#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব৩
#রাউফুন
চাচার ওমন বিষাক্ত কথায় ঝুমুরের চোখ ছলছল করে উঠলো। আজিজ সাহেব তা লক্ষ্য করে ধমক দিলেন ছোট ভাইকে। অন্য হাতে মেয়ের চোখ মুছে দিলেন সযত্নে। বললেন,
‘আমার ছোট মাইয়া, আমার আম্মা। আমার আম্মা কোনো দিনও ভুল কাজ করবো না, আর না আমার মান-সম্মান ডুবাইবো! মিলাইয়া নেইস আমার কথা!’
‘তাইলে ভাইজান ঐ কথায় রইলো। আপনে আইজ ওই রওনা দেন ভাবি, মাইয়া গুলারে নিয়া!’
ঝুমুর কিছুই না বুঝতে পেরে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে।
আসলাম মনের অন্তরালে ক্রুর হাসেন। তার বড় ভাই গ্রাম থেকে চলে গেলে তো তিনি এখানে রাজত্ব করতে পারবেন। তাছাড়া বড় ভাই শহরে গেলে তার একমাত্র ছেলে তীর্থকে ওখানে পাঠাবেন। শহরে থেকে পড়তে পারবে তার ছেলে৷ ভালো ভবিষ্যৎ হবে ছেলের এটাই তো চান তিনি। আর এখান থেকে একবার বড় ভাই চলে গেলে লোকের কাছে ঋতুর বিয়ের খবর টা ছড়াতে সুবিধা হবে না? এরপরই তো শুরু হবে আসল খেলা!
•
ঝুমুর হাঁক ছেড়ে ঋতুকে ডাকলো, ‘আপা ও আপা, আব্বাই আমগো তৈয়ার হইতো কইলো।’
‘ক্যান কই যাইবো?’
‘আমগোর নিয়া শহরের বাড়িতে যাইবোগা।’
‘কি কস এইগুলা? আব্বা সত্যই শহরে চইলা যাবো?’
‘হো!’
‘কেন যাইতে চাই শুনছস?’
‘না আপা৷’
ঋতু কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে রেডি হতে চলে গেলো। তার মুখ দেখে বোঝা গেলো না তার মনে কি চলছে।
ঝুমুর তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই বের হবে তারা। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা খেলা করছে তার, একজনকে একটা নজর দেখার উম্মাদনা। দু চোখ যেনো উম্মুখ হয়ে আছে মানুষটাকে দেখার জন্য। যাওয়ার আগে কি তার দেখা পাবে না তবে? কেন এই তৃষ্ণা সে জানে না! এই অনুভুতির নাম কি সে এটাও জানে না। তবে সে মানুষটার প্রতি আলাদা কিছু অনুভব করে। যেটা তার ভালো লাগে। অনুভুতির শুরু কবে থেকে সেটাও সে জানে না। শুধু এটা জানে এই অনুভুতিটা ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভীষণ সুন্দর!
‘কি রে কালি , কই যাস?’
চমকপ্রদ হয়ে তাকালো ঝুমুর। ভেতরটা ছলকে উঠলো খুশিতে। কারণ তাকে কালি বলে তো একজনই ডাকে। মানুষটা তাকে যতবারই কালি সম্বোধন করে প্রতিবারই যে রেগে আ’গু’ন হয়ে যায় সে। তবে আজকে রাগার পরিবর্তে তার ঠোঁটের কোল জোরে হাসি ফুটে উঠেছে।
‘তুমি কহন আইলা তীর্থ ভাই?’
‘চোখে কি ন্যাবা হয়েছে দেখিস না ব্যাগ হাতে। এখনো বাড়ির ভিতরে যায় নাই। এখন বল কই যাস?’
‘আব্বা শহরের বাড়িতে নিয়া যাইতাছে। আমার যাইতে মন চাইতাছে না। তয় কোনো উপায়ও নাই। আব্বাই কইলো, আমারে ওইহানের ভালা ইস্কুলেই পড়াইবো!’
তীর্থ ঝুমুরের দিকে ভালো ভাবে দৃষ্টিপাত করলো। চোখে এবড়োথেবড়ো করে কাজল দিয়েছে মেয়েটা। ঠোঁটে তেলতেলে লাল টকটকে রঙের লিপস্টিক মেখে যা-চ্ছে তা অবস্থা চেহেরার!
‘এসব দিতে পারোস না দেস কেন?’
‘কি?’ অবাক হয়ে স্বগোতক্তি করলো ঝুমুর।
তীর্থ ঝুমুরের মুখের দিকে হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধা আর তর্জনী আঙুল দিয়ে ওর নরম ঠোঁটের তেল তেলে লিপস্টিক মুছে দিলো। পকেট থেকে রুমাল বের করে কাজলও তুলে দিলো। এদিকে ঝুমুর প্রথম বারের মতো তীর্থর স্পর্শে থরথর করে কাঁপছে। সর্বাঙ্গে যেনো কোনো কিছুর দ্বারা দংশিত হলো। ঝুমুর তীর্থর হাত চেপে ধরে থামিয়ে দিলো। অতঃপর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘তীর্থ ভাই, আমারে কি এতোটাই বিচ্ছিরি লাগতাছিলো?’
তীর্থ নিজেও জানে না সে এমন একটা কাজ কেন করলো। তবে সে তার মনের কথা শুনেছে। তার মন বললো, এই কালো মেয়েটাকে সাজতে দেখার একমাত্র অধিকার শুধুই তার। পর মুহুর্তে ঝুমুরের কম্পিত কন্ঠে সম্বিত ফিরে পেলো। ডাগর ডাগর চোখে তাকাতেই ঝুমুর আবারও বললো,
‘আমায় ওরাম কইরা ছুঁইবা না তীর্থ ভাই। আ-আ-আমার কেমন যেনো লাগছিলো!’
তীর্থ এবার বুঝলো ঝুমুরের কাঁপা কন্ঠের মানে। সে ভুলেই গেছিলো সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়েটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। এই তো সেদিন ঝুমুর জন্মালো।হঠাৎই এতোটা লম্বা কি করে হলো মেয়েটা? নাকি আরও আগেই বড় হয়ে গেছে সে খেয়াল করতে দেরি করে ফেলেছে!
‘আমি ভুলে গেছিলাম তুই এখন বড় হয়ে গেছিস!’ আনমনে আওড়ালো তীর্থ।
‘এই তীর্থ কহন আইলি? যা তো ব্যাগ রাইখা একটা ভ্যান নিয়া আয়!’
পর মুহুর্তে জেঠার কথায় হুস ফিরলো তার। সে ব্যাগ রেখে ভ্যান ডাকতে গেলো। ভ্যান আনলে সবাই ভ্যানে চড়লো। ঝুমুর তখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিছুতেই তীর্থের আচমকা স্পর্শ ভুলে উঠতে পারছে না। আজিজ সাহেব তীর্থকে ডেকে বললেন,
‘শোন তীর্থ, আমি আসার আগ পর্যন্ত এই দিকটা তুই সামলাবি। তোর বাপরে তো ভরসা নাই। মাথা মোটা একটা, তোর মতো ওমন ডাকাবুকো ছেলেটারে তো তোর বাপে গুরুত্ব দিলো না। ফোন দিয়া কইয়া দিমু বাকিটা। ইলেকশনের আগে কোনো ঝুট-ঝামেলা চাই না। আমি এক সপ্তাহের মধ্যেই চইলা আসুম!’
তীর্থ মাথা নাড়লো। তার ভেতরে কিছু একটার অভাব বোধ হচ্ছে। কেমন জ্বালা করছে। সুফিয়া শেষ বারের মতো তাদের বাড়িটা দেখে নিলো। তীর্থর মা রুমি আড়াল থেকেই দেখছেন ওঁদের সবাইকে।সম্পর্কে দুই জা হলেও তাদের মধ্যের সম্পর্ক হলো দুই বোনের মতো। সুফিয়া চলে যাচ্ছেন এটা নিজ চোখে দেখার সাদ্ধি তো তার নেই। দরজার আড়াল থেকেই মুখে কাপড় চেপে কাঁদছেন। সুফিয়া এটা দেখে কাঁদতে কাঁদতেই কাছে ডাকলেন, ‘রুমি, এই রুমি একবারও সামনে আইলি না যে! তোর বড় আপারে বিদায় দে, আয়!’
রুমি ছুটে এসে গলা জাপটে ধরলেন সুফিয়ার। সুফিয়া তার চোখ মুছে দিয়ে বললেন, ‘এই পাগলি, কাঁনদোস ক্যা? আমরা কি আর আইমু না গেরামে?’
‘বড়বু, তুমি গেলা আমি কার লগে গপ্পো করমু? তুমি ছাড়া আমার সুখ দুঃখের সাথী আর ক্যাডা আছে? আমার যে অনেক গপ্পো জইমা থাকবো গো!’
‘ও চাচি তোমার বুঝি আমাগোর কথা মনে পরবো না?’ বললো ঋতু।
রুমি আবেগপ্রবন হয়ে ঝুমুর আর ঋতুকেও কাছে টেনে আদর করলেন।
‘তোরা তো আমার আরও দুইটা মাইয়া। তোগোর কথা আমার না মনে পইরা যাইবো কই? একটু পর পর এমনেই আইসা কেউ কইবো না, ওঁ চাচি কই তুমি? তিন বেলায় কেউ-ই আমার দ্বারে আইসা কইবো না, চাচি তোমার তরকারি দেও, আম্মার হাতের রান্ধন খাইতে খাইতে মুখে কড়া পরছে। আমারে জ্বালাতন করার মানুষ গুলা আর থাকবো না, আমি এই বাড়িতে একলা কেমনে থাকুমরে তোগো ছাড়া?’
তীর্থ মায়ের আর্তনাদ দেখে বুকে চিন চিন ব্যথা অনুভব করলো।
‘এই তীর্থ দূরে খাড়াই আছোস ক্যান? এদিকে আয়! আপার কাছে আইবি না?’
তীর্থ ঋতুর কাছে গেলো। তীর্থ মাথা নত করে শুধু দাঁড়িয়ে রইলো। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না তার।
‘আইজ থেইক্কা বাঁইচা গেলি, রোজ বিকেলে তোরে আর কেউ-ই পাঠাইবো না ট্যাকা তুলার জন্য! কইবো না কেউ, আমারে ফোনে কইডা ট্যাকা উঠাই দে তো! কেউ-ই কইবো না, ওই গাছের আম, ওই গাছের পেয়ারা, ডুমুর পাইরা আইনা দে!’
‘হো তীর্থ ভাই, আমার থেকেও বাঁইচা গেলা। এহন আর তোমার খাওনের ভাগ বসানোর কেউ থাকলো না।’
তীর্থ আড়ালে চোখ মুছে বললো, ‘এই কালি যা তো। তুই থাকলে আমার সব কিছুতেই অসুবিধা। এখন আমি কত শান্তিতে ঘুমাবো! রোজ রোজ তোর জ্বালাতনে তো সকাল বেলায় ঘুমাইতে পারি না। আমার মুখে পানি আর পরবো না। আহ কত শান্তি!’
হুহু করে কেঁদে দিলো ঝুমুর। ঋতুর চোখেও পানি। সুফিয়া তীর্থকে বুকে টেনে নিলেন। বুক পকেটে সবার আড়ালে টাকা গুজে দিয়ে বললেন,
‘সময় কইরা শহরে আহিস বাপ। তোরে না দেইখা কিন্তু তোর জেঠিমা থাকবার পারেনা। আমারে আল্লাহ একটা পোলা দেই না ঠিকই, কিন্তু তোরে দিসে। আমি গেলে তোর হাত খরচা ক্যাডাই দিবো? তোর লাইগা ট্যাকা জমাই রাখুম আমি, আইসা, আইসা নিয়া যাবি।’
তীর্থর বুকের ভেতরটাই মনে হলো কেউ পাথর চেপে ধরেছে। সে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো। ভ্যান ছেড়ে দিলো। সবাই তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ!
রুমি ছুটে চলে গেলেন ভেতরে। তীর্থ ভবঘুরের মতো হেলে দুলে বাড়ির ভেতরে যেতেই ভারী শুন্যতা অনুভব করলো। বাড়িতে কোনো সারা শব্দ নেই। ঋতু আপা, জেঠি মায়ের গলা, সবশেষে ঝুমুরের বাশির ন্যায় ঝাঝালো কন্ঠ, সর্বত্র যেনো বাজছে। কিন্তু হায় বাড়ির মালিক যে নেই বাড়িতে। যেই মানুষ গুলো কাল অব্দিও ছিলো তারা এখন নেই। কেমন খাঁ-খাঁ করছে জেঠিমা বিহীন। জেঠি মায়ের কাছে ঘন ঘন আবদার করা বুঝি আর হবে না।
#চলবে