পূর্ণতা পর্ব-২১

0
445

#পূর্ণতা ❤️
#Writer_তানজিলা_তাবাচ্ছুম❤️

২১.

‘ মা তুমি একাই এত কষ্ট করছ কেনো? দাও আমাকে দাও। আমি বানাচ্ছি।’

আলোক তার মাকে বলল।

‘ তোমাকে ভাঁজতে হবে না।’

আলোকের মা সকালে সবার জন্য নাস্তা হিসেবে রুটি বানাচ্ছিল। আলোক তার থেকে নিয়ে বানানো শুরু করলো। আলোকের হালকা হাসলো। এখন প্রায় সকাল সাড়ে সাতটার মতন বাজে। সবাই ঘুমোচ্ছে।

‘ চাঁদ উঠে নি আলোক? ‘

‘ উঠেছিল কিন্তু আবার ঘুমিয়েছে তাই আর ডাকি নি মা। ‘

তারপর আশা আলোক অনেক কথা বলতে শুরু করলো। আজ কত দিন পর তাঁরা এভাবে কথা বলছে। বেশ কিছুক্ষণ পর সেখানে চাঁদের আগমন ঘটলো। চাঁদ হাসি হাসি মুখ করে এলো। এসে রুটি ভাঁজতে চাইলে আলোক তাকে কড়া কন্ঠে বলল,

‘ তোমাকে এখন তাপের কাছে যেতে হবে না। আগে সুস্থ হও ঠিকমত তারপর করো। ‘

চাঁদ আর কিছু বলল না। আশা , চাঁদ বের হলো। আলোক তাদের এখান থেকে যেতে বলেছে। আশা আসতে আসতে ধীর গলায় বললো,

‘ জানো চাঁদ! আলোক আমার নিজের ছেলে নয়। ‘

চাঁদ বিস্ময় নিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকালো। আশা সামনে তাকিয়ে আছে । মুখে মৃদু হাসি। তারপর চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ কি ? অনেক অবাক হলে? ‘

চাঁদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আশা সামনে চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো, ‘ বসো ‘। তারা দুজন বসলো।

‘ হ্যাঁ এটা সত্যি আলোক আমার সৎ ছেলে। তবুও দেখো আমাদের সম্পর্ক টা কেমন! কতটা ঘনিষ্ট, কতটা গভীরতা। আমার কখনো একবারের জন্যেও মনে হয়নি ও আমার নিজের ছেলে নয়। নিজের সন্তানের থেকেও অনেক বেশি কিছু ও। ‘

চাঁদ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে মনোযোগ সহকারে শুনছে। আশা আনমনেই আবার বলে উঠলো,

‘ আলোকের মা আলোকের জন্মের প্রায় ৪-৫ মাস পর মারা যান। তখন আলোকের দাদী মানে আমার শাশুড়ি মা উনি রায়হান কে আমার সাথে বিয়ে দেন। প্রথম প্রথম আমার কেমন অস্বস্তি লাগতো। যে একজনের স্ত্রী হওয়ার আগেই আমি একজন মা হয়ে গেলাম। কিন্তু যখন আলোক কে দেখতাম তখন কেমন মায়া ধরে যেত। আসলে ছোট বাচ্চারাই এমন মায়াময় হয়। ‘

একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বললেন,

‘ প্রায় বিয়ের কয়েক মাস পর রায়হান আর আমার মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। আর এরই মধ্যে আমার শাশুড়ি মা মারা যান। ‘

বলে হাসলো আশা।

‘ আমার ভাগ্য টা কিরকম দেখো! বিয়ের কয়েক বছর চলে যায় কিন্তু আমার নিজের কোনো সন্তান নেই। তারপর ডক্টর দেখিয়ে জানতে পারি আমি কখনোই মা হতে পারবো না। সে সক্ষমতা আমার মধ্যে নেই। কিন্তু জানো? এতে কেনো জানি আমার বিন্দু পরিমাণ খারাপ লাগে নি। ডক্টর বলেছেন আমি মা হতে পারবো না কিন্তু! আমি তো আগে থেকেই একজনের মা হয়ে আছি। নিজের গর্ভে নাহয় নাই ধরি তাতে কি? আমারই ছেলে ও। ‘

চাঁদ ছলছলে চোখ নিয়ে আসলো। আশা কথা গুলো বলতে বলতে তার নয়নে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। কিন্তু তাতে বিন্দু মাত্র কষ্টের ছাপ নেই। আশা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ দেখো ও তোমাকে সবসময় নিজের দ্বারা যতটুকু সম্ভব খুশি রাখার চেষ্টা করবে। ‘

চাঁদ মাথা নিচু করে একটু হাসলো। আশা চাঁদের হাত ধরে ছলছলে চোখে তাকিয়ে করুণ কন্ঠে বলল,

‘ তুমি ওকে কখনো কষ্ট দিও না। ওর মন মেয়ে মানুষের থেকে অনেক নরম। বাহিরে প্রকাশ না করলেও আমি জানি, ভিতরে ও কতটা কষ্ট পায়। আ__

সিঁড়ি বেয়ে রেলিং ধরে নামছে তাসলিমা। আশা তাকে দেখেই চুপসে গেলো। তাসলিমা এসে বসলো। আশা হাসি মুখে বললো,

‘ ঘুম হলো? ‘

তসলিমা ঘুমোঘুমো কন্ঠে বলল, ‘ হ ভাবি।’

‘ রিদওয়ান , নাহিদ উঠে নি? সবাই একসাথে নাস্তা করতাম। ‘

‘ না ভাবি উঠে নাই। সারাদিন কি যে করে আল্লাহ জানে।’

চাঁদ উঠে কিচেনে গেলো। আলোক বানানো শেষ করলো। চাঁদ যেতেই তার মুখে একটু আটা মেখে দিল। খুনসুটি ভালোবাসা চলছিল তাদের মধ্যে। হটাৎ বাহির থেকে এক পুরুষের কণ্ঠে তাদের ধ্যান ভেঙ্গে গেল। চাঁদ শাড়ির আঁচল টা মাথায় টেনে দিলো ঘোমটার মতন। যাতে তার মুখ না দেখা যায়। শুধু মাত্র হাতের তালু ও পিছন ছাড়া চাঁদের পুরো শরীর ঢাকা। চাঁদ খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে টেবিলে এসে রাখলো। তাসলিমা মুখে বিষন্নতার ছাপ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আর বিড়বিড় করে বলছে, ‘ এ আবার কেমন বউ। স্বামী কে দ্বারা কাজ করার! ‘ তারপর নিজের চোখ ঘুরিয়ে নেয়। চাঁদ রাখার পর পিছনে ঘুরে যেতে ধরবে তখনই তার সামনে একজন এসে বলে,

‘ আরে ভাবি জি। ‘

চাঁদ মাথা নিচু করে আছে। নাহিদের মুড অফ হয়ে গেলো। তার প্রচন্ড রাগ লাগছে। এই মেয়েকে দেখার জন্য সে কতো ব্যাকুল হয়ে আছে আর এই মেয়ে কিনা সামনে ঘোমটা দিয়ে আছে। চাঁদ তার পাশ কেটে চলে যাবে নাহিদ তার সামনে এসে বললো,

‘ আরে ভাবি জি দাঁড়ান। আপনার একমাত্র দেবরের সাথে পরিচিত হবেন না? ‘

তারপর হাত বাড়ায় হ্যান্ড সেক করার জন্য আর বলে উঠে,

‘ আমি নাহিদ! আপনার হাসব্যান্ড এর একমাত্র চাচাতো ভাই আর আপনার একমাত্র দেবর। ‘

চাঁদ কি করবে বুঝতে পারে না।তাই কোনোরকম তাড়াতাড়ি করে পাশ কেটে চলে আসে। চাঁদ যেতেই নাহিদ কেমন বাকা হাসে। তারপর নিজে নিজে বলে, ‘ Unbelievable ‘ ।বলে আবারো হাসে। চাঁদ তাড়াতাড়ি করে এসেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। আলোক দেখে বলে,

‘ কি হয়েছে তোমার তুমি ঠিক আছো? ‘

চাঁদ আঁচল টা কিছুটা উঠিয়ে মাথা নাড়ায়। আলোক দেখলো চাঁদের মুখে ঘামে ভিজে আছে।

‘ তুমি খেয়ে ঘরে যাও। এভাবে থাকার দরকার নেই। আর হ্যা আজকে আমরা কিছুক্ষন পর হসপিটালে যাবো। রেডি থেকো।’

চাঁদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

_______________

টেবিলে সবাই খাচ্ছে । রিদওয়ান রায়হান খেয়ে চলে গেছে বাহিরে। বসে আছে তাসলিমা , আশা, নাহিদ, আলোক।তাসলিমা উৎকণ্ঠা বলে উঠলো,

‘ কি আলোক? তোর বউ কে কি আমাদের সামনে আনবি না নাকি? সারাদিন ঘরের ভিতর ই থাকে। বের হলে এত বড় একটা ঘোমটা টেনে দেয়!’

আলোক খেতে খেতে থেমে গেলো। শান্ত গলায় বললো,

‘ কেনো চাচী আপনি কি ওকে দেখেন নি?’

‘ দেখব না কেনো? দেখেছি। কিন্তু এইভাবে চললে কি হয় নাকি? ‘

আলোক আবার খাওয়া শুরু করলো। তারপর খেতে খেতে বললো,

‘ তাহলে সমস্যা কি চাচী! ওর এই ভাবে থাকার? ‘

তাসলিমা ব্যাঙ্গ করে বললো,

‘ আরে আমরা তো ঘরেই মানুষ ! ‘

আলোক এবার জোড় গলায় বললো,

‘ আহ চাচী এতে আপনার সমস্যা কি? আমি ওর স্বামী আমার তো কোনো সমস্যা নেই। ‘

তাসলিমা আর কিছু বলল না। রাগে ভিতর ভিতর ফুঁসছে সে।

‘ হেই ব্রো। ভাবির সাথে তো আমার পরিচয় ই হলো না ইভেন তাকে দেখলাম ও না।’

আলোক তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘ কেনো তুই দেখে কি করবি? ‘

নাহিদ আলোকের কোথায় একটু নড়েচড়ে উঠলো তারপর বললো,

‘ আরে ব্রো আমার একমাত্র ভাবি। তাকে আমি দেখবো না! স্ট্রেজ্ঞ না? ‘

আলোকের খাওয়া শেষ হলো। সে উঠতে উঠতে বললো,

‘ না তোর দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। ‘

আলোকের কথায় নাহিদ কিছু অপমান বোধ করলো। আলোক যাবে এমন সময় তাসলিমা বলল,

‘ আরে ও তো ভাইয়ের মত। ‘

আলোক থেমে পিছনে ঘুরে হেসে বললো,

‘ “দেবর মৃত্যুর সমতুল্য “[সহীহ বুখারী :৫২৩২, মুসলিম ৩৯/৮ ,হাঃ২১৭২ ,আহমাদ ১৭৩৫২](আধুনিক প্রকাশনী – ৪৮৪৯, ইসলামিক ফাউ্ডেশনের – ৪৮৫২)

______________________

হসপিটাল এ বসে আছে আলোক, চাঁদ। তাদের কয়েকটা টেস্ট করতে দেয়েছে ডক্টর। সেগুলো করলো। রিপোর্ট একদিন পর দিবে। তাই তাঁরা আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো হসপিটাল থেকে। আলোক ভাবলো আজ যখন বের হয়েছে তখন চাঁদ কে নিয়ে একটু ঘুরবে। এতে চাঁদ কে ভালো লাগবে। চাঁদ কে নিয়ে একটা পার্কে গেলো। পার্কের পাশে কিছুটা দুরত্বে একটা বড় রাসায়নিক ফ্যাক্টরি। চাঁদ আলোক পাশাপাশি বসে আছে। চাঁদের হাত আলোকের হাতে আবদ্ধ। আলোক চাঁদ কে বললো,

‘ সাইনিং মুন কিছু খাবে? অনেকক্ষণ হয়েছে খেয়েছি। আমারও ক্ষুদা লেগেছে। তুমি নিকাবের ভিতর থেকে খেও?’

চাঁদ সম্মতি দিল। কারণ সে না করলে আলোক ও খাবে না তা চাঁদ ভালো করে জানে। তাই সম্মতি দিল। আলোক দাড়িয়ে বললো,

‘ দাড়াও আমি একটু দেখে আসি ভালো রেস্টুরেন্ট কোথায়। কয়েক বছর যাবত এদিকে আসা হয়নি তাই জানাও নেই। ‘

‘ তুমি বসে থাকো আমি দেখে আসছি।’

আলোক গেলো। চাঁদ বসে আছে। আশেপাশে আরো মানুষ রয়েছে। চাঁদ চারিপাশ টা দেখছে আর আলোকের কথা ভাবছে । আলোকের মত ছেলে খুব কমই আছে। চাঁদের নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করে কারণ সে আলোকের মত একজন কে পেয়েছে। চাঁদ কখনোই ভাবে নি তার জীবনেও এইরকম দিন আসবে। এতটা সুখের জীবন। হঠাৎ চাঁদ নাকে গন্ধ ভেসে আসছে। কেমন পোড়া পোড়া। চাঁদ সামনে তাকিয়ে আলোককে খুঁজছে। চাঁদ দাঁড়ালো। আশেপাশে কেমন কোলাহল। আসতে আসতে দেখলো মানুষ দৌড়াদৌড়ি করছে। চাঁদ আশেপাশে কয়েক পা বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা সামনে যেতেই দেখলো রাসায়নিক ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে। মানুষ দৌড়াদৌড়ি করছে। আশেপাশে শত শত মানুষের ভিড়। চাঁদ ঘামতে শুরু করলো।তার চোখ বয়ে পানি পড়তে শুরু করে। সে কাঁদতে শুরু করে। হঠাৎ পাশ থেকে তার একজন হাত টানে। তারপর জরিয়ে ধরে। চাঁদ কাঁদতে এতটাই ব্যস্ত যে কে টেনে জরিয়ে ধরলো তা দেখার পরিস্থিতি তে নেই। কিছুক্ষণ পর ছাড়লো তার পর গালে হাত রেখে বলল,

‘ চাঁদ?তুম_তুমি ঠিক আছো? ওখানে থেকে এখানে এসেছো কেনো? জানো আমি তোমাকে খুঁজছি।’

চাঁদ কোনো রেসপন্স করলো না। আলোক চাঁদকে দেখতেই বুঝতে পারল চাঁদ কাঁদছে। আলোক ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলো,

‘ কি হয়েছে তুমি কাঁদছো কেন? ‘

তারপর আশেপাশে ভালো করতেই বুঝতে পারল চাঁদের কেন কাঁদছে! আলোক চাঁদ কে আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘ আরে তুমি কাঁদছো কেন ? ওখানে কোনো মানুষ নেই। আজকে ওই ফ্যাক্টরি বন্ধ ছিল আর ভাগ্যক্রমে আজকেই আগুন লেগেছে।’

কিন্তু তবুও চাঁদ কাঁদছে। আলোক চাঁদ কে বাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা হলো। বাইকে করে এসেছিল তারা। তাদের বাড়ি থেকে হসপিটাল কয়েক ঘন্টার রাস্তা। আলোক যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলো চাঁদ প্রায় অর্ধেকের বেশি রাস্তা কেঁদেছে। স্বাভাবিক ভাবে এমন ঘটনা ঘটলে অবশ্যই খারাপ লাগবে আর কষ্ট পাওয়া টাও স্বাভাবিক কিন্তু চাঁদকে অস্বাভাবিক লাগছে।তার এভাবে কাঁদার কারন টা আলোকের কাছে অন্য মনে হচ্ছে।

______________

দেখতে দেখতে বাড়িতে এসে গেল তারা। চাঁদ নামতেই আলোক বলল,

‘ চাঁদ তুমি যাও আমি একটু আসছি।’

চাঁদ শুনে ভিতরে সোজা নিজের ঘরে গেল। বোরখা খুলে গিয়ে ফ্রেশ হলো। শাড়ি টাও চেঞ্জ করে করলো। সাথে মাথাটাও ধুয়ে ফেলল। যাওয়ার সময় গোসল করেই গিয়েছে। ওয়াশরুম থেকে মাথা মুছতে মুছতে বের হয় চাঁদ।তারপর তার কানে একটা পুরুষের কন্ঠ ভেসে আসলো,

‘ ভাবি জি?’

চাঁদ মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখলো নাহিদ।

#চলবে….

[*রি-চেক হয়নি । ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]