পুষ্পের নিদ্র পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
545

#পুষ্পের_নিদ্র
#আনআমতা_হাসান
পর্ব : অন্তিম

বারো-চৌদ্দ মিনিট পর নিদ্র রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে নিদ্র। পুষ্পকে কিছু না বলেই গাড়ি থেকে নেমে সামনের ফ্যাশন হাউজ চলে যায় সে। গাড়িতে বসে পুষ্প নিদ্রের যাওয়া দিয়ে তাকিয়ে থাকে। পাঁচ মিনিট পর একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে ফ্যাশন হাউজ থেকে বের হয়ে আসে নিদ্র। পুষ্পকে কিছু না বলেই ব্যাগটা পিছনের সিটে রেখে আবার গাড়ি স্টাট দেয় সে। প্রায় সাত-আট মিনিট পর নিদ্র গাড়ি নিয়ে একটা বিল্ডিং এর পার্কিং লটে চলে যায়। এইখানে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে বের হয়ে পুষ্পের পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে বলল
– নামো।

পুষ্প কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। নিদ্র গাড়ির দরজা লাগিয়ে পিছনের দরজা খুলে সেই শপিং ব্যাগটা নিয়ে গাড়ি লক করে দেয়। পুষ্পের দিকে না তাকিয়েই বলল
– চল।

কথাটা বলেই লিফটের দিয়ে হাটা শুরু করে সে। পুষ্পও চুপচাপ নিদ্রের পিছন পিছন হাটতে শুরু করে। লিফটে উঠে 5 বাটন প্রেস করে নিদ্র। লিফট গিয়ে 5 থামে। নিদ্র লিফট থেকে বের হয়। তা দেখে পুষ্পও লিফট থেকে বের হয়ে যায়। নিদ্রের পিছন পিছন হাটতে হাটতে পুষ্প ভাবতে থাকে রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত নিদ্র ওর দিকে তাকিয়নি। তাহলে ও যদি পিছন থেকে হাওয়া হয়ে যেত তাহলে কি নিদ্র বুঝতে পারতো? হয়তবা বুঝতো। পিছনের মানুষের পায়ের শব্দ না পেয়ে। নিদ্র 5B ফ্ল্যাটে ডুকে। পুষ্প ভেবে পায় না, নিদ্র ওকে এখানে নিয়ে এসেছে কেন? মেরে টেরে ফেলবে নাকি জোর করে সুইসাইড নোড লিখিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিবে। ও তো ভয়ে কিছু বলতেও পারবে না। চুপচাপ মরতে হবে।আল্লাহ মাএ ১৮ বছর হায়াত দিয়ে ওকে পৃথিবীতে পাঠালো। এখন বাবার ওর্ডার দেয়া ১৮তম বার্থডে কেকটা আর খাওয়া হবে না। মার রান্না করা খাবার গুলাও নষ্ট হবে। মা সবসময় বলত খাবার নষ্ট করলে পাপ হয়। সে মরে গেলে যে খাবার গুলো নষ্ট হবে তাতে কি তার পাপ হবে? এমন নানান কথা ভাবতে ভাবতে পুষ্পও নিদ্রের পিছু পিছু ফ্ল্যাটে ডুকে পরে। ফ্ল্যাটে ডুকে পুষ্প চারজন পুরুষ মানুষকে দেখতে পায়। এদের মধ্যে নিদ্রের বেস্ট ফ্রেন্ড, মেয়রের ছোট ছেলে তিতাস। আর একজন সেই রেস্টুরেন্টে নিদ্রকে থামানো ছেলেটা। একটা লোক কালো ড্রেস পরে আছে। টিবিতে দেখা উকিলরা সাধারণত যেমন পরে। ও আসলে বাস্তবে কখনো উকিল দেখেনি। আর একজন বয়স্ক হুজুর টাইপের লোক বড় বড় সাদা দাড়ি।

নিদ্র ডুকতেই সবাই দাঁড়িয়ে যায়। তিতাস আর চন্দন নিদ্রের কাছে আসে। তিতাস নিদ্রকে বলল
– রাকিবকে নিয়ে তোর আর চিন্তা করতে হবে না। আমি ভাইয়াকে বলেছি। ভাইয়া বলেছে রাকিব আর কখনো ভাবির আশেপাশে আসারও সাহস পাবে না।

নিদ্র খুশি হয়ে বলল
– ভাইয়াকে আমার হয়ে একটা থ্যাংকস দিয়ে দিস। আর সব কিছু রেডি তো।

চন্দন বলল
– হ্যাঁ সব রেডি। শুধু তোদের অপেক্ষাতেই বসে ছিলাম।

তারপর নিদ্র গিয়ে উকিল আর হুজুরের সাথে হেন্ডস্যাক করে সোফাতে বসে পুষ্পকে ওর পাশে দেখিয়ে বলল
– পুষ্প এখানে বস।

পুষ্প নিদ্রের কথা মতো একটু দূরত্ব বজায় রেখে ওর পাশে বসে পরে। তারপর নিদ্রে ওর হাতের সেই ব্যাগটা থেকে একটা লাল ওড়না বের করে পুষ্পের মাথায় দিয়ে দেয়। পুষ্প অবাক চোখে নিদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখানে আশার পর থেকে নিদ্রের সাথে ওর বন্ধুদের বলা কথাগুলোর কোন মানে আর কাজের মানে সে বুঝছেনা। তার মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা কার বাসা? নিদ্র কেন তাকে এখানে নিয়ে এসেছে? এনারা নিদ্রের কি হয়? কে এই ভাবি? নিদ্র কেন তাকে এই বিয়ের লাল ওড়না পরিয়ে দিল? কিন্তু সাহিস করে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। চুপচাপ নিদ্র যা বলছে তাই করে যাচ্ছে সে।

নিদ্র পুষ্পের মাথায় ওড়না পরিয়ে কাজির দিকে তাকিয়ে বল।
– বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।

পুষ্প এখন বুঝতে পারে নিদ্র ওকে বিয়ে দিতে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ও বুঝতে পারছেনা ও কি এমন করেছে যে ওকে কিছু না জানিয়ে ওর মতামত না নিয়ে যার তার সাথে এখনই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। পুষ্প নিজের চিন্তায় এতোটাই মত্ত যে কাজিসাহেবের কথা তার কান দিয়ে ডুকছেই না। ও সোফার সামনের স্বচ্ছ কাচের টেবিলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছে। ওর ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটলো নিদ্রের দমক শুনে। নিদ্র দমক দিয়ে বলে উঠলো
– কি কথা কানে যায় না। সেই কখন থেকে কাজিসাহেব কবুল বলতে বলছে বলছো না কেন।

দমক কানে যেতেই পুষ্প নিদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখে নিদ্রের চোখে-মুখে রাগ আর বিরক্তের ছাপ। পুষ্প অবাক চোখে নিদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে কেন নিদ্র ওকে এতো বড় শাস্তি দিচ্ছে? কেন বাবা-মা কাউকে কিছু না জানিয়ে নিদ্র ওকে এভাবে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে? পুষ্প মনে মনে ঠিক করে সে কবুল বলবে না। সে চুপ করে বসে রইলো। নিদ্র এবার পুষ্পের কানের কাছে এসে বলল
– এখন যদি কবুল না বল তাহলে যে অবস্থা রাকিবের করেছি তার থেকে করুন অবস্থা তোমার করবো।

নিদ্রের কথাটা কানে যেতেই ভয়ে পুষ্পের হাত-পা কাপাকাপি শুরু করে দিল। নিজেকে কোন রকমে সামলে নিয়ে পুষ্প আস্তে করে বলল
– কবুল

কাজিসাহের পুষ্পের মুখ থেকে কবুল শোনার পর পুষ্পকে উদেশ্য করে বলল
– মা আবার বল কবুল

পুষ্প আবার বলে
– কবুল।

কাজিসাহেব এবার আবার বলে
– মা আবার বল কবুল

পুষ্পের এবার রাগ উঠে যায় এই কাজীর উপর। ইচ্ছা করে হাতুড়ি দিয়ে মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে। কিন্তু বাঘের সামনে বসে বিড়াল তো আর লাফালাফি করতে পারে না। তাই রাগটাকে গিলে শান্ত কন্ঠে বলল
– কবুল।

উকিল সাহেব এবার কতোগুলো পেপার নিদ্রের দিকে দিয়ে সাইন করতে বলে। নিদ্র কাগজ গুলোতে সাইন করে। সাক্ষী হিসাবে চন্দন আর তিতাসও সাইন করে। তারপর নিদ্র পুষ্পের সামনে কাগজ গুলো দিয়ে যেখানে সাইন করতে হবে ওইখানটা দেখিয়ে বলল
– এখানে সাইন করো।

পুষ্প কাপাকাপা হাতে কলম দরে সাইন করে মাথা নিচু করে কান্না করতে থাকে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে কখনো সপ্নেও ভাবতে পারেনি যে তার বিয়ে এমন করে তার বাবা-মাকে ছাড়া হবে। তার বাবা-মা জানতে পারলে না জানি কতটা কষ্ট পাবে। তাদের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তাদেরও তো অনেক সপ্ন ছিল। কাজিসাহেব বলল
– এবার মালা পরিয়ে দিন।

টেবিল থেকে একটা মালা নিয়ে নিদ্র পুষ্পের কোলের উপর রাখা হাতে দিল। পুষ্প মালাটা হাত দিয়ে ধরলো ঠিকই কিন্তু ও কাকে মালাটা পড়াবে তাই বুঝতে পারছে না। ও তো জানেই না কার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে। ভয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারছেনা। নিদ্র পুষ্পকে স্থীর হয়ে বসে থাকতে দেখে বলল
– কি হলো মালাটা পরিয়ে দেও।

পুষ্প কার গলায় মালা পড়াবে তা ভেবে না পেয়ে মনে মনে ঠিক করে ও মালাটা শূন্যে দরবে যে এসে তার দিকে মাথা এগিয়ে দিবে তাকেই সে মালাটা পরিয়ে দিবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী যেইনা পুষ্প মালাটা উঠাবে তার আগেই নিদ্র মালাসহ পুষ্পের হাত উঠিয়ে মালাটা নিজের গলায় পরে নেয়। পুষ্প অবাক চোখে নিদ্রের দিকে তাকায়। ওর চোখে-মুখে এখনো পানি। নাক-মুখ লাল হয়ে আছে। এতোক্ষণে পুষ্প বুঝলো তার বিয়ে আর কারও সাথে না নিদ্রের সাথে হয়েছে। কিন্তু যে মানুষটি সাথে তার দরকারের বেশি কথা হয়নি কখনো, সেই মানুষটি কেন হঠাৎ তাকে বিয়ে করলো? উত্তর জানা নেই পুষ্পের। প্রশ্নটিও করার সাহস নেই তার। নিদ্র টেবিলের উপর রাখা অন্য মালাটা নিয়ে পুষ্পের গলায় পরিয়ে দেয়। সেই মুহুর্তে তোলা ছবিটাই ফ্রেম বন্দী করা। সাদা কলেজ ড্রেস মাথায় লাল ওড়না চোখেমুখে কান্নার পানি নিয়ে অবাক চোখে নিদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা পুষ্প। পাশেই নিদ্র এস কালারের শার্ট আর কালো জিন্সের প্যান্ট পরা। গলায় সাদা আর লাল গোলাপের মালা। ঠোঁটে হালকা হাসি নিয়ে পুষ্পের দিকে মালা ধরে আছে।

————————-

– গিফটটা পছন্দ হয়েছে?

নিদ্রের প্রশ্ন শুনে বর্তমানে ফিরে আসে পুষ্প। ছবি থেকে মুখ তুলে নিদ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
– এতো ছবি থাকতে আপনি এই ছবিটা বাধালেন কেন?

– কারণ এই পিকটা আমাদের বিয়ের কাহিনি বলে।

– কিভাবে?

– দেখ এখানে তুমি কলেজ ড্রেস পড়া। মাথায় লাল ওড়না। আর আমি শার্ট, জিন্স প্যান্ট পরা।

– হুম্ম, তো?

– এটা দাড়া বুঝা যাচ্ছে, আমাদের বিয়েটা হুট করে হয়েছে। তোমার চোখেমুখে কান্নার পানি দেখে বুঝা যাচ্ছে বিয়েটাতে তুমি রাজি ছিলেনা। আবার তোমার অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে বুঝা যাচ্ছে যে, তুমি জানতে না বিয়েটা আমার সাথে হচ্ছে। আর আমার ঠোঁটের হালকা হাসি দেখে বুঝা যাচ্ছে আমার ইচ্ছেতেই বিয়েটা হয়েছে।

ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভেবে পুষ্প বলল
– একটা মার্কার হবে? পার্মানেন্ট হলে ভালো হয়।

নিদ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
– মার্কার! মার্কার দিয়ে কি করবে?

– কিছু লিখবো? যা দেখলে সবাই বুঝবে আপনি আমাকে জোড় করে বিয়ে করলেও আমি আপনাকে ভালোবাসি। প্লিজ দিন না।

নিদ্র বুঝে তপুর মতো অন্য কেউ যাতে তাদের সম্পর্কে উল্টো পাল্টা ভেবে তাদের মধ্যে আসতে না চায় তারজন্য পুষ্প ছবিতে কিছু একটা করতে চায়। তাই আর কিছু জিজ্ঞেস না করে মুচকি হেসে উঠে রুম থেকে বের হয়ে যায় সে। স্টাডিরুম থেকে একটা মার্কার এনে পুষ্পকে দেয়। পুষ্প মার্কারটা নিয়ে ছবির এককোনায় গুটি গুটি অক্ষরে লিখে –

” পুষ্পের নিদ্র ”

🌺

★ সমাপ্ত ★

************************************************