরুনিমা ফের বললো, ‘কি ব্যাপার এত সুন্দর করে তোর প্রশংসা করলাম, কিছু বললি না যে? মন খারাপ নাকি?’

‘না এমনিতেই ভালো লাগছে না।’

‘কি বলিস কি? ভালো লাগছে না আবার কি? তোর আজকে বিয়ে, তোরই তো দিন।’

‘এই দিন দিয়ে আমি কি করবো?’ নিচু স্বরে বললো মৃন্ময়ী।

‘বুঝতে পারছি। বিয়েটা তুই এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারিস নি। তাহলে গিয়ে বলি, তুই বিয়েটা করতে চাচ্ছিস না।’

মৃন্ময়ী অরুনিমা কে বাঁধা দিয়ে বললো, ‘আমি কখন বললাম আমি বিয়ে করবো না। এইতো বিয়ে করার জন্য লাল শাড়ি পড়ে বসে আছি, দেখতেছো না।’

‘এটা তো লোক দেখানোর জন্য।’

‘তেমন কোন ব্যাপার না।’

‘শোন একটা কথা বলি তোকে। তুই এখনো শিশিরের মধ্যে থেকে বের হতে পারিস নি।’

‘সেটা কখনোই সম্ভব নয়।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। নতুন একটা সম্পর্কের মধ্যে জড়াচ্ছিস, কারণটা যাই হোক না কেন; অনুপমের সাথে বিয়ে হওয়া মাত্র সে তোর স্বামী। এই কথাটা মাথায় রাখতে হবে।
তুই তো এত কিছু বুঝিস, আর এইটা বুঝতে পারছিস না? তোকে সব কিছু ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অতীত ভুলে যা; এই অতীত শুধুমাত্র যন্ত্রণাই দেবে তোকে।
অনুপম কেও বলেছি। তোকেও বললাম। নিজের দুঃখে এত বেশি স্বার্থপর হয়ে যাস না।
বুঝতে পারছি শিশির তোর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এই দুর্বলতা কে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। তখন আর কোন কিছুতেই আটকাবে না।
এই যে শিশির, এখন নেই। কিন্তু ওর ভালোবাসা তো তোর সাথে সারা জীবন থাকবে। এই ভালোবাসাকে পুঁজি করে তো সারা জীবন তোর পক্ষে থাকা সম্ভব না।
তুই ওকে ছাড়া থাকতে পারছিস, ওকে ছাড়া তোর পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। তবুও তো বেঁচে রয়েছিস।
এখন একটা কথা ভাব, শিশিরকে হারিয়ে যখন বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে; তখন তোর পক্ষে সব কিছুই সম্ভব।
একটু বুঝে দেখ, জীবন কতটা সুন্দর হয়!’

মৃন্ময়ীর মাথায় অরুনিমার বলা কথাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগলো। সত্যিই তো, এভাবে তো কখনো ভেবে দেখা হয়নি। যেখানে তার প্রাণ প্রিয় বোনকে হারিয়ে, ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে বেঁচে আছে; সেখানে পার্থিব কোন দুঃখই তো তাকে ছুঁতে পারার কথা না। সব কষ্টই তো সে নির্দ্বিধায় সহ্য করে গেছে। দুঃখগুলো থেকে এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে না। সবকিছুর মুখোমুখি হতে হবে।

অরুনিমার দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসলো। ‌
.
.
সেদিন সন্ধ্যা ঠিক সাতটার সময় মৃন্ময়ীর বিয়ে হয়ে গেলো অনুপমের সাথে।
সত্যি কথা বলতে ‘কবুল’ বলতে এইবার আর তার কষ্ট হয়নি। স্ব ইচ্ছেয় বলেছে।
.
.
.
একটা ফুল বিছানো ঘরে মৃন্ময়ী বসে আছে। মাথার ঘোমটা তুলে আশপাশ তাকিয়ে দেখলো।
এই ঘরটা একসময় তার বোনের হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পরিস্থিতি কিভাবে ঘুরে গেল! চাপা দিয়ে বিশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে।
তখন হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো। মৃন্ময়ী একটু ভয় পেয়ে গেল অন্ধকারে, যেহেতু সে একাই রয়েছে ঘরে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত শুধু অন্ধকার।
সারা গ্রাম অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। থাকুক ডুবে।
এমন সময় ঘরে কেউ একজন এলো। ডাক দিলো, ‘মৃন্ময়ী!’

মৃন্ময়ী পিছন ফিরে তাকালো। কন্ঠ শুনে বুঝতে পারলো এটা তার শাশুড়ি মা।
ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘জী।’

‘ভয় লাগছে মা অন্ধকারে?’

‘নাহ।’

‘দাঁড়াও আমি একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

‘তুমি কিছুক্ষণ বসো আচ্ছা। অনুপম কিছুক্ষণের মধ্যে আসবে।’

তিনি নিঃশব্দে চলে গেলেন।
মৃন্ময়ী মোমবাতির আলোয় বসে রইলো একা একা। এখনো ইলেকট্রিসিটি আসেনি।

হঠাৎ করেই মৃন্ময়ী কেমন চাঁপা ফুলের গন্ধ অনুভব করলো। হালকা এক ধরনের সুবাস, মুহূর্তেই গাঢ়ো হচ্ছে।
এই সুবাস টা শিশিরের গা থেকে পাওয়া যেতো। মৃন্ময়ী স্পষ্ট গন্ধটা অনুভব করতে পারছে। তার কেন জানি না মনে হচ্ছে, শিশির আশেপাশেই আছে এবং এই রুমেই আছে। কিন্তু এটা কি আদৌ সম্ভব?
খুব অস্থির লাগছে। একটা দমকা হাওয়া এসে মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে গেল। মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে কে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। কিন্তু কে কথা বলবে? সে ব্যতীত অন্য কেউ তো ঘরে নেই।
মৃন্ময়ী জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। স্পষ্ট মনে হল, কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলো।
এটা কি তার অবচেতন মনের কল্পনা? নাকি সত্যি অন্য ভুবনের কেউ? কিন্তু এসব কি সত্যি? পৃথিবীর সমস্ত অ’শরী’রীর জন্মই কি অবচেতন মনে নয়?
মৃন্ময়ী সামনের দিকে তাকালো। পর্দাটি খুব নড়ছে। যেন কেউ পর্দা নাড়িয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।
মৃন্ময়ী ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো। তার ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে, শিশির এসেছে।

মৃন্ময়ী কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পরলো। এই অন্ধকারের কেমন অলৌ’কিক সৌন্দর্য। সবটাই মায়া। অসুস্থ মনের জর্জরিত সুখ কল্পনা। এসবের কোন স্থান বাস্তবে নেই। প্রকৃতি নিশ্চয়ই চাপছে তার মন ফিরিয়ে নিতে। সেজন্যই এই স্বপ্ন দেখিয়ে তাকে ভোঁলাচ্ছে।
চাঁপা ফুলের গন্ধটা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। মৃন্ময়ী একবার কথা বলতে গিয়ে, চুপ করে গেলো।

মৃন্ময়ী এগিয়ে গিয়ে মোমবাতি জানালো। আলো আসুক। আলোর স্পর্শে সব মায়া কেটে যাক। সব রহস্য কেটে যাক, যে রহস্যের কোন স্থান পৃথিবীতে নেই।

এমন সময় অনুপম এলো। অনুপমের উপস্থিতি মৃন্ময়ী টের পেলেও কথা বললো না।
আচ্ছা অন্ধকারে দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে। অনুপম এইটুকু বুঝতে পারে, মৃন্ময়ীর শরীরটা অল্প অল্প কাঁপছে।

সে নিচু গলায় ডাকলো, ‘মৃন্ময়ী!’

‘হ্যাঁ বলো।’

‘কি হইছে? কোন সমস্যা কি?’

‘মনে হচ্ছে কেউ একটা এসেছিল এই ঘরে।’

‘কে?’

‘আমি জানিনা। শুধু মনে হচ্ছে অন্য ভুবনের কেউ। বাস্তবেই কি এরকম রয়েছে?

‘এ জগতের সমস্তই কি যুক্তিগ্রাহ্য? কোন না কোন রহস্য এই আকাশ, অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে থেকেই থাকে। হয়তো তোমার অনুভব করা সে অন্য ভুবনের কেউ, এমনই একজন রহস্য মানব।’

মৃন্ময়ী আর কথা বলার অবকাশ পেল না।
অনুপম বললো, ‘আমি তোমাকে ধরে রাখবো?’

‘রাখো।’

অনুপম তখন হাত দিয়ে মৃন্ময়ীকে শক্ত করে ধরে।

মৃন্ময়ী ফিসফিস করে বললো, ‘শোনো।’

‘বলো।’

‘তুমি সারা জীবন আমাকে এভাবে ধরে রাখবে?’

‘রাখবো।’

‘কথা দাও।’

‘কথা দিলাম!’

মৃন্ময়ী খেয়াল করলো, একটা ছায়া মানব সরে গেলো। সে নিজেকে বোঝালো, এসব মিথ্যা। এসব কখনোই হতে পারে না।
সে খুব সাবধানে তার হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের কোনাটি মুছে নিলো। তারপর অনুপমের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
.
.
.
.
সমাপ্ত।