পূর্ণিমাতিথি পর্ব-২১+২২

0
514

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-২১

হঠাৎই উনি রেগে গিয়ে আমার হাত দুটো বিছানার সাথে চেপে ধরেন। হঠাৎ উনার রেগে যাওয়ার কারণটা আমি বুঝতে পারছি না। উনার এমন হুট হাট আক্রমনে কোনদিন না জানি আমি হার্ট এ্যাটাক করে ফেলি। উনি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলেন.,

তুমি….

উনি উনার কথা আর সম্পূর্ণ করতে পারলেন নাহ তার আগেই উনার ফোনটা বেজে ওঠে। উনি আমার এক হাত ছেড়ে দিয়ে ফোনটা বের করলেন। ফোনের স্কিনে এক পলক তাকিয়ে উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। ফোনটা নিয়ে ঝটফট বেলকনিতে চলে গেলেন। উনি বেলকনিতে চলে যেতেই আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এতক্ষণ যেনো দমটা আটকে ছিলো।

______________

কতক্ষণ ধরে লাফাচ্ছি ফুলটা পারার জন্য। কিন্তু কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না। এই বাসার সামনে একটা মোটামুটি বড় একটা বাগান আছে। বিভিন্ন ফুল গাছে ভরপুর। ফুল আমার বরাবরই প্রিয়। বেলী ফুল একটু বেশি প্রিয়। হুট করেই ইচ্ছে জাগলো বেলি ফুলের মালা গাঁথার। নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে ফুল পারতে এসেছিলাম। কিন্তু হাত দিয়ে ফুল কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না। হুট করেই কারো হাসির শব্দ শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। হাসির শব্দটা একদমি অপরিচিত। আমি ঘাড়
ঘুরিয়ে পিছনে তাকাই। আমার থেকে একটু দূরে রুদ্র দাঁড়িয়ে আছেন। বুকে দুই হাত গুঁজে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমি চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি যে হাসতেও পারেন। সেটা আমার অজানা ছিল। ত্রয়ীর মতো আজকে আমারও মনে হচ্ছে উনি এতো কিউট কেনো? উনার হাসিতে আমি ফিদা হয়ে গেলাম। উফ এই মানুষটা এতো পারফেক্ট কেনো? উনার সবকিছুই নিখুঁত। হাসলেও যে একটা মানুষকে এতো সুন্দর লাগতে পারে আমার জানা ছিল না। ইচ্ছে করছে কপালে একটা নজর ফোটা দিয়ে দেই। যাতে কেউ নজর না দিতে পারে।

উনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন, তোমার মতো আঙ্গুর সাইজ মেয়ে এই ফুল নাগাল পাবে না।

আমি গাল ফুলিয়ে উনার দিকে তাকাই। উনি কিউট না আস্ত একটা বজ্জাত। আমাকে পিঞ্চ মেরে কথা বলার একটা সুযোগও উনি ছাড়েন না। আমি চলে আসতে নিলে উনি আমাকে ডেকে ওঠেন,

কী হলো? ফুল নিবা না?

না এই ফুলগুলো দেখতে ভালো না।

আমার কথা শুনে উনি আরো বেশি হাসা শুরু করে দিয়েছেন। যেনো আমি কোনো জোক্স বলছি। উনি হাসতে হাসতে আমার উদ্দেশ্যে বলেন,

ইউ নো তোমার অবস্থাও হয়েছে শেয়ালের মতো। আঙ্গুর ফল টক।

আমি উনার দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করতে করতে বলি,

আমার কোচিংয়ের সময় হয়ে গেছে। আপনি কী নিয়ে যাবেন? নাকি আমি একাই চলে যাব।

আজকে আমার কোথাও যেতে টেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি একাই চলে যাও। যেতে পারবা তো একা? রাস্তা চিনবা? তুমি তো আবার পিচ্চি রাস্তা-টাস্তা হারিয়ে ফেলতে পারো।

আমি উনার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাই। তারপর শব্দ করে হেঁটে চলে আসি। শব্দ করে হেঁটে আসার উদ্দেশ্য হলো উনাকে বুঝানো আমি ভীষণ রেগে আছি।

____________

উনি নিয়ে আসবেন নাহ বলেও নিয়ে আসছেন। আমি প্রথমে উনার সাথে না আসতে চাইলে উনি বলেন,

তোমাকে নিয়ে রিস্ক নেওয়া যাবে না। বউ গেলে বউ পাওয়া যাবে। কিন্তু এমন কিউট বউ পাওয়া যাবে না।

কোচিংয়ে আসতেই ত্রয়ীর বকবক শুরু হয়ে গেছে। ওর কথাটাকে পাত্তা না দিয়ে ক্লাসে চলে আসি। স্যার ক্লাস করাচ্ছেন হঠাৎ করে কেউ গুতা মারলো। পাশে তাকিয়ে দেখি ত্রয়ী। আমি ইশারায় জিঙ্গেস করি কী হইছে? ত্রয়ী ফিসফিস করে বলে,

ঐ ছেলেটা তোর কে হয়? বল না প্লিজ?

আমি ত্রয়ীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাই। আমার চোখ রাঙানো দেখে ত্রয়ী চুপ করে যায়। অতঃপর মনোযোগ সহকারে সবগুলো ক্লাস শেষ করি। ক্লাস থেকে ভাব নিয়ে বের হলাম। ত্রয়ী তখন থেকে এক প্রশ্নই করে যাচ্ছে। আমি ত্রয়ীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু বেশিই ভাব নিয়ে হাঁটছি।

তুই এতো ভাব নিচ্ছিস কেনো? বল না ছেলেটা কে?

আমি বেশ ভাব নিয়ে বললাম, আমার খালাতো ভাই ।

আমার কথা শুনে ত্রয়ী অবাক হয়ে যায়। অবিশ্বাসের সুরে বলে,

তুই সত্যি বলছিস রিয়া? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ঐ কিউট ছেলেটা তোর খালাতো ভাই। আমি ঙ্গান হারাবো।

আল্লাহ এই মাইয়া রুদ্র আমার খালোতো ভাই এটা শুনেই ঙ্গান হারানোর মতো ভাব করছে। যদি শুনতো রুদ্র আমার হাজবেন্ড। তাহলে হয়তো হার্ট এ্যাটাক করতো।

এতো সুন্দর খালাতো ভাই থাকতে তুই সিঙ্গেল। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। রিয়া সত্যি করে বল তো তোর খালাতো ভাইয়ের সাথে তোর কোনো চক্কর টক্কর চলছে না তো? এতো সুন্দর একটা ছেলে চোখের সামনে থাকলে সিঙ্গেল থাকা অসম্ভব।

বইন সবাই তো আর তোর মতো না। রাস্তা-ঘাটে যাকে দেখিস তাকে দেখেই ক্রাশ খাস। বাইক আছে এমন ছেলে দেখলে তো তুই পাগল হয়ে যাস। হোয়াট এ বাইক, হোয়াট এ বাইক বলে চিৎকার শুরু করিস। তোর আব্বু আসছে তোকে নিতে। যা এখান থেকে এখন ফুট।

আজকে তোক কথা শুনে আমি একটুও রাগ করলাম না। তোর খালাতো ভাইকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। উনাকে পটাতে তুই আমাকে সাহায্য করবি।

কথাগুলো বলে লজ্জা লজ্জা মুখ করে ত্রয়ী চলে গেলো। আমি ত্রয়ীর যাওয়ার দিকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছি। আমার জামাইকে পটানোর জন্য আমার কাছেই হেল্প চাইছে।

______________

মামুনি রান্না করছে আর আমি মনোযোগ সহকারে মটরশুঁটি থেকে খোসা ছাড়াচ্ছি। এটা করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। মামুনি হঠাৎ বলে ওঠেন,

আমার রুদ্রটা আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। সেই চঞ্চল, দুরন্ত আর হাস্যজ্বল। আমি কতদিন পর আজকে ওকে প্রাণ খোলে হাসতে দেখলাম। সবই তোর জন্যই সম্ভব। তোর সাথে কেউ কিছুদিন থাকার পর কিছুতেই গম্ভীর মুখে থাকতে পারবে না। তুই ম্যাজিক জানিস। সবাইকে হাসিখুসি রাখার।

আর তোমার ছেলের সাথে থাকার পর কেউ হাসিমুখে থাকতেই পারে না। উনার বাতাস আমার গায়েও লাগছে। না জানি কোনদিন আমি হাসতে ভুলে যাই।

__________________

একটানা দুই ঘন্টা ধরে মুখস্থ করে যাচ্ছি। কিন্তু পড়া কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। চুলে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাই।

কী করছেন আপনি?

হুসসসস। তুমি তোমার পড়া পড়। আমার কাজে ডিস্টার্ভ করো না আর আমার কাজে তোমার কোনো ডিস্টার্ড হবে না।

উনি আমার চুল নিয়ে নড়াচড়া করছেন। আমি আবার পড়ায় মনোনিবেশ করলাম। খোপায় কিছু একটা লাগালেন। আগে থেকে চুলগুলো খোপা করা থাকাই উনাকে আর নতুন করে খোপা করতে হয়নি। নাকে বেলি ফুলের ঘ্রাণ আসতেই খোপায় হাত দেই। খোপায় মালা জাতীয় কিছু একটা পড়িয়ে দিয়েছেন। উনি উনার কাজ শেষ করে বলেন,

পারফেক্ট।

আমি গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালাম।
আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে বেলিফুলের গাজরাটা দেখতে লাগলাম। অসম্ভব সুন্দর গাজরাটা। উনি উনার ফোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

এতো রাতে ইলান কেনো ফোন দিলো?

কল রিসিভ না করলে বুঝবেন কী করে? হয়তো কোনো দরকার। ফোনটা রিসিভ করুন আর স্পিকারে দিন আমিও কথা বলবো।

উনি ফোনটা রিসিভ করে স্পিকারে দেন। উনি ভ্রু কুচকে বলেন,

তোর আশেপাশে এতো গাড়ির আওয়াজ শুনে যাচ্ছে কেনো? তুই কোথায় এখন?

ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।

তুই ব্রিজের ওপর সুইসাইড টুইসাইড করতে গেছিস নাকি?

ফাজলামি বাদ দে। আমি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে এসেছি।

অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য ব্রিজের ওপর যেতে হয়।

ভাই আমি বাবা হতে চলেছি। আই কান’ট বিলিভ দিস। নিউজটা শোনার পর আমি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি নিজের ফিলিংসটা তোকে বুঝাতে পারবো না। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি হয়তো বাবা হওয়ার অনুভূতি। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না কেউ একজন আদো আদো গলায় আমাকে বাবা বলে ডাকবে। আমার হাত ধরে হাঁটবে। আমি আমার জীবনের সেরা আনন্দটা পেয়ে গেছি।

হঠাৎ করে কানে একটা আর্তনাদ ভেসে এলো। গাড়ির চাকার শব্দ শোনা গেলো। তারপর তারপর সবকিছু নিরব।

চলবে…..

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-২২

পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি হয়তো বাবা হওয়ার অনুভূতি। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না কেউ একজন আদো আদো গলায় আমাকে বাবা বলে ডাকবে। আমার হাত ধরে হাঁটবে। আমি আমার জীবনের সেরা আনন্দটা পেয়ে গেছি। আমার স্বপ্ন পুরণ হবার পরও হয়তো এতোটা আনন্দ হয়নি আজকে যতটা আনন্দ হচ্ছে। আমি বাবা হবো আমার কতো দায়িত্ব। সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে। শুন তোকে আর রিয়াকে নিয়ে আমি আগামীকাল শপিংয়ে যাব রুনা আর বাচ্চার জন্য যা লাগবে সবকিছু কি…..

হঠাৎ করে কানে একটা আর্তনাদ ভেসে এলো। গাড়ির চাকার শব্দ শোনা গেলো। তারপর তারপর সবকিছু নিরব। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। ফোন কেটে গেছে তবুও রুদ্র হ্যালো হ্যালো করছে। রুদ্র অস্থির হয়ে বলে ওঠে,

ইলান এভাবে চিৎকার কেনো করলো? আর ফোনই বা কেনো কেটে দিয়েছে? ওর কিছু হয়নি তো?

আপনি প্লিজ শান্ত হন। ইলান ভাইয়ার কিছু হবে না। চলুন ইলান ভাইয়া যেখানে আছে সেখানে যাই। আপনি জানেন তো ইলান ভাইয়া কোথায় আছে?

রুদ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।

__________________

রুদ্র ব্রিজের রেলিং ঘেষে বসে আছে। রুদ্র যেনো পাথর হয়ে গেছে। অনিমেষ তাকিয়ে আছে অদূরে পড়ে থাকা ইলান ভাইয়ার ফোনটার দিকে। এক্সিডেন্টের খবর শুনেই পুলিশ চলে এসেছিল। পুলিশ ধারণা করছে যে, ইলান ভাইয়া ব্রিজ থেকে পানিতে পড়ে গেছে। এই নদীতে পড়ে যাওয়ার পর বেঁচে থাকা অসম্ভব।

আমিও রুদ্রের পাশ ঘেষে বসে আছি। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না ইলান ভাইয়া আর নেই। কিছুক্ষণ আগেও কতোটা হাসিখুসি ছিল। মুহূর্তের মাঝেই সেই ব্যক্তিটা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আমিই মানতে পারছি না সেখানে রুনা আপু কীভাবে মেনে নিবে। আজকে জানতে পেরেছে রুনা আপু মা হতে চলেছে। আজকেই স্বামীর মৃত্যুর খবর কীভাবে নিবে?

হঠাৎই রুদ্রের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্কিনের নামটা দেখেই কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আসছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। রুনা আপু ইলান ভাইয়ার মৃত্যুর শক নিতে পারবে? কান্না আটকিয়ে ফোনটা রিসিভ করি।
আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে হাসিখুসি একটা কন্ঠ ভেসে আসে,

রিয়া কেমন আছো? তোমাকে একটা গুড নিউজ দেওয়ার আছে। আমি মা হতে চলেছি আর তুমি ফুফি। এবার কিন্তু তোমার পালা। কবে আমাদের গুড নিউজ শুনাবে?

মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। রুনা আপু নিজের সন্তান আসার খবর শুনে কতোটা খুশি। ইলান ভাইয়ার মৃত্যুর খবর শোনার পর কী হাসিখুসিটা থাকবে? আমি কিছুতেই ইলান ভাইয়ার মৃত্যুর খবর রুনা আপুকে বলতে পারব না। খট করে ফোনটা কেটে দিলাম।

__________________

নিস্তব্ধ পরিবেশে ভেসে আছে কিছু মানুষের কান্নার শব্দ। ইলান ভাইয়ার মৃত্যুর খবরটা কারো বিশ্বাসই হচ্ছে না। সবার চোখেই জল। ইলান ভাইয়ার জন্য সবাই কাঁদতে বাধ্য। কারণ তিনি এমনই একজন মানুষ। মুহূর্তের মাঝেই সবাইকে আপন করে নিতে পারে। সবাইকে হাসিখুসিতে মাতিয়ে রাখতে উনিই একাই যথেষ্ট।

রুদ্র পাথরের মতো সিঁড়ি বসে আছেন। কাঁদতে কাঁদতে হয়তো চোখের জল শুকিয়ে গেছে। সারা রাস্তা এক ফোটাও কাঁদেননি। এই বাসায় আসার পরই ইলান ভাইয়ার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছিলেন। এমন একটা কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ যে এভাবে কাঁদতে পারে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। প্রিয়জন হারানোর ব্যথা হয়তো পাথরের মতো মনকেও গলিয়ে দেয়।

রুনা আপু খবরটা শোনার পর পরই ঙ্গান হারিয়েছে। এখনো ঙ্গান ফিরেনি। ইলান ভাইয়ার আম্মুও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উনার এক কথা নিজের ছেলেটাকে শেষ দেখা দেখতে পারলাম না। ইলান ভাইয়ার বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। ইলান ভাইয়ার পরিবার বলতে রুনা আপু আর উনার মা।

হঠাৎই রুদ্র সিঁড়ে থেকে ওঠে দাঁড়ায়। হেঁটে সোজা বাইরে চলে গেলেন। আমিও উনার পিছু পিছু গেলাম। এই মুহূর্তে উনাকে একা ছাড়া একদমি ঠিক না। উনি সোজা গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। আমি পিছন থেকে কতো ডাকলাম। কিন্তু উনি শুনলেনই না।

____________

মৃত্যু একটা চিরন্তন সত্য। মৃত্যু সবার জন্যই অবধারিত। সবাইকেই একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। ইলান ভাইয়া আমাদের মাঝে নেই আজকে দুই দিন হলো। গ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে আজকে মরলে কালকে তিনদিন। সত্যিই চোখের পলকে দুই দিন হয়ে গেলো। ঐদিন রুদ্র ঐভাবে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর রুদ্র আর বাসায় ফিরেনি। আমি ঐদিন মামুনি আর আংকেলের সাথে বাসায় ফিরে এসেছিলাম। এই দুইদিনের মাঝে বেশ কয়েক বার ঐ বাসায় গিয়েছি। রুনা আপুর দিকে তাকানো যায় না। কারো সাথে কথা বলে না। শুধু নিষ্প্রভ তাকিয়ে থাকে।

এই দুই দিনে রুদ্রকে আমি আর মামুনি হাজারটা কল দিয়েছি। কিন্তু রুদ্র রিসিভ করেনি। টেনশনে যখন আমরা অস্থির হয়ে ওঠেছিলাম ঠিক তখনি রুদ্রের এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলে রুদ্র তার কাছে আছে। রুদ্র একদম ঠিক আছে। নিজেকে সামলে নিলে উনাকে বাসায় পাঠিয়ে দিবেন। উনি ঠিক আছেন শুনে আমরা সবাই সস্থির নিশ্বাস ফেলি।

__________

দুই দিন ধরে কোচিংয়ে যাওয়া হয় না। আগামীকাল থেকে কোচিংয়ে যেতে হবে। ত্রয়ীর কাছ থেকে পড়া জেনে পড়তে বসেছিলাম। ঠিক তখনি উনি বাসায় ফিরে আসেন। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে যান। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বেলকনিতে চলে গেলেন। আমিও খাতা কলম রেখে উনার পিছু পিছু আসি। উনি বেলকিনেতে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও উনার পাশে বসে পড়ি।

উনি আমার দিকে এক পলকও তাকাননি। দুই দিনেই নিজের কি অবস্থা করেছেন উনি। চোখ, মুখ শুকিয়ে গেছে। ঠিক মতো যে খাওয়া দাওয়া করেননি সেটা উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এগুলো উনার নির্ঘুম রাত কাটানোর সাক্ষী। আমি উনার কাদে হাত রাখতেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন। কান্না মিশ্রিত গলায় বলেন,

তুমি হয়তো ভাবতেই পারছো না এই দুই দিন আমার কীভাবে কেটেছে। যাকে ছাড়া আমার এক সেকেন্ড চলতো না। আর আজ দুই দিন হলো আমি তাকে ছেড়ে আছি। আমার এখনোও বিশ্বাস হচ্ছে না ইলান নেই। ও আমার সাথে কীভাবে করতে পারলো? আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো। আমি পারছি না ওকে ছাড়া থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ইলান বলেছিলো তো ওর ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবে। বিয়েতে ও আর আমি কাপল ডান্স করবো। বুড়ো বয়সে সকালে এক সাথে হাঁটতে বের হবো। টংয়ের দোকানে বসে চা খাবো। ও ওর কথা রাখেনি। ছোটবেলা থেকে আমরা দুজন তো একসাথেই ছিলাম। আমাদের শৈশব কৈশর সব এক সাথে কেটেছে। আমরা দুজন যা করেছি সব একসাথে। কিন্তু ও আজকে আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো।

আমি রুনার মুখের দিতে তাকাতে পারছি না। রুনার দিকে তাকালেই অপরাধবোধে তাড়া করে। ও যখন বলেছিল ইলানকে ফিরিয়ে আনার কথা নিজেকে তখন অক্ষম মনে হচ্ছিল। আমার তো সাধ্য নেই ইলানকে ফিরিয়ে আনার। আমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম না। অসহ্যকর এক অনুভূতি তাড়া করছিল ইচ্ছে করছিল নিজেকে শেষ করে দেই। দুজন কতো খুশি ছিল বাবা-মা হবে বলে। একটা এক্সিডেন্ট জীবন থেকে সকল সুখ, আনন্দ কেড়ে নিল। ও কতোটা খুশি ছিল।

চলবে……..