পুষ্প কন্যার প্রেম পাবক পর্ব-০৮

0
152

#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব৮
#রাউফুন

ভীষণ জ্বরে পুঁ’ড়ে যাচ্ছে ঝুমুরের শরীর! সদ্য কা’চে কা’টা হাত কাটার একদিন ও পেড়োইনি। এর মধ্যেই সে প্রায় ঘন্টা খানেক ভিজেছে। হাতের ঘা’ দগদগে হয়েছে। ব্যান্ডেজের উপরেই দেখা যাচ্ছে রক্তের দাগ। তখন তীর্থ ঝুমুরকে পরতে দেখে কোনো রকমে ধরতে চাইছিলো ঝুমুরকে। কিন্তু সে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেছিলো। ততক্ষণে ঝুমুর গড়িয়ে পরেছে সিড়ি থেকে। প্রথম সিড়ি থেকে পুরো পুরি গড়ানোর আগেই তীর্থ তাকে ধরে ফেলে। সুফিয়া ভাতের গামলাটা হাত থেকে রেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। উৎকন্ঠা নিয়ে বললেন,

‘কি হইলো রে তীর্থ ঝুমের! এই ঝুম, ঝুম, উঠ।’

‘জেঠিমা, ঝুমুর অজ্ঞান হয়ে গেছে, পানি আনো। আমি ওঁরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।’ তীর্থ খুব কষ্টে ঝুমুরের ভারী দেহ খানা কোলে তুলে নিয়ে রুমে গেলো। রুমিও ছুটলেন ছেলের পেছন পেছন। আর আসলাম ও একটু ঘাবড়ে গেছে। তবে মনে মনে সে ওতোটাও চিন্তিত না৷

সুফিয়া পানি নিয়ে দরজার কাছে যেতেই আসলাম এক গা জ্বা’লা করা কথা বললেন, ‘কি গো ভাবি, তোমার ছোডা মাইয়া আবার পেট বা’জা’ইনি তো? এমনে হুট কইরা অজ্ঞান হইলো ক্যা?’

‘আসলাম, এই খানেই থাইমা যাও, আমার মাইয়ারে আমি চিনি। এই টুকুন মাইয়া, ওঁর সম্পর্কে এই ধরনের কু-রুচিকর কথা কইতে বাঁধলো না? আমার মাইয়া তো তোমারও মাইয়ার মতো!’

রুমি কটমট করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আইজ যদি আমার মাইয়া থাকতো ঝুমুরের জায়গায়, যদি সেও এইভাবে অসুস্থ হইতো তখনও কি আপনে এই ধরনের নোং’রা কথা কইতে পারতেন? ছিঃ তীর্থর বাপ। ঘেন্না লাগতাছে।’

আসলাম কিছুটা দমে গিয়ে চুপ করে রইলো।
তীর্থর কোনো দিকে ধ্যান নেই। তার মস্তিষ্কে শুধু ঝুমুরের অসুস্থতার কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্য কোনো দিকে কান দেওয়ার সময় নেই৷ সুফিয়া পানি এগিয়ে দিতেই তীর্থ তার মুখে পানি ছেটালো৷ ঝুমুর নড়েচড়ে উঠলো কিন্তু চোখ খুলতে পারলো না৷ সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে তীর্থকে বললেন, ‘বাপ, তোর জেঠোরে ফোন দিয়া কো, বাড়িতে আসার সুময় ডাক্তার নিয়া আসতে। আইজকাই অনেক কিছু প্ররমান হওনের দরকার আছে।’

শেষ কথা গুলো আসলামের দিকে তাকিয়ে বললেন সুফিয়া। তীর্থ তা শুনে বললো, ‘একটু পরে দিচ্ছি কল।’

তীর্থ শরীরে কোনো বল পাচ্ছে না। তার শরীর অস্বাভাবিক ভাবেই কাঁপছে। সে কম্পনরত হাতেই ঝুমুরের হাত পা ঘষে গরম করার চেষ্টা করলো। সুফিয়াও তাই করলেন। কপাল গরম থাকলেও হাত পা ঠান্ডা খুবই। ঝুমুরের হাতের রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে ড্রেসিং করিয়ে আবার ব্যান্ডেজ করে দিলো তীর্থ৷ ততক্ষণে সুফিয়া কান্নায় ভেঙে পরেছেন। তীর্থ জেঠিমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। রুমিও স্বান্তনা দিলেন।

তীর্থ উঠে গিয়ে ফোন দিয়ে সবটা জানালেন আজিজ সাহেবকে। তীর্থ ফোন করে বললে হুরমুড়িয়ে বাড়ি এলেন আজিজ সাহেব। ডাক্তার চেইক করে জানালেন কাচে হাত কা’টা গেছে, আর শরীর দুর্বল থাকাই জ্ঞান হারিয়েছে কিংবা অতিরিক্ত চিন্তার কারণেও হতে পারে এমনটা। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই ওষুধ লিখে প্রেসক্রিপশন করে দিয়েছেন। ঠিক করে ওষুধ খেলেই ঘা শুকিয়ে যাবে আর জ্বরও সেরে যাবে। ঋতুও মার্কেট থেকে ছুটে এসেছে ঝুমুরের অসুস্থতার কথা শুনে৷ এসে থেকেই কেঁদে কে’টে একশাঁ করে ফেলেছে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুমুরের জ্বর বাড়ছিলো।সুফিয়া চিন্তা করতে করতে ঝুমুরের পাশেই ঝিমাচ্ছেন। তীর্থর বাবা মা বেলা গড়ানোর আগেই বিদায় নিয়েছিলো। যদিও রুমি যেতে চাইছিলো না ঝুমুরের এমন অবস্থা দেখে৷ তবে বাড়ি ফাঁকা একদম৷ গরু, ছাগল গুলোর কথা চিন্তা করে চলে গেছেন। এদিকে তীর্থর দু চোখে ঘুম নেই। মন চাইছে ঝুমুরের পাশে বসে থাকতে। দু-চোখ ভরে দেখতে ঝুমুরকে৷ ঋতু জেগে আছে এখনো, পাশে তুষার বসে আছে চেয়ার পেতে। ঋতু জেগে আছে সে ঘুমোবে কিভাবে? ঝুমুর আঁধো চোখে তাকালো, বললো,

‘আপা তুমি এহন ঘুমাও। যাও ঘরে যাও। রাত ম্যালা হইছে।’

‘চুপ করবি তুই ঝুম! আমার যখন শরীর খারাপ হয়, তুই বুঝি খুব ঘুমাস? আর এখন আমাকে দূর দূর করছিস এখন? আমার অসুখ হলে, আমি বললে তুই যেতি?’

‘ওও আমার সেবা করে শোধবোধ করতে চাইছো?’

‘টেনে মা’র’বো একটা চ’ড়! খুব বড় হয়ে গেছো না?’

ঝুমুর এক হাতে আপার চোখের পানি মুছে দিলো৷ মুচকি হেসে বললো, ‘আমি কি ম’ই’রা গেছি নাকি আপা? এইভাবে ম’রা কান্দা জুড়ে দিসো ক্যা?’

‘ঝুম, এবারে কিন্তু সত্যিই ঠা’টি’য়ে এক চ’ড় বসাবো! অসুস্থ বলে ছা’ড় পাবি না। সব সময় আজে বাজে কথা না?’

ঋতু ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। তুষার তখনও ছিলো ঋতুর পাশে বসে।

রাত এগারোটা নাগাদ তুষারের বাড়ি থেকে কল আসায় সে বারান্দায় গেলো৷ কল রিসিভ করে কানে নিতেই শুনলো,

‘বড় ভাইয়া, আম্মার তো ম্যালা অসুখ, তারপর একটু আগে বৃষ্টির মধ্যে কলপাড়ে যাইয়া পইরা গেছিলো পিছলে। আমি আর আব্বা কোনো রকমে ধইরা ঘরে নিসি। আম্মার পা ফুইলা গেছে, কোমড়ে জখম হইছে। তুমি জলদি করে কাল সকালে চইলা আহো ডাক্তার এর কাছে যাওন লাগবো।’

ছোট বোনের মুখে মায়ের অসুস্থতার কথা শুনতেই কলিজা কেঁপে উঠলো তার। তার যখন পনেরো বছর তখন তার মায়ের কোল জুড়ে আসে তার আদরের ছোট্ট বোনটি। কি ফুটফুটে একটা মুখ ছিলো!

চাকরি সুত্রে তাকে ঢাকাতেই থাকতে হয়। শশুর বাড়িতে না হোক, অন্য একটা ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেই হতো। চাইলেও গ্রামে গিয়ে থাকতে পারতো না। কিন্তু তার বাবা মায়ের কথাও তো তাকে চিন্তা করতে হবে। দশ বারো বছরের ছোট বোনটা কি আর ওতো দিক সামলে উঠতে পারে? সে মনে মনে ঠিক করলো, এরপর ঋতুকে গ্রামেই রাখবে তার বাবা মাকে দেখাশোনার জন্য! সে নিজেকে ধাতস্থ করে বোনের উদ্দেশ্যে বলল,

‘আফিয়া, তুই মাকে দেখে রাখ আমি এক্ষুনি আসতেছি!’

‘ভাইয়া কইলাম ই তো, কাইল সকালে আইসো। আমি আম্মার পায়ে গরম হলুদের মিশ্রণ লাগিয়ে দিসি।’

‘তুই চিন্তা করিস না, আমি ঠিক যেতে পারবো!’

ফোন কে’টে ঘরে এসে ঋতুর উদেশ্যে বলল,

‘ঋতু আমারে এক্ষুনি গ্রামে যাইতে হবে। আম্মা কলপাড়ে পিছলে পরে পায়ে ব্যথা পেয়েছে।’

কথা শেষ করেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো তুষার। ঋতু পেছনে পেছনে দৌঁড়ে এলো। বললো, ‘কাল সকালে যাবেন, এখন এতো রাতে গাড়ি পাবেন না।’

‘তোমার মায়ের যদি ঐ রকম ভাবে আঘাত লাগতো তুমি কি করতে ঋতু? কাল সকালের জন্য অপেক্ষা করতে? আমার মায়ের জন্য আমার ই তো চিন্তা করতে হবে। তুমি তোমার বোনকে দেখে রেখো যাও।’

ঋতুর কলিজায় লাগলো কথাটা। সে কি তার শাশুড়ী মাকে নিজের মায়ের মতো ভালোবাসে না? এভাবে বলতে পারলো তুষার?

পরদিন ঋতু কল দিলো তুষারকে।

‘হ্যালো তুষার, মাকে কোন হাসপাতালে ভর্তি করাইছেন? ঠিকানা দেন আমি যাবো!’

‘আসতে হবে না। যদি ইচ্ছে থাকতো তবে কাল রাতেই আমার সঙ্গে আসতে।’

ঋতু শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো, ‘এভাবে কেন কথা বলছেন আপনি? আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তো আপনি চলে গেলেন। মা অসুস্থ হয়ে পরেছেন এখানে আমার দোষ কোথায়? আমাকে কেন কথা শুনাচ্ছেন?’

‘আমি তো বলি নাই তোমার দোষ আছে, যায় হোক, আমার মাথার ঠিক নেই। আমি ঠিকানা টেক্সট করে পাঠাচ্ছি চলে আসো। একা আসার দরকার নেই তীর্থকে সঙ্গে নিও।’

কল কে’টে দিলো তুষার। ঋতু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেলেও কিছু মনে করলো না। বোঝ দিলো নিজেকে, তুষারের মায়ের এখন অবস্থা ভালো না, এসবের মধ্যে মাথা ঠিক নেই। তাই এসব আবোল-তাবোল কথা বলছে। এতো কিছুর মধ্যেও যে তার জন্য তু্ষারের চিন্তাও মাথায় আছে এটাই অনেক। না হলে একা গেলে বিপদ হতে পারে ভেবে তীর্থকে সঙ্গে নিতে বলতো?


সাত দিনের মধ্যে ঝুমুর সেড়ে উঠেছে। বই সামনে খুব মনোযোগ দিয়েই পড়ছিলো সে। দরজায় দাঁড়িয়ে তুষার গলা খাকারি দিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিলো। ঝুমুর শুনেও বইয়ে মনোনিবেশ করে রইলো। সেদিনের পর থেকে ঝুমুর তীর্থর সঙ্গে কথা বলেনি। ইভেন সামনে পর্যন্ত যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে তীর্থই এসেছে ঝুমুরের সঙ্গে কথা বলতে। তীর্থ আলতো পায়ে রুমে ঢুকলো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখনই ঝুমুরের কন্ঠ শুনলো,

‘আসবেন, বসবেন বাঁধা নেই,
পড়ার সময় কথা নেই।
যদি কথা বলতে চান,
দয়া করে বাইরে যান!’

তীর্থ বুঝলো ঝুমুর তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না।তাই সে প্রস্থান করলো। ভীষণ অপমান বোধে নিজের রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা আটকে দিলো।

‘কি ভেবেছিস তুই কালি? আমি,এই তীর্থ তোর প্রতি সদয় হয়ে কথা বলতে গেছি? উঁহু!কেউ আমার সম্বন্ধে ভুল ধারণা নিয়ে বসে থাকলে সেটা আমার ভালো লাগে না।উসখুস লাগে।আজকের পর আমিও আর তোর সঙ্গে কথা বলব না কালি। আমিও দেখতে চাই কার জেদ বেশি।’

#চলবে