পুষ্পের নিদ্র পর্ব-১৩

0
339

#পুষ্পের_নিদ্র
#আনআমতা_হাসান
পর্ব : ১৩

নিদ্র পুষ্পকে নিয়ে গিয়ে সোফাতে বসে। টেবিলের উপর ছোট একটা হাফ পাউডের সাদা কেক রাখা। কেকের উপর লেখা হেপি বার্থডে প্লাস এনিবার্সেরি পুষ্প। কেকের এক কোনে লাভ সেভের একটা মোমবাতি রাখা। পুষ্প ফু দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে কেক কাটে। একটা ছোট পিস কেটে নিদ্রকে খাইয়ে দেয়। নিদ্রও একটা ছোট পিস কেটে পুষ্পকে খাইয়ে দেয়। তারপর নিদ্র পুষ্পের হাতে একটা রেপিং পেপারে মোড়ানো স্কয়ার সেপের একটা গিফট দেয়। পুষ্প গিফটা হাতে নিয়ে নিদ্রকে জিজ্ঞেস করল
– এটাতে কি?

নিদ্র মুচকি হেসে উত্তর দিল
– নিজেই খুলে দেখ।

পুষ্প রেপিং পেপার খুলে দেখে তাতে পুষ্প আর নিদ্রের সাত বছর আগের বিয়ের ছবি। ছবিটা দেখেই পুষ্পর সেইদিনের কথা মনে পরে যায়।

সাত বছর আগে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

তখন পুষ্প ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। কলেজ শেষে কলেজের পাশের একটা রেস্টুরেন্টে পুষ্প তার চার বান্ধবী তমা, বৃষ্টি, মিতু, মেঘার সাথে তার আঠারোতম বার্থডে পার্টি করছিল। গিফট নিয়ে, কেক কেটে খাওয়া-খাওয়ি করে বিরিয়ানি খেতে খেতে পুষ্পের বান্ধবী তমা পুষ্পকে জিজ্ঞেস করল
– আচ্ছা তোকে তো আন্টি একা একা আমাদের বাসায়ও যেতে দেয় না। আজকে রেস্টুরেন্টে কিভাবে?

পুষ্প বিরিয়ানি খেতে খেতে বলল
– টানা একমাস মাকে বলতে বলতে রাজি হয়েছে মা।

মেঘা হাতে এক লোকমা বিরিয়ানি প্লেটের উপরে ধরে পুষ্পের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
– তুই এতো ভীতু কেন রে?

বলেই হাতের লোকমা মুখে পুরে দেয় সে। পুষ্প মুখের বিরিয়ানি গিলে মেঘার দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল
– এখানে ভয়ের কি হলো?

মেঘা বিরিয়ানি চিবতে চিবতে বলল
– আমি তোর জায়গায় হলে না ক্লাস ফাকি দিয়ে পার্টি করে নিতাম। কতো করেছি।

বৃষ্টি পানির গ্লাসটা হাত থেকে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল
– কলেজ ফাকি দিবে আর ও! সপ্ন দেখ তুই।

তমা, বৃষ্টি, মিতু, মেঘা হো হো করে হেসে ফেলে। পুষ্প আড় চোখে ওদের দেখে বলল
– তোদের মতো দরা খেয়ে মার খাওয়া থেকে আমি মনে করি এটা বেটার।

তমা ভাব নিয়ে বলল
– এই আমি কিন্তু কখনোই দরা খাইনি হুম্ম।

মেঘা চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলল
– একদিন দরা খেয়েছি পিঠে বেলোনের বাড়ি আর দুইবেলা খাওয়া বন্ধ ছিল। এটা তেমন কিছুই না।

বৃষ্টি গর্ব করে বলল
– কতবার দরা খেয়েছি। মার খেয়েছি। মার হাতের মারটা এখন আমার নেশায় পরিনত হয়ে গেছে। কিছুদিন পর পর না খেলে ভালো লাগেনা।

পুষ্প চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলল
– আমার তোর মতো এমন কোন নেশা হয়নি। আর হওয়ার ইচ্ছাও নেই। আমি যেমন আছি তেমনি ভালো আছি।

মেঘা মুখ বাকিয়ে বলল
– ভিতুর ডিম একট।

পুষ্প হেসে বলল
– আই লাভ আনডা বাজি

সবাই তারপর একসাথে হেসে দিল। ঠিক তখনি একটা ছেলে এসে পুষ্পকে উদ্দেশ্য করে বলল
– হ্যাপি বার্থডে পুষ্প।

বলেই পুষ্পের সামনে একটা ফুলের তোড়া ধরলো। পুষ্প ওর ডানপাশে বসা মেঘার দিকে তাকিয়ে তখন হাসছিল।হঠাৎ কেউ ওর নাম ধরে ডেকে ওকে বার্থডে উইশ করায় ও ঘাড় গুরিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই ফুলের তোড়াটা ওর চোখে পরে। আর তোড়াটাকে অনুসরণ করে ব্যাক্তিটার দিকে মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখে রাকিব নামের সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। যে তার পিছনে গত এক বছর দরে ঘুরছে। পুষ্প বিরক্ত ভাব নিয়ে বলল
– দেখুন ভাইয়া আমি আপনাকে বলেছি যে আমি আপনার থেকে কিছু নিতে পারবো না।

রাকিব বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে পুষ্পের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলাতে বুলাতে বলল
– দুদিন পর তো পুরো পুষ্পটাই আমার হয়ে যাবে এখন এই পুষ্প গুলো আমার হাত থেকে নিতে এতো সমস্যা কিসের বেবি।

রাকিবের এই বিশ্রী হাসি, চাহনি আর কথা শুনে রাগে পুষ্পের চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। পুষ্প প্রতিবাদী মেয়েদের মতো প্রতিবাদ করে মানুষকে কড়া দু-চারটা কথা শুনিয়ে দিতে পারে না। আর না পারে রাগে এসব অমানুষ গুলোর গালে দু-চারটে থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে। রাগে সে শুধু মাথা নিচু করে কান্না করতেই পারে। যার জন্য ওর এখন নিজেকে নিজের কাছেই পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

রাকিব এই এলাকার এক ধনী পরিবারের উচ্ছৃঙ্খল ছেলে। আর পুষ্পের বান্ধবীরা সবাই হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তাই সাহস করে পুষ্পের বান্ধবিরাও কিছু বলতে পাচ্ছে না। বলেও কোন লাভ নেই। রাকিব ভালো কথা শোনার ছেলে না। আর রাকিবের সাথে খারাপ আচরণ করার ফল যে তাদের সাথে সাথে তাদের পরিবারকে ভুগতে হবে। তাই রাগ হলেও কেউ কিছু বলতে পারলো না। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকলো।

এদিকে নিদ্র ,,,,,,,

আজকে পুষ্পের ১৮ বছর হয়েছে তাই নিদ্র ঠিক করে আজকেই পুষ্পকে তার মনের কথা বলবে। সেই প্ল্যান অনুসারেই পুষ্পের জন্য একটা সাদা গোলাপ আর খুব সুন্দর একটা বেসলেট নিয়ে নিদ্র পুষ্পের কলেজ ছুটির ৫ মিনিট আগে থেকেই ওর কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কলেজ ছুটির পর পুষ্প কলেজ গেইট দিয়ে বের হলেই নিদ্র পুষ্পের কাছে যেতে নিতেই দেখে পুষ্প তার বান্ধবিদের সাথে কলেজের পাশের রেস্টুরেন্টে দিকে যাচ্ছে। তাই নিদ্র পুষ্পকে ডাক না দিয়ে ওর পিছু পিছু রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওদের একটেবিল পড়ে বসে ওদের কথা শুনছিল আর ব্লাক কফি খাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে আড়চোখে পুষ্পের দিকে তাকাছিল। যার ফলে রাকিবের আসা থেকে সুরু করে প্রতিটি কথাই নিদ্র শুনে। রাকিবের শেষে বলা কথাগুলো শুনে আর ওর বিশ্রী হাসি সাথে চোখের চাহনি দেখে নিদ্রের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। রাগে চোখ দুটো লাল হয়ে যায়। নিদ্র গিয়ে রাকিবের গালে মারে এক ঘুষি।রাকিব ঘুষি খেয়ে পরে যায়। আর ওর গাল লাল হয়ে ফুলে যায়। রাকিব গালে হাত দিয়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল
– কার এতো বড় সাহস যে রাকিবের গায়ে হাত তুলে।

কথাটা বলে মাথা তুলতেই নিদ্রকে দেখে ভয় পেয়ে যায় রাকিব। কারণ নিদ্ররা রাকিবদের থেকে ধনী। তার উপর নিদ্র তার কলেজের বেস্ট স্টুডেন্ট এর সাথে সাথে অনেক পলিটিক্যাল লিডারদের সাথেও ওর খুব ভালো সম্পর্ক। শুধু কলেজে না এই এলাকার পর্যন্ত কোন বখাটে ছেলে নেই নিদ্রের ভয়ে। নিদ্র গিয়ে রাকিবের কলার চেপে দরে ওকে টেনে তুলে ওর নাক বরাবর ঘুষি মারে। যায় ফলে রাকিবের নাক কেটে গিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে। কিন্তু নিদ্র তাতে থামে না। আবারো রাকিবকে কলার দরে টেনে তুলে এলোপাতাড়িভাবে মারতে থাকে। রেস্টুরেন্টে ম্যানেজার আর আশেপাশের লোকেরা শুধু দাঁড়িয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কেউ নিদ্রের কাছে যাওয়ার সাহস পায় না। নিদ্রের ওই রাগী লাল চোখগুলোকে সবাই ভয় পায়। সেখানের নিদ্রদের কলেজের কিছু স্টুডেন্টও ছিল। তারা নিদ্রের ফ্রেন্ড চন্দনকে ফোন করে। চন্দন এসে নিদ্রকে শান্ত করে রেস্টুরেন্টে থেকে বাহিরে নিয়ে যায়। আর যাওয়ার আগে কলেজের ছেলেগুলোকে বলে যায় রাকিবকে হস্পিটালে নিয়ে যেতে।

নিদ্র যখন রাকিবকে প্রথম ঘুষি মারে তখন পুষ্পসহ ওর সব বান্ধবীরা দাঁড়িয়ে যায়। তখন থেকেই পুষ্প দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। পুষ্প ছোটবেলা থেকেই নিদ্রের রাগ আর জেদ সম্পর্কে শুনে এসেছে। যার কারনে ও ভয়ে নিদ্রের কাছে বেশি যেতনা৷ নিদ্রের সাথে কথাও তেমন বলতোনা। দেখা হলে নিদ্র কিছু জিজ্ঞেস করলে মাথা নিচু করে শুধু তার উত্তর দিত। কখনোই আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতোনা। তাই বলে যে নিদ্র এতো রাগী তা ও কল্পনাতেও ভাবেনি। যদিও রাকিব মার খাওয়ারই যোগ্য। কিন্তু নিদ্রের সেই লাল লাল চোখের চাহনির কথা ভাবলেই পুষ্পের সারা শরির কেপে উঠছে। পুষ্প সেখানে আর না দাঁড়িয়ে ওর বান্ধবীদেরও কিছু না বলেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যায়। পিছন থেকে ওর বান্ধবীরা ডাকলেও শুনে না। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে রিকশা খুজছিল। তখনি ওর সামনে একটা কালো গাড়ি এসে থামে। ওর দিকের গ্লাসটা খুলে কেউ একজন গাড়ির ভিতর থেকে রাগী কণ্ঠে বলে উঠল
– গাড়িতে উঠো।

পুষ্পের কাছে কন্ঠটা কেমন পরিচিত পরিচিত বলে মনে হয়। তাই ও মাথা নিচু করে ঝুকে দেখে গাড়ি ভিতরে কে আছে। ঝুকে তাকাতে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে নিদ্রকে দেখতে পায় সে। সামনের দিকে তাকিয়ে রাগে চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। যদিও এখন নিদ্রের চোখদুটো আগের মতো লাল হয়ে নেই। কিন্তু সেই চোখে এখনও রাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তা দেখেই ভয়ে পুষ্পের হাত-পা কাপতে শুরু করে। নিদ্র দমকের সুরে পুষ্পকে বলল
– কি হলো তোমাকে গাড়িতে উঠতে বলেছিনা।

পুষ্প এতোই লক্ষি একটা মেয়ে যে সবাই সবসময় ওকে আদর করে। দমক দেওয়া তো দূরের কথা কেউ ওর সাথে জোড়ে চিল্লিয়ে কথাও বলে না। এই প্রথম কেউ তাকে দমক দিয়েছে। পুষ্প ভয়ে কেপে উঠে। কাদো কাদো মুখ করে কাপা কাপা হাতে চুপচাপ গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে।

পুষ্প বসতেই নিদ্র গাড়ি স্টাট দেয়। পুষ্প ভেবেছিল নিদ্র তাকে বাড়িতে দিয়ে আসবে। কিছুদূর যাওয়ার পর পুষ্প দেখলো নিদ্র তাদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে না গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভয়ে পুষ্প আর নিদ্রকে জিজ্ঞেস করতে পারে না, যে তারা কোথায় যাচ্ছে। পুষ্প চুপচাপ বসে থাকে। ভয়ে যেন নিশ্বাসটাও মনেহয় সে ঠিকমতো ফেলছেনা।

🌺

চলবে………..