#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব৪
#রাউফুন
ঋতু শহরে এসে খুশিই হয়েছে। এখন সে মুক্ত পাখির মতো উড়ু উড়ু মন নিয়ে ঘুরে। যখন তখন আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকে। সুযোগ পেলেই ফোন হাতে ছাদে চলে যায়। বেশ সুখী সুখী লাগে তাকে দেখতে। ঝুমুর রুমে আসার আগে দেখলো তার আপা মুচকি মুচকি হাসছে। সেও তার কোমল ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো!
‘আপা, তুমি এমন একলা একলা হাসো ক্যা?’
ঋতু ধরা পরে যাওয়াই চুপসে গেলো। মুখ বেজার করে বললো, ‘ কেন হাসাও বারণ? তোর জন্য কি হাসাও যাবে না?’
ঝুমুর চোখ পিটপিটিয়ে চাইলো তার আপার দিকে। ঝুমুর ঋতুর কপাল, গাল, গলায় হাত ছুঁয়ে দিয়ে অবাক হয়ে শুধালো, ‘আপা তোমার জ্বর টর হয় নাই তো?’
‘কি আবোল তাবোল বকছিস?’
‘এই যে তুমি কি কত সুন্দর কইরা শুদ্ধ করে কতা কইতাছো!’
বোনের উৎকন্ঠা বুঝলো এবারে ঋতু। বোনকে নিজের কাছে বসিয়ে গাল টেনে বললো,’তোর তুষার ভাই বলেছে শুদ্ধ ভাবে কথা বলতে। আমি তো শুদ্ধ ভাষা আগে থেকেই জানি শুধু বলিনি! চাইলে তুইও কিন্তু শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারিস!’
‘আপা কি যে সুন্দর লাগতাছে শুনতে তোমার কতা গুলা।’
‘তুইও বল তোর টাও সুন্দর লাগবে শুনতে।’
‘তুইও বল তোর টাও সুন্দর লাগবে শুনতে।’
‘ওরেহ পাঁজিটা আমাকে নকল করছিস!’
‘ওরেহ পাঁজিটা আমাকে নকল করছিস!’
‘তবেরে দাঁড়া!’
‘তবেরে দাঁড়া!’
ঝুমুর ফের তার আপাকে নকল করলো।
তাদের রুম থেকে হাসির রিনিঝিনি আওয়াজ শোনা গেলো। কখনো খিলখিল করে তো কখন চাপা স্বরে হাসছে। দুই বোনের খুনসুটি চলছেই।
•
আজিজ সাহেব হন্তদন্ত হয়ে গ্রাম থেকে বাড়ি ফিরলেন। তার মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে। সুফিয়া স্বামীকে দেখেই বুঝলেন গ্রামে গিয়ে কিছু একটা ঘটেছে। তারা আজ এক সপ্তাহ হলো এখানে এসেছে। সপ্তাহ গড়াতেই আজিজ সাহেব ছুটলেন গ্রামে। সুফিয়া শরবত করে এনে আজিজ সাহেবের সামনে ধরতেই এক ঝটকায় ফেলে দিলেন। কাচের গ্লাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। স্বামীর এমন ব্যবহারে হতভম্ব সুফিয়া। বিয়ের এতো বছরেও যে লোক তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেননি তার আজ কি হলো? হ্যাঁ চোখে ধমকেছে তাকে তার স্বামী তবে এভাবে কখনোই জিনিস ছুড়ে মা’রে নি। স্বামীকে ফুসতে দেখে ভয় পেলেন সুফিয়া। সারা শরীর শিউরে ওঠে তার। আওয়াজ পেয়ে ততক্ষণে ঋতু আর ঝুমুর রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ির কাছে চলে এসেছে। দু-তালা বিশিষ্ট এই বাড়ির উপর তলায় তারা দুই বোন থাকে আর নিচের তলায় তার বাবা মা থাকেন। বাবার ওমন অগ্নি মূর্তি দেখে দুই বোন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো উপরেই।
সুফিয়া আলগোছে স্বামীর নিকট এগিয়ে গেলেন। সন্তর্পণে শুধালেন,’ কি হইছে ঋতুর বাপ, আপনে এমন রাইগা আছেন ক্যান?’
চড়চড় করে রাগ উঠে গেলো আজিজ সাহেবের। তিরিক্ষি গলায় বললেন, ‘খবরদার সুফিয়া, ওই মাইয়ার নাম নিবা না আমার সামনে। ওই নামে কোনো মাইয়া আমার নাই। মইরা গেছে।’
সুফিয়ার বুক ধক করে কেঁপে উঠলো৷ আস্তে আস্তে বললো, ‘কি হইছে কইবেন তো?’
‘তোমার মাইয়ার নাগরে, পুরা এলাকা ছড়াই দিসে চেয়ারম্যান এর মাইয়ারে বিয়া করছে। সে চেয়ারম্যান এর জামাই। পুরা এলাকা থইথই তোমার মাইয়ার কেলেংকারীতে! আমার সম্মান কই থাকলো দেখছো? সবাই আমারে কত কটাক্ষ কইরা কথা শুনাইতেছে। যাকে দেখলে সবাই মাথা নত করে থাকতো আজ আমি সেই সবার সামনে দিয়ে নত মস্তকে শহরে ফিরছি। ঐ মাইয়ার লাইগা আমার আর কত কি সইতে হইবো কওতো? আল্লাহ আমার মরন দিলো না ক্যান এতো অসম্মানের আগে।’
ঋতু পুরো ব্যাপারটা বুঝতেই তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। বাবার এমন বিদ্ধস্ত অবস্থা সে তার বয়সে দেখেনি। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে। ঝুমুর নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার বাবার পাহাড়ের মতো উঁচু মাথা আজ নিচু হয়ে গেছে এটা সে মানতেই পারছে না। তার চোখে থেকে অনর্গল পানি পরছে বাবার এমন নির্মম অবস্থা দেখে৷ ঋতু ছুটে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো৷ কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে কল দিলো। প্রথম বারেই তথাকথিত পুরুষ কল রিসিভ করলো। আগপাছ না ভেবেই ঋতু প্রশ্ন ছুড়লো তুষারের দিকে।
‘আব্বা এগুলা কি কইতাছে তুষার?’
‘তোমার বাপ আবার কি বলে? তোমার বদ মেজাজি, চেয়ারম্যান বাপের খনে খনে কি হয় বলো তো? আমার শাশুড়ী মায়ের মতোন ওমন, অবলা, নরম মানুষ যে এরকম রাগী, গম্ভীর লোককে এতোদিন টলারেড করেছে কিভাবে আল্লাহ জানে। আমি ফর শিওর, শাশুড়ী মায়ের জীবনটা একেবারে ভাজা ভাজা হয়ে গেছে। শুধু তোমাদের মুখ চেয়ে উনি এই সংসারে থেকে গেছেন।’
‘আহ থামেন! আপনি এগুলা ক্যান করলেন?’
তুষারের এবার ভ্রু কুচকে আসে। ঋতুর ভারী কন্ঠে ভীমড়ি খেলো সে।
‘কি করেছি আমি? একটু খোলাসা করবা ঋতু?’
‘আপনে আমাগো গেরামে আপনের আর আমার বিয়ার খবর ছড়াই দিসেন! ক্যান করলেন এইডা? আমি তো কারোর অমতে যাইয়া বিয়া করতে চাই নাই। আপনে যদি আ’ত্ম’হ’ত্যা’র চেষ্টা না করতেন তাইলে আমি কস্মিনকালেও এরাম কইরা বিয়া করতাম না। কিন্তু এহন আপনে, আমার আব্বার সম্মান নিয়া এইরম খেলা করবেন? কি ভাবছেন, আমি তার মাইয়া হইয়া তার এমন অপমান সইহ্য করমু?’
‘কি বাজে বকছো তুমি? যা বলছো ভেবে বলছো? আমি কোনোভাবেই বিয়ের খবর লিক করিনি। হ্যা, বিয়ের প্রস্তাব তোমার বাসায় দেওয়ার পর তারা নাঁকোচ করেন৷ তখন আমার মাথা ঠিক ছিলো না৷ এই কারণে তোমাকে পাওয়ার জন্য আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়েছি। পরবর্তীতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে পদ্ধতিতে তোমায় বিয়েটা করেছি তা ভুল পদক্ষেপ ছিলো। কিন্তু আমি কোনো মতেই চাইনি তোমার অসম্মান হোক। লোকে তোমাকে চারটে কথা শোনাক, তোমার চরিত্রের দিকে কেউ-ই আঙুল তুলুক, তোমার বাবা- মায়ের মাথা হেট হয়ে যাক, এসব আমি চাইনি বিশ্বাস করো। যদি তাই চাইতাম, তাহলে আমি তোমায় নিয়ে অন্যত্র পারি জমাতাম না? যদি আমি তোমাদের সম্মান নষ্টই করতে চাইতাম, এভাবে লুকোচুরি করতাম তুমি বলো?’
‘থাক তুষার, আর সাফাই গাওন লাগবো না। আমার আব্বাই আর যায় হোক মিসা কতা কইবো না। আপনের কতা যদি সত্য হই তাইলে কি আমার আব্বাই মিসা কতা কইতাছে?’
‘আহাহ্ ঋতু রিল্যাক্স! আমার কথা শুনো, আই স্যোয়ার আমি বিয়ের কথাটা ফাস করিনি। আর আমি কি একবার ও বলেছি, তোমার চেয়ারম্যান বাপ মিথ্যা কথা বলছে? হতেও তো পারে তোমার চাচাই এগুলো করেছে আর আমার নাম দিয়েছে যাতে তোমার বাপ আমাকে ভুল বুঝে, খারাপ ভাবে। তোমার চাচাকে কিন্তু আমি প্রথম দিন দেখেই বুঝেছি, সে তোমার বাপকে হিংসে করে। সে ভালো মানুষ না।’
‘চুপ করেন তুষার। নিজের দোষ ঢাকতে আমার কাছে আমার চাচাকে বদনাম করছেন? আপনার লজ্জা করে না? নিজের দোষ অন্যের উপর বর্তাবেন না।’
‘তুমি আমায় অবিশ্বাস করছো তোমার বাপের কথায়?’
‘আমার বাপ কি ‘হ্যা? আমার বাপ আপনের কি হয়? শশুর হয়। শশুর মশাইকে মানুষ বাবা বলে জানেন না!’
‘তোমার বাপ আমাকে যতদিন না জামাই বলে মানবে ততদিন বাবা ডাকবো না। তোমার চেয়ারম্যান বাপ বলেই সম্বোধন করবো। আর,–!’
তুষার আরও কিছু বলবে তার আগেই ঋতু রেগে কল কে’টে দিলো। ঋতুর রাগে সর্বাঙ্গ কাঁপছে৷ তুষার এরপর অনেক বার কল করলো কিন্তু ঋতু একবার ও কল ধরলো না। গলা ফাটিয়ে কান্না আসছে তার। সে কি তবে ভুল মানুষের হাত ধরলো? ভুল মানুষকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে বাছলো?
রাতে ঋতুর রুমে আসলেন আজিজ সাহেব, গম্ভীর মুখে বলে গেলেন,
‘ওই নদের চাঁদরে কইবি কাইল সকালে আমগোর গেরামে ওর বাপ মা সমেত যাইতে। দরকার আছে।’
ঋতু ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়লো। পরেরদিন গ্রামে গিয়েই সেদিনের মধ্যে ঋতুর আর তুষারের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন আজিজ সাহেব। পরিস্থিতি অনুকুলে আনার জন্য তুষার আর ঋতুর আবার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো পুরো গ্রামের সবার সামনেই। এছাড়া তো গ্রামের মানুষ জনকে শান্ত করা যাচ্ছিলো না। গ্রামের সবাইকে বুঝানো হলো ভালো ভাবে, তারা যা শুনেছে তার একাংশ সত্যি! ঋতুর বিয়ের সম্বন্ধের জন্যই শহরে যাওয়া হয়েছিলো। এখন বিয়ে ঠিকঠাক হওয়াই ধুমধামে বিয়ের ব্যবস্থা করা হলো৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো এমন খবরে। আজিজ সাহেব চেয়ারম্যান হওয়ার পর গ্রামের প্রায় লোকের উপকার করেন, আবার তারা সে উপকার ভুলে গিয়ে আড়ালে নিন্দাও করেন। কিন্তু আবার তাকে বিশ্বাসও করেন। আপদ বিপদে যত যায় হোক সবার আগে তো আজিজ সাহেব ই এগিয়ে আসেন। আসলাম ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পরলো। তার এবারের চাল টাও বাঞ্চাল হলো। তার বড় ভাইকে তার জায়গা থেকে সরাতে সক্ষম হলো না। এবারে নতুন কিছু ভাবতে হবে।
ঋতুর আর তুষারের বিয়ের পর আবার তারা শহরে ফিরে এলো। সঙ্গে তীর্থকেও আনা হলো। এখানকার ভালো একটা কলেজে ভর্তি হবে তীর্থ।
#চলবে